হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর সংক্ষিপ্ত জীবনী মোবারক
তরিকুল ইসলাম তারিফ
আমাদের মাঝে বছর ঘুরে এলো ১২ই রবিউল আউয়াল ‘পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবি (সা.)। সর্বকালের সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব, কুল কায়েনাতের রহমত হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর শুভাগমনি দিবস। তিনি মহান আল্লাহ্র ইচ্ছায় ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দের আমুল ফীল (হস্তিবাহিনীর বছরে) ১২ই রবিউল আউয়াল সোমবার প্রভাতকালে শুভাগমন করেন। তাঁর শুভাগমনের দিন সকল উম্মতে মোহাম্মদীর জন্য সবচেয়ে আনন্দের দিন, খুশির দিন। এমনকি সকল সৃষ্টির জন্য রহমত লাভের দিন। তাই তাঁর শুভ জন্মদিনে বিশ্বব্যাপী আশেকে রাসুলেরা আনন্দের সাথে পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবি (সা.) পালন করেন।
আমার মহান মোর্শেদ সূফী সম্রাট হুজুর কেব্লাজান পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবি (সা.) প্রসঙ্গে বলেন, ‘সৃষ্টিকুলের শ্রেষ্ঠ ঈদ দয়াল রাসুল (সা.)-এর শুভ জন্ম ঈদ।’ হযরত রাসুল (সা.) ধরার বুকে শুভাগমন করায় আমরা প্রতিবছর পবিত্র ঈদুল ফিতর ও পবিত্র ঈদুল আজহা দুটি ঈদ উৎসব পালন করি। তিনি আগমন না করলে আমরা এই দুটি ঈদ হযরত রাসুল (সা.)-এর কাছ থেকে পেতাম না। তাই আমাদের জন্য ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার খুশির দিনের চেয়ে আরো বেশি খুশির দিন হচ্ছে দয়াল রাসুলের শুভ জন্ম ঈদ। সকল ঈদের সেরা ঈদ পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবি (সা.)।
হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর উম্মত হিসেবে সকল মুসলমানকে তাঁর জীবনী মোবারকের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলি ও সংক্ষিপ্ত জীবনী মোবারক জানা আবশ্যক। সর্বকালের সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ এ মহামানব হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর শুভ জন্ম থেকে ওফাত পর্যন্ত জীবনী মোবারকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলি পাঠকদের জ্ঞাতার্থে উপস্থাপন করছি।
হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর পিতার নাম হযরত আবদুল্লাহ্ (আ.) এবং মাতার নাম হযরত আমিনা (আ.)। তাঁর শুভ জন্মের ৬ মাস পূর্বেই পিতা হযরত আবদুল্লাহ্ (আ.) ইন্তেকাল করেন। তিনি শিশুকালে দুধ মা হযরত হালিমা (রা.)-এর গৃহে লালিত পালিত হন। তাঁর জন্মের সাত দিন পর আরবের নিয়ম অনুযায়ী দাদা হযরত আবদুল মুত্তালিব (আ.) তাঁর নাম রাখেন ‘মোহাম্মদ’ এবং তাঁর সম্মানিত মাতা হযরত আমিনা (আ.) নাম রাখেন ‘আহমদ’। এভাবেই নুর নবি (সা.) এই দুই নামেই পরিচিতি লাভ করেন। ‘মোহাম্মদ’ নামের অর্থ পরম প্রশংসিত, আর ‘আহমদ’ নামের অর্থ পরম প্রশংসাকারী।
হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর ৬ বছর বয়সে মহীয়সী মাতা হযরত আমিনা (আ.) ইন্তেকাল করেন। তাঁর মায়ের ইন্তেকালের পর দাদা হযরত আবদুল মুত্তালিব (আ.)-এর তত্ত¡াবধানে লালিত পালিত হন। দাদা হযরত আবদুল মুত্তালিব (আ.) ছিলেন আরবের মক্কা নগরীর শাসনকর্তা। তাঁর বয়স যখন ৮ বছর তখন দাদা হযরত আবদুল মুত্তালিব ইন্তেকাল করেন। দাদার ইন্তেকালের পর আপন চাচা আবু তালিব (রা.)-এর তত্ত¡াবধানে লালিতপালিত হন। তিনি ১২ বছর বয়সে ৫৮২ খ্রিষ্টাব্দে চাচা আবু তালিবের সাথে সিরিয়ায় ভ্রমণ করেন। আরবদের প্রায়ই যুদ্ধ বিগ্রহ লেগে থাকতো। খুনের বদলে খুন করা নিয়ে বিভিন্ন গোত্রের মাঝে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ চলতো বছরের পর বছর। হযরত মোহাম্মদ (সা.) যুদ্ধ বিগ্রহ বন্ধ করে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য মাত্র ১৫ বছর বয়সে ‘হিলফুল ফুজুল’ (শান্তি সংঘ) প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ২৪ বছর বয়সে হযরত খাদিজা বিনতে খুয়াইলিদ (রা.)-এর ব্যবসার অংশীদার হিসেবে সিরিয়া দ্বিতীয়বার বাণিজ্য যাত্রায় গমন করেন এবং দ্বিগুণ মুনাফা নিয়ে মক্কায় ফিরে আসেন। তিনি মক্কার সবচেয়ে ধনাঢ্য রমণী হযরত খাদিজাতুল কুবরা (রা.)-এর বিবাহের প্রস্তাব গ্রহণ করে ২৫ বছর বয়সে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। অতঃপর তিনি মহান আল্লাহ্র নৈকট্য লাভ এবং মানব মুক্তির পথের দিশা দেখানোর জন্য ধ্যান সাধনা শুরু করেন। তিনি ২৫ বছর থেকে ৪০ বছর বয়স পর্যন্ত সুদীর্ঘ ১৫ বছর যাবৎ হেরাগুহায় আল্লাহ্র প্রেমে মশগুল হয়ে মোরাকাবা করেন।
হযরত মোহাম্মদ (সা.) ৪০ বছর বয়সে লাইলাতুল কদরে মহান আল্লাহ্র পক্ষ থেকে নবুয়ত ও রেসালাত লাভ করেন। সর্বশ্রেষ্ঠ ওহির কিতাব আল কুরআন তাঁর উপর নাজিল শুরু হয় ৪০ বছরের পবিত্র রমজান মাসের শবে কদরের রাতে। তিনি নবুয়ত ও রেসালাত লাভের পর প্রথম ৩ বছর গোপনে মোহাম্মদী ইসলাম প্রচার করেন। তারপর আত্মীয়, নিকটাত্মীয় ও সমাজের লোকদেরকে মোহাম্মদী ইসলামের দাওয়াত দেন। তিনি ৪৫ বছর বয়সে মহান আল্লাহ্র পক্ষ থেকে প্রকাশ্যে ধর্ম প্রচারের জন্য ওহির হুকুম লাভ করেন। তিনি প্রকাশ্যে ব্যাপকভাবে ধর্ম প্রচার করায় মক্কাবাসী কাফির মুশরিকরা তাঁর উপর প্রতিনিয়ত অত্যাচার নির্যাতন শুরু করে। অতঃপর তারা তাঁকে ৪৭ থেকে ৪৯ বছর বয়স পর্যন্ত শীআবে আবু তালিবে অন্তরীন জীবন যাপনে বাধ্য করে। এ সময় তাঁর জীবনের ৫০ বছর বয়সে চাচা আবু তালিব (রা.) এবং উম্মুল মু’মিনিন হযরত খাদিজাতুল কুবরা (রা.) ওফাত লাভ করেন। ঐ সময়টা তাঁর জীবনে খুবই কষ্টের সাথে অতিবাহিত হয়। তাই এ সময়টাকে বলা হয় ‘আমুল হুজন’ বা দুঃখের বছর। অতঃপর তিনি ৫০ বছর বয়সে অর্থাৎ নবুয়তের ১০ম বর্ষে তায়েফে গমন করে মোহাম্মদী ইসলামের দাওয়াত দেন এবং সেখানে তায়েফের অধিবাসী কর্তৃক নির্যাতনের শিকার হন।
