Cancel Preloader

হযরত রাসুল (সা.) হায়াতুন নবি

মহান সংস্কারক, মোহাম্মদী ইসলামের পুনর্জীবনদানকারী, সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহবুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (রহ.) হুজুর কেবলাজান

[সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান রচিত ‘আল্লাহ্ কোন পথে? ও ‘মুক্তি কোন পথে?’ নামক কিতাব থেকে প্রবন্ধটি সংকলন করা হয়েছে।-সম্পাদক]

হায়াতুন নবি শব্দের অর্থ হচ্ছে- জীবিত নবি। মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিন এই পৃথিবীতে হযরত আদম (আ.) থেকে শুরু করে রাহমাতুল্লিল আলামিন হযরত মোহাম্মদ (সা.) পর্যন্ত অসংখ্য নবি রাসুলকে প্রেরণ করেছেন। আল্লাহ্ তায়ালা তাঁর নিজের সম্পর্কে বর্ণনা দিতে গিয়ে ফরমান “সমস্ত প্রশংসা সেই আল্লাহর, যিনি বিশ্ব জগতের প্রতিপালক।” (সূরা ফাতেহা ১: আয়াত ১) অপরদিকে হযরত রাসুল (সা.) সম্পর্কে আল্লাহ্ ফরমান- “হে রাসুল! আমি তো আপনাকে জগৎসমূহের জন্য রহমত করে প্রেরণ করেছি।” (সূরা আম্বিয়া ২১: আয়াত ১০৭)


পবিত্র কুরআনের অন্যত্র আল্লাহ্ নিজের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন- “আল্লাহ্ আসমানসমূহ ও জমিনের নুর, তাঁর নুরের উপমা যেমন- একটি তাক, যাতে একটি প্রদীপ আছে” (সূরা নূর ২৪: আয়াত ৩৫) অর্থাৎ আল্লাহর উপমা একটি জ্বালানো বাতির মতো। অপরদিকে হযরত রাসুল (সা.) প্রসঙ্গে আল্লাহ্ ফরমান- “হে নবি (সা.)! নিশ্চয়ই আমি তো আপনাকে সাক্ষীরূপে, সুসংবাদদাতারূপে ও সতর্ককারীরূপে প্রেরণ করেছি এবং আল্লাহর আদেশে তাঁর দিকে আহ্বানকারীরূপে ও প্রজ্বলিত প্রদীপরূপে।” (সূরা আহ্যাব ৩৩: আয়াত ৪৫-৪৬)


পবিত্র কুরআনের বর্ণনা মতে, যিনি সৃষ্টি জগতের রহমত স্বরূপ প্রেরিত হয়েছেন, তিনি যদি মৃত্যুবরণ করেন, তাহলে সৃষ্টিজগৎ রহমত থেকে বঞ্চিত হয়ে ধ্বংসপ্রাপ্ত হওয়ার কথা। তাছাড়া আল্লাহ্ হলেন আসমান ও জমিনের নুর। তাঁর উপমা একটি জ্বালানো বাতির মতো। আর হযরত রাসুল (সা.) হলেন সেই প্রজ্বলিত প্রদীপ। এখন প্রশ্ন হলো- আল্লাহ্ চিরস্থায়ী ও চিরঞ্জীব। তাহলে আসমান ও জমিনের প্রজ্বলিত প্রদীপস্বরূপ যাঁকে আল্লাহ্ সৃষ্টি করলেন, সেই নুরে মোহাম্মদী কি জগৎ থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাবে? যদি তা হয়, তবে বিশ্ব জাহান যে রহমত থেকে বঞ্চিত হয়ে ধ্বংস হয়ে যাওয়ার কথা। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিন হযরত রাসুল (সা.)-কে সাক্ষীদাতা বলে ঘোষণা করেছেন। অর্থাৎ হাশরের দিন তিনি সকলের সাক্ষীদাতা হবেন। কোনো ঘটনা সংঘটিত হওয়ার সময় সেখানে যে উপস্থিত থাকে না, সে সাক্ষী দিবে কীভাবে? কেননা, সাক্ষীর জন্য শর্ত হলো স্বচক্ষে দর্শন করা। তাহলে হযরত রাসুল (সা.) যদি হায়াতুন নবি না হন, তবে কীভাবে তিনি মানুষের সাক্ষীদাতা হবেন?


