হযরত মালেক দিনার (রহ.)-এর তওবা ও ক্ষমা লাভ
বর্ণিত আছে- “হযরত মালেক দিনার (রহ.) সিরিয়ার দামেস্কের অধিবাসী ছিলেন। তাঁর জন্মগ্রহণকালে তাঁর পিতা দাস জীবন-যাপন করেছিলেন। দারিদ্র্যের কশাঘাতে হযরত মারেক দিনার (রহ.) পাপ কাজে জড়িয়ে পড়েন। একদা তিনি দামেস্ক শহরের বড় মসজিদ সংলগ্ন এক ধনাঢ্য আমিরের বাড়িতে রাতের অন্ধকারে চুরি করার উদ্দেশ্যে প্রবেশ করেন। আমির ছিলেন আবেদ, পরহেজগার ও মোত্তাকি মানুষ। দামেস্কে শহরের বড় মসজিদটিও তাঁরই হাতে নির্মিত ছিল। পারিবারিক জীবনে তিনি ছিলেন একটি মাত্র কন্যা সন্তানের জনক। ফলে সে বিশাল সম্পদের একমাত্র উত্তরাধিকারীও ছিল এ কন্যা সন্তান।
আমির গভীর রাতে প্রিয়তমা স্ত্রীর সাথে আলাপ করছিলেন- তাদের একমাত্র কন্যা বিবাহের যোগ্য, তাকে যথাযোগ্য পাত্রস্থ করা দরকার। অতঃপর আমির স্বীয় স্ত্রীসহ পরিকল্পনা গ্রহণ করেন যে, আল্লাহ্ তো আমাদের ধনসম্পদে কোনো কমতি রাখেননি। সুতরাং একটি সৎ, যোগ্য ও মোত্তাকি পাত্র দরকার। সেই লক্ষ্যে আমির সিদ্ধান্ত নেন যে, তিনি চল্লিশ দিন পর্যবেক্ষণ করবেন। দামেস্কের এ বড় মসজিদে যে যুবক সর্বাগ্রে প্রবেশ করে জামাতের সাথে নামাজ আদায় করবে অতঃপর সর্বশেষে মসজিদ হতে প্রস্থান করবে, এভাবে দৈনন্দিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ একাধারে চল্লিশ দিন যে আদায় করবে তিনি এমন যুবককেই তাঁর কন্যার জন্য বেছে নেবেন।
এদিকে মালেক দিনার চুরি করতে এসে অন্দর মহলের এ গোপন বার্তা স্পষ্টই শুনতে পেলেন। তিনি মুহূর্তকাল বিলম্ব না করে আমিরের বাসভবন ত্যাগ করলেন। সিদ্ধান্ত নিলেন এ শর্ত তিনিই পূরণ করবেন। কেননা একদিকে আমিরের একমাত্র আদরের দুলালী, রূপে ও গুণে অনন্যা, অন্যদিকে দামেস্কের সর্বশ্রেষ্ঠ ধনী আমিরের সকল স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির একমাত্র মালিক হওয়ার সুবর্ণ সুযোগ তিনি হাতছাড়া করতে নারাজ। এ সুযোগে মসজিদের মুতাওয়াল্লিও হওয়া যাবে। সেদিন সুবহে সাদিকের সময় সর্বাগ্রে মালেক দিনার দামেস্কের বড় মসজিদে প্রবেশ করেন, উদ্দেশ্য সালাতুল ফজর আদায় করা। শুরু হলো সাধনা। তবে এ সাধনা আল্লাহ্কে পাওয়ার জন্য নয়, আল্লাহর সৃষ্টি আমিরের একমাত্র সুন্দরী ও ধনবতী কন্যাকে বিয়ে করার সাধনা। নিজের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অন্তঃপুরে গোপন রেখে মালেক দিনার প্রত্যহ প্রতি ওয়াক্ত নামাজে সর্বাগ্রে মসজিদে প্রবেশ করেন এবং নামাজ আদায় করে সর্বশেষে মসজিদ ত্যাগ করেন। এভাবে দিন, সপ্তাহ ও মাস অতিবাহিত হয়ে যায়। কিন্তু দামেস্কের সর্ববৃহৎ মসজিদের হাজার হাজার মুসল্লির কেউ তার দিকে ফিরেও তাকায় না। কারোরই যেন তার ব্যাপারে আগ্রহ নেই। আমিরের কন্যা মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে রাখলেন- আমার পিতা যেরূপ তাকওয়া সম্পন্ন যুবকের কাছে আমাকে পাত্রস্থ করতে চেয়েছেন, জীবনে যদি ঐরূপ যুবকের সাক্ষাৎ পাই, তবেই আমি বিয়ে করব, অন্যথায় নয়। মালেক দিনারও সে লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার জন্য তার সাধনা কর্মে অবিচল।
