Cancel Preloader

হাকিকতে কোরবানির বিধি বিধান


ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম

কোরবানি শব্দটি আরবি ‘কুরবুন’ শব্দ থেকে এসেছে, যার আভিধানিক অর্থ হলো নৈকট্য লাভ করা, নিকটবর্তী হওয়া, উৎসর্গ করা। মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে পবিত্র জিলহজ মাসের নির্দিষ্ট তারিখসমূহে হালাল পশু জবেহ করাকে কোরবানি বলে। অন্যভাবে বলা যায়- মানুষ যে কর্মের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করে মূলত এটাই তার জন্য কোরবানি। সুফি সাধকদের মতে- নিজের জীবাত্মার পশু প্রবৃত্তিকে পরিত্যাগ করত মহান আল্লাহর ইচ্ছার উপর আত্মসমর্পণের মাধ্যমে স্রষ্টার নৈকট্য হাসিল করাই প্রকৃত কোরবানি।


কোরবানির উৎপত্তি:
কোরবানি বাবা আদম (আ.) থেকে শুরু হয়েছে। হযরত আদম (আ.)-এর দুই পুত্র আল্লাহর নামে কোরবানি করেছিল। এক ভাইয়ের কোরবানি আল্লাহ্ কবুল করেছিলেন। অন্য ভাইয়ের কোরবানি আল্লাহর দরবারে কবুল হয়নি। এই প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনে আল্লাহ্ বলেন- “তুমি তাদের যথাযথভাবে শুনাও আদমের দুই পুত্রের বৃত্তান্ত। যখন তারা কোরবানি করেছিল তখন তাদের একজনের কোরবানি কবুল করা হয়েছিল এবং অপরজনের কবুল করা হয়নি। সে বলল: অবশ্যই আমি তোমাকে হত্যা করব। অপরজন বলল: আল্লাহ্ কেবলমাত্র মোত্তাকিদের কোরবানি কবুল করেন।” (সূরা আল মায়িদা ৫: আয়াত ২৭)
আমাদের সমাজে যে কোরবানি করা হয়, তার উৎপত্তি মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইব্রাহিম (আ.) থেকে। এটাকে সুন্নতে ইব্রাহিম বলা হয়। যা সংঘটিত হয়েছিল পবিত্র মক্কা নগরীর মিনা উপত্যকায়। প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ হাজি হযরত ইব্রাহিম (আ.)-কে অনুসরণ করে হজের পরের দিন কোরবানি করে থাকেন।


কোরবানি যাদের উপর ওয়াজিব:
পবিত্র ঈদুল আজহার দিন সুবহে সাদিকের সময় পর্যন্ত যারা নিসাব পরিমাণ উদ্বৃত্ত্ব সম্পদের মালিক, তাদের উপর কোরবানি ওয়াজিব। নিসাব হলো- সাড়ে সাত ভরি স্বর্ণ অথবা সড়ে বায়ান্ন ভরি রূপা বা তার সমপরিমাণ মূল্য।


কোরবানিতে শরিক:
১। ছাগল, ভেড়া, দুম্বা, একজনের পক্ষ থেকে আল্লাহর নামে কোরবানি করা যায়।
২। গরু, মহিষ ও উট ১ জন থেকে সর্বোচ্চ সাতজনের পক্ষ থেকে আল্লাহর নামে কোরবানি করা যায়।


পবিত্র কুরআন ও হাদিসের আলোকে কোরবানি:
কোরবানি একটি ত্যাগের মহিমা, সামর্থবান মুসলমানদের উপর কোরবানি ওয়াজিব। আল্লাহর নির্দেশে হযরত ইব্রাহিম (আ.) তাঁর সবচেয়ে প্রিয় পুত্রকে আল্লাহর নামে উৎসর্গ করে ‘খলিলুল্লাহ্’ উপাধি লাভ করেন। হযরত ইব্রাহিম (আ.)-এর ত্যাগের মহিমা মুসলিম সমাজে ছিল, আছে এবং থাকবে। মহাগ্রন্থ আল কোরআনে কোরবানি সম্পর্কে এরশাদ করেন- “আর আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্য কোরবানি বিধিবদ্ধ করে দিয়েছি, যেন তারা আল্লাহ্ তাদেরকে যে চতুস্পদ জন্তু দিয়েছেন, তা জবেহ করার সময় তার উপর আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে। আর তোমাদের উপাস্য তো একমাত্র উপাস্য আল্লাহ্। সুতরাং তোমরা তাঁরই কাছে আত্মসমর্পণ করো।” (সূরা আল হাজ্ব ২২: আয়াত ৩৪)