হযরত আদম (আ.) থেকে শুরু করে কিয়ামত পর্যন্ত এ পৃথিবীতে যত মানুষ আগমন করবেন, হযরত রাসুল (সা.) যেহেতু সকলের সাক্ষীদাতা হবেন, সুতরাং সকল ঘটনাই তাঁকে প্রত্যক্ষভাবেই দেখতে হবে। একারণে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ্ তায়ালা এরশাদ করেন- “[হে রাসুল!] আপনি কি দেখেননি, আপনার রব হস্তী বাহিনীর সাথে কী আচরণ করেছেন।” (সূরা ফীল ১০৫: আয়াত ১)
অন্যত্র এরশাদ হয়েছে- “[হে রাসুল!] আপনি কি লক্ষ্য করেননি, আপনার রব কেমন ব্যবহার করেছিলেন আদ সম্প্রদায়ের সাথে, যারা ছিল ইরাম গোত্রভুক্ত, যাদের দেহাবয়ব ছিল সুউচ্চ স্তম্ভের মতো।” (সূরা ফাজর ৮৯: আয়াত ৬ ও ৭)


অনুরূপভাবে আল্লাহ্ হযরত রাসুল (সা.)-কে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেছেন- “ফেরাউনের সম্প্রদায় এবং তাদের পূর্ববর্তীদের আচরণের ন্যায় তারাও অস্বীকার করেছিল তাদের রবের আয়াতসমূহ, ফলে আমি তাদের ধ্বংস করে দিয়েছি তাদের পাপের কারণে এবং ডুবিয়ে দিয়েছি ফেরাউনের লোকজনকে। আর তারা সবাই ছিল জালিম।” (সূরা আনফাল ৮: আয়াত ৫৪)


হযরত মোহাম্মদ (সা.) দুনিয়ায় আবির্ভূত হয়েছেন, আদ ও সামুদ জাতি এবং ফেরাউনকে ধ্বংস করে দেওয়ার হাজার হাজার বছর পরে। অথচ আল্লাহ্ তায়ালা বলেছেন- হে রাসুল! আপকি কি দেখেননি, আমি কিভাবে আদ ও সামুদ জাতি এবং ফেরাউনকে ধ্বংস করে দিয়েছি? এতে প্রমাণিত হয় যে, হযরত রাসুল (সা.) তখনও উপস্থিত ছিলেন। হাদিস শরীফে হযরত রাসুল (সা.) ফরমান- “মহিমান্বিত আল্লাহ্ সর্বপ্রথম আমার নুরকে সৃষ্টি করেছেন।” (তাফসীরে রুহুল বয়ান ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩৭০)


আমাদের আদি পিতা হযরত আদম (আ.) আল্লাহর কাছে রাসুল (সা.)-এর অসিলা ধরে প্রার্থনা করে তাঁর অপরাধের ক্ষমা পেয়েছিলেন। তাছাড়া এ পৃথিবীতে যত নবি রাসুল আগমন করেছেন, প্রত্যেকেই স্বজাতির কাছে হযরত রাসুল (সা.)-এর আগমনের সুসংবাদ দিয়েছেন।


আমরা বিশ্বাস করি যে, সকল নবির ধর্মই ছিল ইসলাম। আর সকল নবিই হলেন ‘নুরে মোহাম্মদী’র ধারক ও বাহক। এখন প্রশ্ন হলো- নুরে মোহাম্মদী যদি বিদ্যমান না থাকে তাহলে অন্যান্য নবিগণ নুরে মোহাম্মদী’র ধারক ও বাহক হবেন কীভাবে? আর সকল নবির ধর্ম ইসলাম হবে কী করে? এতে বুঝা যায় নুরে মোহাম্মদী তখনও নবিগণের মধ্যে বিদ্যমান ছিল।


বিশ্বনবি হযরত মোহাম্মদ (সা.) জগতের বুকে আগমন করবেন একথা স্বজাতির কাছে সকল নবি রাসুলই ঘোষণা দিয়েছেন। আর সত্যিই সেই নুরে মোহাম্মদী সকল নবির শেষে স্বনামে আত্মপ্রকাশ করে জগৎকে ধন্য করলেন। হযরত রাসুল (সা.)-এর আগমনের সুসংবাদ নবিগণ দিয়ে বলেছেন যে, সাইয়্যেদুল মুরছালিন হযরত মোহাম্মদ (সা.) জগতে আসবেন। অপরদিকে এই বেলায়েতের যুগে সকল অলী-আল্লাহই বলে থাকেন যে, বিশ্ব মানবতার মুক্তির অগ্রদূত হযরত রাসুল (সা.) জগতে এসেছিলেন। অথচ হযরত রাসুল (সা.) জগতের বুকে আবির্ভূত হলেন সকল নবির শেষে এবং বেলায়েত বা বন্ধুত্বের যুগের সকল অলী-আল্লাহর পূর্বে। এতে প্রমাণিত হয় যে, নুরে মোহাম্মদী অর্থাৎ হযরত মোহাম্মদ (সা.) ছিলেন- সকল নবি-রাসুল ও অলী-আল্লাহগণের শিরোমণি।

