Cancel Preloader

হেরা গুহার শিক্ষা ও গুরুত্ব


ড. পিয়ার মোহাম্মদ

মক্কা শরীফ থেকে ৬ কিলোমিটার উত্তর-পূর্ব দিকে অবস্থিত একটি পাহাড়ের নাম জাবালে নুর। এ পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত একটি গুহাকে বলা হয় হেরা গুহা। নবুয়ত লাভের পূর্বে হযরত রাসুল (সা.) এ গুহায় গভীর ইবাদতে মগ্ন থাকতেন। এখানেই তাঁর উপর সর্বপ্রথম অহি নাজিল হয়েছিল। সেজন্য হেরা গুহা ইসলামের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানের নাম। এখন প্রশ্ন হলো হযরত রাসুল (সা.) কী করতেন হেরা গুহায়? যেখান থেকে এসে তিনি কেনইবা প্রচার করলেন শান্তির ধর্ম মোহাম্মদী ইসলাম। কী ছিল সেই শিক্ষা, যা গ্রহণ করে তিনি মহান আল্লাহ্কে পেয়ে এবং তাঁর বাণী মোবারক লাভ করে তাঁর ধর্ম প্রচারের দায়িত্ব প্রাপ্ত হয়েছিলেন? কেনইবা এ শিক্ষা এতো গুরুত্বপূর্ণ?

হযরত রাসুল (সা.) মুলত হেরা গুহায় নির্জনে অবস্থান করতেন মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভের শিক্ষা গ্রহণের জন্য। তাঁর জন্য এটি ছিল একটি আধ্যাত্মিক শিক্ষায়তন। এখানে তাঁকে দেখা যায় সর্বশক্তিমান প্রশিক্ষকের একনিষ্ঠ প্রশিক্ষণার্থী ও গবেষক হিসেবে। তাঁর প্রশিক্ষক স্বয়ং আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিন। মহান আল্লাহ্ পাকের ইশারায় তিনি পঁচিশ বছর বয়স থেকে চল্লিশ বছর বয়স অবধি গভীর ধ্যান বা মোরাকাবায় নিয়োজিত থেকেছিলেন। অহি নাজিলকাল পর্যন্ত তাঁর এ মোরাকাবা একাধারে অব্যাহত ছিল। প্রথম অহি লাভের পর তিনি বাড়িতে চলে আসেন, তারপর ফের সেখানে গিয়ে এক মাসের নির্ধারিত অবশিষ্ট মেয়াদ পূর্ণ করেন। (সিরাত ইবনে ইসহাক) এরপর আর তিনি হেরা গুহায় যাননি। যাবেনইবা কেন? যে শিক্ষা গ্রহণের জন্য তিনি হেরা গুহায় যেতেন, সেই শিক্ষাতো পেয়ে গেছেন। এতে বুঝা যায় মহান প্রভুর শিক্ষা গ্রহণ করার জন্যই হযরত রাসুল (সা.)-এর হেরা গুহায় যাওয়া। যে শিক্ষা সমাপ্ত হওয়ার পর তাঁর আর হেরা গুহায় যাওয়ার প্রয়োজন হয়নি, বরং মহান আল্লাহর ইচ্ছায় জগদ্বাসীকে সেই শিক্ষা দেওয়ার কাজে নিয়োজিত হতে হয়েছে তাঁকে।

