হিদায়েতের জ্বলন্ত প্রদীপ চিরন্তন
ড. মোবারক হোসেন
বিশ্ব জাহানের মহান স্রষ্টা ও প্রতিপালক আল্লাহ্ তায়ালা মানব জাতিকে আশরাফুল মাখলুকাত হিসেবে সৃষ্টি করে তাঁর প্রতিনিধির মর্যাদা দিয়ে এ পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন। সমগ্র মাখলুকাতের মধ্যে জ্ঞান, বুদ্ধি, বিবেক, বিবেচনার দিক থেকে শ্রেষ্ঠ বলেই মানুষ আশরাফুল মাখলুকাত হিসেবে পরিগণিত। সৃষ্টির সেরা হচ্ছে মানব জাতি।
মানব জাতিকে সঠিক পথের সন্ধান দেওয়ার জন্য মহান রাব্বুল আলামিন অসংখ্য নবি-রাসুল ও অলী-আল্লাহ্কে প্রেরণ করেছেন। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ্ বলেন- “(হাশর দিবসে) পরম দয়ালু আল্লাহর কাছ থেকে যে ব্যক্তি প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করবে, সে ছাড়া কারো সুপারিশ (শাফায়াত) করার অধিকার থাকবে না।” (সূরা মারইয়াম ১৯: আয়াত ৮৭)
মহান আল্লাহর প্রতিশ্রুত মহামানব ছাড়া কেউই এ দায়িত্ব পালন করতে পারবে না। মানুষের জন্য আল্লাহ্ প্রদত্ত নেয়ামতের মধ্যে অন্যতম সেরা নেয়ামত হলো- আল্লাহর বন্ধুদের অনুসারী হওয়া। সে বিষয়টি পবিত্র কুরআনেও উল্লেখ করা হয়েছে। মহান আল্লাহ্ বলেন- “আমি যাদের সৃষ্টি করেছি, তাদের মধ্যে এমন এক দল আছে, যারা সত্য পথ দেখায় এবং সেই অনুযায়ী ন্যায় বিচার করে।” (সূরা আল আরাফ ৭: আয়াত ১৮১)
ধর্ম পালনে যুগে যুগে ধর্ম প্রচারের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তির গুরুত্ব সর্বাধিক। এ মহামানবের পরিচয় জানা, তাঁর সান্নিধ্যে যাওয়া, তাঁর আনুগত্য করা, তাঁর প্রেম হৃদয় ধারণ করা, তাঁর নির্দেশিত পথে চলা এবং তাঁর হুকুম পালন করার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা সম্ভব হয়। মহান প্রভুর কাছ থেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত মহামানবদের পথ ও মতকে পবিত্র কুরআনের ভাষায় সিরাতুল মুস্তাকিম বা সরল পথ বলা হয়। যারা মহামানবদের উপর বিশ্বাস স্থাপন করে, তাঁদের নির্দেশ মতো নিজেকে পরিচালনা করে, তারাই প্রভুর সন্ধান লাভ করে। আল্লাহর বন্ধুদের পথ ও মতে চললে আদর্শ মানুষ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়।
নবুয়তের যুগে নবি-রাসুলগণ ও বেলায়েতের যুগে হেদায়েতকারী অলী-আল্লাহ্গণ সিরাতুল মুস্তাকিমের পথ দেখান। রাহমাতুল্লিল আলামিন হযরত রাসুল (সা.)-এর ওফাতের পর প্রায় দেড় হাজার বছর গত হতে চললেও হিদায়েতের কাজ বন্ধ হয়নি। নুরে মোহাম্মদীর নুর চলমান। মহান আল্লাহ্ তাঁর অবারিত রহমত দ্বারা ‘নুরে মোহাম্মদীকে’ সৃষ্টি করেছেন। সকল সৃষ্টির মূল হচ্ছে নুরে মোহাম্মদী। গুপ্ত ধনাগার মহান আল্লাহ্ নিজেকে প্রকাশ করার মানসে এ জগত সৃষ্টির প্রক্রিয়ায় সর্বপ্রথম তাঁর নুর থেকে নুরে মোহাম্মদীকে সৃষ্টি করেন। নুরে মোহাম্মদী থেকে ক্রমান্বয়ে জগতের অন্য সব কিছু সৃষ্টি করেন।
