সৃষ্টির মাঝেই স্রষ্টা বিরাজমান
ড. সৈয়দ মেহেদী হাসান
মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিন বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি করে তাঁর প্রতিটি সৃষ্টির মাঝে বিরাজমান থেকেই সৃষ্টিকে লালন-পালন করে চলেছেন। তিনি রব বা প্রতিপালক হিসেবে সকলের রিজিক দানের মাধ্যমে রিজিকদাতার কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। তাছাড়া জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি তিনি প্রতিটি সৃষ্টজীবকে ভালোবাসার বন্ধনে জড়িয়ে তাঁর সকল সৃষ্টিকে পরিবেষ্টন করে আছেন।
জাত-পাক (The Holy Spirit) আল্লাহ্ তায়ালার মাঝে প্রথমে প্রেমের সৃষ্টি হয়। তাঁর ভিতর দুধরনের প্রেমের উদ্ভব ঘটে। অর্থাৎ কাউকে ভালোবাসার ইচ্ছা এবং কারো ভালোবাসা পাওয়ার ইচ্ছা।১ মূলত যিনি সৃষ্টিজগতের মালিক তিনি হচ্ছেন প্রেমময়। মানুষকে ভালোবেসে তিনি এই জগত সংসার সৃষ্টি করেন। এ প্রসঙ্গে হাদিসে কুদসিতে মহান আল্লাহ্ বলেন- “আমি ছিলাম গুপ্ত ধনাগার, নিজেকে প্রকাশ করতে ভালোবাসলাম, তাই সৃষ্টিজগত সৃজন করলাম।”২
সনাতন ধর্মমতে, এমন একদিন ছিল যখন ঈশ্বর বা সৃষ্টিকর্তা ছাড়া আর কিছুই ছিল না। তিনি অনাদি, অনন্ত, সর্বশক্তিমান, সর্বজ্ঞ, সর্বগুণান্বিত। তিনি অনাদিকাল থেকেই বিরাজমান, তিনি অনন্তকাল আছেন। তিনি সম্পূর্ণ ইচ্ছাকৃতভাবেই সৃষ্টি করলেন এই বহুত্বের জগত। উপনিষদে আছে, সৃষ্টির পূর্বে একমাত্র অদ্বিতীয় ব্রহ্মই ছিলেন।৩ পরমেশ্বর চিন্তা করলেন- “একাকী ন রমেত।” তখনি সিদ্ধান্ত নিলেন আমি এক, বহু হবো (সৃষ্টি করব)।৪ ফলে তৎক্ষণাৎ সৃষ্টি হলো এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড।
মহান আল্লাহ্ আসমান জমিন সৃষ্টি করার পর আরশে সমাসীন হওয়ার পর সেদিন সকল আদম সন্তানের রূহসমূহ মহান আল্লাহ্কে ‘রব’ অর্থাৎ প্রতিপালক হিসেবে স্বীকার করে নেন। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে- ‘‘স্মরণ করো, আদম সন্তানদের পৃষ্ঠদেশ থেকে তোমার রব বের করলেন তাদের বংশধরদের এবং তাদের থেকে স্বীকারোক্তি নিলেন তাদেরই সম্মন্ধে এবং বললেন- ‘আমি কি তোমাদের প্রভু নই?’ তারা বলল: হাঁ, আমরা সাক্ষী রইলাম! (তা এজন্য যে) তোমরা যেন কিয়ামতের দিন বলতে না পারো যে, আমরা তো এ ব্যাপারে বেখবর ছিলাম।’’ (সূরা আল আ‘রাফ ৭: আয়াত ১৭২)
মহান আল্লাহ্ পবিত্র আশুরার দিবসেই আসমান ও জমিন, আরশ, কুরসি, লাওহ, কলম সবকিছু সৃষ্টি সুসম্পন্ন করে রাব্বুল আলামিন তথা জগতসমূহের প্রতিপালকরূপে আরশে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। অতঃপর এ দিবসেই তিনি সকল রূহকে সামনে হাজির করে তাদের উদ্দেশে প্রশ্ন করেছিলেন ‘আলাসতু বিরাব্বিকুম?’ অর্থাৎ ‘আমি কি তোমাদের প্রভু নই?’ “ক্বালূ বালা” অর্থাৎ ‘রূহসমূহ জবাব দিয়েছিল নিশ্চয়ই, আপনি আমাদের প্রতিপালক।’ মহান প্রভু একক বিশ্ব স্রষ্টা ও বিশ্ব প্রতিপালক। যিনি সৃষ্টি জগতের স্রষ্টা, পালনকর্তা, জীবনদাতা, রিজিকদাতা, মৃত্যুদাতা ইত্যাদি।
