Cancel Preloader

হাকিকতে হজ ও কোরবানি


মহান সংস্কারক, মোহাম্মদী ইসলামের পুনর্জীবনদানকারী, সূফী সম্রাট হযরত
সৈয়দ মাহ্বুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (রহ.) হুজুর কেবলাজান


[সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান রচিত ‘শান্তি কোন পথে?’ ও ‘মুক্তি কোন পথে?’ থেকে প্রবন্ধটি সংকলন করা হয়েছে।-সম্পাদক]

হজ শব্দটির আভিধানিক অর্থ সংকল্প করা, ইচ্ছা করা। শরিয়তের পরিভাষায় জিলহজ মাসের ৯ তারিখে কতগুলো নির্দিষ্ট কাজ সম্পাদনের উদ্দেশ্যে ইহরামের সাথে বাইতুল্লাহ অর্থাৎ পবিত্র কাবা শরীফ জিয়ারতের সংকল্প করার নামই হজ। এটি কেবলমাত্র ধনীদের উপর ফরজ করা হয়েছে। হজের পারিভাষিক সংজ্ঞা প্রসঙ্গে সংক্ষিপ্ত ইসলামী বিশ্বকোষে বলা হয়েছে- “শরিয়তের পরিভাষায় নির্দিষ্ট মাসের নির্দিষ্ট তারিখে মক্কার কাবাঘর প্রদক্ষিণ, আরাফাত ময়দানে অবস্থান, সাফা-মারওয়া পাহাড়ের মধ্যবর্তী স্থানে গমনাগমন, মিনায় অবস্থান, প্রভৃতি কতিপয় কার্য যেভাবে হযরত মোহাম্মদ (সা.) নির্ধারণ করে দিয়েছেন, সেভাবে সম্পাদন করার নাম হজ। এটি ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের পঞ্চম।” (ই.ফা.বা. কর্তৃক প্রকাশিত সংক্ষিপ্ত ইসলামী বিশ্বকোষ ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৫২৩)


বিষয়টি মহান আল্লাহ্ ওহির বাণী আল কুরআনে সুস্পষ্ট করেছেন- “নিশ্চয় সর্বপ্রথম যে ঘর মানুষের (ইবাদতের) জন্য স্থাপিত হয়েছিল, তা তো সে ঘর, যা মক্কায় অবস্থিত, যা বরকতময় এবং বিশ্বাবাসীর জন্য হিদায়েত। এতে রয়েছে অনেক প্রকাশ্য নিদর্শন, মাকামে ইব্রাহিম তার অন্যতম। যে কেউ এ ঘরে প্রবেশ করে, সে নিরাপদ হয়ে যায়। মানুষের মধ্যে তার উপর আল্লাহর জন্য এ ঘরের হজ করা ফরজ, যার সেখানে যাওয়ার সামর্থ্য আছে।” (সূরা আলে ইমরান ৩: আয়াত ৯৬-৯৭)


ধনীরা সাধারণত পার্থিব বিষয়ে অধিক নিমগ্ন থাকে। ফলে ধর্ম পালনের ব্যাপারে তারা কিছুটা উদাসীন থাকে। হজ পালনের মাধ্যমে দৈহিক, আর্থিক ও মানসিক বিভিন্ন অনুশীলন (ট্রেনিং) তাদের মনকে ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট করে থাকে। যেমন ইহরাম বাঁধার সময় সেলাইবিহীন সাদা কাপড় পরিধানের মাধ্যমে হাজিদের হৃদয়ে মৃত্যু চিন্তা আসে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেন- “মূতূ ক্বাবলা আন তামূতূ।” অর্থাৎ- মৃত্যু আসার পূর্বে তোমরা মরার বিদ্যা শিখে নাও। (সূফী দর্শন, পৃষ্ঠা ৩৯ ও ১৫৭)


