সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজানের সুমহান শিক্ষা ও সংস্কার
ইমাম ড. আরসাম কুদরত এ খোদা
পর্ব-১
মহান সংস্কারক, মোহাম্মদী ইসলামের পুনর্জীবনদানকারী, সূফী সম্রাট হযরত দেওয়ানবাগী (রহ.) হুজুর কেবলাজান কুল-কায়েনাতের রহমত, বিশ্বনবি হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর রেখে যাওয়া শান্তির ধর্ম মোহাম্মদী ইসলাম প্রচার করেছেন। আর এ মোহাম্মদী ইসলামের প্রধান শিক্ষা চারটি। যথা- ১। আত্মশুদ্ধি, ২। দিল জিন্দা, ৩। নামাজে হুজুরি ও ৪। আশেকে রাসুল হওয়া।
১। আত্মশুদ্ধি: আত্ম অর্থ নিজ, নফ্স তথা জীবাত্মা। আর শুদ্ধি অর্থ পবিত্রকরণ। সুতরাং আত্মশুদ্ধি অর্থ নিজের নফ্স বা জীবাত্মাকে পরিশুদ্ধ করা, অর্থাৎ আত্মশুদ্ধির মর্ম হচ্ছে নিজের নফ্সকে ষড়রিপুর বেড়াজাল থেকে মুক্ত করে নিজেকে পরিশুদ্ধ করা। মহিমান্বিত আল্লাহ্ বলেন “নিশ্চয় সাফল্য লাভ করবে সে, যে আত্মশুদ্ধি লাভ করে।” (সূরা আল আ‘লা ৮৭: আয়াত ১৪)
অনুরূপভাবে অশেষ দয়াময় আল্লাহ্ ওহির বাণী আল কুরআনের অন্য আয়াতে এরশাদ করেন “অবশ্যই সফলকাম হয়েছে সেই ব্যক্তি, যে নিজেকে পরিশুদ্ধ করেছে। আর ব্যর্থ হয়েছে সেই ব্যক্তি, যে নিজেকে পাপাচারে কলুষিত করেছে।” (সূরা আশ শামস ৯১: আয়াত ৯ ও ১০)
কুল-কায়েনাতের রহমত বিশ্বনবি হযরত মুহাম্মদ (সা.) বর্বর আরবজাতিকে আত্মশুদ্ধির এ সুমহান শিক্ষা দিয়েই আদর্শ চরিত্রবান রূপে গড়ে তোলেন এবং সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্য অনুসরণীয়, পরিশুদ্ধ এক মানব সভ্যতা বিনির্মাণ করেন। এ কারণে যুগের ইমাম সূফী সম্রাট হযরত দেওয়ানবাগী (রহ.) হুজুর কেবলাজানের প্রধান চারটি শিক্ষার মধ্যে প্রথম শিক্ষাই হলো আত্মশুদ্ধি।
২। দিল জিন্দা: দিল অর্থ হৃদয়। পবিত্র কুরআনে হৃদয়কে ক্বালব বলা হয়েছে। আর জিন্দা অর্থ জীবিত। অর্থাৎ ক্বালব বা হৃদয়ে আল্লাহর জিকির জারি করার মধ্য দিয়ে দিল জিন্দা করা। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে এরশাদ হচ্ছে “দুর্ভোগ তাদের জন্য, যাদের ক্বালব বা হৃদয় কঠোর, আল্লাহর জিকির থেকে গাফেল বা বিমুখ। তারা রয়েছে প্রকাশ্য গোমরাহিতে।” (সূরা আঝ ঝুমার ৩৯ : আয়াত ২২)
সেইসাথে মহিমান্বিত আল্লাহ্ ওহির বাণী আল কুরআনের অন্য আয়াতে এরশাদ করেন “যারা ইমান আনে এবং আল্লাহর জিকিরে যাদের ক্বালব প্রশান্তি লাভ করে; জেনে রেখো আল্লাহর জিকিরেই কেবল ক্বালব প্রশান্তি লাভ করে।” (সূরা আর রা‘দ ১৩: আয়াত ২৮)
সুতরাং মহান আল্লাহর জিকির ক্বালবে জারি করেই মানুষ সুস্পষ্ট গোমরাহি থেকে মুক্তি লাভ করে এবং ক্বালবে নুরে ইমান লাভ করে ইসলামের শান্তি বাস্তবে উপলব্ধি করতে পারে। এ কারণে সূফী সম্রাট হযরত দেওয়ানবাগী (রহ.) হুজুর কেবলাজান তাঁর পবিত্র শাহাদত অঙ্গুলি মোবারকের স্পর্শে তরিকা গ্রহণকারী মানুষের ক্বালবে ‘আল্লাহ্’ শব্দের নুর বপন করে ক্বালব জিন্দা করে দিতেন।
