হযরত ওয়ায়েস কারনী (রহ.)-এর দোয়ায় উম্মতে মোহাম্মদীর ক্ষমা
মহামানবগণের জীবনী থেকে
হযরত ওয়ায়েস কারনী (রহ.) একজন স্বনামধন্য বিশিষ্ট তাবেয়ি ছিলেন। তিনি ছিলেন ইয়েমেনের অধিবাসী। তিনি সর্বদা হযরত রাসুল (সা.)-এর প্রেমসাগরে ডুবে থাকতেন। রাহমাতুল্লিল আলামিন হযরত রাসুল (সা.) ফরমান- ওয়ায়েস তাবেয়িনদের মধ্যে উত্তম ব্যক্তি। তিনি আরো ফরমান, আমি ইয়েমেনের দিক থেকে আল্লাহর রহমতের সুঘ্রাণযুক্ত বাতাস অনুভব করছি। একদা আল্লাহর রাসুল (সা.) সাহাবায়ে কেরমাকে বললেন, তোমারা জেনে রাখ, আমার উম্মতের মধ্যে এক লোক আছে, যার সুপারিশে মহান রাব্বুল আলামিন কবিলায়ে রাবী ও কবিলায়ে মোজারের ছাগপালের পশম সংখ্যা তুল্য গুনাহগার লোকদের ক্ষমা করে দেবেন। সাহাবায়ে কেরাম আরজ করলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! এমন সৌভাগ্যবান লোকটি কে? হযরত রাসুল (সা.) বললেন, সে আল্লাহর এক প্রিয় বান্দা, নাম তার ওয়ায়েস কারনী। সাহাবিগণ আরজ করেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ্! তিনি কি আপনাকে দেখেছেন? আল্লাহর নবি (সা.) বললেন, না, সে আমাকে কখনও বাহ্যিক চোখে দেখেনি, তবে অন্তর চোখে দেখেছে। সাহাবায়ে কেরাম আরজ করলেন, তিনি যদি আপনার এতটাই আশেক হবেন, তাহলে তিনি আপনার খেদমতে আসেন না কেন? হযরত রাসুল (সা.) জবাব দিলেন, প্রথমত সে আল্লাহ্ ও তাঁর রাসুল (সা.)-এর মহব্বতে এমনই বিভোর হয়ে রয়েছে যে, তার কোথাও যাবার মতো অবস্থা নেই। দ্বিতীয়ত তার অতিশয় বৃদ্ধা ও অন্ধ জননী জীবিত রয়েছেন, তাকে দেখা-শোনা ও খেদমত করার সে ছাড়া আর কোনো লোক নেই। তাছাড়া, মাতার ভরণ পোষণের দায়িত্বও তাঁর কাঁধে। উট পালন করে সে নিজের ও মায়ের দৈনন্দিন জীবিকার ব্যবস্থা করে। সাহাবায়ে কেরাম আরজ করলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ্! তার সাথে কি আমাদের সাক্ষাৎ হবে? তিনি বললেন না, তোমাদের সাথে তার সাক্ষাৎ হবে না। তবে উমর (রা.) ও হযরত আলী র্কারামাল্লাহু ওয়াজহাহু-এর সাথে তার সাক্ষাৎ হবে। অতঃপর তিনি ওয়ায়েস কারনী (রহ.)-এর দুটি শারীরিক নিদর্শনের কথা প্রকাশ করেন যে, তার সর্বশরীর অপেক্ষাকৃত দীর্ঘ লোমাবৃত। আর দুই হাতের বাম দিকে একটা করে সাদা রংয়ের দাগ আছে।