এমনিভাবে কাবা শরীফ তাওয়াফ করার সময়, মন আল্লাহর প্রতি আকৃষ্ট হয়; আরাফাতের ময়দানে গিয়ে আদি পিতার গুনাহ মাফের ঘটনা স্মরণ করে, নিজের জীবনের কৃত গুনাহের জন্য মনে অনুশোচনা সৃষ্টি হয় এবং মহান আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করা হয়। এ প্রসঙ্গে হযরত জাবের (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, আরাফাত দিবসে মহান আল্লাহ্ ফেরেশতাদের বলেন- “তোমরা আমার বান্দাদের দিকে দেখো, তারা আমার নিকট আসছে এলামেলো কেশ, ধুলোবালি গায়ে, ফরিয়াদ করতে করতে বহু দূর-দূরান্ত থেকে। হে ফেরেশতাগণ! আমি তোমাদেরকে সাক্ষী রেখে বলছি- আমি তাদেরকে মাফ করে দিলাম। তখন ফেরেশতাগণ বলেন- হে আমার প্রতিপালক! অমুককে তো বড়ো গুনাহগার বলা হয়। আর অমুক পুরুষ ও অমুক স্ত্রীকেও গুনাহগার বলা হয়। হযরত রাসুল (সা.) বলেন, তখন আল্লাহ্ তায়ালা বলেন- আমি তাদেরকেও মাফ করে দিলাম। অতঃপর আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেন- আরাফাতের দিবসে এতবেশি সংখ্যক লোককে আল্লাহ্ দোজখ থেকে মুক্তি দেন, যা আর কোনো দিন দেন না।” (শরহে সুন্নাহ কিতাবের সূত্রে মেশকাত শরীফ, পৃষ্ঠা ২২৯)


মদীনায় গিয়ে হযরত রাসুল (সা.)-এর রওজা শরীফ জিয়ারতের মাধ্যমে অন্তরে হযরত রাসুল (সা.)-এর প্রেম জাগ্রত হয়। এ প্রসঙ্গে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেন- “মান হাজ্জা ফাঝারা ক্বাবরী বা‘দা মাওতী কানা কামান ঝারানী ফী হাইয়াতী।” অর্থাৎ- আমার ওফাতের পর যে ব্যক্তি হজ সম্পাদন করে আমার রওজা জিয়ারত করবে, সে যেন আমার জীবদ্দশায় আমার সাথে সাক্ষাৎ করল। (বায়হাকি শরীফ ৫ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪০৩)


হযরত উমর (রা.) বলেন, আমি আল্লাহর রাসুল (সা.)-কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেন- “মান ঝারা ক্বাবরী আও ক্বালা মান ঝারানী কুনতু লাহূ শাফী’আন আও শাহীদা।” অর্থাৎ- যে ব্যক্তি আমার রওজা জিয়ারত করবে, অথবা তিনি বলেছেন- যে ব্যক্তি আমার রওজায় এসে আমার সাথে সাক্ষাৎ করবে, আমি তার জন্য শাফায়াতকারী হবো, অথবা আমি তার জন্য সাক্ষ্যদাতা হবো। (বায়হাকি শরীফ ৫ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪০৩)


এছাড়া হজের মাধ্যমে মুসলিম জাতির আদি পিতা হযরত ইব্রাহিম খলিলুল্লাহ (আ.), তাঁর সম্মানিত সাহেবজাদা হযরত ইসমাঈল জবিহুল্লাহ (আ.) এবং হযরত বিবি হাজেরা (আ.)-সহ পূর্ববর্তী মহামানবগণের স্মৃতির কথা স্মরণ হয়ে থাকে। মোট কথা, ধনীদের উপর হজ পালনের বিধান রাখার উদ্দেশ্য হলো, তাদেরকে ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার অনুশীলন করার একটি ব্যবস্থা তৈরি করা। এমনিভাবে হজের যেমন জাহের তথা বাহ্যিক বাস্তবতা ও তাৎপর্য রয়েছে, তেমনি হজের বাতেন তথা আত্মিক বাস্তবতা ও তাৎপর্যও রয়েছে। মারেফাতের দৃষ্টিকোণ থেকে আপন ক্বালবে আল্লাহ্র দিদার লাভ করা এবং তাঁর আনুগত্য স্বীকার করার মাধ্যমে হাকিকতে হজ পালন হয়ে থাকে।