এদিকে একটি ঘটনা মালেক দিনারের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিল। সেদিন ছিল বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত তথা জুমার রাত্রি। অন্যদিকে চল্লিশ দিন পুরা হতে মাত্র একদিন বাকী। এশার নামাজ শেষ করে তিনি কিছু ওয়াজিফা-কালাম করছিলেন। মসজিদে তিনি ভিন্ন আর কোনো মুসল্লিও নেই। হঠাৎ তিনি তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়লেন। এ সময় তিনি হৃদয়ের কানে এক অদৃশ্য গায়েবি আওয়াজ শুনেত পান- ‘হে মালেক! আমার সৃষ্টি একটি মেয়েকে পাওয়ার জন্য তুমি এতগুলো দিন সাধনা করলে, আমার কি কোনো মূল্য তোমার কাছে নেই? বাহ! আমার জন্য তো তুমি একটি দিনও সাধনা করলে না?’ মালেক দিনারের তন্দ্রা ভেঙ্গে গেল। পুরো শরীরই ঘর্মাক্ত, তিনি বিচলিত হয়ে পড়লেন। কে সে, যে এভাবে আমাকে সম্বোধন করল? দামেস্কের সুবিশাল মসজিদে তখন পিন-পতন নীরবতা। শহরজুড়ে রাতের নিস্তব্ধতা নেমে আসল। মালেক দিনার ওযু করলেন। অতঃপর সিজদায় লুটিয়ে পড়লেন। দু’চোখ বেয়ে তাঁর অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। হৃদয়ের সবটুকু আবেগ ও হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা ঢেলে দিলেন আল্লাহর নুরের কদম মোবারকে। আরজ করলেন- হে দয়াময়! আমাকে দিদার দাও, এই কণ্ঠ যে বড় মধুর! আমি যে তোমাকে পেতে চাই। কিন্তু হে প্রভু! আমি যে বড় পাপী, আমাকে দয়া করে ক্ষমা করো, তোমার নুরের কদমে আশ্রয় ভিক্ষা দাও। এভাবে আল্লাহর প্রেম সাগরে ডুবে এক সিজদায় রাত অতিবাহিত হয়ে যায়। এমনিভাবে রাতের শেষ প্রহরে মালেক আর মালেক নেই, সে যেন জগতের মালিকের দাসে পরিণত হয়েছেন। রাতের শেষ প্রহরে মালেক দিনার অদৃশ্য কণ্ঠের আওয়াজ পুনরায় শুনতে পেলেন- হে মালেক! আমি তোমাকে ক্ষমা করেছি, তোমাকে আমার বন্ধুদের মধ্যে শামিল করে নিয়েছি।
এদিকে সুবহে সাদিকের উন্মেষ ঘটল, মসজিদে আজান হলো। মুসল্লিদের সমাগমে মসজিদ পূর্ণ। কিন্তু একি! আজকের চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন রকম। সকল মুসল্লির দৃষ্টি মালেক দিনারের দিকে। সবাই যেন তাকে ভালোবাসতে চায়, কিছু বলতে চায়। সুদীর্ঘ চল্লিশ দিন যাদের কোনো আগ্রহ ছিল না, কে সে, যে আজ সকল মুসল্লির অন্তরে মালেক দিনারের প্রতি ভালোবাসা জাগিয়ে দিলেন? অন্যদিকে দিনের আলো ফুটতেই আমির লোক পাঠিয়ে মালেক দিনারকে বাসায় ডেকে নেন এবং বলেন- আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমার মেয়েকে তোমার কাছে বিয়ে দেবো এবং সকল সম্পত্তি তোমার নামে লিখে দেবো। মালেক দিনার বললেন- আমাকে সময় দিন, আমি একটু বঝে নেই। অতঃপর তিনি ফিরে আসলেন। মালেক দিনার আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলেন, এতদিন তিনি দুনিয়ার জন্য পাগল ছিলেন অথচ দুনিয়া তাকে ধরা দেয়নি। আর একটি রাত দুনিয়া ছেড়ে দুনিয়ার মালিকের পেছনে লেগে থাকায় আজ দুনিয়ার সবই তার পদচুম্বন করছে। হায় দুনিয়া! ধিক