হযরত আদম (আ.)-এর পুত্র হাবিলের কোরবানি কবুলের অলৌকিক ঘটনা
মু‘জিঝাতুল আম্বিয়া (পর্ব-০৫)
হযরতুল আল্লাম এমরান হোসাইন মাজহারী
মহান রাব্বুল আলামিন হলেন বিশ্বজাহানের সৃষ্টিকর্তা। তিনি যখন একা অবস্থান করছিলেন তখন তিনি কাউকে ভালোবাসবেন এবং কারো ভালোবাসা পাবেন এ অভিলাশে সৃষ্টিজগৎ সৃজন করেছেন। তাই মানুষ যখন তাঁকে ভালোবেসে তাঁর হুকুম-আহকাম মতো পরিচালিত হয়, তখন মহান আল্লাহ্ অত্যন্ত আনন্দিত হন। এর ফলে বান্দার প্রতি দয়াময় আল্লাহ্ তাঁর দয়া ও ভালোবাসা দান করে থাকেন। আবার বান্দা যখন নিজের রিপুর প্রভাবে অন্যায়-অপরাধ করে, তখন মহান আল্লাহ্ কষ্ট পান। ক্ষমাশীল আল্লাহ্ অপেক্ষা করতে থাকেন বান্দা তাঁর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করে কিনা, কেননা আল্লাহ্ও চান তাঁর বান্দাকে ক্ষমা করে দিতে।
হাদিসের আলোকে বলা যায় যে, পাপিবান্দা যখন তার পাপ স্বীকার করে খালেছ নিয়তে দয়াময় আল্লাহ্র নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করে, ক্ষমাশীল আল্লাহ্ তাকে ক্ষমা করে দিয়ে আনন্দ পেয়ে থাকেন। দয়াময় আল্লাহ্ বলেন- আমার বান্দা পাপ করেছে, পরক্ষণেই সে উপলব্ধি করেছে যে- তাঁর একজন সৃষ্টিকর্তা মহান মালিক রয়েছেন, যিনি তাকে শাস্তি দিতে পারেন আবার ইচ্ছা করলে তাকে ক্ষমাও করে দিতে পারেন। তাই বান্দা ক্ষমা পাওয়ার প্রত্যাশায় আমার নিকট মাফ চেয়েছে। হে ফেরেশতারা তোমরা সাক্ষী থাকো আমি আল্লাহ্ আমার এ বান্দাকে ক্ষমা করে দিলাম।
করুণাময় আল্লাহ্র বিধান মতো যদি মানুষ পরিচালিত হয়, তাহলে বিশ্বজগতে শান্তি বিরাজমান থাকে। পক্ষান্তরে স্রষ্টার বিধান বহির্ভূত হয়ে পরিচালিত হলেই আশান্তিতে বিশ্বজগত ভরে উঠে।
মহান আল্লাহ্র নিয়মের বাহিরে পরিচালিত হলে যে অশান্তি ও দাঙ্গা হাঙ্গামা সৃষ্টি হয়, তা স্পষ্ট হয়েছে সৃষ্টির শুরুতেই হযরত আদম (আ.)-এর পুত্র কাবিল ও হাবিলের ঘটনায়। হযরত আদম (আ.) তাঁর পুত্রদের সমস্যা সমাধানের জন্য আল্লাহ্র উদ্দেশ্যে কোরবানি করার জন্য নির্দেশ দিয়েছিলেন। মহান আল্লাহ্ অলৌকিকভাবে আগুন পাঠিয়ে হাবিলের কোরবানিকৃত পশুকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেন। যাতে প্রমাণিত হয় অসীম দয়ালু আল্লাহ্ হাবিলের কোরবানি কবুল করেছেন।
হাবিলের কোরবানি কবুলের অলৌকিক ঘটনা
এ প্রসঙ্গে আল্লামা ইবনে কাছীর (রহ.) প্রণীত ‘কাসাসুল আম্বিয়া’ গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে- হযরত সুদ্দী (রহ.) বর্ণনা করেন- ইবনে আব্বাস (রা.) ইবনে মাসউদ (রা.) এবং আরো কয়েকজন সাহাবা (রা.) বললেন যে, হযরত আদম (আ.) হযরত হাওয়া (আ.)-এর এক গর্ভের পুত্র সন্তানের সাথে পরবর্তী বছরের গর্ভের কন্যা সন্তানকে বিয়ে দিতেন। এ কারণে হাবিল কাবিলের সাথে জন্ম নেওয়া বোনকে বিবাহ করতে ইচ্ছা করেন। কাবিল হাবিলের চেয়ে বয়সে বড়ো ছিল। কাবিলের বোনটি অত্যন্ত সুন্দরী হওয়ায় কাবিল তার সাথে জন্ম নেওয়া সুন্দরী বোনকে নিজেই বিবাহ করতে ইচ্ছা করল। কিন্তু হযরত আদম (আ.) শরিয়ত মোতাবেক কাবিলকে বললেন যে, তোমার সাথে জন্ম নেওয়া বোনকে হাবিলের সাথে বিবাহ হতে দাও। এতে হস্তক্ষেপ করো না। কিন্তু কাবিল পিতার কথাকে অমান্য করল। তখন হযরত আদম (আ.) উভয় পুত্রকে কোরবানি করার জন্য আদেশ দিয়ে তিনি মক্কার উদ্দেশে রওয়ানা হয়ে যান। রওয়ানা দেওয়ার পূর্বে তিনি তাঁর সন্তানদের দেখাশুনার জন্য আকাশকে বললেন, আকাশ অস্বীকার করল। অবশেষে বড়ো ভাই কাবিল এ দায়িত্ব গ্রহণ করে।