৩। নামাজে হুজুরি: নামাজে হুজুরি অর্থ পরিপূর্ণ একাগ্রতার সাথে নামাজ আদায় করে নামাজ কবুলিয়াতের ফায়েজ, রহমত ও বরকত লাভ করা। অর্থাৎ আমাদেরকে নামাজে এমনভাবে দাঁড়াতে হবে যে, পরম করুণাময় আল্লাহ্ আমাকে দেখছেন, আমি কী বলছি, তিনি তা শুনছেন। সুতরাং মহান আল্লাহ্কে হাজির, নাজির, ওয়াহিদ জেনে একাগ্রতার সাথে তাঁর সামনে উপস্থিত হওয়া এবং আল্লাহর নুরের কদম মোবারকে সিজদা করা। পবিত্র কুরআনে সুমহান আল্লাহ্ এরশাদ করেন“ অবশ্যই মু’মিনগণ সফলকাম হয়েছে, যারা নিজেদের নামাজে বিনয়-নম্র, যারা অনর্থক বিষয় থেকে দূরে থাকে।” (সূরা আল মু’মিনূন ২৩: আয়াত ১ থেকে ৩)
অন্যত্র মহিমান্বিত আল্লাহ্ এরশাদ করেন- “নামাজ কায়েম করুন। নিশ্চয় নামাজ অশ্লীল ও মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখে। আল্লাহর স্মরণই শ্রেষ্ঠতর।” (সূরা আল ‘আনকাবূত ২৯: আয়াত ৪৫)
সেই সাথে হাদিস শরীফে আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেন- “হুজুরি দিল বিহনে নামাজ কবুল হয় না।” [নূরুল-আসরার (নূর তত্ত্ব)-১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৫ এবং যাদুত তাকওয়া-২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ২২২]
এজন্য সূফী সম্রাট হযরত দেওয়ানবাগী (রহ.) হুজুর কেবলাজান নামাজে হুজুরি শিক্ষা দিতেন। এ মহামানবের শিক্ষা গ্রহণ করে নামাজ আদায় করলে, দুনিয়ার চিন্তুামুক্ত হয়ে খেয়াল ক্বালবে ডুবিয়ে আল্লাহর প্রেমে মশগুল অবস্থায় নামাজ আদায় করা যায়। আর এভাবে নিয়মিত নামাজ আদায় করতে পারলে আত্মশুদ্ধি লাভ করা যায় এবং নামাজে মি’রাজ তথা আল্লাহর দিদার লাভ হয়।
উপরন্তু আত্মশুদ্ধি, দিল জিন্দা ও নামাজে হুজুরির এ শিক্ষাই ছিলো মুসলিম জাতির আদি পিতা বাবা হযরত ইব্রাহীম (আ.) ও হযরত মুসা (আ.)সহ সকল আম্বিয়ায়ে কেরামের। যুগ পরিক্রমায় আল্লাহর মনোনীত মহামানবগণ নিজ নিজ অনুসারীদেরকে এ উত্তম শিক্ষা দিয়েই তাদেরকে চরিত্রবানরূপে গড়ে তুলেছেন। বিষয়টি অশেষ দয়াময় আল্লাহ্ স্বীয় পাক জবানেই সুস্পষ্ট করেছেন, এরশাদ হচ্ছে- “নিশ্চয় সাফল্য লাভ করবে সে, যে আত্মশুদ্ধি লাভ করে এবং সে স্বীয় প্রতিপালকের নাম স্মরণ করে ও নামাজ আদায় করে। বস্তুত তোমরা পার্থিব জীবনকে প্রাধান্য দাও, অথচ আখিরাত বহু গুণে শ্রেয় ও চিরস্থায়ী। আর এটিই লিখিত রয়েছে পূর্ববর্তী কিতাবসমূহে ইব্রাহীম (আ.) ও মুসা (আ.)-এর ওহির কিতাবসমূহে।” (সূরা আল আ‘লা ৮৭: আয়াত ১৪ থেকে ১৯)
এ সূরা প্রসঙ্গে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন- “যখন সূরা আল আ‘লা তথা ‘সাব্বিহিসমা রাব্বিকাল আ‘লা’ নাযিল হলো, তখন আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেন- এই পুরো সূরাটিই ইব্রাহীম (আ.) ও মুসা (আ.)-এর সহিফার মধ্যে ছিল।” (তাফসীরে ইবনে কাছীর-৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৭০৫)