হাদিস শরীফে হযরত রাসুল (সা.) বলেন- “আমি তখনও নবি ছিলাম যখন আদম মাটি ও পানির সাথে মিশ্রিত ছিল।” এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, হযরত রাসুল (সা.) সৃষ্টির আদি থেকে অন্ত পর্যন্ত সকল যুগেই ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন। (সূত্র: সূফী সম্রাটের যুগান্তকারী অবদান: আল্লাহ্ কোন পথে?)


হযরত আদম (আ.) থেকে শুরু করে যুগে যুগে অসংখ্য নবি ও রাসুল দুনিয়ার বুকে আগমন করেছেন মানুষকে সত্য পথের সন্ধান দেওয়ার জন্য। এক নবির তিরোধানের পর মানুষ যখন হিদায়েতের আলো থেকে দুরে সরে গোমরাহির অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়েছে, তখন পরবর্তী নবির আবির্ভাবের প্রয়োজন হয়েছে পথভোলা মানুষকে পুনরায় সঠিক পথের সন্ধান দেওয়ার উদ্দেশ্যে। এভাবে সময় এবং অবস্থার পরিবর্তনের সাথে সাথে নবিগণের শিক্ষাপদ্ধতি বিভিন্ন হয়েছে। অর্থাৎ পূর্ববর্তী নবির শিক্ষাপদ্ধতি পরবর্তী নবির উম্মতের জন্য যুগোপযোগী না হওয়ায়, তা সংস্কার করে পরবর্তী নবির শিক্ষাপদ্ধতি (তরিকা) কায়েম হয়েছে।
হযরত রাসুল (সা.) ছিলেন সর্বশেষ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ নবি। কিয়ামত পর্যন্ত মুক্তিকামী মানুষের জন্য তাঁর শিক্ষাপদ্ধতি বলবৎ থাকবে। এজন্য তাঁকে হায়াতুন নবি বলা হয়। আর হায়াতুন নবির যথার্থতা বলতে গিয়ে আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেন- “আল্লাহর নবিগণ কখনো মৃত্যুবরণ করেন না। বরং তাঁরা এক ঘর থেকে অন্য ঘরে স্থানান্তরিত হন মাত্র।” (তাফসীর কাবীর ৯ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৫৯৬৭)
এমনিভাবে আল্লাহর রাসুল (সা.) হলেন সকল কালের সকল স্থানের সকল সৃষ্টির জন্য রহমত। তিনি হায়াতুন নবি বলেই কুল-কায়েনাতের সকলের জন্য রহমত।


হযরত রাসুল (সা.) হায়াতুন নবি বলেই তিনি সকল মানুষের কর্মের সাক্ষী। দুনিয়ার কোনো আদালতে এমন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয় না, যে সাক্ষী ঘটনার সময় অনুপস্থিত ছিল, কিংবা যে ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী নয়। তদ্রুপ মহান আল্লাহ্ সকল নবি ও রাসুলের ইমাম হযরত মোহাম্মদ (সা.)-কে সমগ্র মানবজাতির জন্য সুসংবাদদাতা, সতর্ককারী ও সাক্ষ্যদাতারূপে প্রেরণ করেছেন।

যুগে যুগে স্বধর্মীদের অজ্ঞতা ও বিধর্মীদের চক্রান্তের ফলে হযরত রাসুল (সা.)-এর শিক্ষাপদ্ধতির মধ্যে তাঁর আদর্শের পরিপন্থী যে সমস্ত বিষয়ের অনুপ্রবেশ ঘটবে, আল্লাহ্ তায়ালার অপার মেহেরবানিতে সংস্কারক অলী-আল্লাহগণ দুনিয়ায় আগমন করে হযরত রাসুল (সা.)-এর মূল শিক্ষা পদ্ধতি পুনর্জীবিত করবেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেন- “নিশ্চয় মহান ও মহিমান্বিত আল্লাহ্ এই উম্মতের জন্য প্রত্যেক শতাব্দীর শিরোভাগে এমন এক ব্যক্তিকে পাঠাবেন, যিনি তাঁদের ধর্মকে সংস্কার করে সজীব ও সতেজ করবেন।” (আবু দাউদ শরীফের সূত্রে মেশকাত শরীফ, পৃষ্ঠা ৩৬)