সনাতন ধর্ম দর্শন এবং হিন্দু পৌরণিক কাহিনীতে উল্লেখ আছে- “ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর (শিব)-পরম ঈশ্বরেরই তিনটি ভাব। যথা- ব্রহ্মারূপে তিনি হচ্ছেন সৃষ্টিকর্তা (The Creator of the Universe), বিষ্ণুরূপে তিনি হচ্ছেন পালনকর্তা (The Operator or Preserver) এবং মহেশ্বর বা শিবরূপে তিনি হচ্ছেন ধ্বংসকারী (The Destroyer)।
মহান আল্লাহ্ পবিত্র কুরআনে বলেন- “কুল্লু শাইয়িন হালিকুন ইল্লা ওয়াজহাহূ।” অর্থাৎ একমাত্র আল্লাহর চেহারা মোবারক ব্যতীত সবকিছুই ধ্বংসশীল। (সূরা কাসাস ২৮: আয়াত ৮৮) ইসলাম ধর্ম মতে- মহান আল্লাহ্ যেমন সৃষ্টিকর্তা (খালিক), প্রতিপালক (রব) এবং ধ্বংসকারী (হালিক)। প্রকৃত অর্থে মহান আল্লাহ্ ছাড়া পৃথিবীতে আর কোনো প্রভু নেই। ইসলাম ধর্মে কালেমাতে ১ম অংশে বলা হয় “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্।” অর্থাৎ আল্লাহ্ ছাড়া কোনো মা‘বুদ নেই। সনাতন ধর্মমতে বলা হয়- “একম্ এব দ্বিতীয়ম্।” অর্থাৎ ঈশ্বর এক এবং অদ্বিতীয়।৫ গীতায় আছে- ব্রহ্ম হইতে স্থাবর-জঙ্গমাদি সকল সৃষ্ট জীব-জগৎ বিনষ্ট হলেও তিনি বিনষ্ট হন না।৬
খ্রিষ্ট ধর্ম মতে- ‘GOD’ হচ্ছে Generator, Operator এবং Destroyer।৭ তাই প্রতিটি ধর্ম মতে পরিলক্ষিত হয় মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিন সৃষ্টির মাঝে বিরাজমান থেকে সৃষ্টিকে প্রতিপালন করে আসছেন। তিনি সৃষ্টিকে যেমন অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্বে রূপ দান করেন, তেমনি সৃষ্টিকে ধ্বংসও করেন। একমাত্র তিনিই অবিনশ্বর। তাইতো সৃষ্টির আদিতে ছিলেন তিনি, সৃষ্টির সকল কিছু ধ্বংসের পরেও তিনিই থাকবেন। অর্থাৎ তিনি আদিতে ও তিনিই অন্তেÍ, প্রকাশ্য এবং গোপনে বিরাজমান রয়েছেন।
বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের প্রতিটি সৃষ্টি মহান আল্লাহর পরিবারতুল্য। মহান রাব্বুল আলামিন তাঁর পরিবারতুল্য সকল সৃষ্টিকে বেষ্টন করে আছেন। হযরত আনাস (রা.) ও হযরত আবদুল্লাহ (রা.) বলেন, হযরত রাসুল (সা.) বলেন- “সমস্ত মাখলুক (সৃষ্টজীব) আল্লাহ্ তায়ালার পরিবার।”৮ সংস্কৃত সাহিত্যে আছে- ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’- সমগ্র জগৎ তাঁর আত্মীয়। আত্মা মাত্রই অব্যক্ত ব্রহ্ম। মহান আল্লাহ্ পৃথিবীর সকল মানুষকেই পরিবেষ্টন করে আছেন। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে- “যা কিছু আছে আসমানে এবং যা কিছু আছে জমিনে, সবকিছু আল্লাহরই। আর এ সকল কিছুকেই আল্লাহ্ পরিবেষ্টন করে আছেন।” (সূরা নিসা ৪: আয়াত ১২৬)