সুতরাং সূফী সম্রাট হযরত দেওয়ানবাগী (রহ.) হুজুর কেবলাজান মানুষকে যে আত্মশুদ্ধি, দিল জিন্দা, নামাজে হুজুরীর শিক্ষা দিতেন, এ শিক্ষাই ছিলো আল্লাহর প্রেরিত সকল মহামানবের।
একইভাবে সূফী সম্রাট হযরত দেওয়ানবাগী (রহ.) হুজুর কেবলাজানের সর্বশেষ শিক্ষা হচ্ছে-
৪। আশেকে রাসুল হওয়া: কুল-কায়েনাতের রহমত বিশ্বনবি হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রেম মানুষের হৃদয়ে সৃষ্টি করে দিয়ে তাদেরকে ‘আশেকে রাসুল’ হিসেবে গড়ে তোলা। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ্ এরশাদ করেন “হে মাহবুব (সা.)! আপনি বলে দিন, তোমরা যদি আল্লাহ্কে ভালোবাসতে চাও, তবে আমার অনুসরণ করো। তাহলে আল্লাহ্ তোমাদের ভালোবাসবেন এবং তোমাদের পাপরাশি ক্ষমা করে দেবেন। অবশ্যই আল্লাহ্ পরম ক্ষমাশীল ও পরম দয়াময়।” (সূরা আলে ইমরান ৩: আয়াত ৩১)
আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেন “যে ব্যক্তি নিজের পিতামাতা, সন্তানসন্ততি ও অন্য সকল মানুষ অপেক্ষা আমাকে বেশি ভালো না বাসবে, সে মু’মিন হতে পারবে না।” (বোখারী শরীফ-১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৭; এবং মুসলিম শরীফ-১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪৯)
এজন্য সূফী সম্রাট হযরত দেওয়ানবাগী (রহ.) হুজুর কেবলাজান মানুষকে আশেকে রাসুল হওয়ার শিক্ষা দিতেন, যেন মানুষ সকল কিছু অপেক্ষা আল্লাহর রাসুল (সা.)-কে বেশি ভালোবেসে মু’মিন হতে পারে। জগৎশ্রেষ্ঠ এ মহামানবের অনুসারীদের হযরত রাসুল (সা.)-এর উপর দৈনিক ৭২২ বার দরূদ শরীফ পাঠ করতে হয় এবং রহমতের (তাহাজ্জুদের ওয়াক্ত) সময় ও সপ্তাহের সোমবার ও বুধবার বাদ মাগরিব মিলাদ শরীফ পাঠ করতে হয়।
সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজানের অন্যান্য শিক্ষাসমূহ
সূফী সম্রাট হযরত দেওয়ানবাগী হুজুর কেবলাজান যেহেতু মোজাদ্দেদ তথা ধর্মের সংস্কারক ছিলেন, সেহেতু তিনি ইসলাম ধর্মে অনুপ্রবেশ করা কুসংস্কার চিহ্নিত করে তা সংশোধন করেন এবং হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ধর্ম থেকে যা হারিয়ে গিয়েছিল, তা পুনরুত্থান করে সমাজে তুলে ধরেছেন। ফলশ্রুতিতে তিনি মানুষকে নির্ভুল পদ্ধতিতে ধর্মের সকল বিষয় পালন করা এবং ইবাদত করার নিয়ম শিক্ষা দিতেন। তিনি হাকিকতে রোজা, হাকিকতে যাকাত, হাকিকতে হজ পালন করার পদ্ধতি শিক্ষা দেন। সেই সাথে মানুষেরা তাদের হায়াতে জিন্দেগি শেষে ইমানি পরীক্ষায় যেন উত্তীর্ণ হতে পারে, সেই উদ্দেশ্যে তিনি তাদেরকে আল্লাহর পরিচয়, হযরত রাসুল (সা.)-এর পরিচয় লাভ করার পদ্ধতি শিক্ষা দিতেন। তিনি এলমে তাসাউফের সর্বোচ্চ মাকামে উন্নীত হবার লক্ষ্যে সকল সবক শিক্ষা দিতেন।
প্রকৃতপক্ষে সূফী সম্রাট হযরত দেওয়ানবাগী হুজুর কেবলাজান রাহমাতুল্লিল আলামিন ইমামুল মুরসালিন হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর রেখে যাওয়া শান্তির ধর্ম মোহাম্মদী ইসলাম মানুষকে শিক্ষা দিয়ে গেছেন। যে ধর্ম মহান আল্লাহ্ মানবজাতির শান্তি ও মুক্তির তরে হযরত মোহাম্মদ (সা.)-কে উপহার দেন। এ প্রসঙ্গে মহিমান্বিত আল্লাহ্ বলেন “আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের ধর্মকে পূর্ণ করে দিলাম। তোমাদের প্রতি আমার নিয়ামত পরিপূর্ণ করে দিলাম এবং ইসলামকেই তোমাদের জন্য (পরিপূর্ণ) ধর্ম হিসেবে মনোনীত করলাম।” (সূরা আল মায়িদাহ ৫: আয়াত ৩)
সূফী সম্রাট বিশ্বনবি হযরত মুহাম্মদ (সা.) প্রবর্তিত মোহাম্মদী ইসলামে মানবজাতির ইহ ও পরলৌকিক শান্তির পথনির্দেশনা অনুযায়ী মানুষকে এলমে শরিয়ত, তরিকত, হাকিকত ও মারেফাতের আলোকে ইসলামের পূর্ণাঙ্গ শিক্ষা অনুসরণ করে দুনিয়া ও আখিরাতের জীবন শান্তিময় করার উপায় শিক্ষা দিতেন। মূলত তাঁর শিক্ষা পালন করে আল্লাহর রহমতে অসংখ্য মানুষ পার্থিব জীবনে রোগ-ব্যাধি, বালা-মুসিবত, বিপদ-আপদ, অভাব-অনটন থেকে পরিত্রাণ লাভ করছেন।
এক কথায় যুগের ইমাম সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান মানুষকে কুরআন ও হাদিসের আলোকে নুরে মোহাম্মদীর পথে আহ্বান করতেন এবং আল্লাহর প্রকৃত প্রতিনিধি তথা ‘ইনসানে কামেল’ হবার শিক্ষা দিয়ে গেছেন।
সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজানের সংস্কারমূলক কার্যাবলি
হাদিস শরীফে বর্ণিত হয়েছে, হযরত রাসুল (সা.) ফরমান “নিশ্চয় মহান ও মহিমান্বিত আল্লাহ্ এই উম্মতের জন্য প্রত্যেক শতাব্দীর শিরোভাগে এমন এক ব্যক্তিকে পাঠাবেন, যিনি তাদের ধর্মকে সংস্কার করে সজীব ও সতেজ করবেন।” (আবু দাউদ শরীফের সূত্রে মেশকাত শরীফ, পৃষ্ঠা-৩৬)
আল্লাহ্ তায়ালার প্রেরিত এ শতাব্দীর ‘মোজাদ্দেদ’ বা মহান সংস্কারক সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান স্বধর্মীদের অজ্ঞতা ও বিধর্মীদের চক্রান্তের ফলে ইসলামের নামে পবিত্র কুরআন ও হাদিস-বিরোধী যেসব বিধান মুসলিম সমাজে প্রচলিত রয়েছে, এর সংস্কার সাধন করেছেন। দেশে-বিদেশে বিপুলভাবে সমাদৃত এ সংস্কারসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি সংস্কার নিম্নে সংক্ষিপ্তাকারে দেওয়া হলো-
১। মহান আল্লাহ্ নিরাকার নন; তাঁর অপরূপ সুন্দর নুরের সুরত আছে:
আমাদের সমাজে প্রচলিত আছে ‘মহান আল্লাহ্ নিরাকার, তাঁকে দেখা যায় না।’ সূফী সম্রাট হযরত দেওয়ানবাগী হুজুর কেবলাজান বলেন, “সমাজের প্রচলিত এ ধারণা ভুল। আসলে মহান আল্লাহ্ নিরাকার নন; তাঁর অপরূপ সুন্দর নূরের সুরত আছে। সাধনা-রিয়াজতের মাধ্যমে আল্লাহ্কে এ দুনিয়ার জীবনে দেখা যায়।” আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেন- “মহান আল্লাহ্ হযরত আদম (আঃ)-কে তাঁর নিজের সুরতে সৃষ্টি করেছেন।” (বোখারী ও মুসলিমের সূত্রে মেশকাত শরীফ, পৃষ্ঠা ৩৯৭)
