হযরত আমীর হামযা (রা.)-এর ইসলাম গ্রহণ
হযরত আমীর হামযা (রা.) ছিলেন আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর আপন চাচা। তাঁর মা হালা বিনতে উহাইব ছিলেন হযরত আমিনা (আ.)-এর চাচাত বোন। তাছাড়া হামযা (রা.) ছিলেন- হযরত রাসুল (সা.)-এর দুধ ভাই। আবু লাহাবের দাসী সুওয়াইবা তাদের দু’জনকেই দুধ পান করিয়েছেন।
বয়সে তিনি হযরত রাসুল (সা.) অপেক্ষা দু’বছর মতান্তরে চার বছরের বড়ো ছিলেন। ছোটো বেলা থেকেই তরবারি চালনা, তিরন্দাজী ও কুস্তির প্রতি ছিল তাঁর প্রবল আগ্রহ। ভ্রমণ ও শিকারে ছিল তাঁর সীমাহীন নেশা। জীবনের বিরাট একটি অংশ তিনি এ কাজে ব্যয় করেন।
হযরত রাসুল (সা.) যখন মক্কায় রিসালাতের অমিয় বাণী প্রচার শুরু করেন, তখন আমীর হামযার বীরত্বের কথা মক্কা জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল। তবে আমীর হামযার ধর্মের প্রতি তেমন মনোযোগ ছিল না।
একদিনের একটি ঘটনা তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। তিনি হরিণ শিকারে বের হন। সেই দিনের শিকারের মুহূর্তগুলো অন্যান্য দিনের মতো ছিল না। বারবার শিকারের উদ্দেশে ছোড়া তিরগুলো লক্ষ্যভ্রষ্ট হচ্ছিল। একে একে তৃণীর ভিতরে থাকা তিরগুলোও ফুরিয়ে এলো। কিন্তু কোনো শিকারই তিনি পেলেন না। আমীর হামযা সর্বশেষ একটি হরিণকে লক্ষ্য করে তীব্র গতিতে ছুট চললেন। লক্ষ্য, তূণীর ভিতর থাকা সর্বশেষ তিরটি দিয়ে অন্তত এ হরিণটিকে শিকার করা। এক পর্যায়ে আমীর হামযা হরিণটির কাছাকাছি পৌঁছে গেলেন।
কিন্তু একি! তিনি যখন হরিণটির দিকে তির নিক্ষেপ করতে চলেছেন, তখনই হরিণটি থমকে দাঁড়ায় এবং মানুষের মতো করে কথা বলতে শুরু করে। এ সময় হরিণটি বলে- ‘হে আমীর হামযা! যে তিরটি দিয়ে আপনি আমাকে শিকার করতে চলেছেন, এ তিরটি রেখে দিন আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর দুশমন আবু জাহেলের জন্য। সে পাপিষ্ঠ আজ আল্লাহর রাসুল (সা.)-কে ভীষণ কষ্ট দিয়েছে।’’ হরিণের মুখে এ কথা শুনে আমীর হামযার অন্তরে ভাবান্তর দেখা দিলো। মুহূর্তেই তাঁর অন্তরে নবিপ্রেমের আগুন জ্বলে উঠে, হায়রে! আমি আপন চাচা হয়ে মোহাম্মদ (সা.)-কে চিনতে পারিনি, অথচ বনের হরিণ পর্যন্ত তাঁকে চেনে এবং তাঁকে সাহায্য করার জন্য ব্যাকুল বেকারার হয়ে আছে।
হযরত আমীর হামযা হরিণের মুখে এ কথা শুনে মুহূর্তকাল বিলম্ব করলেন না। লাগাম ধরে ঘোড়ার গতিপথ ঘুরিয়ে সোজা কাবা অভিমুখে রওনা হলেন। আজ তিনি আবু জাহেলকে সমুচিত জবাব দেওয়ার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।
সাফা পাহাড়ের কাছাকাছি আসলে আবদুল্লাহ্ ইবনে জুদআনের এক দাসী আমীর হামযাকে খবর দিলো যে, হে আবু আম্মারা! কিছুক্ষণ আগে আপনার ভাতিজাকে আবু জাহেল ভীষণ অত্যাচার করেছে। তিনি কাবার পাশে মানুষকে উপদেশ দিচ্ছিলেন। আবু জাহেল সভা পণ্ড করে দিয়েছে এবং ভীষণ আঘাত করেছে। কিন্তু মোহাম্মদ (সা.) কোনো প্রত্যুত্তর না করে নিতান্ত অসহায়ভাবে ফিরে গেলেন।
আমীর হামযা দেখলেন, হরিণের কথার সাথে দাসীর কথাও মিলে গেল। তাঁর সৈনিকসুলভ রক্ত তখন টগবগ করে উথলে উঠল। দ্রুত তিনি কাবার দিকে এগিয়ে গেলেন। তার অভ্যাস ছিল, শিকার থেকে ফেরার পথে কারো সঙ্গে সাক্ষাৎ হলে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে তার সঙ্গে দু’চারটি কথা বলা।
