বাঙালি সংস্কৃতি ও সুফি সাহিত্য
মুহাম্মদ জহিরুল আলম
মহান সৃষ্টিকর্তার অপরূপ সৃষ্টি মানুষ। তিনি মানুষকেই শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। সকল সৃষ্টির মাঝে একমাত্র মানুষেরই সংস্কৃতি রয়েছে। মানুষ ছাড়া আর কোনো প্রাণীর সংস্কৃতি নেই, কারণ সংস্কৃতি একটি মানবীয় ব্যাপার। মানুষের দ্বারাই সভ্যতার সৃষ্টি ও বিকাশ। মানব শিশু জন্মের পর থেকেই চিন্তায়, কথা, কর্মে ও আচরণে; সুন্দর, উৎকর্ষ ও মানবীয় হয়ে উঠে যে পদ্ধতিতে, তাই সংস্কৃতি। সংস্কৃতির মধ্য দিয়েই ব্যাক্তির কর্ম ও জ্ঞানের নবজন্ম ঘটে। সংস্কৃতিবান ব্যক্তিই স্রষ্টার পরম সৌন্দর্য ধারণ করতে সক্ষম হয়। যুগে যুগে মহামানবগণ উত্তম সংস্কৃতির মাধ্যমে স্বজাতির চারিত্রিক কলুষতা দূর করে মানবীয় বৈশিষ্ট্যের উৎকর্ষ সাধন করেছেন। তাই তাঁরা স্মরণীয়, বরণীয় ও অনুসরণীয়। সংস্কৃতি হলো নিজেকে সুন্দর করে বিকাশের কৌশল, তাই পৃথিবীতে মানুষই একমাত্র সংস্কৃতিবান প্রাণী। সংস্কৃতি শিখতে হয়, এটি অর্জিত আচরণ। কারণ সদ্গুণ অর্জন করতে হয়।
ইংরেজী Culture এর বাংলা প্রতিশব্দ ‘সংস্কৃতি’। যার অর্থ চিৎপ্রকর্ষ বা মানবীয় বৈশিষ্ট্যের উৎকর্ষ সাধন। রোমান দার্শনিক সিসেরো তার তুসকালেন ডিসপুটেন্স (Tusculance Disputationes) নামক গ্রন্থে প্রথম আধুনিক ‘সংস্কৃতি’ (Culture) শব্দটি ব্যবহার করে ‘আত্মার চর্চা’ বা (Cultura animi) কথাটি বলেন। এখানে তিনি পরমকারণবাদের (Teleologically) দ্বারা বোঝান যে, আত্মার চর্চা মানুষের উন্নয়নের সর্বোচ্চ সম্ভাব্য আদর্শ। এডওয়ার্ড টেইলর-সহ অন্যান্য দার্শনিকগণও ‘সংস্কৃতি’ বলতে মানুষকে বর্বরতা কাটিয়ে, পুরোপুরি মানুষ হওয়াকেই বুঝিয়েছেন। সংস্কৃতি দু’ ধরনের হয়, অবস্তুগত সংস্কৃতি ও বস্তুগত সংস্কৃতি। অবস্তুগত সংস্কৃতি হলো মূল্যবোধ, বিশ্বাস প্রক্রিয়া, নিয়ম-নীতি, আদর্শ, নৈতিকতা, ভাষা, সাহিত্য, দর্শন। অন্যদিকে বস্তুগত সংস্কৃতির মাঝে রয়েছে প্রযুক্তি, স্থাপত্য ও শিল্প। সংস্কৃতি বহতা নদীর মতো প্রবাহমান। সংস্কৃতির রূপান্তর ঘটে। উন্নয়ন, বিবর্তন, সংস্কার, নতুন ভাবনা, বিপ্লব, পুনর্জাগরণ, আধুনিকীকরণের মাধ্যমে তা হতে পারে।
আমরা বাঙালি, আমরা অনন্য সংস্কৃতির অধিকারী। হাজার বছর ধরে নানা নৃতাত্ত্বিক এবং ধর্মীয় গোষ্ঠী ও শাখা গোষ্ঠী, নানা শ্রেণির মিলন, পারষ্পরিক প্রভাব এবং সমন্বয়ের ফলে গড়ে উঠেছে ‘বঙ্গীয় সংস্কৃতি’। ‘বাঙালি সংস্কৃতির’ ভিত্তি ‘বঙ্গীয় সংস্কৃতি’। হাজার বছরের পুরানো সংস্কৃতিক ঐতিহ্যের উপর ভিত্তি করে গঠিত হলেও ‘বাঙ্গালা’ নামে স্বতন্ত্র অঞ্চল গড়ে উঠার আগের সংস্কৃতিকে