সুতরাং যে মহিমান্বিত আল্লাহ্ তাঁর নিজের রূপে স্বীয় প্রতিনিধি আদম (আ.)-কে রূপ দিলেন, তাঁকে নিরাকার বলার চেয়ে বড় ভুল জগতে আর আছে কি? তবে মহান আল্লাহ্ মানুষের মতো রক্ত-মাংসের দেহধারী নন; তিনি নুরের। পরম করুণাময় আল্লাহ্ স্বরূপে বিদ্যমান বলেই, তিনি সকল কালের সকল যুগের নবি ও রাসুলদের মাধ্যমে মানবজাতিকে নির্দেশ দিয়েছেন তারা যেন একমাত্র উপাস্য আল্লাহর ইবাদত করে।
সূফী সম্রাট বলেন, “এক, দুই, তিন, এগুলো গণিতের সংখ্যা। নিরাকার কোনো কিছুকে এ সংখ্যা দ্বারা গণনা করা যায় না। যার আকার আছে, কেবল তাকেই এক গণনা করা যায়। সুতরাং আল্লাহ্ এক এর অর্থ অশেষ দয়াময় আল্লাহ্ একমাত্র উপাস্য, তাঁর নুরের রূপ আছে; তিনি নিরাকার নন।”
একইসাথে সূফী সম্রাট বলেন- ‘মহান আল্লাহর অপরূপ সুন্দর নুরের চেহারা মোবারক রয়েছে।’ আর এ বিষয়টির বর্ণনা পবিত্র কুরআনেও রয়েছে। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ্ এরশাদ করেন- “তোমরা যেদিকে তাকাও, সেদিকেই আল্লাহর চেহারা মোবারক বিদ্যমান রয়েছে।” (সূরা-আল বাকারাহ ২: আয়াত ১১৫)
এভাবেই মহান আল্লাহ্ ওহির বাণী আল কুরআনের ১৪ (চৌদ্দ) খানা আয়াতে তিনি স্বয়ং তাঁর চেহারা মোবারকের বর্ণনা দিয়েছেন। পবিত্র কুরআনে মহিমান্বিত আল্লাহর চক্ষু মোবারকের বর্ণনায় ৬৩ খানা আয়াত নাজিল হয়েছে। আল্লাহ্ বলেন- “হে রাসুল (সা.)! আপনি আপনার প্রতিপালকের নির্দেশের অপেক্ষায় ধৈর্যধারণ করুন। নিশ্চয়ই আপনি আমার দুই চোখের সামনে রয়েছেন।” (সূরা আত্ব ত্বুর ৫২: আয়াত ৪৮)
এমনিভাবে পরম করুণাময় আল্লাহর শ্রবণেন্দ্রিয় বা কান মোবারকের বর্ণনায় ওহির বাণী আল কুরআনে ৪৮ (আটচল্লিশ) খানা আয়াত নাযিল হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় মহান আল্লাহর জবান মোবারকের বর্ণনায় ওহির বাণী আল কুরআনে ৪৭৭ খানা আয়াত, একইভাবে তাঁর হাত মোবারকের বর্ণনায় ১৭ খানা আয়াত, তাঁর দেহ মোবারকের বর্ণনায় ৬ খানা আয়াত, তাঁর কদম মোবারকের বর্ণনায় ২ (দুই) খানা আয়াত নাজিল করে অশেষ দয়াময় আল্লাহ্ প্রমাণ করেছেন- তিনি নিরাকার নন, তাঁর নুরের রূপ আছে।
সূফী সম্রাট হযরত হুজুর কেবলাজান বলেন- “পৃথিবীতে আগত সকল নবি ও রাসুল আল্লাহ্কে দেখেছেন, তাঁরা আল্লাহর পরিচয় লাভ করেছেন, তাঁদের কিছু সংখ্যক সরাসরি আল্লাহর সাথে কথাও বলেছেন। নবুয়ত পরবর্তী বেলায়েতের যুগে তরিকার ইমামগণ, মাজহাবের ইমামগণ মহান আল্লাহ্কে দেখেছেন, তাঁর পরিচয় লাভ করেছেন, এমনকি তাঁদের কেউ কেউ আল্লাহর সাথে কথাও বলেন। আমার ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি।