মোহাম্মদী ইসলামের মৌলিক শিক্ষাটাই হলো হেরা গুহার সেই মোরাকাবা বা ধ্যানভিত্তিক অনুশীলন। সেজন্য পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের পর মোরাকাবা করতে হয়। মোরাকাবা দ্বারা আত্মাকে পরিশুদ্ধ করা যায়। আর পরিশুদ্ধ আত্মার মাধ্যমেই আল্লাহর দিদার লাভ করা সম্ভব হয়। যার আত্মা পরিশুদ্ধ হয়, তার পক্ষে অনেক কিছুই জানা সম্ভব হয়। হতে পারে সেটা স্বপ্নের মাধ্যমে, ফায়েজ নতুবা এলহামের মাধ্যমে। যাদের অন্তর পবিত্র তারা খুব সহজেই ভালো-মন্দ উপলদ্ধি করতে পারেন। এ উপলদ্ধিটা পরিশুদ্ধ অন্তর থেকেই আসে। এটিই ছিল হেরা গুহার শিক্ষা। বিজ্ঞানও সম্প্রতি তুলে ধরছে ধ্যানের মাধ্যমে মেধাশক্তি বৃদ্ধি পায়। এ ধ্যানের শিক্ষাটাই মহানবি (সা.) আজ থেকে প্রায় ১৪৫০ বছর আগে মানব জাতিকে শিখিয়ে ছিলেন। যে শিক্ষার গুরুত্ব, সত্যতা ও প্রয়োজনীয়তা বিজ্ঞানীরা এ যুগে এসেও অস্বীকার করতে পারছেন না। তারা অকপটে স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছেন মহানবি (সা.) সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব। মহান প্রভু যার সরাসরি শিক্ষক, তিনিতো সর্বকালের সেরা মহামানব হবেনই।

মোরাকাবা বা ধ্যান জগতের সব ধর্মের নিগূঢ় ব্যবস্থাপত্র। জগতের সকল মহামানবই মোরাকাবা করে মহামানব হয়েছেন। মহানবি (সা.) হেরা গুহায় একাধারে পনের বছর মোরাকাবা করেছেন। এ মোরাকাবার মাধ্যমেই তিনি তাঁর হৃদয়কে আলোকিত করেছেন এবং সাধনার সর্বোচ্চ স্তরে উপনীত হয়ে আল্লাহর দিদার লাভ করেছেন। হযরত রাসুল (সা.) ফরমান, ‘‘আমার প্রভুকে আমি অতি উত্তম সুরতে দেখেছি।’’ (তাফসীরে রুহুল বয়ান) তরিকতে মোরাকাবা ছাড়া সাধনার স্তর অতিক্রম করার কোনো বিকল্প নেই। মোরাকাবা করলে হৃদয়ের কালিমা বিদূরিত হয়ে হৃদয় আলোকিত হয়। একজন সাধক প্রতিদিন পাঁচবার মোরাকাবার মাধ্যমে পাঁচ ধরনের ফায়েজ লাভ করেন। প্রত্যক নামাজের ওয়াক্তে আলাদাভাবে আল্লাহর পক্ষ থেকে আপন মোর্শেদের সিনা হয়ে এ ফায়েজ ওয়ারেদ হয়। যথা- ফজরের ওয়াক্তে কুয়াতে ইলাহির ফায়েজ। এ ফায়েজ দ্বারা ক্বাল্বের ৭০ হাজার পর্দার ভেতরের সব গুনাহর পাহাড় সাফ হয়। ক্বাল্বে তখন আল্লাহর জিকির জারি হয়। জোহরের ওয়াক্তে হযরত রাসুল (সা.)-এর মহব্বতের ফায়েজ আসে। এতে নবিজির মহব্বতে দিল ভরপুর হয়। আছর ও মাগরিবের ওয়াক্তে তওবা ও তওবা কবুলিয়াতের ফায়েজ অবতীর্ণ হয়। ফলে সব ধরনের গুনাহ মাফ হয়ে দিল পরিস্কার হয়। এশার ওয়াক্তে অবতীর্ণ হয় গাইরিয়াতের ফায়েজ। এ দ্বারা নফসের খারাপ কামনাসহ যাবতীয় অসত্য ও অসুন্দর ধ্বংস হয় এবং দিল সাফ হয়। আর রাতের শেষ তৃতীয়াংশে রহমতের ফায়েজ পাওয়া যায়। এতে দিল আল্লাহ্র রহমতে ভরপুর হয়। এসব মহাপ্রাপ্তি কেবলমাত্র মোরাকাবা বা ধ্যানের মাধ্যমেই সম্ভব।