উদাহরণস্বরূপ বলা যায়- একটি জ্বালানো বাতি, অন্ধকার ঘরের অন্ধকার দূর করে ঘরকে আলোকিত করে থাকে। অতঃপর অপর একটি বাতি জ্বালানো বাতিটি নিভে যাওয়ার পূর্বেই ঐ বাতি থেকে আলো সংগ্রহ করতে পারে, তবে জ্বালানো বাতিটি নিভে গেলেও ঘরটি অন্ধকার হবে না। এভাবে একটির পর একটি বাতির দ্বারা যদি আলো জ্বালিয়ে রাখা যায়, তবে পূর্বোক্ত বাতি নিভে গেলেও মূল আলো কখনো হারিয়ে যাবে না। তদ্রুপ কুল-কায়েনাতের রহমত হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর হৃদয়ে আল্লাহ্ প্রদত্ত যে হিদায়েতের নুর প্রজ্বলিত ছিল, এ নুর নবুয়ত পরবর্তী অলী-আল্লাহ্, অর্থাৎ যুগের ইমাম, মোজাদ্দেদ ও আওলিয়ায়ে কেরামের সিনা-ব-সিনা হয়ে জগদ্বাসীকে রাসুলের আলো দ্বারা আলোকিত করে আশেকে রাসুল মু’মিন হিসেবে গড়ে তুলছে। অর্থাৎ- যখন যে, অলী-আল্লাহ্ এই নুর হৃদয়ে ধারণ করেন, রাসুলের উত্তরসূরি হিসেবে তাঁর মাধ্যমেই রাসুলের হিদায়েতের কাজ অব্যাহত থাকে। এভাবে উম্মতে মোহাম্মদীকে হিদায়েত করার কাজ চলছে এবং ভবিষ্যতেও চলবে। আর এই অলী-আল্লাহগণের মাধ্যমে হযরত রাসুল (সা.)-এর মহান আদর্শ কিয়ামত পর্যন্ত জগতে জারি থাকবে। এ প্রসঙ্গে হযরত আবু হুরায়রাহ (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেন- “আমি আদম সন্তানদের প্রত্যেক যুগের উত্তম শ্রেণিতে যুগের পর যুগ প্রেরিত হয়ে আসছি। অবশেষে ঐ যুগে জন্মগ্রহণ করেছি, যে যুগে আমি বর্তমানে আছি।” (বোখারী শরীফ ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৫০২ ও ৫০৩; তাফসীরে মাজহারী ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৩৫ ও ১৩৬; মুসনাদে আহমদ ৯ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৫ ও ১৯৬; মেশকাত শরীফ, পৃষ্ঠা ৫১১)
নবুয়ত পরবর্তী বেলায়েতের যুগে এ হাদিসের দৃষ্টান্ত উপলদ্ধি করা যায় যুগের ইমাম, মোজাদ্দেদ ও আওলিয়ায়ে কেরামের সহবত লাভ করার মধ্য দিয়ে। কেননা অলী-আল্লাহগণ ‘নুরে মোহাম্মদী’ আপন সিনায় ধারণ করেন, আর তাঁদের মাধ্যমেই হযরত রাসুল (সা.)-এর হিদায়েতের ধারা অব্যাহত আছে এবং থাকবে।


বস্তুত অলী-আল্লাহগণের মাঝে হযরত রাসুল (সা.)-এর নুর বিরাজমান। ফলে নবুয়ত পরবর্তী বেলায়েতের যুগে জামানার মোজাদ্দেদ যুগের ইমাম ও আওলিয়ায়ে কেরামের মাধ্যমে হযরত রাসুল (সা.)-এর হিদায়েতি কার্যক্রম জগতে কায়েম ও দায়েম থাকে। অর্থাৎ পরিচালিত হতে থাকে। এভাবে হযরত রাসুল (সা.) হায়াতুন নবি হয়ে জগতে বিরাজ করছেন।
[লেখক: দেওয়ানবাগ শরীফের প্রতিষ্ঠাতা]

সম্পর্কিত পোস্ট