হাকিকতে রোজা পালনের গুরুত্ব
মহান সংস্কারক, মোহাম্মদী ইসলামের পুনর্জীবনদানকারী, সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহ্বুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (রহ.) হুজুর কেবলাজান
[সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান রচিত ‘সূফী সম্রাটের যুগান্তকারী ধর্মীয় সংস্কার ১ম খণ্ড’ এবং ‘শান্তি কোন পথে?’ থেকে প্রবন্ধটি সংকলন করা হয়েছে।-সম্পাদক]
রোজা ফারসি শব্দ, আরবি ভাষায় যাকে সাওম বলে; সিয়াম হলো এর বহুবচন। সব নবির যুগে রোজা পালনের বিধান চালু ছিল। সুফি সাধকদের মতে, মহান আল্লাহ্ স্বীয় সত্তা থেকে নফ্সকে আলাদা করে প্রশ্ন করলেন, আমি কে? আর তুমি কে? নফ্স উত্তর দিলো, তুমি-তুমি আর আমি-আমি। এ জবাব শুনে আল্লাহ্ তায়ালা অসন্তুষ্ট হয়ে নফ্সকে শায়েস্তা করার জন্যে ৭০ হাজার বছর আগুনের মধ্যে দগ্ধীভূত করে পুনরায় প্রশ্ন করলেন, আমি কে? আর তুমি কে? নফ্স এবারও জবাব দিলো, তুমি-তুমি, আমি-আমি। এতে মহান আল্লাহ্ নফ্সকে শায়েস্তা করার জন্যে ৭০ হাজার বছর বরফ চাপা দিয়ে রাখলেন। অতঃপর নফ্সকে পুনরায় প্রশ্ন করলেন, তুমি কে? আর আমি কে? এবারেও নফ্স একইভাবে উত্তর দিলো, তুমি-তুমি আর আমি-আমি। এবার আল্লাহ্ ভীষণ অসন্তুষ্ট হয়ে নফ্সকে ৭০ হাজার বছর অনাহারে রাখলেন। ফলে দীর্ঘকাল অনাহারে থেকে নফ্স দুর্বল হয়ে পড়ল। এবার আল্লাহ্ তাকে একই প্রশ্ন করলে নফ্স আল্লাহ্র বশ্যতা স্বীকার করে বিনীতভাবে জবাব দিলো, তুমি আমার প্রভু এবং আমি তোমার অনুগত দাস। যেহেতু উপবাসের ফলে নফসের স্বেচ্ছাচারিতা দূর হয়ে আল্লাহ্তে আত্মসমর্পণের অবস্থার সৃষ্টি হয়, সেহেতু নফসের এসলাহ করার জন্যে প্রত্যেক নবির উম্মতের উপর আল্লাহ্ তায়ালা রোজা ফরজ করেছেন।
ইসলামের পাঁচটি মূল স্তম্ভের মধ্যে তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে রোজা বা সিয়াম। প্রতিটি প্রাপ্তবয়স্ক নর-নারীর জন্যে রমজানের মাসব্যাপী সিয়াম পালন করাকে ফরজ করে পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ্ ঘোষণা করেন- “হে মু’মিনগণ! তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হলো, যেরূপ ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের উপর। যেন তোমরা মোত্তাকি হতে পারো।” (সূরা আল বাকারাহ ২: আয়াত ১৮৩) সুতরাং রোজা পালনের মাধ্যমে মু’মিনগণ আত্মিক বিশোধন লাভ করে পরিশুদ্ধ হতে পারেন। আত্মাশুদ্ধ না হলে কোনো ইবাদতই শুদ্ধভাবে পালন করা যায় না। কেননা, কু-রিপুমুক্ত না হতে পারলে আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আনুগত্য ও ইবাদতের জন্য প্রয়োজনীয় একনিষ্ঠতা অর্জিত হয় না। রোজা মানুষের কুরিপুসমূহকে সংযমী করে শুদ্ধভাবে ইবাদতের পথ প্রশস্ত করে দেয়। তাই হাদিস শরীফে আল্লাহ্ রাসুল (সা.) ফরমান- “প্রতিটি জিনিসের একটি দরজা আছে, আর ইবাদতের দরজা হচ্ছে সিয়াম।” কাজেই শুদ্ধভাবে রোজা পালনকারী কুরিপুসমূহকে দমন করতে সক্ষম হয় বিধায় তার চরিত্রে মানবীয় গুণাবলি বিকাশ লাভ করে। কিন্তু বড়োই পরিতাপের বিষয় বছরের পর বছর নিয়মিত রোজা পালন করা সত্ত্বেও আমাদের চরিত্রে কোনো উন্নতি লক্ষ্য করা যায় না। তাই হাকিকতে সিয়াম পালনের পদ্ধতি শিক্ষার মাধ্যমে সমাজের মানুষ রোজার প্রতিশ্রুত সুফল লাভ করতে সক্ষম হয়।