এভাবে বিভিন্ন ওয়াক্তের মোরাকাবায় দিলের মধ্যে ফায়েজ পড়ে দিল সাফ হয়, তথাপিও রহমতের সময়। মহান আল্লাহ্ বান্দার ডাকে অধিক সাড়া দেন। তিনি বান্দাকে ইবাদতের মাধ্যমে তাঁর নৈকট্য লাভের আহ্বান জানান। হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত হযরত রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘‘আমাদের প্রতিপালক প্রতি রাতের যখন শেষ তৃতীয়াংশ অবশিষ্ট থাকেন, তখন প্রথম আসমানে অবতরণ করেন এবং বলতে থাকেন, ‘হে বান্দা আমার কাছে প্রার্থনা করো, আমি তোমার প্রার্থনা কবুল করব। আমার কাছে তোমার কী চাওয়ার আছে চাও, আমি তা দান করব। আমার কাছে তোমার জীবনের গুনাহের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করো, আমি তোমার গুনাহ মাফ করে দিব’।’’ (বোখারি শরীফ) এ ক্ষমা প্রাপ্তির জন্যও প্রয়োজন হেরা গুহার সেই শিক্ষা তথা মোরাকাবার নিয়মিত অনুশীলন করা।

মোরাকাবা এক ধরনের নফল ইবাদত। নফল ইবাদত হলো আল্লাহর নৈকট্য লাভের উত্তম পন্থা। হাদিসে কুদসিতে আল্লাহ্ পাক এরশাদ করেন, “আমার বান্দা নফল ইবাদত দ্বারা আমার এতো নিকটবর্তী হয়ে যায়, আমি তাকে ভালোবাসতে বাসতে তার কর্ণ হয়ে যাই, যে কর্ণ দ্বারা সে শুনে; চক্ষু হয়ে যাই, যে চক্ষু দ্বারা সে দেখে; হাত হয়ে যাই, যে হাত দ্বারা সে ধরে এবং পা হয়ে যাই, যে পা দ্বারা সে হাঁটে। এমন বান্দা কোনো বিষয়ে প্রার্থনা করা মাত্র আমি তা দান করে থাকি এবং কোনো বিষযে আমার কাছে আশ্রয় চাওয়া মাত্র তাঁকে আশ্রয় দিয়ে থাকি।” (বোখারী শরীফ ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৯৬৩, তাফসীরে মাজহারী ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৫৮; মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক ১০ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৯৮; বোখারী শরীফের সূত্রে মেশকাত শরীফ, পৃষ্ঠা ১৯৭) তার মানে মোরাকাবা সাধকের জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। মোরাকাবার মাধ্যমে যার হৃদয়ের কালিমা বিদূরিত হয়, তিনি নামাজে আল্লাহর সঙ্গে কথোপকথন করেন। তাই প্রতি ওয়াক্ত নামাজ ও ইবাদত শেষে নিয়মিত মোরাকাবা করা আবশ্যক। এতে সাধক ধীরে ধীরে আল্লাহর নৈকট্যে পৌঁছে যেতে সক্ষম হন। মেরাকাবা করলে ক্বাল্বের চোখ খুলে যায়। তবে মোরাকাবা চর্চার শুরুতে চাই খাঁটি মোর্শেদের সাহচর্য। পবিত্র কুরআনের বহু স্থানে এ বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা এসেছে। এরশাদ হয়েছে, ‘‘যারা ইমান এনেছ, তোমরা আল্লাহ্কে ভয় করো এবং সত্যবাদীদের সঙ্গী হয়ে যাও।’’ (সূরা তওবা ৯: আয়াত ১১৯)

মোরাকাবার গুরুত্ব সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ্ তায়ালা ঘোষণা করেন, ‘‘নিশ্চয়ই আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টিতে, দিন-রাতের পরিবর্তনে জ্ঞানীদের জন্য নিদর্শন রয়েছে। তারা দাঁড়িয়ে, বসে বা শায়িত অবস্থায় আল্লাহর স্মরণ করে; তারা আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টির ব্যাপার নিয়ে ধ্যানে মগ্ন হয় এবং বলে, হে আমাদের প্রতিপালক! তুমি এসব নিরর্থক সৃষ্টি করোনি।’’ (সূরা আলে ইমরান ৩: আয়াত ১৯০-১৯১) মুক্তির পথ অনুসন্ধান লাভের জন্য গভীর মনোনিবেশ ও আত্মনিমগ্নতার নির্দেশ আল্লাহ্ পবিত্র কুরআনে একাধিক জায়গায় উল্লেখ করেছেন। এমনকি মহানবি (সা.)-কে আল্লাহ্ বলেছেন, ‘‘অতএব যখনই আপনি অবসর পাবেন, তখনই একান্তে ইবাদতে রত হবেন। আর আপনার প্রতিপালকের প্রতি মনোনিবেশ করেন।’’ (সূরা ইনশিরাহ ৯৪: আয়াত ৭-৮) তাহলে মোরাকাবা যে একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত তাতে আর সন্দেহ থাকার সুযোগ নেই।