অন্যত্র আল্লাহ্ এরশাদ করেন- “[হে রাসুল (সা.)!] আপনি বলুন- নিশ্চয় আমার নামাজ, আমার কোরবানি, আমার জীবন ও আমার মরণ- জগতসমূহর প্রতিপালক একমাত্র আল্লাহর জন্য।” (সূরা আল‘আন আম ৬: আয়াত ১৬২)
পবিত্র কুরআনের উল্লিখিত ২টি আয়াত থেকে আমরা জানতে পারি মহান রাব্বুল আলামিন সুস্পষ্ট ঘোষণা করেছেন- আল্লাহর নামে কোরবানি করার জন্য। যেমনটি করেছিলেন হযরত ইব্রাহিম (আ.)। আল্লাহর নির্দেশ সম্পূর্ণভাবে তিনি পালন করেছেন, আমাদের সমাজে প্রচলিত নিয়মে আমরা লক্ষ্য করি, কোরবানির পশু জবেহ করার জন্য আমরা যাদের উপর নির্ভর করি, তারা এসে কোরবানি দাতাদেরকে প্রশ্ন করে কার কার নামে কোরবানি দিবেন, একটি কাগজে নাম লিখে দেন। সরলমনা মুসলমানরা মনে করে এটাই হয়তো ধর্মের বিধান। বান্দার নামে কোরবানি করা কোরআন ও হাদিস পরিপন্থি। যাকে যোগ্য মনে করে এই গুরুত্বপূর্ণ কাজটি সম্পাদন করার জন্য আমরা মনোনীত করলাম, তিনি আল্লাহর নির্দেশ সঠিকভাবে পালন করছেন না। ফলে সাধারণ মুসলমানরা হাকিকতে কোরবানি হতে বঞ্চিত হচ্ছে।


হযরত ইব্রাহিম (আ.) তিনি কি তাঁর নিজের নামে, বাবা-মায়ের নামে, দাদা-দাদির নামে কিংবা নানা-নানির নামে কোরবানি দিয়েছিলেন, নাকি আল্লাহর নামে কোরবানি করেছিলেন? নামধারী হুজুররা কখনও এটার সঠিক নিয়ম তালাস করে না, সরলমনা মুসলমানরা মনে করে এটিই ধর্মের বিধান। আল্লাহর নাম ব্যতীত আমরা যদি বান্দার নামে কোরবানি করি, তাহলে তা আল্লাহর সাথে শরিক হয়ে গেলো, যা একটা জঘন্য অপরাধ। আমরা যখন নামাজ, রোজা, হজ করি নিয়তের সময় কি কখনো কোনো বান্দার নাম উল্লেখ করি, নাকি আল্লাহর নামে নিয়ত করি? স্বধর্মীদের অজ্ঞতা আর বিধর্মীদের চক্রান্তে আজ আমরা ধর্মীয় কার্যকলাপে মূল থেকে ভুলের দিকে ধাবিত হয়ে পড়েছি। যার ফলশ্রুতিতে কোরবানি ত্যাগের মহিমা না হয়ে হয়েছে ভোগের ও প্রতিযোগিতার অনুষ্ঠান। হযরত ইব্রাহিম (আ.) থেকে প্রচলিত কোরবানি সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে অন্যত্র এরশাদ হয়েছে- “[হযরত ইব্রাহিম (আ.) বললেন] হে আমার প্রতিপালক! আমাকে একটি সুপুত্র দান করুন। অতঃপর আমি তাঁকে একটি ধৈর্যশীল পুত্রের সুসংবাদ দিলাম। তারপর সে যখন তাঁর পিতার সাথে চলাফেরা করার বয়সে উপনীত হলো, তখন ইব্রাহিম (আ.) বললেন, হে বৎস! আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, আমি তোমাকে জবেহ করছি, এখন তুমি বলো, তোমার মতামত কী? সে বলল, হে আমার আব্বাজান! আপনি যা আদিষ্ট হয়েছেন, সেটি পূর্ণ করুন। ইনশাআল্লাহ, আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত পাবেন। অতঃপর যখন তাঁরা উভয়ে আনুগত্য প্রকাশ করলেন এবং পিতা পুত্রকে কাত করে শায়িত করলেন, তখন আমি তাঁকে ডেকে বললাম, হে ইব্রাহিম! আপনি তো স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করে দেখালেন। আমি এরূপেই খাঁটি বান্দাদের প্রতিদান দিয়ে থাকি।” (সূরা আস সাফফাত ৩৭: আয়াত ১০০-১০৫)