মহান রাব্বুল আলামিন নুরে মোহাম্মদীকে হযরত আদম (আ.)-এর মাধ্যমে জগদ্বাসীর জন্য রহমতস্বরূপ দুনিয়াতে প্রেরণ করেন। আল্লাহর প্রতিনিধি হযরত আদম (আ.)-কে নুরে মোহাম্মদীর ধারক প্রথম নবির মর্যাদা লাভ করেন। তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে হযরত আদম (আ.)-এর তিরোধানের পর ‘নুরে মোহাম্মদী’ হযরত নূহ (আ.), হযরত ইব্রাহিম (আ.) প্রমুখ রাসুলগণের সিনায় আরোহণ পূর্বক জগতে হিদায়েতের ধারা অব্যাহত রেখেছেন।
তারপর ‘নুরে মোহাম্মদী’ আরবের মক্কা নগরীতে বিশ্ববাসীর ইমাম হিসেবে আপন পরিচয়ে ‘মোহাম্মদ’ নামে আবির্ভূত হন। তাই হযরত রাসুল (সা.)-কে ‘ইমামুল মুরসালিন’ বা রাসুলগণের ইমাম বলা হয়। হযরত রাসুল (সা.) বলেন- “আমি আদম সন্তানের প্রত্যেক যুগের উত্তম শ্রেণিতে যুগের পর যুগ প্রেরিত হয়েছি। শেষে এ যুগে জন্মগ্রহণ করি, যে যুগে আমি বর্তমান আছি।” (বোখারি শরীফ, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৫০৩ ) হযরত রাসুল (সা.)-এর ওফাতের পর নবুয়তের যুগের সমাপ্ত হয় এবং বেলায়েতের যুগ শুরু হয়। বেলায়েতের যুগের ইমাম শেরে খোদা হযরত আলী র্কারামাল্লাহু ওয়াজহাহু নুরে মোহাম্মদীর নুর ধারণকারী মহামানব। হযরত রাসুল (সা.)-এর ওফাতের পর হযরত আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহু ছিলেন মোহাম্মদী ইসলামের ইমাম এবং আমিরুল মু’মিনিন। নুরে মোহাম্মদীর ধারণকারী মহামানবগণ হয়েছেন নবুয়াতের যুগে নবি-রাসুল ও বেলায়েতের যুগে হিদায়েতকারী মোর্শেদ বা পথপ্রদর্শক। হযরত রাসুল (সা.)-এর ওফাতের প্রায় সাড়ে ১৪ শত বছর পর বাংলার জমিনে হেদায়েতের মহাভাণ্ডার নিয়ে আগমন করেছিলেন মহান সংস্কারক, মোহাম্মদী ইসলামের পুনর্জীবনদানকারী, যুগের ইমাম, সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহ্বুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (রহ.) হুজুর কেবলাজান।
হিদায়েতের চিরন্তন ধারাবাহিকতায় এ যুগের মানুষের শান্তি ও মুক্তির দিশারি হিসেবে হযরত রাসুল (সা.)-এর সুমহান আদর্শ ও শিক্ষা তথা মোহাম্মদী ইসলাম জগদ্বাসীর কাছে তুলে ধরে ছিলেন এ মহামানব।
মহান আল্লাহ্ নুরে মোহাম্মদীর ধারক বাহক করে জগতের মানুষকে আলোর পথ দেখানোর জন্য যে সকল মহামানব প্রেরণ করেন, তাঁরা মায়ের কোলে জন্ম নিয়ে রক্ত মাংসের দেহ ধারণ করেই জগতে আগমন করেন। এক সময় স্থূল দেহ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। আলোদানকারী মহামানবগণের পবিত্র দেহ বিদ্যুতের বাল্বের মতো। বাল্বের সাহায্য ছাড়া যেমন বিদ্যুতের আলো পাওয়া যায় না। তেমনি স্থূল দেহধারী মহামানব ছাড়া জগতের মানুষের কাছে হিদায়েতের আলো পৌঁছানো সম্ভব হয় না। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কোনো আলোকৃত বাল্ব যদি নষ্ট হয়ে যায় বা মেয়াদ ফুঁরিয়ে যায়, তাহলে অন্য একটি বাল্বকে বিদ্যুতের সাথে সংযোগ দিয়ে আমরা পুনরায় আলো পেয়ে থাকি। বিদ্যুতের আলো পাওয়ার জন্য শর্ত হচ্ছে, একটি ভালো বাল্বের সাথে বিদ্যুত প্রবাহের সংযোগ দেওয়া। নুরে মোহাম্মদীর নুর ঠিক তেমনি এক দেহধারী মহামানব পর্দা করার প্রাক্কালে অন্য মহামানবের হৃদয় প্রজ্বলিত করে, জগতের মানুষকে সত্যের আলো দান করেন।