মোরাকাবা সম্পর্কে হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত এক হাদিসে উল্লেখ আছে, হযরত রাসুল (সা.) বলেন, ‘‘এক ঘণ্টা মোরাকাবা করা ৬০ বছর নফল ইবাদতের চেয়ে উত্তম।’’ মহান আল্লাহ্ সর্বদর্শী ও সর্বজ্ঞানী, তিনি যেন ক্ষমার পাশাপাশি আমাদের দয়া করেন। ধ্যান এমন একটি প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে অস্থির ক্বাল্ব বা মনকে স্থির ও প্রশান্ত করার পর মনকে দিয়ে বড়ো কিছু করানোর প্রস্ততি নেওয়া যায়। ধ্যান মনকে নফস বা প্রবৃত্তির শৃঙ্খলমুক্ত হতে সাহায্য করে এবং তাকওয়াবান হতে সহায়তা করে। হযরত রাসুল (সা.) বলেন, “জেনে রেখো, মানবদেহের মাঝে একটি মাংসের টুকরো রয়েছে, সেটি যখন ঠিক হয়ে যায়, অর্থাৎ পবিত্র হয়ে যায়, তখন গোটা মানবদেহ পবিত্র হয়ে যায়। আর তা যখন খারাপ হয়ে যায়, তখন গোটা শরীরই খারাপ হয়ে যায়। জেনে রাখো, সেই মাংসের টুকরোটি হলো ক্বালব বা হৃদয়।’’ (বুখারি শরীফ ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৩; ই.ফা.বা. কর্তৃক অনূদিত বোখারী শরীফ ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩৯ ও ৪০) এসব আলোচনা থেকে বুঝা যায় মোরাকাবা বা ধ্যান হচ্ছে স্রষ্টার সঙ্গে সৃষ্টির সাক্ষাৎ লাভের মোক্ষম উপায়। মুক্তি লাভের সেটাই একমাত্র অসিলা।

হযরত আদম (আ.)-থেকে বিশ্বনবি হযরত রাসুল (সা.) পর্যন্ত যত নবি-রাসুল জগতের বুকে তাশরিফ নিয়েছিলেন, তাঁরা প্রত্যেকেই মোরাকাবার মাধ্যমে মহান আল্লাহর সাথে যোগাযোগ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। বেলায়েতের যুগে আউলিয়ায়ে কেরাম একই পদ্ধতিতে আল্লাহর সাথে যোগাযোগ করতে সক্ষম হচ্ছেন। মহান আল্লাহর দর্শন একমাত্র মোরাকাবার মাধ্যমেই সম্ভব। মানুষের হৃদয়ে আল্লাহর বাসস্থান। যুগে যুগে যত মহামানব আল্লাহ্কে পেয়েছেন তাঁদের সকলেই এ হৃদয় মাঝে অনুসন্ধান করে প্রভুর পরিচয় লাভ করেছেন। মোরাকাবার মাধ্যমেই অন্তর চক্ষু জাগ্রত করতে হয়, তাহলেই আল্লাহর দর্শন পাওয়া যায়। আমাদের দয়াল মোর্শেদ সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহ্বুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (মা. আ.) দয়াল বাবা কেবলাজান সেজন্য মোরাকাবার উপর গুরুত্ব দিয়ে থাকেন।
মহান মোর্শেদের মাধ্যমে রাব্বুল আলামিনের নিকট ফরিয়াদ আমরা যেন আমাদের মোর্শেদ কেবলাজানের শিক্ষা অনুযায়ী সঠিকভাবে মোরাকাবা করে মহান আল্লাহ্ ও দয়াল রাসুল (সা.)-এর নৈকট্য লাভ করে কামিয়াব হতে পারি। আমিন।
[লেখক: অতিরিক্ত সচিব, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার]

সম্পর্কিত পোস্ট