এর পরের ঘটনা হলো এরূপ, আল্লাহ্র সাথে হযরত রাসুল (সা.)-এর মহামিলনকাল ঘনিয়ে এলে একদা তিনি হযরত উমর (রা.) ও হযরত আলী র্কারামাল্লাহু ওয়াজহাহুকে ডেকে বললেন, তোমরা আমার ইন্তেকালের পর আমার খেরকা (জুব্বা) ওয়ায়েস কারনীকে দিয়ে দেবে, আর তাকে আমার পক্ষ থেকে সালাম জানিয়ে বলবে, তিনি যেন আমার গুনাহগার উম্মতের জন্য দোয়া করে। অতঃপর হযরত উমর (রা.)-এর খেলাফতকালে হযরত উমর (রা.) আহলে বাইতের অন্যতম সদস্য হযরত আলী র্কারামাল্লাহু ওয়াজহাহুকে সঙ্গে নিয়ে ওয়ায়েস কারনী (রহ.)-এর সন্ধানে মদীনা থেকে কুফা হয়ে ইয়েমেনে পৌঁছেন। আল্লাহ্র রাসুল (সা.)-এর ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী হযরত উমর (রা.) ও হযরত আলী র্কারামাল্লাহু ওয়াজহাহু-এর সাথে ওয়ায়েস কারনীর সাক্ষাৎ হলো। প্রাণপ্রিয় রাসুলের প্রিয় সাহাবিদ্বয়ের সাক্ষাৎ পেয়ে ওয়ায়েস কারনী তাঁদেরকে সালাম জানালেন এবং পরম ভক্তি ও মহব্বতের সাথে উভয়ের হস্ত চুম্বন করলেন। অতঃপর হযরত উমর (রা.) আল্লাহ্র রাসুল (সা.)-এর দেওয়া খেরকা মোবারক ওয়ায়েস কারনীর হাতে তুলে দিলেন এবং হুজুরের বাণী পৌঁছে দিলেন যে, হে ওয়ায়েস কারনী! আপনি গুনাহগার উম্মতে মোহাম্মদীর ক্ষমার জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করুন। ওয়ায়েস কারনী আরজ করলেন রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর গুনাহগার উম্মতের মুক্তির দোয়ার জন্য আপনারাই অধিক যোগ্য ব্যক্তি। হযরত উমর (রা.) বললেন, আমরা তো অবশ্যই তা করছি। আপনিও আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর নির্দেশ পালন করুন। হযরত ওয়ায়েস কারনী (রহ.) তখন হযরত রাসুল (সা.)-এর খেরকাটি হাতে নিয়ে অনতিদূরে সিজদায় লুটিয়ে পড়েন। আরজ করেন, হে গাফরুর রাহিম খোদা! তোমার প্রিয় হাবিব আমাকে এই খেরকা মোবারক দান করেছেন। কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত তুমি উম্মতে মোহাম্মদীর গুনাহ ক্ষমা না করবে, ততক্ষণ আমি এই খেরকা পরিধান করব না। হযরত রাসুল (সা.) তাঁর প্রিয় সাহাবি হযরত উমর (রা.) ও হযরত আলী র্কারামাল্লাহু ওয়াজহাহু-এর প্রতি যে দায়িত্ব অর্পণ করে গিয়েছেন, তারা তা পালন করেছেন। হে দয়াময় খোদা! এখন শুধু তোমারই কাজ বাকী রয়েছে। তুমি তোমার হাবিবের উম্মতের গুনাহ মাফ করে দাও।
এ সময় এলহাম হলো, হে ওয়ায়েস! তোমার দোয়ায় কিছু সংখ্যক উম্মতে মোহাম্মদীকে ক্ষমা করা হলো। কিন্তু হযরত ওয়ায়েস (রহ.) তাতে সন্তুষ্ট হতে পারলেন না। তিনি আরজ করলেন, হে দয়াময় খোদা! যে পর্যন্ত সকল উম্মতকে মাফ করা না হবে, সেই পর্যন্ত আমি হযরত রাসুল (সা.) প্রদত্ত খেরকা মোবারক পরিধান করব না। এলহাম হলো, যাও ওয়ায়েস! তোমার প্রার্থনায় কবিলায়ে রাবী ও কবিলায়ে মোজারের ছাগপালের পশম সংখ্যা তুল্য গুনাহগার উম্মতে মোহাম্মদীকে ক্ষমা করে দিলাম।