হযরত মোহাম্মদ (সা.) ৫২ বছর বয়সে ২৭শে রজব রাতে মসজিদে হারাম (বায়তুল্লাহ শরীফ) থেকে বাইতুল মোকাদ্দাসে গমন করেন এবং তিনি সেই রাত্রিতে মেরাজে গিয়ে মহান আল্লাহ্র দিদার লাভ করেন। মক্কাবাসীর নির্যাতনের কারণে মহান আল্লাহ্র নির্দেশে ৫৩ বছর বয়সে মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করেন। হিজরতের পর হিজরি ১ম বর্ষে মসজিদে নববি প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ৫৫ বছর বয়সে ২য় হিজরিতে মহান আল্লাহ্র হুকুমে ‘বাইতুল মুকাদ্দাস’ থেকে পুনরায় ‘বাইতুল্লাহ শরীফ’ কাবাকে কেব্লা করে নামাজ আদায় করেন।
মহান আল্লাহ্র সর্বশ্রেষ্ঠ বন্ধু ও রাসুল হযরত মোহাম্মদ (সা.) ২য় হিজরিতে ৫৫ বছর বয়সে বদর যুদ্ধে জয়লাভ করেন। তিনি ৩য় হিজরিতে ৫৬ বছর বয়সে ওহুদ যুদ্ধে মক্কার কাফির বাহিনীর মোকাবেলা করেন। তিনি ৬ষ্ঠ হিজরিতে ৫৯ বছর বয়সে হুদায়বিয়ার সন্ধি করেন এবং হুদায়বিয়া স্থানের বাবলা গাছের নিচে উপস্থিত সাহাবায়ে কেরামের বাইয়াত গ্রহণ করেন। তারপর তিনি ৮ম হিজরিতে ৬১ বছর বয়সে মক্কা বিজয় করেন। মোহাম্মদী ইসলামের প্রতিষ্ঠাতা হযরত মোহাম্মদ (সা.) ১০ হিজরিতে ৬২ বছর বয়সে ১০ম হিজরির ১৮ই জিলহজ গাদীরে খুম নামক স্থানে বাণী মোবারক প্রদান করে আমীরুল মু’মিনীন শেরে খোদা হযরত আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহুকে মু’মিনের অভিভাবক ঘোষণা করেন। তারপর তিনি ১১ হিজরির সফর মাসে কিছুদিন অসুস্থ থাকার পর ২৫শে সফর সুস্থ হয়েছেন। সেদিনটি সকল উম্মতে মোহাম্মদীর নিকট ‘আখেরি চাহার সোম্বা’ নামে ব্যাপক পরিচিত। মুসলিম উম্মাহ দিনটিকে স্মরণ করে গরিব মিসকিনদের দান সদকা করে থাকেন। অবশেষে আশেকে রাসুলদের জান, মু’মিনগণের ইমান হযরত রাসুল (সা.) ১১ হিজরির ১লা রবিউল আউয়াল সোমবার ৬৩ বছর বয়সে ওফাত লাভ করে মহান আল্লাহ্র বন্ধু আল্লাহ্র সাথে মিলিত হন।
পরিশেষে হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর ১৪৯৮তম (আরবি চান্দ বর্ষ হিসেবে) পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবি (সা.) উপলক্ষ্যে তাঁর প্রতি জানাই শতকোটি দরুদ ও সালাম। মহান আল্লাহ্র সর্বশ্রেষ্ঠ বন্ধুর পবিত্র কদম মোবারকে জানাই লাখো সালাম ও কদমবুচি।
[লেখক: গবেষক, আল কুরআন গবেষণা কেন্দ্র, দেওয়ানবাগ শরীফ]