রমজান মাসে আসমানের দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হয়, জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং শয়তানকে বন্দি করা হয়। প্রকৃতপক্ষে রমজান মাসে আমাদের কুরিপুসমূহকে রোজার বিধানে বন্দি রাখা হয়। যেমন রোজাদার ব্যক্তিকে সংযম অবলম্বন করার শিক্ষা দিয়ে হযরত রাসুল (সা.) ফরমান- যদি কোনো রোজাদার ব্যক্তির সাথে কেউ ঝগড়া বিবাদ করতে চায় তাহলে সে যেন জবাব দেয়- আমি রোজা আছি, তোমার সাথে ঝগড়া বিবাদ করতে পারব না। এভাবে একজন রোজাদার ব্যক্তি দৈনন্দিন জীবনের পথে চলতে গিয়ে নফ্সের রিপুসমূহকে আল্লাহর বিধানে বন্দি রেখে সংযমী হয়ে চলার যে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে, বাকী ১১ মাস সেই মোতাবেক চলা তার জন্য সহজ হয়ে যায়। সংযমশীলতার প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্যেই রোজা আমাদের মাঝে ঘুরে ঘুরে আসে। রমজান মাসে আল্লাহ্ তায়ালা জগতের বুকে বিশেষ রহমত ও বরকতের ফায়েজ বর্ষণ করে থাকেন। ইবাদতকারীর উপর রমজানের ফায়েজের প্রতিক্রিয়া বর্ণনা করে নবিজি (সা.) এ মাসকে তিনটি অংশে বিভক্ত করে বলেছেন: “প্রথম দশ দিন রহমতের, দ্বিতীয় দশ দিন মাগফেরাতের এবং শেষ দশ দিন দোজখ থেকে মুক্তির।”
বস্তুত মহান আল্লাহর অনুগ্রহ ব্যতীত মানুষ ইবাদত করতে পারে না। রমজানের বিশেষ ফায়েজ মানুষের মধ্যে ইবাদতের স্পৃহাকে জাগ্রত করে। ফলে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সে আল্লাহর ইবাদতের দিকে ঝুঁকে পড়ে এবং তার পক্ষে আল্লাহর দয়া লাভের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। প্রথম দশদিন এভাবে অতিবাহিত করার পর তার মধ্যে আল্লাহর প্রেম সৃষ্টি হয়। এই প্রেমের প্রভাবে সে তার জীবনে কৃত অপরাধসমূহ ও আল্লাহর নাফরমানির জন্যে অনুতাপের আগুনে দগ্ধীভূত হতে থাকে; কাকুতি-মিনতি করে আল্লাহর দয়া ও ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকে; পাপ কাজের প্রতি তার অন্তরে ঘৃণার উদ্রেক হতে থাকে। রমজানের দ্বিতীয় দশদিন মানুষ ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর ক্ষমা লাভ করার সুযোগ পেয়ে থাকে। আল্লাহর দয়া হলে মানুষ তার কৃত অপরাধের জন্য মার্জনা লাভ করে থাকে। পাপ কাজের প্রতি অন্তর থেকে ঘৃণাবোধ জন্মানোর ফলে নফসের কু-রিপু তাকে সহজে আর পাপকাজে উদ্বুদ্ধ করতে পারে না। ফলে মানুষের আত্মার যে অনাবিল এক শান্তি অনুভব হতে থাকে তা আর অশান্তির আগুন দ্বারা বিঘ্নিত হয় না। এজন্যে রমজানের শেষ দশদিনের ইবাদতকে বলা হয়েছে- দোজখ থেকে মুক্তির।