মহান আল্লাহ্ এরশাদ করেন- “ক্বুল ইন্না সালাতী ওয়া নুসুকী ওয়া মাহইয়াইয়া ওয়া মামাতী লিল্লাহী রাব্বিল ‘আলামীন।” অর্থাৎ- হে রাসুল (সা.)! আপনি বলুন- নিশ্চয় আমার নামাজ, আমার যাবতীয় ইবাদত (হজ ও কোরবানি), আমার জীবন ও আমার মরণ জগতসমূহের প্রতিপালক আল্লাহই উদ্দেশ্যে। (সূরা আল আন‘আম ৬: আয়াত ১৬২)


সুতরাং হাকিকতে হজসহ ইবাদতের মূল উদ্দেশ্যে পৌঁছার বিধান প্রত্যেকটি মানুষের জন্য অবশ্য পালনীয়। সে হিসেবে হাকিকতে হজ উপরে বর্ণিত বাহ্যিক অনুষ্ঠান পালন করার মাধ্যমে হজ করার চেয়ে আরো অধিক মাহাত্মপূর্ণ।


হাকিকতে কোরবানি
কোরবানি শব্দটি আরবি ‘ক্বুরবুন’ মূল শব্দ থেকে উৎপত্তি। সুতরাং কোরবানি শব্দটির অর্থ নিকটবর্তী হওয়া, নৈকট্য লাভ করা, উৎসর্গ করা, সান্নিধ্য লাভ করা। যেহেতু মুসলমান ব্যক্তি তার প্রিয় বস্তু আল্লাহর নামে উৎসর্গ করে প্রমাণ করে, সে সবকিছুর ঊর্ধ্বে আল্লাহ্কে বেশি ভালোবাসে এবং এরই মাধ্যমে সে আল্লাহর নিকটবর্তী হয়, এজন্য এ ইবাদতকে কোরবানি বলে।


প্রচলিত ধর্ম বিশ্বাস অনুযায়ী কোরবানি বলতে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে পবিত্র জিলহজ মাসের নির্দিষ্ট তারিখসমূহে হালাল পশু জবেহ করাকে বুঝায়। বর্তমানে আমাদের সমাজে ৫ জন, কিংবা ৭ জনের নামে গরু কোরবানি করা হয়ে থাকে। বস্তুত কোরবানি একমাত্র আল্লাহর নামেই হওয়া উচিত। এর সাথে কোনো বান্দার নাম সংযোগ করে কোরবানি করলে তা শিরক বলে গণ্য হবে। সামাজিক রীতি অনুযায়ী আমরা ৫ কিংবা ৭ জনের নাম কাগজে লিখে নিয়ে, ঐ সকল নামে কোরবানি করে থাকি। এ প্রথা এবং এ দৃষ্টিভঙ্গি ঠিক নয়। আল্লাহ্ বলেন- “হে রাসুল (সা.)! আপনি বলুন- নিশ্চয় আমার নামাজ, আমার যাবতীয় ইবাদত, আমার জীবন ও আমার মরণ- জগতসমূহের প্রতিপালক আল্লাহই জন্য।” (সূরা আল আন‘আম ৬: আয়াত ১৬২)

এমনিভাবে মহান আল্লাহ্ ওহির বাণী আল কুরআনের অন্যত্র এরশাদ করেন “আর আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্য কোরবানি বিধিবদ্ধ করে দিয়েছি, যেন তারা আল্লাহ্ তাদেরকে যে চতুষ্পদ জন্তু দিয়েছেন, তা জবেহ করার সময় তার উপর আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে। আর তোমাদের উপাস্য তো একমাত্র উপাস্য আল্লাহ্। সুতরাং তোমরা তাঁরই কাছে আত্মসমর্পণ করো।” (সূরা আল হাজ্জ ২২: আয়াত ৩৪)


প্রকৃতপক্ষে কোরবানি কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর নামে দেওয়া হারাম, অর্থাৎ কোরবানি বান্দার নামে নয়, বরং বান্দার পক্ষ থেকে আল্লাহর নামে করতে হয়। বিষয়টি মহিমান্বিত আল্লাহ্ ওহির বাণী আল কুরআনে সুস্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন। এরশাদ হচ্ছে- “ইন্নামা হাররামা ‘আলাইকুমুল মাইতাতা ওয়াদ্দামা ওয়া লাহমাল খিনঝীরি ওয়ামা উহিল্লা বিহী লিগাইরিল্লাহ।” অর্থাৎ- নিশ্চয় আল্লাহ্ তোমাদের উপর হারাম করেছেন মৃত জন্তু, রক্ত, শূকরের মাংস এবং সে পশুর মাংস, যেটির উপর জবেহের সময় আল্লাহর নাম ছাড়া অন্যের নাম উচ্চারিত হয়েছে।” (সূরা আল বাকারাহ ২: আয়াত ১৭৩)