কিন্তু আজ তিনি প্রতিশোধ স্পৃহায় উন্মাদ হয়ে পড়লেন। রাস্তায় কারো দিকে কোনো রকম ভ্রুক্ষেপ না করে সোজা কাবার কাছে গিয়ে আবু জাহেলের মাথায় ধনুক দিয়ে সজোরে এক আঘাত বসিয়ে দিলেন। আবু জাহেল মারাত্মকভাবে জখম হয়। অবস্থা বেগতিক দেখে বনু মাখযুমের কিছু লোক আবু জাহেলের সাহায্যে ছুটে এলো। তারা বলল, “হামযা! সম্ভবত তুমি ধর্মত্যাগী হয়েছ।”
আমীর হামযা জবাব দিলেন, “মোহাম্মদের সত্যতা যখন প্রকাশ হয়ে পড়েছে, তখন তা থেকে আমাকে বিরত রাখবে কে? হ্যাঁ, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, মোহাম্মদ (সা.) আল্লাহর রাসুল। যা কিছু তিনি বলেন, সবই সত্যি। আল্লাহর কসম! আমি তা থেকে আর ফিরে আসতে পারি না। যদি তোমরা সত্যবাদী হও, আজ আমাকে একটু বাধা দিয়েই দেখ।”
আবু জাহেল তার সাহায্যে এগিয়ে আসা লোকদের বলল, “তোমরা আবু আম্মারাকে ছেড়ে দাও। আল্লাহর কসম! কিছুক্ষণ আগেই আমি তার ভাতিজাকে মারাত্মক আঘাত করেছি।”
এদিকে আমীর হামযা আবু জাহেলকে একটা দফারফা করে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটলেন, হযরত রাসুল (সা.)-এর অবস্থা দেখার জন্য। হায়রে! আবু জাহেল রাসুল (সা.)-কে কতই না অত্যাচার করেছে। বাড়িতে প্রবেশ করে আমীর হামযা উম্মুল মু’মিনিন হযরত খাদিজা (রা.)-এর কান্নার আওয়াজ শুনতে পেলেন।
এ সময় তিনি লক্ষ্য করলেন, মা খাদিজা (রা.) হযরত রাসুল (সা.)-এর সেবা করছেন, আর গভীর বেদনায় বলছেন, আফসোস! আমার স্বামীকে সাহায্য করার জগতে কেউ নেই। যদি কেউ থাকত, তবে আবু জাহেল আমার স্বামীর এ অবস্থা করতে পারতো না।
আমীর হামযা আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না। তিনিও কেঁদে দিলেন। আমীর হামযা বললেন, “হে খাদিজা! জগতে কেউ না থাকুক আমি তো আছি। অতঃপর আমীর হামযা আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন এবং কালেমা পড়ে মুসলমান হয়ে গেলেন।”
হযরত রাসুল (সা.) বললেন, “চাচাজান! আবু জাহেল আমাকে যত কষ্ট দিয়েছে, আপনি ইসলাম কবুল করায় আমি তার চেয়ে বেশি খুশি হয়েছি। আমার মনে আর কোনো দুঃখ নেই। আপনাকে পেয়ে মনের সব কষ্টই আমি ভুলে গেছি।”
এ মহাবীর ইসলাম কবুল করায় মু’মিনদের সাথে কাফিরদের অহেতুক বাড়াবাড়ি ও বেপরোয়াভাব অনেকটাই বন্ধ হয়ে যায়। কারণ তাঁর বীরত্বের কথা সকলেরই জানা ছিল। এভাবেই হযরত আমীর হামযা ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় গ্রহণ করেন।
মক্কায় অবস্থানকালে হযরত রাসুল (সা.) তাঁর প্রিয় খাদেম যায়েদ ইবনে হারেসার সাথে আমীর হামযাকে ভ্রাতৃসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে দেন। নবুয়তের ত্রয়োদশ বছরে আরো অনেকের সাথে হযরত আমীর হামযা (রা.)-ও মদীনায় হিজরত করেন।
হিজরতের মাত্র সাত মাসের মাথায় হযরত রাসুল (সা.) সিরিয়া ফেরত কাফির কুরাইশদের গতিবিধি লক্ষ্য করার জন্য মুহাজিরদের যে ক্ষুদ্র বাহিনী প্রেরণ করেন, এ বাহিনীর ঝাণ্ডা তিনি আমীর হামযা (রা.)-এর হাতেই তুলে দেন। দ্বিতীয় হিজরির ১৭ রমজান সংঘটিত ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধে আমীর হামযা (রা.) যে বীরত্ব ও সাহসিকতার পরিচয় দেন, সত্যের পথে অবিচল থাকতে চিরদিনই মুসলিম মিল্লাতকে তা সাহস জোগাবে।
দ্বীনে মোহাম্মদীর অকুতোভয় এ বীর সেনানি উহুদের যুদ্ধে শাহাদতের অমিয় সুধা পান করেন। তিনি জীবিত থাকাকালীন আল্লাহর রাসুল (সা.) যেমন তাঁকে ‘আসাদুল্লাহ্’ উপাধিতে ভূষিত করেন, তেমনি উহুদের যুদ্ধে নিহত হওয়ার পর তাঁকে ‘সাইয়্যেদুশ শুহাদা’ তথা ‘শহিদগণের সর্দার’ খেতাবে ভূষিত করেন।’’
[তাফসীরে সূফী সম্রাট দেওয়ানবাগী, ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৫০ থেকে সংকলিত]