মুসলমানদের অন্যান্য ইবাদত-বন্দেগির মতো রোজাকে শুদ্ধভাবে পালনের জন্যে অলী-আল্লাহ্গণের সহবত লাভ করা একান্ত প্রয়োজন। কারণ শুধুমাত্র উপবাস থাকলেই মানুষের আত্মা শুদ্ধ হয় না এবং মানুষ সংযমী হতে পারে না। এজন্যে প্রয়োজন অলী-আল্লাহ্গণের ফায়েজের শক্তি। অলী-আল্লাহর সহবতে গিয়ে মানুষ যখন রোজা পালন করবে, তখন তার আত্মার কু-রিপু বা জীব-প্রবৃত্তি দুর্বল হয়ে পড়বে এবং অলী-আল্লাহ্র তরফ থেকে আত্মায় পরিপূর্ণভাবে ফায়েজ ওয়ারেদ হতে থাকবে। ফলে রোজাদারের আত্মা পরিশুদ্ধি লাভ করবে। অন্যথায় উপবাস থাকা ছাড়া আর কোনো লাভ হবে না। যেমন, একটি পশুকে যদি সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত গাছের সাথে বেঁধে উপবাসে রাখা হয় এবং সন্ধ্যায় তাকে খাবার দেওয়া হয়, তাহলে পশুর এ উপবাসকে যেমন রোজা বলা যায় না, তেমনি শুধুমাত্র পানাহার ও কামাচার পরিত্যাগ করা একজন মানুষের রোজা পালনের উদ্দেশ্য নয়।
অপূর্ণাঙ্গ রোজা পালনের অসারতা উল্লেখ করে হাদিসে কুদসিতে মহান আল্লাহ্ ফরমান- “যার সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আমার নিষিদ্ধকৃত বিষয়সমূহ থেকে বিরত না থাকে, আমার নামে তার পানাহার ত্যাগ করার কোনো দরকার নেই।” দেহ ও আত্মার সমন্বয়ে একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ। কাজেই দেহ ও আত্মা-এ উভয়ের সাহায্যেই রোজা পালন করতে হবে। তাই এ প্রসঙ্গে হাদিস শরীফে হযরত রাসুলে পাক (সা.) ফরমান-“এমন অনেক সিয়াম পালনকারী আছে যাদের ক্ষুধার্ত ও তৃষ্ণার্ত থাকাই সার হয়েছে।”
প্রকৃতপক্ষে রোজা পালনের মাধ্যমে যারা নিজের জীব-প্রবৃত্তিকে পরিশুদ্ধ করে হৃদয়ে আল্লাহ্কে সমাসীন করতে সক্ষম হয়েছেন, তাঁরাই হাকিকতে রোজা পালনের মাধ্যমে সফলকাম হয়েছেন। এ জন্যেই উত্তম চরিত্র গঠনের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য রমজানই প্রকৃষ্ট সময়। রোজা মানুষের আমিত্বকে দূর করে আল্লাহর চরিত্রে চরিত্রবান হওয়ার শিক্ষা দেয়। রোজার মাধ্যমে আল্লাহ্কে পাওয়ার অর্থ হলো নিজের মাঝে আল্লাহর চরিত্র বিকশিত হওয়া। তাই অন্তরের পাপকালিমা বিদূরিত করে হৃদয়ের মাঝে বিরাজমান আল্লাহ্র সুপ্ত নুর বিকশিত করার লক্ষ্যে শুদ্ধভাবে রোজা পালনের জন্যে আল্লাহর মনোনীত মহামানবগণের সাহচর্য লাভ করা সকল মুক্তিকামী মানুষের অবশ্য কর্তব্য।
মাটি থেকে ইট তৈরি করার এক বিশেষ প্রক্রিয়া আছে। মাটিকে পানি মিশ্রিত করে কাদা বা লেইতে রূপান্তরিত করে ছাঁচে ঢেলে নির্দিষ্ট আকৃতি দেওয়া হয়। এ কাঁচা ইট রৌদ্রে শুকিয়ে তারপর ভাটায় এক নাগাড়ে দীর্ঘ সময় পোড়ানো হয়। ফলে আগুনের দীর্ঘ সংস্পর্শ থেকে মাটির স্বাভাবিক গুণাগুণ পরিবর্তিত হয়ে ভিন্ন এক চরিত্র অর্জন করে ফেলে। আগুনে না পোড়ানো পর্যন্ত ইটের আকৃতি পেলেও মাটির পূর্ব গুণাগুণ থেকেই যায়। সেজন্যে পানির সংস্পর্শে গেলে কাঁচা ইট