হযরত ইব্রাহিম খলিলুল্লাহ (আ.) আল্লাহর নির্দেশে যখন পুত্র হযরত ইসমাঈল (আ.)-কে কোরবানি করেন, তখন তিনি নিজের নামে কোরবানি করেননি, বরং তিনি আল্লাহর নামে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য প্রিয় পুত্র হযরত ইসমাঈল (আ.)-কে কোরবানি করেন। মুসলমান সমাজে কোরবানির যে প্রথা বর্তমানে চালু রয়েছে, এটি মূলত হযরত ইব্রাহিম (আ.)-এর কোরবানি থেকেই এসেছে। সুমহান আল্লাহ্ কোরবানিদাতার মনের অবস্থার উপর তার এই ইবাদত কবুল করে থাকেন। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ্ ফরমান- “লাইয়্যানাল্লাহা লুহূমুহা ওয়ালা দিমাউহা ওয়ালাকিই ইয়ানালুহুত তাক্বওয়া মিনকুম।” অর্থাৎ- আর আল্লাহর কাছে পৌঁছে না এগুলোর মাংস এবং না এগুলোর রক্ত, বরং তাঁর কাছে পৌঁছে তোমাদের তাকওয়া। (সূরা আল হাজ্জ ২২: আয়াত ৩৭)


মূলত আমাদের অন্তরে আল্লাহর প্রতি কতটুকু কৃতজ্ঞতা ও ভালোবাসা রয়েছে, সেটিই পৌঁছায়। এ কারণে কোরবানি নিজের হাতে করা যেমন সুন্নতে রাসুল (সা.), তেমনি আল্লাহর দেওয়া জন্তু নিজের পক্ষ থেকে আল্লাহর নামে কোরবানি করা ফরজ। এ প্রসঙ্গে হযরত আনাস ইবনে মালেক (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন- “একদা আল্লাহর রাসুল (সা.) ধূসর বর্ণের দু’ শিংবিশিষ্ট দুটি মেষ কোরবানি করেন। আর তিনি জবেহ করার প্রাক্কালে ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার’ বলেন। আমি আল্লাহর রাসুল (সা.)-কে স্বহস্ত মোবারকে কোরবানি করতে দেখেছি, আর তখন তাঁর কদম মোবারক জন্তুটির পাঁজরের উপর রেখেছিলেন।” (সুনানে ইবনে মাজাহ, পৃষ্ঠা ২২৫, ই.ফা.বা. কর্তৃক অনূদিত সুনানে ইবনে মাজাহ ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৩৩, হাদিস নম্বর ৩১২০)


সুতরাং যে কয়জন মিলে একটি গরু বা মহিষ কোরবানি করা হয়, তাদের পক্ষ থেকে আল্লাহর নামে কোরবানি করে, কোরবানি কবুল করানোর জন্য আল্লাহর কাছে অনুনয় বিনয় করে কোরবানি দাতাদের মনে মনে বলা উচিত- কেবল আল্লাহর নামে পশু জবেহ করা হচ্ছে। গুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়টি আল্লাহর রাসুল (সা.) নিজেই উম্মতে মোহাম্মদীকে শিক্ষা দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে হযরত জাবের (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) কোরবানির পশু জবেহ করার সময় বলতেন- “আল্লাহুম্মা মিনকা ওয়া লাকা ‘আন মুহাম্মাদিও ওয়া উম্মাতিহী বিসমিল্লাহি ওয়াল্লাহু আকবার ছুম্মা যাবাহ।” অর্থাৎ- হে আল্লাহ্! (এই পশু) তোমার পক্ষ থেকে প্রাপ্ত এবং তোমারই উদ্দেশ্যে উৎসর্গিত। তুমি এটি কবুল করো, মোহাম্মদের (সা.)-এর পক্ষ থেকে এবং তাঁর উম্মতের পক্ষ থেকে। আল্লাহ্ তোমার নামে কোরবানি করছি এবং আল্লাহ্ই মহান। অতঃপর রাসুল (সা.) জবেহ করতেন। (আহমদ, আবু দাউদ, ইবনে মাজাহ ও দারেমী শরীফের সূত্রে মেশকাত শরীফ, পৃষ্ঠা ১২৮)