বঙ্গীয় সংস্কৃতি বলা যাবে না। মূলত ১৩৫০ এর দশকে গৌড়ের সুলতান শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ সোনারগাঁ জয় করে বৃহত্তর ‘বাঙ্গালা’ অঞ্চলের সৃষ্টি করেন। তখন থেকেই বাংলা ভাষা নিজের বৈশিষ্ট্য অর্জন করে স্বতন্ত্র রূপ লাভ করে। তাই বঙ্গীয় সংস্কৃতির বয়স আটশো থেকে এক হাজার বছর। আমাদের ভাষা, সাহিত্য, সঙ্গীত, ধারনা, ধর্ম ও বিশ্বাস; শিক্ষা, অভ্যাস, রীতি-নীতি, সামাজিক মূল্যবোধ ও নিয়ম-কানুন; উৎসব ও পার্বণ; স্থাপত্য ও শিল্প কর্ম এবং প্রযুক্তি নিয়েই বাঙালি সংস্কৃতি। বাঙালি সংস্কৃতিতে যেসব উপাদান রয়েছে, তার মাঝে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো বাংলা ভাষা। বাঙালি সংস্কৃতির সূচনায় বাংলা ভাষার উম্মেষ গুরুত্বপূর্ণ। চর্যাপদকে বাংলা ভাষার নিদর্শন হিসেবে গ্রহণ করলেও তার ভাষা পুরোপুরি বাংলা ছিল না।
বাংলা ভাষা, সংস্কৃত ভাষার মৌখিক রূপ প্রাকৃত থেকে উৎপন্ন, তাই এ ভাষার শব্দাবলির প্রধান ভাগই সংস্কৃত, নয়ত সংস্কৃত শব্দের বিবর্তিত রূপ (যেমন চন্দ্র থেকে চাঁদ)। সেন রাজ দরবার এবং ব্রাহ্মণ সমাজে বাংলা ভাষাকে যথাযথভাবে গ্রহণ করা হয়নি। কিন্তু বাংলায় মুসলিম শাসন, বাংলা ভাষাকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে অলী-আল্লাহ্গণ অনেক আগে বাংলায় আগমন করলেও মুসলমানদের বঙ্গ বিজয়ের পর তা পৃষ্ঠপোষকতা পায়। মহামানবগণ ঢাকা, বগুড়া, পাবনা, চট্টগ্রাম, নেত্রকোনা, সিলেট, রাজশাহী, খুলনা-সহ বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে বসতি স্থাপন করে খানকাহ, মসজিদ, মক্তব ইত্যাদি স্থাপনের মাধ্যমে ইসলাম প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন। সুফিদের উদারনীতি ও মানবপ্রেম এবং ইসলামের সাম্য ও ভ্রাতৃত্ববোধে আকৃষ্ট হয়ে সমাজের অবহেলিত, নিপীড়িত ও বঞ্চিত উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। তখন পুরো অঞ্চল জুড়ে সামাজিক সাম্য অনুপস্থিত ছিল, তার বিপরীতে ইসলাম ধর্মের সাম্য ও মৈত্রী সকলকে মোহিত করে। ধীরে ধীরে সুফি-দরবেশ, বহিরাগত মুসলিম শাসক, ধর্মান্তরিত স্থানীয় জনগণের সমন্বয়ে একটি নব্য মুসলিম সম্প্রদায় গড়ে ওঠে। সুলতানগণ বাংলা ভাষাকে পৃষ্ঠপোষকতা করেন, তখন হাজার হাজার আরবি-ফারসি শব্দ বাংলা ভাষায় ঢুকে যায়। তের শতকের শেষদিকে সোনারগাঁ এবং চৌদ্দশতকে সিলেট, চট্টগ্রাম এবং ত্রিবেনী মুসলমান সমাজ ও সংস্কৃতির কেন্দ্রে পরিণত হয়। তাদের মানসিক চাহিদা নিবৃত্তি ও সুফি দর্শনকে প্রাধান্য দিয়ে সুফি ভাবধারার কবিগণ বাংলা ভাষায় যে সাহিত্য নির্মাণ করেন, তাই সুফি সাহিত্য নামে বিকশিত হয়। পনের শতক থেকেই সুফি সাহিত্য বাংলা সাহিত্যকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করতে থাকে।
