সূফী সম্রাটের ধর্মীয় সংস্কার: সাহরি ও ইফতারের সময়সূচি প্রবর্তন – ড. জাহাঙ্গীর আলম
সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত নিয়তের সাথে পানাহার ও কামাচার থেকে বিরত থাকাকে রোজা বলে। রোজা ফারসি শব্দ, যার অর্থ উপবাস। আরবি ভাষায় একে সাওম বলে। ইসলামের ৫টি স্তম্ভ বা ভিত্তির মধ্যে রোজা তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। প্রাপ্ত বয়স্ক সকল মুসলমান নর-নারীর উপর রমজানের রোজাকে ফরজ করা হয়েছে। এই প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে- হে মু’মিনগণ! তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হলো, যেরূপ ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের উপর, যেন তোমরা মোত্তাকি হতে পারো।” (সূরা বাকারাহ ২: আয়াত ১৮৩)
পূর্ববর্তী নবি-রাসুলদের উপর রোজা ফরজ করা হয়েছিল। আদম সন্তানের সকল কর্ম তার নিজের জন্য একমাত্র রোজা ব্যতীত। রোজা শুধুমাত্র আল্লাহ্র জন্য। যার প্রতিদান স্বয়ং রাব্বুল আলামিন নিজেই। এ প্রসঙ্গে হাদিসে কুদসিতে আল্লাহ্ বলেন, “রোজা আমার জন্য এবং আমিই তার প্রতিদান। (বোখারী শরীফ ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৫৪) রোজা পালন করে যারা নিজের পশুপ্রবৃত্তিকে দমন করতে পেরেছে, আত্মশুদ্ধি লাভ করে মহান রাব্বুল আলামিনের সান্নিধ্য লাভ করতে পেরেছে তারাই সফলকাম হয়েছে। রোজা পালন করে একজন মানুষ উত্তম চরিত্র গঠন করতে পারে। ‘রোজার প্রতিদান মহান রাব্বুল আলামিন নিজেই’-এর অর্থ হলো নিজের মাঝে আল্লাহ্র চরিত্র ধারণ করা। আল্লাহ্র চরিত্র বিকশিত হওয়ার একমাত্র মাধ্যম হলো রোজা। রোজা মানুষকে যাবতীয় পাপ কাজ থেকে বিরত রাখে। এ প্রসঙ্গে হযরত মোহাম্মদ (সা.) বলেন, “রোজা হচ্ছে ঢালস্বরূপ।” (বোখারী শরীফ ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৫৪) যুদ্ধক্ষেত্রে ঢাল আত্মরক্ষার্থে ব্যবহৃত হয়। ইবাদতের মধ্যে রোজা ঢাল হিসাবে ব্যবহৃত হয়। এই ঢাল আমরা সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারলে যাবতীয় অন্যায় অত্যাচার ও পাপাচার হতে সহজে বাঁচতে পারব। সময়ের কাজ আমাদেরকে যথাসময়ে করতে হবে। ঠিক তেমনি ধর্ম পালনেও সারাদিন সিয়াম সাধনা করে যথাসময় যদি ইফতার না করি, তাহলে আমরা ইহুদি-নাছারাদের পর্যায়ভুক্ত হয়ে যাব। কারণ ইহুদি-নাছারারা দেরিতে ইফতার করে। এ প্রসঙ্গে হযরত মোহাম্মদ (সা.) বলেন, “দ্বিন জয়ী থাকবে ততদিন, যতদিন মানুষ (সূর্যাস্তের পর) শীঘ্র শীঘ্র ইফতার করবে, কেননা ইহুদি-নাছারারা বিলম্বে ইফতার করে।” (আবু দাউদ শরীফ ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩২১) হযরত রাসুল (সা.) ফরমান- “মানুষ কল্যাণের সাথে থাকবে ততকাল, যতকাল তারা শীঘ্র ইফতার করবে।” (বোখারী শরীফ ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৬৩) তিনি আরো ফরমান- “আল্লাহ্ তায়ালা বলেন, আমার বান্দাদের মধ্যে আমার নিকট অধিকতর প্রিয় তারাই, যারা শীঘ্র শীঘ্র ইফতার করে।” (তিরমিজি শরীফ ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৫০)
১৯৯৩ সালের পূর্বে আমাদের দেশে ইফতারের সময় নির্ধারণ করা হতো সূর্যাস্ত থেকে ১০ থেকে ১৫ মিনিট পর। দেরিতে ইফতার করে মুসলমানরা ইহুদি-নাছারাদের মতো কাজ করছে এবং হযরত রাসুল (সা.)-এর নির্দেশ অমান্য করছে। তেমনি সাহ্রির সময় সূর্যোদয়ের দেড় থেকে দুই ঘন্টা পূর্বেই শেষ করতো। এটি একদিকে কুরআন ও হাদিস বিরোধী, অন্যদিকে সাধারণ মানুষের জন্য কষ্টদায়ক। সাহ্রির শেষ সময় নির্ধারণ করে পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে- “ওয়া কুলূ ওয়াশরাবূ হাত্তা ইয়াতাবাইয়্যানা লাকুমুল খাইত্বুল আবইয়াদ্বু মিনাল খাইত্বিল আসওয়াদি মিনাল ফাজরি, ছুম্মা আতিম্মুস সিইয়ামা ইলাল লাইল।” অর্থাৎ- “তোমরা পানাহার করো যতক্ষণ না (রাতের) কালো রেখা থেকে প্রভাতের সাদা রেখা সুস্পষ্ট দেখা যায়। তারপর রোজা পূর্ণ করো রাত পর্যন্ত।” (সূরা বাকরাহ ২: আয়াত ১৮৭)