আল্লাহর রহমত ও বরকত নুরে মোহাম্মদীর অসিলায় তাঁর ধারক ও বাহকের মাধ্যমে সৃষ্টিজগতের উপর বর্ষিত হয় বলেই নূরে মোহাম্মদীকে রাহমাতুল্লিল আলামিন হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে । স্থান কাল বা পাত্র ভেদে জগতের কোথাও না কোথাও এ ঐশী আলো চিরভাস্বর হয়ে জেগে থাকে। জগতের প্রত্যেক জনগোষ্ঠীর কাছে সতর্ককারী হিসেবে মহামানব প্রেরণের প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেছেন মহান রাব্বুল আলামিন। স্বর্গীয় নুর বা রহমতে কামেলা সর্ম্পকে পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে- “হে রাসুল! আমি তো আপনাকে বিশ্বজগতের প্রতি কেবল রহমতস্বরূপই প্রেরণ করেছি।” (সূরা আম্বিয়া ২১: আয়াত ১০৭)
মূলত যিনি নুরে মোহাম্মদীর ধারক ও বাহক, তিনিই সমকালীন যুগের ইমাম। হিদায়েতের চিরন্তন ধারাবাহিকতায় আমাদের মহান মোর্শেদ, মহান সংস্কারক, মোহাম্মদী ইসলামের পুনর্জীবনদানকারী সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহ্বুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (রহ.) হুজুর কেবলাজান তাঁর সর্বশেষ অছিয়তনামায় পরবর্তী মোহাম্মদী ইসলাম পরিচালনার নেতৃত্ব দানকারী ইমাম হিসাবে তাঁর প্রাণপ্রিয় মেজো সাহেবজাদা ইমাম ড. আসরাম কুদরত এ খোদা (মা. আ.) হুজুরকে এ মহান দায়িত্ব অর্পণ করেছেন। হিদায়াতের দায়িত্ব যখনই স্থানান্তরিত হয়েছে, পূর্ববর্তী অলী-আল্লাহর অনুসারীদের পরবর্তী দায়িত্বপ্রাপ্ত অলী-আল্লাহ্কে বা ইমামকে মেনে নিয়েই হিদায়েতের পথে অবিচল থাকতে হয়। পক্ষান্তরে দায়িত্বপ্রাপ্ত ইমামকে অবজ্ঞা করার ফলে অনেকে গোমরাহীতে নিমজ্জিত হয়েছে।
কোনো সরকারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক মৃত্যুবরণ করলে অন্য একজন ব্যক্তি প্রধান শিক্ষকের দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে স্কুল পরিচালনা অব্যাহত রাখেন। প্রাক্তন প্রধান শিক্ষকের একনিষ্ঠ ভক্ত হওয়ার কারণে নবাগত শিক্ষককে মেনে না নেয় কিংবা তাঁর সাথে অসৌজন্যমূলক আচরণ করে বসে, তাহলে উক্ত স্কুল থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষা পাশের আশা তারা করতে পারে কি? প্রধান শিক্ষকের স্বাক্ষর এবং সুপারিশ ছাড়া কোনো মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীর ফরম বোর্ড কর্তৃক গৃহীত হবে না এবং সে ছাত্র পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতেও পারবে না।
হিদায়েতকারী অলী-আল্লাহ্গণ খোদায়ী সরকারের মনোনীত শিক্ষক স্বরূপ। তিনি নিজে ব্যক্তি কেন্দ্রিক এক স্বয়ংসম্পূর্ণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। তাই আল্লাহর নির্দেশে তিনি যেখানেই অবস্থান করেন না কেন, সেখানেই তাঁর ধর্ম প্রচারের কাজ অব্যাহত রাখা সম্ভব হয়। আল্লাহর ধর্ম প্রচারে নিজেকে উৎসর্গকৃত এরূপ মহামানবগণের কল্যাণে ‘নুরে মোহাম্মদীর’ প্রজ্বলিত প্রদীপের আলো থেকে জগতের মানুষ কখনও বঞ্চিত থাকে না। স্থান, কাল বা পাত্র ভেদে জগতের কোথাও না কোথাও ঐশী আলো চিরভাস্বর হয়ে জেগে থাকে।