জেনে রাখা দরকার যে, আল্লাহর নামের সাথে নিজেদের নাম সংযুক্ত করে পশু কোরবানি করা, আর পৌত্তলিকদের দ্বারা তাদের দেবদেবীর নামে পশু বলির মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। প্রকৃত অর্থে কোরবানি হচ্ছে- মানুষের আত্মা থেকে পশু প্রবৃত্তিকে দূর করে আল্লাহর প্রেম হাসিল করা। অর্থাৎ জীবাত্মার কুরিপুসমূহ, যথা- কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসর্যকে পরিশুদ্ধ করা। অন্তরে আল্লাহর প্রেম প্রবল হয়ে চূড়ান্ত রূপ ধারণ করলে পশু প্রবৃত্তি আপনা-আপনিই দূর হয়ে যায়। তবে কোরবানির বাহ্যিক অনুষ্ঠান সাধারণ মানুষের কুরিপুকে ধ্বংস করার লক্ষ্যে মানসিকতা তৈরি করার একটা প্রশিক্ষণ।


যথার্থ কোরবানির মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ হয় বলে, এই বিধান হযরত আদম (আ.)-এর সময় থেকে পালিত হয়ে আসছে। আল্লাহ্ বলেন- “তুমি তাদের যথাযথভাবে শুনাও আদমের দুই পুত্রের বৃত্তান্ত। যখন তারা কোরবানি করেছিল, তখন তাদের একজনের কোরবানি কবুল করা হয়েছিল এবং অপরজনের কোরবানি কবুল করা হয়নি।” (সূরা আল মায়িদাহ ৫: আয়াত ২৭)
অতঃপর মুসলিম জাতির আদি পিতা হযরত ইব্রাহিম খলিলুল্লাহ (আ.)-এর সময় থেকে কোরবানির বর্তমান প্রথা চালু হয়েছে। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে- “হযরত ইব্রাহিম (আ.) বললেন- হে আমার প্রতিপালক! আমাকে একটি সুপুত্র দান করুন। অতঃপর আমি তাঁকে একটি ধৈর্যশীল পুত্রের সুসংবাদ দিলাম। তারপর সে যখন তাঁর পিতার সাথে চলাফেরা করার বয়সে উপনীত হলো, তখন ইব্রাহিম (আ.) বললেন, হে বৎস! আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, আমি তোমাকে জবেহ করছি; এখন তুমি বলো, তোমার মতামত কী? পুত্র বলল, হে আমার আব্বাজান! আপনি যা আদিষ্ট হয়েছেন, সেটি পূর্ণ করুন। ইনশাআল্লাহ্, আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত পাবেন। অতঃপর যখন তাঁরা উভয়ে আনুগত্য প্রকাশ করলেন এবং পিতা পুত্রকে কাত করে শায়িত করলেন, তখন আমি তাঁকে ডেকে বললাম, হে ইব্রাহিম! আপনি তো স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করে দেখালেন। আমি এরূপেই খাঁটি বান্দাদেরকে প্রতিদান দিয়ে থাকি।” (সূরা আস সাফফাত ৩৭: আয়াত ১০০ থেকে ১০৫) এমনিভাবে আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেন- “আমি দু’জবেহকৃত পিতার সন্তান। একজন হযরত ইসমাঈল (আ.) এবং অপরজন হলেন হযরত আবদুল্লাহ (আ.)।” (তাফসীরে কাবীর ৯ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৫৬০৮)