অন্যত্র এরশাদ হয়েছে- “নিশ্চয়ই আমার প্রতিপালক তোমরা যা করো, তা পরিবেষ্টন করে আছেন।” (সূরা হূদ ১১: আয়াত ৯২) মহান আল্লাহ্ পৃথিবীর সকল মানুষকেই পরিবেষ্টন করে আছেন। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে- “[হে রাসুল (সা.)!] স্মরণ করুন, আমি আপনাকে বলেছিলাম যে, আপনার প্রতিপালক মানুষকে পরিবেষ্টন করে আছেন।” (সূরা বনি ইসরাঈল ১৭: আয়াত ৬০)
মহান সংস্কারক সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহবুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (রহ.) হুজুর কেবলাজান তাঁর লিখিত কালজয়ী তাফসীর কিতাব ‘তাফসীরে সূফী সম্রাট দেওয়ানবাগী’-তে মহান আল্লাহ্ পৃথিবীর সকল কিছুকেই বেষ্টন করে আছেন, সেই সম্পর্কে পবিত্র কুরআনের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, আল্লাহর একটি নাম হচ্ছে ‘আল-মুহিত্ব’। যে নামের অর্থ করা হয়েছে পরিবেষ্টনকারী, বেষ্টনকারী, ঘেরাওকারী, নিয়ন্ত্রণকারী, সবদিক পরিবেষ্টনকারী, সবকিছু অবহিত ইত্যাদি। মুহিত্ব নামে পবিত্র কুরআনে মোট ১২টি আয়াত খুঁজে পাওয়া যায়।
মুহিত্ব নামটির অর্থ- অভিধানে মহাসাগরও করা হয়েছে। সাগরের সুবিশাল জলরাশি যেমন অগণিত মৎস্যকুলসহ সমুদ্রে প্রাণীসমূহকে বেষ্টন করে থাকে, তেমনি আল্লাহ্ তায়ালা মানবজাতিসহ সৃষ্টিকুলকে বেষ্টন করে আছেন। তাঁর নিয়ন্ত্রণ বলয়ের বাইরে যেমন কেউ নেই, তেমনি এই নিয়ন্ত্রণ বলয়ের বাইরে কাহারো জীবন ধারণ করার শক্তিও নেই।৯
মানব সংসারের কর্তা হিসেবে পিতাকে যেমন পরিবার-পরিজনের ভরণ পোষণের ব্যবস্থা করে সুখে দুঃখে বেষ্টন করে আগলে রাখতে দেখা যায়। তদ্রুপ মহাবিশ্বের মহান কর্তারূপে আল্লাহ্ তায়ালা তাঁর সকল সৃষ্টিকে লালন-পালন করার পাশাপাশি সকলকে পরিবেষ্টন করে আছেন। অন্যদিকে তিনি কাফের, মুশরিক, শয়তান সকলকেই বেষ্টন করে আছেন। ফলে তারা আল্লাহর আজাব থেকে পরিত্রাণ পাবে না। মু’মিনের জন্য রাশি রাশি নিয়ামত দ্বারা বেষ্টন করে রাখলেও অন্যদিকে কাফিরদের তিনি আজাব গজব দ্বারা গ্রেফতার করেন। তিনি দুষ্টের দমন ও শিষ্টের লালন করে থাকেন।১০
মহান আল্লাহ্ মহাবিশ্বের সবকিছু পরিবেষ্টন করে আছেন। তিনি যেমন সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা, অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্বে রূপদানকারী, তেমনি তিনিই সকলের জীবনদাতা, লালনকর্তা, পালনকর্তা, রিজিকদাতা ও মৃত্যুদাতা। জীবের জীবনে, প্রাণীর প্রাণে, সর্বজীবের অস্তিত্বে তিনি মিশে আছেন। মহাবিশ্বের সকল সৃষ্টির জীবনে তাঁরই সর্বময় কর্তৃত্ব, নিয়ন্ত্রণ ও শক্তিমত্তা নিহিত রয়েছে। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ্ বলেন, “আল্লাহ্ আসমান ও জমিনের নুর বা জ্যোতি।” (সূরা নূর ২৪: আয়াত ৩৫)