বাংলা সাহিত্যের একটি বিশেষ ধারা যা সুফি তত্ত্বকে আশ্রয় করে উদ্ভুত ও বিকশিত হয়েছিল, তা হলো সুফি সাহিত্য। আরব-ইরানিদের সংঙ্গে এ দেশবাসীর ভাবের আদান প্রদানের ফলে সুফি সাহিত্যের প্রচার ও প্রসার লাভ করে। এর ফলে একদিকে যেমন মানুষ আল্লাহ্র পথে নিজেকে ধাবিত করেছে, অন্যদিকে রাসুল প্রেমের দৃষ্টিভঙ্গী গ্রহণ করেছে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের যে রূপ নিয়ে আমরা গর্ব করি, তা শুরু হয়েছিল এখানকার মুসলিম শাসনামল থেকেই। শ্রী দীনেশচন্দ্র সেন-এর বক্তব্য এ প্রসঙ্গে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, “মুসলমান সম্রাটগণ বর্তমান বঙ্গ-সাহিত্যের একরূপ জন্মদাতা বলিলেও অত্যুক্তি হয় না। তাহারা বহু ব্যয় করিয়া শাস্ত্রগুলির অনুবাদ করাইয়া ছিলেন এবং সেগুলি আগ্রহ সহকারে শুনিয়া আনন্দিত হইতেন। আরব-দেশবাসীরা অনেক সংস্কৃত গ্রন্থের অনুবাদ করাইয়াছিলেন।” (বঙ্গ ভাষার উপর মুসলমানদের প্রভাব, সওগাত, ১৩৩৫ সালের চৈত্র সংখ্যায় প্রকাশিত)
মধ্যযুগে ইরানকে কেন্দ্র করে সুফিতত্ত্বের সাহিত্য ভাণ্ডার সৃষ্টি হয়। যার বড় অংশই স্রষ্টা প্রেমের আকুল আবেদন। আবদুর রহমান জামী, নিজামী গঞ্জভী, ওমর খৈয়াম, জালাল উদ্দিন রুমী, শেখ সাদি, ফরিদ উদ্দীন আত্তার, হাফিজ শিরাজী, বুল্লে শাহ্, আমীর খসরু প্রমুখ বিখ্যাত কবি-সাহিত্যিকগণ ফরাসি ভাষার দিওয়ান, মসনভি, গজল, রুবাইয়াৎ,খমসা প্রভৃতি আঙ্গিকে বহু কাব্য রচনা করেন। তারই অনুসরণে বাংলা সুফি সাহিত্যের উদ্ভব ও বিকাশ। সুফি সাহিত্য, বাংলা সাহিত্যকে অনন্য বৈশিষ্ট্য প্রদান করেছে। এ প্রসঙ্গে আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম অত্যন্ত সুন্দর করে বলেন, “আমি মনে করি, বিশ্ব-কাব্যলক্ষীর একটা মুসলমানী ঢং আছে। ও-সাজে তাঁর শ্রীর হানি হয়েছে বলেও আমার জানা নেই। … বাংলা কাব্য-লক্ষীকে দু’টো ইরানি ‘জেওর’ পরালে তাঁর জাত যায় না, বরং তাঁকে আরও খুবসুরতই দেখায়। আজকের কলা-লক্ষীর প্রায় অর্ধেক অলংকারইত মুসলমানী ঢং-এর। বাইরে এ-ফর্মের প্রয়োজন ও সৌকুমার্য সকল শিল্পীরাই স্বীকার করেন।” (কাজী নজরুল ইসলাম, বড়র পিরীতি বালির বাঁধা, আত্মশক্তি, ৩০ ডিসেম্বর, ১৯২৭)। বাংলা ভাষায় সুফিতত্ত্ব বিষয়ে দু’ধরনের কাব্য রচিত হয়েছে, শাস্ত্রকাব্য ও পদাবলি। শাস্ত্রকাব্যে সুফি সাধনা, সৃষ্টিতত্ত্ব, যোগতত্ত্ব, নীতি-উপদেশ, জীবাত্মা ও পরমাত্মা ইত্যাদি বিষয় প্রাধান্য পায়। শেখ জাহিদের আদ্য পরিচয়; সৈয়দ সুলতানের জ্ঞানপ্রদীপ ও জ্ঞানচৌতিশা, যোগকলন্দর; আবদুল হাকিমের চারি-মাকাম-ভেদ; হাজী মহম্মদের সুরতনামা; মীর মুহম্মদ সফীর নুরনামা; শেখ মনসুরের সির্নামা; আলী রজার আগম ও জ্ঞানসাগর অন্যতম। পদাবলিতে সুফিতত্ত্বের আধ্যাত্মিক ভাবের প্রকাশ ঘটে। আল্লাহ্র প্রেম ও সৌন্দর্য, চিত্তশুদ্ধি, আত্মসমর্পণ, আধ্যাত্মিক সাধনা এখানে প্রকাশ পায়। পদকর্তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন আইনুদ্দীন, আফজল, আলাওল, আলী রজা, নাসির মাহমুদ, মীর ফয়জুল্লাহ্, শেখ কবির, শেখ চাঁদ, সৈয়দ মর্তুজা, সৈয়দ সুলতান। এখানে সুফি ধর্ম সাধন ও তত্ত্বচিন্তা কাব্যসৌন্দর্যে ফুটে উঠেছে।
সুফি সাহিত্য আমাদের বাঙালি কবি-সাহিত্যিকদের ব্যাপকভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল। পরবর্তিতে তা আমাদের সংস্কৃতিতেও ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ হয়। কবি নজরুল পারস্যের কবিদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। তাঁর লিখা কবিতায় হাফিজ সিরাজী, ওমর খৈয়াম-এর মতো সুফিবাদী ভাবধারা প্রকাশিত হয় –
“তোমার কন্ঠে রাখিয়া এসেছি মোর কন্ঠের গান
এইটুকু শুধু রবে পরিচয়? আর সব অবসান?
অন্তরতলে অন্তরতর যে ব্যথা, লুকায়ে রয়,
গানের আড়ালে পাও নাই তার কোনদিন পরিচয়।”
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ, হাফিজের সমাধিকে ‘পিতার সমাধি’ বলে উল্লেখ করেন। গবেষকদের মতে ‘গীতাঞ্জলি’র মূল সুরের সাথে রুমির মূল সুরের অনেক মিল রয়েছে। সুফি সাহিত্যের এ প্রভাব আমাদের সংস্কৃতিকেও প্রভাবিত করেছে। বিখ্যাত সুফি নিজামুদ্দিন আউলিয়ার যোগ্য অনুসারী আমীর খসরু, কাওয়ালী গানের জনক। তাঁর হাত ধরেই ক্লাসিক্যাল গান প্রবর্তিত হয়। আমরা যদি মর্সিয়া সাহিত্যের দিকে তাকাই, দেখব এ সাহিত্য কর্ম পুরো বাংলায় ছড়িয়ে আছে। শেখ ফয়জুল্লাহর ‘জয়নবের চৌতিশা’ সমকালীন সময়ে সকলের মুখে মুখেই ছিল। রহস্য ভেদের জন্য আবহমান বাংলার বাউলগণও সুফি সাহিত্যের দ্বারস্থ হন-
“মানুষ হাওয়ায় চলে, হাওয়ায় ফিরে, হাওয়ার সনে রয়,
দেহের মাঝে আছে রে সোনার মানুষ ডাকলে কথা কয়।”
সংস্কৃতির মাধ্যমেই জীবন বিকশিত হয়। আবহমানকালের বাঙালি সংস্কৃতি আমাদের অস্থি মজ্জায় মিশে আছে। ভাষার কারণে আমরা বাঙালি, আর দেশের পরিচয়ে আমরা বাংলাদেশী, আমাদের স্বাধীন জাতিসত্তার স্ফুরণ ঘটেছে আমাদের সংস্কৃতির মাধ্যমে। এরই মাঝে সুফি সাহিত্য আমাদের ধর্ম, দর্শন, সংস্কার ও সমাজ জীবনে মিশে আছে।
[লেখক : প্রাবন্ধিক ও পিএইচডি গবেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়]
1 Comment
Amin