সাহ্রি প্রসঙ্গে হযরত সামুরা ইবনে জুনদুব (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন, আল্লাহ্র রাসুল (সা.) এরশাদ করেনÑ “বিলালের আজান এবং পূর্ব আকাশের এরূপ শুভ্র আলো যতক্ষণ না তা পূর্ব দিগন্তে প্রসারিত হয়, যেন তোমাদেরকে সাহ্রি খাওয়া থেকে বিরত না রাখে।” (আবু দাউদ শরীফ, পৃষ্ঠা ৩২০, ই.ফা.বা. কর্তৃক অনূদিত আবু দাউদ শরীফ ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৪৩, হাদিস নং ২৩৩৮)
আল্লাহ্ তায়ালা মানুষের কল্যাণে ধর্মকে সহজ করেছেন। কঠিন কোনো বিধিবিধান আল্লাহ্ মানুষের উপর চাপিয়ে দেননি। কিন্তু আমরা ধর্মকে কঠিন করে ফেলছি। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে- “তিনি দ্বিনের ব্যাপারে তোমাদের উপর কোনো রকম সংকীর্ণতা আরোপ করেননি। (সূরা আল হাজ্জ ২২: আয়াত ৭৮)
আমাদের দেশে ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ কর্তৃক প্রকাশিত সাহ্রি ও ইফতারের সময়সূচিতে সূর্যাস্তের ১৪ থেকে ১৮ মিনিট পর ইফতারের সময় নির্ধারণ করা হতো। যুগের ইমাম সূফী সম্রাট হযরত দেওয়ানবাগী (রহ.) হুজুর কেব্লাজান হাদিস পরিপন্থী এ সময়সূচি পরিবর্তনের জন্য সরকারের কাছে যে প্রস্তাব উত্থাপন করেন, সে অনুযায়ী ১৯৯৩ সাল থেকে বিজ্ঞানভিত্তিক সাহ্রি ও ইফতারের সময়সূচি প্রবর্তিত হয়েছে।
“১৯৯৩ সালে দেওয়ানবাগ দরবার শরীফ বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর থেকে সরবরাকৃত সূর্যাস্তের নির্ঘন্টের সাথে সঙ্গতি রেখে ইফতারের সময়সূচি প্রকাশ করে। অন্যদিকে ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত সনাতন রীতিতে প্রণীত ইফতারের সময়সূচিতে আবহাওয়া অধিদপ্তরের দেওয়া সূর্যাস্তের সময় থেকে সর্বোচ্চ ৯ মিনিট পর্যন্ত ব্যবধান পরিলক্ষিত হয়। ফলে দেওয়ানবাগ দরবার শরীফ থেকে এর প্রতিবাদ জানানো হয় এবং জাতীয় পত্র-পত্রিকাসমূহে ব্যাপক লেখালেখি হয়। অবশেষে বিষয়টি একজন সংসদ সদস্যের মাধ্যমে জাতীয় সংসদের স্পিকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে, স্পিকার মহোদয় ধর্ম মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত মন্ত্রীকে এ বিষয়ে একটি ব্যাখ্যা প্রদানের আহ্বান জানান। যার পরিপ্রেক্ষিতে তৎকালীন ধর্মপ্রতিমন্ত্রী এ সমস্যা নিরসনের লক্ষ্যে বিজ্ঞানভিত্তিক নামাজের সময়সূচি প্রণয়নের জন্য ১১ সদস্যবিশিষ্ট সাহ্রি-ইফতার ও নামাজের স্থায়ী সময়সূচি নির্ধারণ কমিটি নামে একটি কমিটি গঠন করেন। উক্ত কমিটি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের সময়ের ব্যবধানের প্রতি লক্ষ্য রেখে ৬৪টি জেলাভিত্তিক সময়সূচি নিধারণ করে। ১৯৯৩ সালের ১৩ই অক্টোবর বাংলাদেশ সরকারের তৎকালীন ধর্মমন্ত্রীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় তা গৃহীত হয়। বৈজ্ঞানিক পন্থায় প্রণীত এ সময়সূচিতে আবহাওয়া দপ্তরের নির্ধারিত সময়ের সাথে সঙ্গতি রেখে সাহ্রি ও ইফতারের সময় নির্ধারণ করা হয়। মহান আল্লাহ্ রাব্বুল ইজ্জতের অপার দয়ায় এভাবেই আমার প্রস্তাব অনুযায়ী ১৯৯৩ সাল হতে বাংলাদেশে পবিত্র কুরআন ও হাদিসের আলোকে বিজ্ঞান ভিত্তিক সাহ্রি ও ইফতারের সময়সূচি প্রবর্তিত হয়েছে। (সূফী সম্রাটের যুগান্তকারী ধর্মীয় সংস্কার ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪১-৪২)
নামাজ রোজার মতো ইবাদত বন্দেগি শুদ্ধভাবে পালনের জন্য মহামানব তথা অলী-আল্লাহ্গণের সান্নিধ্য লাভ করে তাদের দেখানো পথেই ইবাদত বন্দেগি করে ধর্মের প্রকৃত স্বাদ পেতে সক্ষম। তাঁদের নিয়মানুযায়ী রোজা পালন করলে একজন মানুষ আত্মশুদ্ধি লাভ করে আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিনের সান্নিধ্য লাভ করতে সক্ষম হয়। মহান রাব্বুল আলামিন আমাদের সবাইকে সঠিকভাবে রোজা পালন করে যথাসময়ে সাহ্রি ও ইফতার করে রোজার পরিপূর্ণ ফায়েজ বরকত ও রহমত লাভ করার তৌফিক দান করুন। আমিন।
[ইসলাম ধর্ম বিষয়ক লেখক]