মহান আল্লাহ্ বলেন, “আল্লাহ্ সেই সত্তা, যিনি সৃষ্টি করেছেন সাত আসমান এবং অনুরূপ জমিনও, এসবের মধ্যে নাজিল হয় তাঁর আদেশ; যাতে তোমরা জানতে পারো যে, আল্লাহ্ সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান এবং সবকিছুকে আল্লাহ্ স্বীয় জ্ঞানে পরিবেষ্টন করে রেখেছেন। (সূরা তালাক ৬৫: আয়াত ১২)
আল্লাহর জাত পাক যেমন নুরের, তেমনি তাঁরই নুর মোবারক সকল সৃষ্টিকে জীবন দিয়েছে। ভূমণ্ডল ও নভোমণ্ডলসহ সারাবিশ্বের সকল সৃষ্টিতে তাঁরই নুর মোবারক জীবনী শক্তিরূপে কাজ করে চলেছে। অতঃপর তিনি যেভাবে ইচ্ছা, সেভাবেই সৃষ্টিজগতের নিয়ন্ত্রণ করেন, পরিচালিত করেন। প্রতিটি সৃষ্টির মাঝে তাঁর উপস্থিতি যেমন সৃষ্টিকে অস্তিত্বে এনেছে, তেমনি তাঁর অনুপস্থিতি মৃত্যু বয়ে আনে, যে কারণে সৃষ্টি পুনরায় অনস্তিত্বে হারিয়ে যায়। আসমান জমিনে যা কিছু আছে, সবকিছুকে মহান আল্লাহ্ পরিবেষ্টন করে আছেন। অর্থাৎ সৃষ্টিকুলে যা কিছু আছে সকলই তাঁর, তাঁর নুর বিহনে কারোই অস্তিত্বে আসার সুযোগ নেই। আর প্রতিটি সৃষ্টির প্রাণস্পন্দনে তাঁর নুর বিরাজিত থাকায় তিনিই সবকিছুকে পরিবেষ্টন করে আছেন।১১
মহান আল্লাহ্ যে, সর্বত্র বিরাজমান এ প্রসঙ্গে উপনিষদেও উল্লেখ আছে- “সর্বং খলু ইদং ব্রহ্ম তজ্জলানিতি।”১২ অর্থাৎ সবার মাঝেই ব্রহ্ম বিরাজমান। শুধু তাই নয়, এসব স্বরূপে ব্রহ্মই। প্রতিটি সৃষ্টি ব্রহ্ম থেকে আগত এবং ব্রহ্মেই অবস্থিত এবং ব্রহ্মেই গমন করে। পবিত্র গীতায় এ মর্মে উল্লেখ রয়েছে- “ঈশ্বর সকল জীবের হৃদয়ে অধিষ্ঠিত।”(শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ১৮/৬১) ইসলাম ধর্মে বলা হয়েছে- “সব সৃষ্টির মধ্যেই স্রষ্টার নিদর্শন বিদ্যমান।” শুধু তাই নয় হাদিস শরীফে বর্ণিত হয়েছে- “কুলুবুল মু’মিনিনা আরশুল্লাহ।” অর্থাৎ মু’মিন বান্দার দিল আল্লাহর আরশ। আল্লাহর অবস্থান মু’মিনের অন্তরে। অন্তরেই আত্মার অধিষ্ঠান। তাই আত্মা স্বয়ং ব্রহ্ম। শ্রীরামকৃষ্ণের ভাষায়- “ভক্তের হৃদয়ই ভগবানের বৈঠকখানা।” প্রতিটি জীবের মধ্যেই যখন ব্রহ্ম উপস্থিত, তখন সেই জীবকে ভালোবাসা এবং সেবা করাইতো প্রকারান্তরে ব্রহ্মের সেবা ও ব্রহ্মকে ভালোবাসা। এ অনুভূতির যুক্তিতেই শ্রীরামকৃষ্ণ পরামর্শ দিলেন এবং স্বামী বিবেকানন্দ ঘোষণা করলেন:
‘বহুরূপে সম্মুখে তোমার, ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর?