পবিত্র কুরআন ও হাদিসের এ অকাট্য বাণী মোবারকই মুসলিম বিশ্বের চিরায়ত ধর্মবিশ্বাস, মুসলিম জাতির আদি পিতা হযরত ইব্রাহিম খলিলুল্লাহ (আ.) স্বীয় পুত্র হযরত ইসমাঈল জাবিহুল্লাহ (আ.)-কে আল্লাহর নির্দেশে কোরবানি করেন। অতঃপর মহিমান্বিত আল্লাহ্ পিতা-পুত্রের কোরবানি কবুল করে, হযরত ইসমাঈল (আ.)-এর পরিবর্তে একটি দুম্বা জবেহ করে দেন। পবিত্র মক্কা নগরীর মিনা প্রান্তরে সংঘটিত কোরবানির এ আদর্শ অনুসরণে হজের অনুষ্ঠানে আগত লক্ষ লক্ষ হাজিদেরকে প্রতি বছর মিনা প্রান্তরেই কোরবানি করতে হয়। আর হজের অনুষ্ঠানের সাথে সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে বিশ্বজুড়ে কেবল উম্মতে মোহাম্মদী তথা মুসলমানদেরকে পশু কোরবানির এ গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত পালন করতে হয়।


কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, মুসলিম উম্মাহর এ চিরন্তন বিধিবিধানের বিরুদ্ধে ২০১০ খ্রিষ্টাব্দের ১ আগস্ট, ইসলামের শত্রুরা এক গভীর ষড়যন্ত্র করে কোরবানির সত্য ইতিহাস বিকৃত করে মুসলিম উম্মার এ চিরায়ত ইবাদতকে প্রশ্নবিদ্ধ করার অপচেষ্টায় মেতে ওঠে। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে তথাকথিত বিশ্ব শান্তি পরিষদের সভাপতি দেব নারায়ণ মহেশ্বর সত্য ইতিহাস বিকৃত করার অসৎ উদ্দেশ্যে একটি রিট পিটিশন দায়ের করে। এ রিট পিটিশনে দেব নারায়ণ মহেশ্বর দাবি করে- “হযরত ইব্রাহিম (আ.) স্বপ্ন পূরণের জন্য তাঁর পুত্র ইসমাঈল (আ.)-কে নয়, বরং ইসহাক (আ.)-কে কোরবানি করেছিলেন।” এদিকে রিট পিটিশনের পর, বিভিন্ন সূত্র ও মিডিয়ার মাধ্যমে জানা যায় যে, বাংলাদেশের বিভিন্ন ধর্মীয় সংস্থা এ বিষয়ে পবিত্র কুরআন ও হাদিস ভিত্তিক জবাব প্রদান এবং আশানুরূপ যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেনি। এ কঠিন পরিস্থিতিতে দেওয়ানবাগ শরীফের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে আমি পবিত্র কুরআন ও হাদিসের পবিত্র বাণী এবং পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্যাবলি অ্যাডভোকেট সৈয়দ মোকাদ্দাস আলীর মাধ্যমে সরবরাহ করি। অতঃপর ২০১০ খ্রিষ্টাব্দের ৫ আগষ্ট বৃহস্পতিবার, জনাকীর্ণ আদালতে মাননীয় বিচারপতি মো. আবদুল ওহাব মিঞা ও মাননীয় বিচারপতি কাজী রেজাউল হক এক ঐতিহাসিক রায়ে ‘হযরত ইব্রাহিম (আ.) তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র হযরত ইসমাঈল (আ.)-কে কোরবানি করেছিলেন’ উল্লেখ করে দেব নারায়ণের রীট পিটিশনটি খারিজ করে দেন। অধিকন্তু মিথ্যা ও ভিত্তিহীন রিট দায়ের ও মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অপরাধে, আদালত দেব নারায়ণকে সাজাও প্রদান করেন।


মহান রাব্বুল আলামিনের অপার দয়ায় আমাদের সময়োপযোগী ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও বিজ্ঞ আদালতের সুচিন্তিত রায়ে মুসলিম জাতির চিরন্তন ধর্মীয় রীতি কোরবানির বিধানটি রক্ষা পায় এবং মহান আল্লাহ্ ও হযরত রাসুল (সা.)-এর ধর্ম স্বমহিমায় বিজয়ী হয়।
[লেখক: দেওয়ানবাগ শরীফের প্রতিষ্ঠাতা]

সম্পর্কিত পোস্ট