সুলতানুল মাশায়েখ হযরত খাজা নিজামুদ্দিন আউলিয়া (রহ.)
জন্ম ও পরিচয়
সুলতানুল মাশায়েখ মাহবুবে এলাহী হযরত খাজা সৈয়দ মোহাম্মদ নিজামুদ্দিন আউলিয়া (রহ.) ১২৩৮ সালে ভারতের উত্তর প্রদেশের বাদাউনে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি নিজামউদ্দিন আউলিয়া নামে পরিচিত। তিনি ভারতীয় উপমহাদেশে চিশতিয়া তরিকার একজন বিখ্যাত সুফিসাধক ছিলেন। তাঁর পিতার নাম হযরত সৈয়দ আবদুল্লাহ বিন আহমদ আল-হোসাইনি (রহ.) এবং মাতার নাম হযরত সৈয়দা বিবি জোলায়খা (রহ.)। তিনি ইমাম হোসাইন (রা.)-এর বংশধর ছিলেন। তাঁর পিতামাতা উভয়েই বোখারা থেকে কিছুদিন লাহোরে অবস্থান করার পর সেখান থেকে ভারতের উত্তর প্রদেশের বাদাউনে চলে আসেন।
হযরত নিজামুদ্দিন আউলিয়া (রহ.)-এর মোর্শেদ ছিলেন হযরত ফরিদ উদ্দিন গঞ্জেশকার (রহ.)। তাঁর সিলসিলা হযরত ফরিদ উদ্দিন গঞ্জেশকর (রহ.), হযরত কুতুবউদ্দিন বখতিয়ার কাকি (রহ.) হয়ে গরিবে নেওয়াজ হযরত খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি (রহ.)-এর সাথে মিলিত হয়। সেই অনুযায়ী তাঁরা চিশতিয়া তরিকার মৌলিক আধ্যাত্মিক ধারাবহিকতা বা সিলসিলা তৈরি করেছেন, যা ভারতীয় উপমহাদেশে ব্যাপকভাবে প্রচলিত। হযরত নিজামুদ্দিন আউলিয়া (রহ.) তাঁর পূর্বসূরিদের ন্যায়, প্রেম বা এশককে স্রষ্টা বা আল্লাহ্ প্রাপ্তির পথ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তাঁর মতে স্রষ্টার প্রতি ভালোবাসা মানবতার প্রতি ভালোবাসার জন্ম দেয়। জিয়াউদ্দিন বারানি নামে ১৪ শতকের একজন ঐতিহাসিক দাবি করেন যে, দিল্লির মুসলমানদের উপর তাঁর প্রভাব এমন ছিল যে পার্থিব ব্যাপারে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি উল্লেখযোগ্য ভাবে পরিবর্তিত হয়। মানুষ আধ্যাত্মিকতা এবং ইবাদতের প্রতি মনোযোগী হয়ে পড়ে। তিনি দিবারাত্রি মহান আল্লাহ ও হযরত রাসুল (সা.)-এর ধ্যানে নিমগ্ন থাকতেন, এমন কি দ্বিনের ব্যাপারেও জীবন উৎসর্গ করতে বিন্দুমাত্র দ্বিদাবোধ করতেন না। তিনি জনসেবা ও ঐশী প্রেমের ক্ষেত্রে তৎকালীন জগতে ছিলেন এক বিশিষ্ট মর্যাদার অধিকারী। জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে তিনি অগণিত মানুষের সেবায় সদা ব্যাপৃত থাকতেন। ভারতবাসীদের ইতিহাসে তাঁর নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে।
শিক্ষা গ্রহণ
শিশুকালে হযরত নিজামুদ্দিন আউলিয়া (রহ.) অন্য ছেলেদের চেয়ে একটু অন্য ধরনের ছিলেন। শৈশবে তাঁর মন মানসিকতা দেখে পিতামাতা বুঝতে পেরেছিলেন এই ছেলে একদিন জগতে মহান ব্যক্তিত্বে পরিগণিত হবে। তিনি শিশুকাল থেকেই তীক্ষ বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছিলেন। তাঁর পিতা দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করে যখন চিরবিদায় নিলেন তখন নিজামুদ্দিন আউলিয়া (রহ.)