গলে পুনরায় মাটির সাথে মিশে যায়। কিন্তু আগুনে পোড়ানো পাকা ইট শত চেষ্টা করলেও মাটির সাথে মিশিয়ে একাকার করা যাবে না। শুদ্ধভাবে ধর্ম পালন মানুষের চরিত্রকে একটা বিশেষ ছাঁচে ঢেলে উত্তম আকৃতি বিশিষ্ট করে ধীরে ধীরে স্থায়িত্ব ও পূর্ণতার দিকে নিয়ে যায়। পূর্ণতা লাভকারী ব্যক্তি শত প্ররোচনা, প্রলোভন, ভয়-ভীতি সত্ত্বেও নিজের চরিত্র বিসর্জন দিয়ে অন্যায়ের সাথে আপস করে না কিংবা পাপসক্ত হয়ে পড়ে না।
হযরত রাসুল (সা.) এর সাহাবিগণের মধ্যে এর অনেক উদাহরণ রয়েছে। আমাদের ধর্ম পালন পর্যালোচনা করতে দেখা যায়, আমরা বছরের পর বছর রোজা পালন করেও কাঁচা ইটের মতই থেকে যাই- ইসলামের চরিত্র আমাদের মধ্যে স্থায়িত্ব পায় না, অন্ততঃপক্ষে আমাদের চরিত্র ক্রমান্বয়ে উন্নতির কোনো লক্ষণ প্রকাশ পায় না। আমাদের চারিত্রিক সংযম কোনো রকম হয়তো রোজার মাসেই সীমাবদ্ধ থাকে- কিন্তু রমজান গত হলে আমরা পূর্বে যা ছিলাম অর্থাৎ যার মধ্যে যে দোষ-ক্রুটি বিদ্যমান ছিল, সেই চরিত্রই পুনরায় প্রকাশ পেয়ে থাকে। পাকা ইট আধুনিক নগর সভ্যতার অন্যতম মৌলিক উপাদান। এ কাজে কাঁচা ইট সম্পূর্ণরূপে ব্যবহারের অযোগ্য। ইসলাম ধর্ম মানুষের চরিত্রকে এমন একটা দৃঢ়তা ও শ্রেষ্ঠত্ব দিতে পারে যে, একজন মু’মিন ব্যক্তির সাহায্যে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সমগ্র মানব সমাজ এমনকি অন্যান্য প্রাণীও উপকৃত হতে সক্ষম হয়। মু’মিন ব্যক্তির উত্তম চরিত্রাদর্শ ও ত্যাগের ফলে সমাজের অশান্তি দূর হয়। যে পদ্ধতিতে রোজা পালন করলে মানুষ রিপু দমন করতে সক্ষম হয়, আত্মার কলুষতা দূর হয়ে শুদ্ধভাবে অন্যান্য ইবাদতসমূহ পালন করার যোগ্যতা অর্জিত হয়, পরিশুদ্ধ হৃদয়ে মহান আল্লাহর প্রেম ও নৈকট্য লাভ হয়। এই শিক্ষা পদ্ধতি আমল করে হাকিকতে সিয়াম পালনের মাধ্যমে আল্লাহর পক্ষ থেকে সুসংবাদ লাভ করত মানুষ নিজেদেরকে সৌভাগ্যবান করে তুলতে সক্ষম হয়।
পরিপূর্ণ রোজা পালনের উপায়
নিয়তের সাথে সূর্যোদয় হতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার ও কামাচার হতে বিরত থাকাকেই শরিয়তের ভাষায় রোজা বলা হয়। মহান আল্লাহ্ বলেন- “তোমরা পানাহার করো যতক্ষণ না (রাতের) কালো রেখা থেকে প্রভাতের সাদা রেখা সুস্পষ্ট দেখা যায়। তারপর রোজা পূর্ণ করো রাত পর্যন্ত।” (সূরা আল বাকারাহ ২: আয়াত ১৮৭)
প্রকৃতপক্ষে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত কেবল পানাহার ও কামাচার থেকে বিরত থাকার নাম পূর্ণাঙ্গ রোজা নয়। পূর্ণাঙ্গ রোজা দেহ ও আত্মার সম্মিলনে পালন করতে হয়। দেহের রোজা হলো- পাপাচার ও কামাচার থেকে মুক্ত হয়ে, নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অভুক্ত থাকা। আর আত্মার রোজা হলো- সব রকম পাপ চিন্তা থেকে অন্তরকে মুক্ত রেখে, সর্বাবস্থায় আল্লাহর জিকিরে নিমগ্ন থাকা। এ কারণে আল্লাহ্র রাসুল (সা.) এরশাদ করেন- “আসসিইয়ামু জুন্নাহ” অর্থাৎ- “রোজা হচ্ছে ঢাল স্বরূপ (অর্থাৎ রোজ পাপ কাজ থেকে ফিরিয়ে রাখে)।” (বোখারী শরীফ ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৫৪) দেহের পাশপাশি আত্মিক রোজা পালনের জন্য প্রয়োজন আত্মা বা দিল পরিশুদ্ধ করা। রোজা তিন শ্রেণিতে বিভক্ত। যথা-