জীবে প্রেম করে যেইজন, সেইজন সেবিছে ঈশ্বর।’
আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, হাদিসে কুদসিতে মহান আল্লাহ্ ফরমান- “আমার জমিন আমাকে ধারণ করতে পারে না, আমার আসমানও আমাকে ধারণ করতে পারে না। কেবল আমার মু’মিন বান্দার ক্বালব (হৃদয়) আমাকে ধারণ করে থাকে।” (তাফসীরে মাজহারী ৭ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৬০) এ প্রসঙ্গে জগদ্বিখ্যাত সুফি কবি ও দার্শনিক মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি (রহ.) তাঁর বিখ্যাত মসনবী শরীফে উল্লেখ করেন, “মান না গুনজাম দার জমিনও আসমান, লেকে গুনজাম দার ক্বুলুবে মুমিনান।” অর্থাৎ মহান আল্লাহ্ আসমান ও জমিনের কোথাও সংকুলান হয় না, কিন্তু মু’মিন বান্দার হৃদয়ে আল্লাহ্ অবস্থান করেন। হাদিস শরীফে আরও বর্ণিত রয়েছে, “ক্বালবুল মু’মিনি মিন ‘আরশিল্লাহ।” অর্থা- “মু’মিনের হৃদয় আল্লাহর আরশ।” (তাফসীরে ইবনে আরাবী ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৮৯)১৩
মহান আল্লাহ্ যে, মানুষের মাঝে বিরাজমান সেই প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে, “ওয়া হুওয়া মা‘আকুম আইনা মা কুনতুম, ওয়াল্লাহু বিমা তা‘মালূনা বাসীর।” অর্থাৎ আর তিনি তোমাদের সঙ্গে আছেন, তোমরা যেখানেই থাক না কেন। তোমরা যা কিছুই করো, আল্লাহ্ তা দেখেন। (সূরা আল হাদিদ ৫৭: আয়াত ৪)
মূলত মু’মিন ব্যক্তির সম্মান কাবাঘরের চেয়েও বেশি। এজন্য তাঁদের মর্যাদা আল্লাহর কাছে অনেক বেশি। কাবাঘরে আল্লাহ্কে খুঁজে পাওয়া যায় না, কিন্তু মু’মিন ব্যক্তির ক্বালবে আল্লাহ্ বিরাজমান। এজন্য সাধনার মাধ্যমে মানুষের ভিতরে মহান আল্লাহর সুপ্ত নুরকে জাগ্রত করতে পারলে বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের মালিকের সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব।
মহান আল্লাহ্ কাল মহাকালের অবিরাম যাত্রায় নতুন নতুন সৃষ্টিকে অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্বে রূপ দেন। তিনি সৃষ্টিকে প্রতিপালন করেন। তাঁর থেকে সকল সৃষ্টি জীবন লাভ করেছে। আবার সকল সৃষ্টি তাঁরই কাছে ফিরে যায়। উপনিষদে আছে: তজ্জলান ইতি।১৪ ব্রহ্মসূত্রে১৫ আছে- সবকিছুর ব্রহ্ম থেকে উৎপত্তি, ব্রহ্মেই অবস্থান এবং ব্রহ্মেই প্রত্যাবর্তন। পবিত্র কুরআনেও বর্ণিত হয়েছে যে, “ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন” অর্থাৎ আমরা তো আল্লাহরই জন্য এবং আমরা সবাই অবশ্যই তাঁরই কাছে ফিরে যাবো। (সূরা বাকারাহ ২: আয়াত ১৫৬)