-এর বয়স মাত্র ৫ বৎসর। পিতার ওফাতের পর তিনি তাঁর মার সাথে দিল্লিতে চলে আসেন। সেখানে ছেলেকে প্রাথমিক মক্তবে ভর্তি করান। হযরত নিজামুদ্দিন আউলিয়া (রহ.) প্রথমে পবিত্র কুরআন খতম করেন। পরে হযরত মাওলানা আলাউদ্দিন উমুলীর নিকট ফিকাহ শাস্ত্রের প্রাথমিক কিতাবসমূহ অধ্যয়ন করেন। একই সাথে মক্তবের পাঠ্যক্রম অনুযায়ী আনুষঙ্গিক অন্যান্য বিষয়সমূহের জ্ঞান অর্জন করেন। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্তির পর মায়ের আদেশানুসারে তাঁকে পাঠানো হয় প্রখ্যাত কামিল ও শিক্ষাবিদ হযরত মাওলানা শামসুদ্দিন দামাগানী (রহ.)-এর হাতে বায়াত গ্রহণ করার জন্য। প্রথম দর্শনেই হযরত মাওলানা শামসুদ্দীন (রহ.) তাঁর প্রতি কেমন যেন অনুপম ও আকর্ষণ অনুভব করেন। তিনি প্রথম দেখাতে বুঝতে পারলেন যে উক্ত ছেলেটির মধ্যে বিরাট প্রতিভা লুকায়িত আছে। তিনি সানন্দে হযরত নিজামুদ্দিন আউলিয়া (রহ.)-কে শিক্ষা প্রদান করেন। হযরত নিজামউদ্দিন আউলিয়া (রহ.) তাঁর নিকট ধর্মীয় শাস্ত্র, ফিকাহ, উম্মুল আকায়েদ, সাহিত্য বিষয়ে জ্ঞান লাভ করার পর হাদিস শরীফে উচ্চতর শিক্ষা লাভের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেন এবং তৎকালীন দিল্লির সর্বশ্রেষ্ঠ বুজুর্গ ও হাদিস বিশারদ হযরত মাওলানা কামালউদ্দিন (রহ.)-এর খেদমতে হাজির হন এবং তাঁর সাহচর্যে হাদিস বিষয়ক কিতাবাদি অধ্যয়নে ব্রতী হন ও সুখ্যাতির সাথে জ্ঞানার্জন করেন। তখন হাদিস বিশারদ মাওলানা আহমদ তাবারিজি (রহ.)-এর স্থানও ছিল অতি উচ্চে। তাঁর চেয়েও তিনি অধিক জ্ঞানী বলে সমধিক প্রসিদ্ধি লাভ করেছিলেন। শুধুমাত্র হাদিস শরীফেই তাঁর শিক্ষা সীমাবদ্ধ ছিল না। তিনি একাধারে যেমনি একজন সুপণ্ডিত ও শাস্ত্রকার ছিলেন তেমনি জ্যোতির্বিদ্যা, গণিতশাস্ত্র, তাফসীর, বালাগাত, উসূল, ফিকাহ, আকায়েদ, ইতিহাস ও সাহিত্য সম্পর্কেও বিভিন্ন মাশায়েখদের নিকট হতে প্রভুত জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। অসাধারণ ধৈর্য ও সহনশীলতা তাঁকে মনজিলে মকসুদে পৌঁছে দেয়। তাঁর মধ্যে কোনোরূপ আড়ম্বর প্রিয়তা ছিল না। সবসময়ই তিনি সহজ সরল জীবন যাপন করতেন। তার পাণ্ডিত্য সকলকেই বিমুগ্ধ করে তুলেছিল।
আধ্যাত্মিকতা
মাহবুবে এলাহি হযরত নিজামুদ্দিন আউলিয়া (রহ.) এলমে জাহেরের সাথে এলমে বাতেন অর্জন করেছিলেন। তিনি গভীর মনোযোগের সাথে অধ্যাত্ম সাধনায় আত্মনিয়োগ করেন। তিনি ভাবতেন কীভাবে এলমে বাতেনের পরিপূর্ণতা লাভ করা যায়। সেজন্য তিনি বিশ বছর বয়সে পড়াশোনা শেষ করার পর বাতেনি শিক্ষা লাভ করার জন্য পাকিস্তানের পাঞ্জাবের অজোধ্যানের পাকপাত্তান শরীফে হযরত বাবা ফরিদ নামে পরিচিত সুফি হযরত ফরিদ উদ্দিন গঞ্জেশকর (রহ.)-এর কাছে বায়াত গ্রহণ করেন।