১। সাধারণ শ্রেণির রোজা: সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত শুধুমাত্র পানাহার ও কামাচার থেকে বিরত থাকাকে সাধারণ শ্রেণির রোজা বলা হয়। এ প্রসঙ্গে হযরত আবু হুরায়রাহ (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে- তিনি বলেন, আল্লাহর নবি (সা.) এরশাদ করেন-“যে (রোজাদার) ব্যক্তি মিথ্যা বলা ও মিথ্যা কর্ম বর্জন করতে পারেনি, তার এ পানাহার পরিত্যাগ করায় আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই।” (বোখারী শরীফ ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৫৫; ই.ফা.বা. কর্তৃক অনূদিত বোখারী শরীফ ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৪২ ও ২৪৩)
২। মধ্যম শ্রেণির রোজা: পানাহার, কামাচার ও পাপাচার থেকে বিরত থাকাকে মধ্যম শ্রেণির রোজা বলা হয়। এ প্রসঙ্গে হযরত আবু হুরায়রাহ (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেন-“রমজান মাস আসলে আসমানের দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হয় এবং জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেওয়া হয়। আর শয়তানগুলোকে শৃংখলিত করে দেওয়া হয়।” (বোখারী শরীফ ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৫৫; ই.ফা.বা. কর্তৃক অনূদিত বোখারী শরীফ ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৪১)
৩। উচ্চ শ্রেণির রোজা: পানাহার, কামাচার ও পাপাচার থেকে বিরত থেকে সর্বক্ষণ আল্লাহর জিকিরে নিমগ্ন থাকাকে উচ্চ শ্রেণির রোজা বলা হয়। আর উচ্চ শ্রেণির রোজাই হলো- হাকিকতে সিয়াম বা প্রকৃত রোজা। হযরত আবু হুরায়রাহ (রা.) বর্ণিত হয়েছে- তিনি বলেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেন- “মহান আল্লাহ্ বলেন- রোজা ব্যতীত আদম সন্তানের প্রতিটি কাজই তার নিজের জন্য, কিন্তু রোজা আমার জন্য। তাই রোজার প্রতিদান আমি নিজেই দেবো। আর রোজাদারের জন্য রয়েছে দুটি আনন্দ, যা তাকে খুশি করে। ১। যখন সে ইফতার করে, সে খুশি হয় এবং ২। যখন সে তার প্রতিপালকের দিদার লাভ করে, তখন রোজার বিনিময়ে আনন্দিত হবে।” (বোখারী শরীফ ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৫৫; ই.ফা.বা. কর্তৃক অনূদিত বোখারী শরীফ ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৪৩)
তবে অন্যান্য ইবাদতের মতো রোজা শুদ্ধভাবে পালনের জন্যও মানুষকে অলী-আল্লাহর শিক্ষা নিয়ে আত্মা শুদ্ধ করতে হবে। নিজের ভেতরে আল্লাহর পরিচয় লাভ করতে হবে, তাঁর কাছে পূর্ণ আত্মসমর্পণ করত তাঁর নির্দেশে নিজেকে পরিচালিত করতে হবে।
[লেখক: দেওয়ানবাগ শরীফের প্রতিষ্ঠাতা]