এ সংবাদ শুনে হযরত উমর (রা.) তাকে প্রশ্ন করলেন, আচ্ছা! আপনি রাসুল (সা.)-কে কেমন মহব্বত করতেন যে, রাসুল (সা.) তাঁর খেরকা মোবারক আপনাকে দিয়ে গেলেন, অথচ আপনি তাঁর সহবত লাভ করলেন না? হযরত ওয়ায়েস (রহ.) এই প্রশ্নের জবাব না দিয়ে তাঁর কাছে একটি প্রশ্ন করলেন, আচ্ছা, আপনি তো হযরত রাসুল (সা.)-কে প্রত্যক্ষ করেছেন। উমর (রা.) বললেন, হ্যাঁ। তবে দয়া করে বলুন তো তাঁর পবিত্র ভ্রুযুগল সংযুক্ত, না পৃথক ছিল? কিন্তু কি আশ্চর্য! উমর (রা.) কোনো জবাবই দিতে পারলেন না। অতঃপর হযরত ওয়ায়েস কারনী (রহ.) আরও একটি প্রশ্ন করলেন, আচ্ছা, আপনি তো মনে হয় প্রিয় নবিজির প্রতি খুবই মহব্বত রাখতেন? যদি তা হয়, তাহলে বলুন তো আপনার মুখে এখনও দাঁতগুলো রয়েছে কীভাবে? জঙ্গে উহুদে প্রিয় নবিজির দান্দান মোবারক শহিদ হয়েছে, অথচ আপনার মুখে সকল দাঁতই তো ঠিক আছে। এই যে দেখুন, আমি তো তাঁকে চর্ম চোখে দেখিনি, কিন্তু যখন দান্দান মোবারক শহিদের কথা আমার কানে পৌঁছালো, আমি ভাবলাম, রাসুল (সা.)-এর মুখে একটি দাঁত নেই, আমার মুখে সকল দাঁত থাকবে তা কী করে হয়? আমি সাথে সাথে একটি দাঁত ভেঙ্গে ফেলি। পরক্ষণেই ভাবি হুজুর (সা.)-এর মুখের কোন দাঁতটি শহিদ হয়েছে, তা তো আমি জানি না। হয়ত সেই দাঁতটি আমার মুখে রয়ে গেছে। অতঃপর সেই সন্দেহ দূর করার জন্য একে একে সবগুলো দাঁত ভেঙ্গে ফেলেছি।
রাহমাতুল্লিল আলামিন হযরত রাসুল (সা.)-এর প্রতি ওয়ায়েস কারনীর এ নজীরবিহীন ভালোবাসার দৃষ্টান্ত দেখে হযরত উমর (রা.) ও হযরত আলী র্কারামাল্লাহু ওয়াজহাহু শিউরে উঠেন এবং মহান আল্লাহ্ ও হযরত রাসুল (সা.)-এর মহব্বতে তারাও কেঁদে ফেলেন।
এখানে বাস্তবতার আলোকে বিষয়টি সুস্পষ্ট যে, হযরত ওয়ায়েস কারনী (রহ.) ছিলেন অন্যতম শ্রেষ্ঠ আশেকে রাসুল। শুধু মাত্র হযরত রাসুল (সা.)-কে প্রাণাধিক ভালোবেসে তিনি আল্লাহ্ ও তাঁর রাসুল (সা.)-এর দরবারে সুউচ্চ মর্যাদার অধিকারী হন এবং লক্ষ লক্ষ উম্মতে মোহাম্মদীর মুক্তির ব্যবস্থা করতে সক্ষম হন।
[তাযকেরাতুল আওলিয়া-এর প্রথম খণ্ডের সূত্রে তাফসীরে সূফী সম্রাট দেওয়ানবাগী ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৯৩-২৯৫ সংকলিত]