আবার গীতায় আছে: আমিই সকল প্রাণীর হৃদয়ে অবস্থিত প্রত্যগাত্মা (অন্তরতম আত্মা)। আমিই প্রাণিগণের উৎপত্তি, স্থিতি ও প্রলয়ের কারণ।১৬ উপনিষদে বর্ণিত রয়েছে- প্রতিটি সৃষ্টির মাঝে মহান ঈশ্বর বিরাজমান, তিনি (ঈশ্বর) প্রতিটি সৃষ্টিতে এবং সর্বত্র বিরাজমান।১৭ তাই শ্রীরামকৃষ্ণের বাণী ‘যত্র জীব তত্র শিব’ বা শিব জ্ঞানে জীব সেবার মাধ্যমে ঈশ্বরের সন্তুষ্টি লাভ করা সম্ভব। সত্যদ্রষ্টা ঋষি বলেছেন: এমন কিছু নেই যা এঁর (ব্রহ্ম) দ্বারা আবৃত নয়, এমন কিছু নেই যাতে ইনি অনুপ্রবিষ্ট হননি। অন্যত্র উল্লেখ আছে, সৃষ্টি করে আবার সবকিছুর মধ্যেই তিনি (সত্তারূপে) অবস্থান করেন।১৮
আসলে মানুষের অন্তর্চক্ষু উন্মোচিত হলে সে দেখতে পাবে মহান আল্লাহর চেয়ে পরম আপনজন আর কেউ নেই। তাঁর মতো পরম বন্ধু মানবজীবনে আর কেউ হতে পারে না। তিনি বান্দার এত নিকটে বিরাজ করেন যে, তাঁর চেয়ে অধিক কাছে আর কেউ নেই এবং পৌঁছতেও পারে না। এই মহান প্রভু এতই দয়ার সাগর, বান্দা তাঁকে ভুলে গেলেও, তিনি মুহূর্তকালের জন্যও বান্দার উপর থেকে তাঁর রব (প্রভু) নামের মহিমা গুটিয়ে নেন না। কেননা তিনি অবগত রয়েছেন তিনি যদি কাউকে রিজিক না দেন, লালন-পালন না করেন তবে জগতে দ্বিতীয় এমন কেউ নেই, যে তাঁর ঐ বান্দাকে রব (পালনকর্তা) রূপে লালন-পালন করতে পারে।১৯
মহান আল্লাহ্ আসমান ও জমিনজুড়ে সকল সৃষ্টিকে বেষ্টন করে আছেন, তাঁর নুরের রূপ আছে; তিনি নিরাকার নন। তবে মহিমান্বিত আল্লাহ্ মানুষের মতো রক্ত-মাংসের দেহধারী নন, তিনি নুরের (জ্যোতির)। তিনি সর্বকালে সর্বযুগে স্বরূপে বিদ্যমান ছিলেন, আছেন ও থাকবেন। উপমাস্বরূপ বলা যায়, আলোর গতি প্রতি সেকেণ্ডে এক লক্ষ ছিয়াশি হাজার মাইল। পৃথিবীর পূর্ব প্রান্ত থেকে পশ্চিম প্রান্তের দূরত্ব এর চেয়ে কম হওয়ায়, আলো এক সেকেণ্ডেরও কম সময়ে পৃথিবীর সর্বত্র পৌঁছে যেতে পারে। তদ্রুপ যে মহান আল্লাহ্ সকল আলোর উৎস, সে নুরময় সত্তা মহাবিশ্বের সর্বত্র একইভাবে স্বরূপে বিরাজিত থেকে সকল সৃষ্টিকে বেষ্টন করে রাখেন; এতে তাঁর কোনোই বেগ পেতে হয় না। তিনি স্বরূপে বিদ্যমান থেকেই সর্বকালের সর্বস্থানে মানবজাতিকে বেষ্টন করে আছেন। আর তিনি এমনই