যুগের ইমাম হচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের মতো। তিনি যখন দায়িত্ব হস্তান্তর করেন, তখন আর একজন উপাচার্যের কাছেই তা অর্পণ করেন। মহান আল্লাহ্ ও হযরত রাসুল (সা.)-এর পক্ষ থেকে একজন মহামানব ইমাম হিসাবে নিযুক্ত হয়ে দায়িত্ব গ্রহণ করে প্রাক্তন ইমামকে অব্যাহতি দেন। প্রাক্তন ইমামের জীবদ্দশায়ই এই দায়িত্ব হস্তান্তর হয়ে থাকে।
জাহেরিতে এবং ওফাতের প্রায় আড়াই মাস পূর্বে রুহানিতে ইমাম সৈয়দ আবুল ফজল সুলতান আহমদ (রহ.) তাঁর সকল দায়িত্ব আমাদের মহান মোর্শেদ, মহান সংস্কারক, মোহাম্মদী ইসলামের পুনর্জীবনদানকারী সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহ্বুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (রহ.) হুজুর কেবলাজানকে অর্পণ করেছেন। হাদিস শরীফে বর্ণিত হয়েছে হযরত রাসুল (সা.) ফরমান- “নিশ্চয় মহান ও মহিমান্বিত আল্লাহ্ এই উম্মতের জন্য প্রত্যেক শতাব্দীর শিরোভাগে এমন এক ব্যক্তিকে পাঠাবেন, যিনি তাদের ধর্মকে সংস্কার করে সজীব ও সতেজ করবেন।” (আবু দাউদ শরীফের সূত্রে মেশকাত শরীফ, পৃষ্ঠা ৩৬)
বিদায় হজের ভাষণ শেষে রাহমাতুল্লিল আলামিন হযরত রাসুল (সা.)-কে মহান রাব্বুল আলামিন বলেন- “হে রাসুল! আপনি পৌঁছে দিন যা আপনার প্রতি আপনার রবের তরফ থেকে নাজিল করা হয়েছে তা, আর যদি তা না করেন তবে তো তাঁর পয়গাম পৌঁছালেন না। আল্লাহ্ আপনাকে মানুষের থেকে রক্ষা করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ্ কাফের কওমকে হিদায়েত দান করেন না।” (সূরা আল মায়িদা ৫: আয়াত ৬৭)
হযরত রাসুল (সা.) ফরমান- “যে ব্যক্তি যুগের ইমামের আনুগত্য না করে মৃত্যুবরণ করেছে, সে জাহেলি যুগের অবস্থায় (তথা ধর্মহীন বেঈমান হয়ে) মৃত্যুবরণ করেছে।” (মুসনাদে আহমদ ১৩নং খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৮৮)
নুরে মোহাম্মদীর ধারক বাহক, প্রজ¦লিত প্রদীপ এবং শান্তির দূত হিসেবে তাঁর বন্ধু মহামানবগণকে পাঠিয়ে থাকেন। তাঁরা জগতে তশরীফ নিয়ে মানুষকে সত্যের আলো দেখানোর জন্য হাসি মুখে জীবন উৎসর্গ করেন।
মহান রাব্বুল আলামিনের পবিত্র কদম মোবারকে দয়া ভিক্ষা চাই, আমরা তাঁর প্রিয় বন্ধু মহান সংস্কারক, মোহাম্মদী ইসলামের পুনর্জীবনদানকারী সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহ্বুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (রহ.) হুজুর কেবলাজানের দেওয়া সর্বশেষ অছিয়তনামা অনুযায়ী সবাই যেন পরিচালিত হতে পারি এবং বর্তমান যুগের ইমামকে চিনে তার আনুগত্য মেনে চলতে পারি। মহান রাব্বুল আলমিনের কাছে আরও দয়া ভিক্ষা চাই, আমরা মুক্তিকামী মানুষেরা যেন বর্তমান যুগের ইমামের নেতৃত্ব মেনে নিজের অপবিত্র আত্মাকে পবিত্র করে এ পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে পারি। আমিন।
[লেখক: ইসলামি গবেষক]