” এ প্রসঙ্গে সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান বলেন, “আমি আমার মহান মালিক আল্লাহ্কে দেখেছি। মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিন আমাকে যতবার তাঁর দিদার দ্বারা ধন্য করেছেন, আমি ততবারই দেখেছি ‘আল্লাহ্ নিরাকার নন; তিনি অপরূপ সুন্দর নূরের সুরতে স্বরূপে বিদ্যমান’।”
অতঃপর সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান সমাজে প্রচলিত ভুল ধারণা সংশোধন করার লক্ষ্যে তিনি সুমহান আল্লাহ্কে যে রূপে দেখেছেন, ওহির বাণী আল কুরআন থেকে সেই রূপের বর্ণনা খুঁজে বের করে আল্লাহর জাত-পাকের পরিচয় বর্ণনা শুরু করেন। এক পর্যায়ে তিনি আল্লাহর পরিচয়ের উপর বিষয়ভিত্তিক তাফসীর লেখার মহান কাজে হাত দেন। অতঃপর একে একে ‘তাফসীরে সূফী সম্রাট দেওয়ানবাগী আল্লাহর জাত-পাকের পরিচয়-১ম খণ্ড’ এবং ‘তাফসীরে সূফী সম্রাট দেওয়ানবাগী আল্লাহর গুণবাচক নামের পরিচয়-২য় খণ্ড থেকে ৮ম খণ্ড’ পর্যন্ত তাফসীর প্রণয়ন করেন। এ তাফসীর শরীফ মুসলিম বিশ্বের জ্ঞানের ভাণ্ডারকে পূর্ণতা দানকারী ও নজিরবিহীন একমাত্র তাফসীর, যে তাফসীর শরীফে আল্লাহর আকারের বর্ণনা, তাঁর অপরূপ সুন্দর নুরের রূপের বর্ণনা তাফসীর প্রণেতার প্রত্যক্ষ দর্শন থেকে যেমন উপস্থাপিত হয়েছে, তেমনি মহিমান্বিত আল্লাহর আসমাউল হুসনা তথা সুন্দর সুন্দর গুণবাচক নামের মহিমা উপস্থাপন করে প্রমাণ করা হয়েছে- মহান আল্লাহ্ সর্বগুণের আধার, তাঁর নুরের রূপ আছে; তিনি নিরাকার নন।
যুগের ইমাম সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান তাঁর হায়াতে তাইয়্যেবার সুদীর্ঘ তেত্রিশটি বছর জুড়ে আল্লাহর পরিচয় লিপিবদ্ধ করার সুমহান কাজে মশগুল ছিলেন। এ মহামানব আল্লাহর পক্ষ থেকে ‘জামানার মোজাদ্দেদ’ হিসেবে প্রেরিত হওয়ার কারণে, তিনি ইসলাম ধর্মে অনুপ্রবেশ করা অসংখ্য কুসংস্কার সংশোধন করে হযরত রাসুল (সা.)-এর প্রকৃত ধর্ম মোহাম্মদী ইসলাম সমাজে তুলে ধরেছিলেন। তাঁর অসংখ্য ধর্মীয় সংস্কারের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ সংস্কার হচ্ছে- মহান আল্লাহ্ নিরাকার নন; তাঁর অপরূপ সুন্দর নুরের সুরত আছে।
২। বিশ্বনবি হযরত মুহাম্মদ (সা.) গরিব ছিলেন না; তিনি ছিলেন ধনী ও মদীনার শাসনকর্তা:
আমাদের সমাজে প্রচলিত আছে ‘হযরত মুহাম্মদ (সা.) গরিব ছিলেন। তিনি অনাহারে-অর্ধাহারে কালাতিপাত করতেন। তাঁর পরিধানের বস্ত্র ছিল জীর্ণ-মলিন, সত্তর তালিওয়ালা। তিনি ইহুদির বাগানে খেজুরের বিনিময়ে কূপ থেকে বালতি দিয়ে পানি উত্তোলন করে বাগানে দিতেন।’
সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান বলেন, “হযরত মোহাম্মদ (সা.) কখনই গরিব ছিলেন না, তিনি ছিলেন সবচেয়ে ধনী। সর্বকালের সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর দাদা হযরত আবদুল মুত্তালিব (আ.) ছিলেন মক্কার শাসনকর্তা। ফলে তিনি শৈশবকালেই রাজপরিবারে লালিত-পালিত হন। তাঁর সম্মানিত পিতা হযরত আবদুল্লাহ (আ.) ছিলেন আন্তর্জাতিক ব্যবসায়ী। পাশাপাশি হযরত রাসুল (সা.) নিজেও ছিলেন মদীনার শাসনকর্তা, অর্থাৎ মদীনার ইসলামী জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রের প্রথম রাষ্ট্রপতি। ‘মদীনার সনদ’ নামে তিনিই এ রাষ্ট্রের সংবিধান প্রণয়ন করে সকলের জীবনে ইনসাফ কায়েম করে শান্তির সমাজ কায়েম করেন। হযরত রাসুল (সা.)-এর লঙ্গরখানায় প্রতিদিন সারে তিনশ’ থেকে চারশ’ লোক আহার করত। সুতরাং তিনি ধনী ছিলেন।
তাছাড়া মহান আল্লাহ্ কুল-কায়েনাতের রহমত হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে নজিরবিহীন সম্মান ও অতুলনীয় ধনসম্পদ দ্বারা তাঁকে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে অধিষ্ঠিত করেন। মহান আল্লাহ্ বলেন- “হে রাসুল (সা.)! আমি আপনাকে অসহায় অবস্থায় পেয়েছি, অতঃপর আপনাকে সম্পদশালী করেছি।” (সূরা আদ্ব দ্বুহা ৯৩: আয়াত ৮)
সুতরাং মহিমান্বিত আল্লাহ্ নিজে যে রাসুল (সা.)-কে সম্পদশালী করলেন, তিনি কি করে গরিব হতে পারেন? মূলত পরম করুণাময় আল্লাহ্ হযরত রাসুল (সা.)-কে এত বেশি সম্পদশালী করেন যে, তিনি তাঁর ধনভাণ্ডারের চাবিসমূহ তাঁর এ শ্রেষ্ঠ মাহবুবের হস্ত মোবারকে অর্পণ করেন।
এ প্রসঙ্গে আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেন- “একদা আমি ঘুমিয়ে ছিলাম। আমাকে দেখানো হলো যে, পৃথিবীর সকল ধনভাণ্ডারের চাবিসমূহ আমার হাতে অর্পণ করা হয়েছে।” (বোখারী ও মুসলিম শরীফের সূত্রে মেশকাত শরীফ, পৃষ্ঠা-৫১২)
ফলে আল্লাহর রাসুল (সা.) এত বেশি দান-সদকা করতেন যে, তাঁর মত এত বড় দানশীল আর কেউ ছিল না। প্রকৃতপক্ষে হযরত রাসুল (সা.) ইহকাল ও পরকালের বাদশাহ। আর তিনি সম্পদশালী-ধনী ছিলেন বলেই তিনি যাকাত দিয়েছেন, হজ করেছেন, বিদায় হজে একশ’ উট কোরবানি করেছেন।
অথচ স্বধর্মীদের অজ্ঞতার সুযোগে বিধর্মীরা চক্রান্ত করে মুসলমানদের পাঠ্যপুস্তকে পর্যন্ত কুরআন বিরোধী এ মিথ্যা অন্তর্ভুক্ত করে দেয়, হযরত রাসুল (সা.) গরিব ছিলেন।
সূফী সম্রাট হযরত দেওয়ানবাগী হুজুর কেবলাজান এ ভুল সংশোধন করে পবিত্র কুরআন ও হাদিসের আলোকে প্রমাণ করেন- বিশ্বনবি হযরত মুহাম্মদ (সা.) গরিব ছিলেন না; তিনি ছিলেন ধনী, দোজাহানের বাদশাহ। জামানার মোজাদ্দেদ সূফী সম্রাট হযরত দেওয়ানবাগী হুজুর কেবলাজান তাঁর মহামূল্যবান এ সংস্কারটি মানবজাতির কাছে উপস্থাপনের লক্ষ্যে এ বিষয়ে একখানা কিতাব রচিত করেন। ‘বিশ্বনবীর স্বরূপ উদ্ঘাটনে সূফী সম্রাট: রাসূল (সঃ) সত্যিই কি গরীব ছিলেন?’ এ নামে প্রণীত কিতাবখানা সূফী সম্রাটের ধর্মীয় সংস্কারের এক জীবন্ত দলিল হিসেবে আজ মুসলিম উম্মাহর নিকট সমাদৃত হয়েছে।
(চলবে)