মহাশক্তির আধার, কেবল আমাদের এ পৃথিবীই নয়, সীমাহীন মহাকাশে যে গ্রহ ও নক্ষত্র রয়েছে, তিনি সেগুলোকেও পরিবেষ্টন করে আছেন। আমাদের এ পৃথিবী যেমন মহাশূন্যে ভাসমান একটি গ্রহ তথা ভূম বা পৃথিবী, তেমনি মহাশূন্যে এমন অসংখ্য-অগণিত গ্রহ তথা ভূম বা পৃথিবী রয়েছে। আমরা যেমন মহাশূন্যের দিকে তাকালে সূর্য ও চন্দ্র ছাড়াও রাত্রিবেলা কোটি কোটি তারকাকে মহাশূন্যে জ্বলজ্বল করতে দেখতে পাই, বিজ্ঞান যখন আরো উন্নত হবে, মানুষ ঐ সকল তারকায় পৌঁছাতে পারবে, তখন পৃথিবীতে ন্যায় বাসযোগ্য আরো অনেক গ্রহের সন্ধান পাওয়া যাবে। অতঃপর সেখানে অবস্থান করে আমাদের এ পৃথিবীর দিকে তাকালে এ পৃথিবীতেও একটি তারকার ন্যায় দেখতে পাবো। আসলে কল্পনাতীত নভোমণ্ডলের অসংখ্য-অগণিত ভূমণ্ডল পৃথিবীতে রয়েছে, যে কারণে মহান আল্লাহ্ আল কুরআনে সাত আসমান ও সাত জমিন উল্লেখ করে তাঁর সৃষ্টি যে অসংখ্য-অগণিত, এটি সুস্পষ্ট করেছেন। কেননা আরব বিশ্বে সাত সংখ্যাটি অসংখ্য বুঝাতে ব্যবহার করা হতো। অতঃপর মহান আল্লাহ্ মানুষকে জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি এতই মহান ও ব্যাপক যে, তিনি সর্ববিশ্বের সকল সৃষ্টিকে বেষ্টন করে আছেন যেখানেই সৃষ্টি, সেখানেই তিনি সৃষ্টিকর্তা, জীবনদাতা, পালনকর্তা, লালনকর্তা, রিজিকদাতা ও মৃত্যুদাতা। তিনিই সকলকে অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্বে রূপ দিয়েছেন। আবার তিনিই এক একটি সৃষ্টিকে মৃত্যু নামক কিয়ামত দ্বারা অনস্তিত্বে নিয়ে নেবেন। উত্থানেও তিনি, পতনেও তিনি। আর জীবনধারণে তো তিনিই সর্বেসর্বা। সৃষ্টিকুলের অণু-পরমাণুতেও তাঁরই জ্যোতি বিদ্যমান রয়েছে। তিনিই আমাদের মহান প্রতিপালক আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিন। মানুষের দেহের অভ্যন্তরে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম জগতে যেভাবে বিরাজ করছে, তেমনি তিনি মানুষসহ সকল সৃষ্টিতে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্মভাবে বিরাজ করে চলেছেন।২০
মহান রাব্বুল আলামিন সমগ্র সৃষ্টিকুলকে পরিবেষ্টন করে রেখেছেন। তিনি ছাড়া সৃষ্টিকুলের এত আপন কেউ আর নেই। তিনি তাঁর সৃষ্টির প্রতি এতই দয়াশীল যে, মাছ যেমন পানি দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকে, একইভাবে তিনি সমগ্র সৃষ্টিকে রহমত, বরকত ও দয়া দিয়ে পরিবেষ্টন করে রেখেছেন। আসলে তিনিই তো সৃষ্টির প্রাণশক্তি, তিনি ছাড়া সকলেই মৃতবৎ অসাড়। মহান আল্লাহ্ নিজেই বলেন, “অবশ্যই তিনি তাদেরকে পরিবেষ্টন করে রেখেছেন এবং তাদেরকে গণনা করে রেখেছেন।” (সূরা মারইয়াম ১৯: আয়াত ৯৪)
