সম্পাদকীয়
বছর ঘুরে আমাদের মাঝে আবার এলো মহিমান্বিত ডিসেম্বর মাস। ১৯৪৯ সালের ডিসেম্বর মাসের ১৪ তারিখ বুধবার মহান আল্লাহ্ দয়া করে হযরত রাসুল (সা.)-এর ওফাতের ১৩১৬ বছর (ইংরেজি সাল অনুযায়ী) পর বেলায়েতের যুগের শ্রেষ্ঠ অলী-আল্লাহ্ মহান সংস্কারক মোহাম্মদী ইসলামের পুনর্জীবনদানকারী সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহবুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (রহ.) হুজুর কেবলাজানকে এই সুজলা শস্য শ্যামল বাংলার বুকে প্রেরণ করেন। ইতিহাস গবেষণা করলে দেখা যায় যে, সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান হলেন হযরত রাসুল (সা.)-এর ২৩তম বংশধর।
সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজানের ঊধ্বর্তন ১৫তম পুরুষ হযরত সৈয়দ দোস্ত মাহমুদ সিপাহী (রহ.) তুর্কী শাসকদের সাথে ভারতবর্ষে এসে বাংলাদেশে আগমন করেন এবং ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আশুগঞ্জ উপজেলাধীন বাহাদুরপুর গ্রামে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। হযরত সৈয়দ দোস্ত মাহমুদ সিপাহী (রহ.) থেকে শুরু করে বংশ পরস্পরায় সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজানের শ্রদ্ধেয় দাদাজান হযরত সৈয়দ আবদুর রফিক (রহ.) হলেন হযরত রাসুল (সা.)-এর ২১তম পুরুষ। হযরত সৈয়দ আবদুর রফিক (রহ.)-এর জ্যেষ্ঠ পুত্র বিশিষ্ট সুফি সাধক আলহাজ হযরত সৈয়দ আবদুর রশিদ সরকার (রহ.), তিনি হলেন সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজানের সৌভাগবান পিতা। সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজানের মহীয়সী মাতা হলেন হযরত জোবেদা খাতুন (রহ.)। মাতৃকুল ও পিতৃকুল উভয় দিক থেকে অলী-আল্লাহগণের পবিত্র রক্তের স্রোতধারা সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজানের মাঝে প্রবাহমান।
মহান আল্লাহ্ তাঁর প্রিয় বন্ধুদেরকে জগতের বুকে প্রেরণের পূর্বাভাস হিসেবে বিভিন্ন অলৌকিক ঘটনা ঘটিয়ে থাকেন। সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজানের আগমনের পূর্বেও বহু অলৌকিক ঘটনা সংঘটিত হয়। তিনি যখন মাতৃগর্ভে তখন তাঁর মাতা হযরত জোবেদা খাতুন (রহ.) বিভিন্ন স্বপ্ন ও ঘটনার মাধ্যমে বুঝতে পারেন যে, তাঁর গর্ভের শিশু সন্তানটি মানবজাতির জন্য বরকতময় হিসেবে এই ধুলির ধরায় আসবেন। সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজানের জন্মের পূর্বে রাতে তাঁর মহীয়সী মাতা স্বপ্নে দেখেন “আকাশে ঈদের চাঁদ উদিত হয়েছে, গ্রামবাসী ঘর থেকে বের হয়ে মহানন্দে ঈদের চাঁদ দেখছেন। ঐ চাঁদ দেখার জন্য তিনিও ঘর থেকে বের হয়ে আসলেন। যখনই তিনি অপলক দৃষ্টিতে চাঁদের দিকে তাকালেন, সাথে সথে চাঁদটি তাঁর কোলে নেমে আসে। তিনি ঈদের চাঁদ কোলে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে যান।” এরপর তাঁর ঘুম ভেঙ্গে যায়। তিনি বুঝতে পারলেন যে, তাঁর পরম কাঙ্ক্ষিত সৌভাগ্যবান সন্তানটির জগতের বুকে আসার সময় হয়ে গেছে। সেদিনই (১৪ই ডিসেম্বর, ১৯৪৯ইং) সকাল ১০টায় যুগের শ্রেষ্ঠ ইমাম সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান জগতের বুকে তশরিফ নেন।
সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজানের জন্মের ৭ম দিবসে তাঁর শ্রদ্ধেয় দাদাজান হযরত সৈয়দ আবদুর রফিক (রহ.) প্রিয় নাতির আকিকার অনুষ্ঠান মহা ধুমধামের সাথে আয়োজন করেন। আকিকার অনুষ্ঠানে উপমহাদেশের প্রখ্যাত আলেম ফখরে বাংলা মাওলানা তাজুল ইসলাম সাহেব সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজানের নাম রাখেন ‘মাহবুব-এ-খোদা’ অর্থাৎ খোদার প্রিয়। অসাধারণ চারিত্রিক গুণাবলি ও মাধুর্যের কারণে সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজানের গৌরবময় জীবনে এই নামের সার্থকতা প্রকাশ পায়।
সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান শিক্ষা জীবনের প্রতিটি স্তরে অসামান্য সফলতার স্বাক্ষর রাখেন। তিনি বৃত্তিসহকারে মাদ্রাসার শিক্ষার উচ্চতর ডিগ্রি লাভ করেন। তাঁর মনোমুগ্ধকর ব্যক্তিত্ব ও আকর্ষণীয় নেতৃত্বগুণের কারণে ছাত্রজীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি মাদ্রাসা ছাত্র সংসদের ভিপি পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে তাঁর অবদান চিরভাস্বর হয়ে আছে। তিনি ১৯৭১ সালের ১১ই এপ্রিল রবিবার, তাঁর ৭২ জন সাথি নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় স্থাপিত বেঙ্গল রেজিমেন্টের মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে যোগ দেন। তিনি রণাাঙ্গনে দুটি মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে হেজামারা ক্যাম্পে ১৯শে নভেম্বর ঈদুল ফিতরের নামাজে ইমামতি করেন। সেদিন তিনি সমবেত মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দেশে দৃঢ় কণ্ঠে বলেন, “আপনারা সাক্ষী থাকুন। আল্লাহর কসম! আগামী বকরা ঈদের আগে দেশ স্বাধীন হবে। আমি আপনাদের নিয়ে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে ঈদের নামাজ আদায় করব।” মহান আল্লাহর অপার দয়ায় তাঁর পবিত্র মুখ থেকে উৎসারিত ভবিষ্যদ্বাণীর ২৭দিন পর ১৬ই ডিসেম্বর, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ চূড়ান্ত বিজয় লাভ করে। স্বাধীনতার পর তিনি নবগঠিত ১৬ বেঙ্গল রেজিমেন্টের ধর্মীয় শিক্ষকপদে যোগদান করেন।
সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান ১৯৭৪ সালে তৎকালীন যুগের ইমাম সৈয়দ আবুল ফজল সুলতান আহমদ (রহ.)-এর নিকট বায়াত গ্রহণ করেন। তিনি তাঁর মোর্শেদ ইমাম হুজুর (রহ.) স্বীয় ৪র্থ কন্যা কুতুবুল আকতাব হযরত সৈয়দা হামিদা বেগম (রহ.)-এর সাথে তাঁর বিয়ে দেন। পরবর্তীতে ১৯৭৫ সালে তিনি ইমাম হুজুরের নির্দেশে সেনাবাহিনীর চাকুরি থেকে ইস্তফা দিয়ে মোর্শেদের দরবারে চলে আসেন। দীর্ঘ ১ যুগ গভীর সাধনার পর তিনি ১৯৮৩ সালের ১৬ই ডিসেম্বর মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে জামানার মোজাদ্দেদ তথা ধর্মের সংস্কারকের সুমহান দায়িত্ব লাভ করেন। স্বীয় মোর্শেদ ইমাম হুজুরের ওফাতের পর তিনি ১৯৮৫ সালের ২৮শে মার্চ রাজধানীর ঢাকার আরামবাগে চলে আসেন এবং সেখানে মোহাম্মদী ইসলামের কার্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে তিনি বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে সর্বমোট ১১টি দরবার শরীফ প্রতিষ্ঠা করেন। এছাড়া দেশ ও বিদেশে তিনি শতাধিক খানকাহ্ শরীফ ও সহস্রাধিক জাকের মজলিশ এবং বহির্বিশ্বে ‘World Ashek-e-Rasul Organization’ প্রতিষ্ঠা করেন। সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান তাঁর গৌরবদীপ্ত জীবনে মহান আল্লাহ্ ও হযরত রাসুল (সা.)-এর পক্ষ থেকে বিভিন্ন লকব লাভ করেন। তিনি ইসলাম ধর্মে প্রবিষ্ট কুসংস্কার সমূহ দূর করে শতাধিক সংস্কার করেন এবং তাঁর বহু সংস্কার বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক রাষ্ট্রীয়ভাবে গৃহীত হয়েছে। এছাড়া তিনি ধর্মের সংস্কার করে ৮ খণ্ড তাফসীর গ্রন্থসহ বহু কিতাবাদি রচনা করেছেন, যা মানবজাতির শান্তির ও মুক্তির দিকনিদের্শনা হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। তিনি আত্মশুদ্ধি, দিলজিন্দা, নামাজে হুজুরি ও আশেকে রাসুল হওয়ার শিক্ষা দিয়ে গেছেন। জগদ্বিখ্যাত এই মহামানবের ৭৩তম শুভ জন্মদিনে তাঁর পরশময় নুরানি কদম মোবারকে জানাই সালাম ও কদমবুসি। আমিন।