হযরত নিজামুদ্দিন (রহ.) যখন হযরত ফরিদউদ্দিন গঞ্জেশকর (রহ.)-এর নাম প্রথমবারের মত শুনেন, তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র বারো কি তেরো বছর। তখন থেকেই ফরিদউদ্দিন (রহ.)-এর প্রতি তাঁর হৃদয়ে সম্মান ও ভালোবাসা জন্মাতে থাকে। তিনি তার শিষ্যগণকে বর্ণনা করেন, বাবা ফরিদ এর নাম শোনার পর তাঁর মনে যে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল অন্য কোনো সুফিসাধকের নাম শুনেও, এমনকি তাঁদের সাথে সাক্ষাতের পরও তাঁর এ অবস্থা হয়নি। আগুনের ফুল্কির মতো তাঁর প্রেম বাড়তেই থাকে। যদি তাঁর সহপাঠীরা তাঁকে দিয়ে কোনো কাজ করাতে চেষ্টা করত তখন তারা বাবা ফরিদের নামের দোহায় দিত এবং তিনি কখনও কেউ বাবা ফরিদের নামে দোহায় দিলে সেই কাজে নিষেধ করতেন না। তিনি তাঁর জীবনে কারো জন্য এ ধরনের অনুভূতি অনুভব করেননি। তিনি বাবা ফরিদের দরবারে তিনবার গিয়েছিলেন। হযরত নিজামুদ্দিন আউলিয়া (রহ.) অজোধ্যানে স্থায়ী বসবাস করতেন না। তিনি হযরত ফরিদউদ্দিন গঞ্জেশকর (রহ.) এর কাছে প্রতি বছর রমজান মাস কাটাতেন। যখন তিনি তৃতীয়বার হযরত ফরিদউদ্দিন গঞ্জেশকর (রহ.)-এর কাছে আসেন, বাবা ফরিদ (রহ.) তাঁকে তাঁর উত্তরাধিকারী (খলিফা) ঘোষণা করেন। হযরত নিজামুদ্দিন আউলিয়া দিল্লি ফিরে আশার কিছুদিন পরই বাবা ফরিদ (রহ.) ওফাত লাভ করেন।
ষোলতম শতাব্দীতে মোগল সম্রাট আকবরের উজির আবুল ফজল মোবারক রচিত আইন-ই-আকবর-এ নিজামুদ্দিনের জীবনীতে উল্লেখ করেছেন- বিশ বছর বয়সে নিজামুদ্দিন সুফিসাধক ফরিদ উদ্দিন গঞ্জেশকরের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। যিনি বাবা ফরিদ নামে অধিক খ্যাত। বাবা ফরিদ থাকা অবস্থায় তিনি প্রতি বছর রমজান মাস অতিবাহিত করতে আজোধ্যানে যেতেন। তৃতীয়বার আজোধ্যান সফরে গেলে বাবা ফরিদ তাকে তার উত্তরসূরি বা খলিফা মনোনীত করেন। এর কিছুদিন পরে, যখন নিজামুদ্দিন দিল্লিতে ফিরে আসেন, তিনি খবর পান যে, বাবা ফরিদ মৃত্যুবরণ করেছেন।
হযরত নিজামুদ্দিন আউলিয়া (রহ.) গিয়াসপুর খানকা শরীফ করার আগে দিল্লির বিভিন্ন শহরে বসবাস করেন। তিনি ১৩২৫ সালের ৩রা এপ্রিল সকালে ওফাত লাভ করেন। তাঁর দরগাহ শরীফ দিল্লিতে অবস্থিত। তাঁর দরগাহ শরীফের বর্তমান কাঠামো ১৫৬২ সালে নির্মাণ করা হয়। প্রতি বছর এখানে ওরস হয় এবং লাখ লাখ মানুষ তাঁর দরগাহ জিয়ারত করতে আসেন।
উল্লেখ্য যে, হযরত নিজামউদ্দিন (রহ.)-এর দস্যু থেকে আওলিয়া হওয়ার আজগুবি ঘটনাটি আমাদের দেশে যুগ যুগ ধরে মানুষের মুখে প্রচারিত হয়ে আসছে। অনেকেই এটাকে মিথ্যা বলে আখ্যায়িত করেছে।
তাঁর নছিহতসমূহ
১। এলেম গভীর সাগর সাদৃশ্য মারফত এর তরঙ্গ,
২। দান করলেই খোদায়ি নিয়ামত লাভ করা সম্ভব,
৩। আরেফ এর নিদর্শন হলো- তিনি মৃত্যুকে বন্ধু মনে করবেন এবং প্রতিটি শ্বাসপ্রশ্বাসে খোদাকে স্মরণ করবেন, ৪। পিতামাতার দিকে ভক্তি সহকারে তাকানোও ইবাদত,
৫। হতভাগা সেই লোক যে গুনার কাজে লিপ্ত থেকে মনে করে খোদা তাঁকে কবুল করে নিবেন,
৬। ভালো করার চেয়ে ভালোদের সাথে থাকা উত্তম, পাপ করার চেয়ে পাপিদের সাথে থাকা অধিক খারাপ,
৭। বন্ধুর সাথে ভালোবাসার প্রকৃত দাবিদার সে, যে সর্বদা বন্ধুর কথা শুনতে ভালোবাসে।
সংকলিত