উল্লিখিত বিষয়টি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিন তাঁর সৃষ্টির মাঝে বিরাজমান থেকে এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড পরিচালনা করে আসছেন। তাঁর নিয়মের কোনো ব্যতিক্রম ঘটে না। তিনি সৃষ্টিকুলের প্রতিটি অণু-পরমাণু থেকে শুরু করে বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের সর্বত্রই বিরাজমান।
[লেখক: প্রাবন্ধিক ও গবেষক]
তথ্যসূত্র :
১। হযরত সৈয়দ মাহবুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (রহ.), সূফী সম্রাটের যুগান্তকারী অবদান: আল্লাহ্ কোন্ পথে? পৃ. ৬৬, মতিঝিল, ঢাকা
২। তাফসীরে মাজহারী ১০ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৮০ ও হযরত আবদুল কাদের জিলানি (রহ.), সিররুল আসরার, পৃ. ১০
৩। ছান্দোগ্য উপনিষদ ৬. ২. ২
৪। তদৈক্ষত বহুস্যাং প্রজায়েয়েতি। ছান্দোগ্য উপনিষদ, ৬.২.৩
৫। ছান্দোগ্য উপনিষদ ৬. ২. ২
৬। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ৮/২০ (গীতায় আছে: যঃ স সর্বেষু ভূতেষু নশ্যৎসু ন বিনশাতি।)
৭। Technophilo 19:28 1 comment
৮। বায়হাকী শো‘আবুল ঈমানের সূত্রে মেশকাত শরীফ, পৃ. ৪২৫
৯। হযরত সৈয়দ মাহবুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (রহ.), তাফসীরে সূফী সম্রাট দেওয়ানবাগী ৭ম খণ্ড. পৃ. ৬০৮, মতিঝিল, ঢাকা
১০। প্রাগুক্ত, পৃ. ৬০৯
১১। প্রাগুক্ত, পৃ. ৬১৯
১২। ছান্দেগ্য উপনিষদ ৩: ১৪: ১
১৩। হযরত সৈয়দ মাহবুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (রহ.), শান্তি কোন পথে? পৃ. ১২১, মতিঝিল, ঢাকা
১৪। ছান্দেগ্য উপনিষদ ৩: ১৪: ১
১৫। ব্রহ্মসূত্র ১.১.২
১৬। গীতা ১০/২০
১৭। শ্বেতাশ্বতার উপনিষদ, ৬.১১ (“একো দেবোঃ সর্বভূতেষু গূঢ়ঃ সর্বব্যাপী সর্বভূতান্তরাত্মা।”)
১৮। তৈত্তিরীয় উপনিষদ ২.৬.৪ (তৎ সৃষ্টৃা তদেবানুপ্রাবিশৎ)
১৯। হযরত সৈয়দ মাহবুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (রহ.), তাফসীরে সূফী সম্রাট দেওয়ানবাগী ৮ম খণ্ড, তাফসীর প্রণেতার বাণী মোবারক, পৃ. ছয়, মতিঝিল, ঢাকা
২০। প্রাগুক্ত, পৃ. ৬৪২