বিশ্বনবির কোরবানি:
বিশ্বনবি হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর কথা এবং কাজকে অনুসরণ ও অনুকরণ করাই হলো একজন মুসলমানের আদর্শ। হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর কোরবানি প্রসঙ্গে হযরত জাবের (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে- তিনি বলেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) কোরবানির পশু জবেহ করার সময় বলতেন, “হে আল্লাহ্! (এই পশু) তোমার পক্ষ থেকে প্রাপ্ত এবং তোমারই উদ্দেশ্যে উৎসর্গিত। তুমি এটি কবুল করো, মোহাম্মদ (সা.)-এর পক্ষ থেকে এবং তাঁর উম্মতের পক্ষ থেকে। আল্লাহ্ তোমার নামে কোরবানি করছি এবং আল্লাহ্ই মহান। অতঃপর রাসুল (সা.) জবেহ করতেন।” (আহমদ, আবু দাউদ, ইবনে মাজাহ ও দারেমি শরীফের সূত্রে মেশকাত শরীফ, পৃষ্ঠা ১২৮)
হযরত আনাস ইবনে মালেক (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন- “একদা আল্লাহর রাসুল (সা.) ধূসর বর্ণের দু’শিং বিশিষ্ট দুটি মেষ কোরবানি করেন। আর তিনি জবেহ করার প্রাক্কালে ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার’ বলেন। আমি আল্লাহর রাসুল (সা.)-কে স্বহস্ত মোবারকে কোরবানি করতে দেখেছি, আর তখন তাঁর কদম মোবারক জন্তুটির পাঁজরের উপর রেখেছিলেন।” (সুনানে ইবনে মাজাহ, পৃষ্ঠা ২২৫, ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক অনূদিত সুনানে ইবনে মাজাহ ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৩৩, হাদিস নং ৩১২০) এ কারণে কোরবানি নিজের হাতে করা যেমন সুন্নতে রাসুল (সা.) তেমনি আল্লাহর দেওয়া জন্তু নিজের পক্ষ থেকে আল্লাহর নামে কোরবানি করা ফরজ।


মহান সংস্কারক, সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহ্বুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (রহ.) হুজুর কেবলাজান বলেন- “কোরবানি বান্দার নামে নয়, বরং বান্দার পক্ষ থেকে আল্লাহর নামে কোরবানি দিতে হয়।” তিনি আরো বলেন- “কোরবানি করার মূল উদ্দেশ্য হলো নিজের ভিতরের পশুত্ব তথা নফসের কুপ্রবৃত্তিকে বিসর্জন দেওয়া এবং আল্লাহর ইচ্ছায় বাকী জীবন যাপনে সচেষ্ট হওয়া।”
মহান রাব্বুল আলামিনের নির্দেশ মোতাবেক নবি-রাসুল, আওলিয়ায়ে কেরাম ও তাঁদের অনুসারীদের কোরবানি ও সমাজে প্রচলিত কোরবানির মধ্যে অনেক বৈষম্য লক্ষ্য করা যায়। বনের পশু নয়, মনের পশুকে কোরবানি করতে হবে। পশু কোরবানি যদি আল্লাহ্ পছন্দ করতেন, তাহলে হযরত ইব্রাহিম (আ.) আল্লাহর নির্দেশ প্রাপ্ত হয়ে ৩০০টি পশু কোরবানি করার পরও মহান আল্লাহর দরবারে তা কবুল হয়নি। যখন নিজের সবচেয়ে প্রিয় বস্তু সন্তানকে আল্লাহর নামে জবেহ করার উদ্দেশ্যে ছুরি চালিয়েছিলেন, তখন তাদের পশু প্রবৃত্তি দুম্বারূপে হাজির হয়ে কোরবানি কবুল হলো। হযরত ইব্রাহিম (আ.)-এর ন্যায় নিজের প্রিয় বস্তু আল্লাহর রাস্তায় উৎসর্গ করার মন মানসিকতা হলো হাকিকতে কোরবানি। নিজের জীবাত্মার পশু প্রবৃত্তিকে আল্লাহর রাস্তায় উৎসর্গ করে, আল্লাহর ইচ্ছার উপর সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণের মাধ্যমে সকল ইবাদত বন্দেগি করার মাধ্যমে আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ করাই হোক আমাদের কোরবানি।


আল্লাহর মনোনীত মহামানবগণের সান্নিধ্যে গিয়ে আমরা যেন তাঁদের নির্দেশ মোতাবেক আমাদের যাবতীয় কাজ-কর্ম সম্পাদন করে ইহলৌকিক ও পারলৌকিক শান্তি অর্জন করতে পারি, মহান রাব্বুল আলামিনের নিকট এই ফরিয়াদ।
[লেখক: ইসলামি গবেষক]

সম্পর্কিত পোস্ট