হযরত আদম (আ.) চলে যাওয়ার পর তারা দুভাই আল্লাহ্র রাস্তায় কোরবানি করল। হাবিল একটি উত্তম ও দোষমুক্ত বকরি কোরবানি করেন। কারণ তিনি অনেকগুলো বকরির মালিক ছিলেন। আর কাবিল যেহেতু কৃষি কাজ করতো, তাই সে তার উৎপন্ন ফসলের একটি অংশ কোরবানি করে। এরপর আগুন এসে হাবিলের কোরবানি জ্বালিয়ে গেল (এতে প্রমাণিত হলো হাবিলের কোরবানি আল্লাহ্ কবুল করেছেন) এবং কাবিলের কোরবানি রেখে গেল। অর্থাৎ কাবিলের কোরবানি কবুল হলো না। এতে কাবিল ক্রোধান্বিত হয়ে হাবিলকে বলল, যদি তুমি আমার বোনকে বিবাহ করা থেকে বিরত না থাক, তাহলে আমি তোমাকে হত্যা করবোই। তখন হাবিল বলল, “নিশ্চয়ই আল্লাহ্ মুত্তাকিদের কোরবানিই কবুল করে থাকেন।”
হযরত আবু জাফর (রহ.) বলেছেন, হযরত আদম (আ.) উভয় পুত্রের কোরবানি (কবুল হওয়া না হওয়া) সম্পর্কে চিন্তিত ছিলেন। কাবিল হযরত আদম (আ.)-কে বলল, আপনি হাবিলের জন্য দোয়া করেছিলেন, এজন্য তার কোরবানি কবুল হয়েছে। আর আমার জন্য আপনি দোয়া করেননি। [আদম (আ.) বললেন, মূলত ব্যাপারটি এমন নয়]
এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ্ কুরআনে বলেন-
“(হে রাসুল (সা.) আপনি) তাদেরকে আদমের দুছেলের কাহিনিটি যথাযথভাবে শুনিয়ে দিন। যখন তারা দুজনে কোরবানি করল তখন একজনের কোরবানি কবুল হলো অপরজনের কোরবানি কবুল হলো না। সে বলল আমি তোমাকে মেরে ফেলবো। অপরজন বলল আল্লাহ্ তো মুত্তাকিদের কোরবানি কবুল করেন।” (সূরা আল মায়িদা ৫: আয়াত ২৭)
এ প্রসঙ্গে হযরত মাওলানা তাহের সুরাটী (ভারত) কর্তৃক লিখিত কুরআন ও হাদিসের আলোকে ‘কাসাসুল আম্বিয়া’ গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে “আদম (আ.) তাঁর দুপুত্রকে বললেন, আল্লাহ্ তায়ালার মতামত প্রতক্ষ্যভাবে যাচাই করার জন্য তোমরা দুজনেই কোরবানি করে দেখ। আল্লাহ্ তায়ালা যার কোরবানি কবুল করবেন আকলিমাকে তার নিকটে বিবাহ দেওয়া হবে। তখনকার সময় এ নিয়ম প্রচলন ছিল যে, কোনো উদ্দেশ্যে কোরবানি করে কোরবানির মাংস রেখে দেওয়া হতো। যার কোরবানি আল্লাহ্ কবুল করতেন পাহাড় অঞ্চলের দিক হতে শ্বেত বর্ণের আগুন এসে ঐ মাংস জ্বালিয়ে দিয়ে যেত। আর যার কোরবানি কবুল হতো না, আগুন ঐ মাংস জ্বালিয়ে দিতো না। বরং মাংস পড়েই থাকতো।”
মূলত সৃষ্টি তাঁর স্রষ্টার বিধানমতো পরিচালিত হওয়ার মাধ্যমেই রয়েছে ইহলৌকিক শান্তি ও পারলৌকিক মুক্তি। পরিশেষে মহান সৃষ্টিকর্তা রাব্বুল আলামিনের নিকট ফরিয়াদ, হে আল্লাহ্, আপনি আমাদেরকে আপনার সন্তুষ্টি মতো পরিচালিত হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।
[লেখক: গবেষক, আল কোরআন গবেষণা কেন্দ্র, খতিব, বাবে রহমত, দেওয়ানবাগ শরীফ; ইসলামি আলোচক, বিভিন্ন টিভি চ্যানেল এবং সমন্বয়ক, দেওয়ানবাগীর দল ওলামা মিশন বাংলাদেশ।]