দুনিয়া! যাও, তোমায় আমি চিরদিনের জন্য ত্যাগ করলাম। কিন্তু তিনি আমিরের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেবেন কিভাবে? এ তো সহজ ব্যাপার নয়। মালেক দিনারের মনুষ্য জগতের অন্তঃপুরে আজ মহীয়ানের এশকের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে। তিনি লোক চক্ষুর অন্তরালে রিক্তহস্তে রাতের আঁধারে বেরিয়ে পড়লেন। আজ তিনি সে মহান সত্তার জন্য দামেস্ক ত্যাগ করছেন, যিনি কখনো তাঁর বান্দাকে ত্যাগ করেন না অথচ দুনিয়াদার ব্যক্তিকে দুনিয়া চিরদিনই ত্যাগ করে থাকে। তিনি অজানার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমালেন। দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় মালেক দিনার এক বিশাল নদীর সম্মুখীন হলেন। অন্য সকল যাত্রীর সাথে তিনি নদী পার হওয়ার জন্য নৌকায় উঠলেন। সকলের গন্তব্য জানা থাকলেও মালেক দিনারের গন্তব্য অজানা। এদিকে নৌকা তখন নদীর মাঝপথে। মাঝি সকল যাত্রীর কাছ থেকে পারাপারের ভাড়া তুলছেন। কিন্তু আল্লাহর বন্ধু মালেক দিনার, সে তো রিক্তহস্ত। ভাড়া দেওয়ার মত একটি দিনার যে তার হাতে নেই। মাঝি ঘটনা জানতে পেরে তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠল। মাঝি হাতে থাকা বৈঠা দিয়ে মালেক দিনারকে প্রহার শুরু করল। বেদম প্রহারের এক পর্যায়ে তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন। আর এ কর্মে নৌকার যাত্রীরা মৌন সম্মতি দিয়ে চলেছে। এক পর্যায়ে মালেক দিনারের জ্ঞান ফিরলে মাঝি রশি দিয়ে হাত-পা বেঁধে নদীতে ফেলে দেওয়ার কাজ শুরু করে। কিন্তু এ কি করে সম্ভব! এ যে আল্লাহর বন্ধু! মহান রাব্বুল আলামিন বিনা প্রার্থনায় স্বীয় বন্ধুর দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন। মুহূর্তেই নদী বক্ষের লক্ষ লক্ষ মাছ একটি করে স্বর্ণের দিনার মুখে নিয়ে নৌকার চারপাশ্বে ভেসে ওঠে। এই দৃশ্য চোখে না দেখলে উপলব্ধি করা কঠিন। মালেক দিনার হাত বাড়িয়ে একটি মাছের মুখ থেকে দিনারটি গ্রহণ করলেন এবং মাঝিকে তার ভাড়া মিটিয়ে দিলেন। এ দৃশ্য মাঝিসহ নৌকার সকল যাত্রীই অবলোকন করল। সবাই তখন লজ্জিত, অনুতপ্ত ও নির্বাক। অতঃপর মাঝিসহ সকল যাত্রী মালেক দিনারের কদম মোবারকে লুটিয়ে পড়ে ক্ষমা প্রার্থনা করে। আল্লাহর বন্ধুগণ পর্বতসম ধৈর্যের অধিকারী হন। মালেক দিনার তাদের ক্ষমা করে দিলেন। তারপর তিনি নৌকা থেকে নেমে পানির উপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে তীরে পৌঁছেন এবং লোকচক্ষুর অন্তরালে অদৃশ্য হয়ে যান। সেদিন থেকেই মালেক নামের সাধারণ মানুষটি হযরত মালেক দিনার (রহ.) নামে অভিহিত হন। এ মহামানবের জীবনের অন্য একদিনের ঘটনা থেকে জানা যায়, একদা মালেক দিনার একটি বৃক্ষের ছায়ায় বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। এ সময় তিনি অত্যন্ত ক্লান্ত ছিলেন। ফলে নিজের অজান্তেই নিদ্রামগ্ন হয়ে পড়েন। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেন, এ সময় একটি বিষধর সর্প নারগিস ফুলের একটি পত্রযুক্ত শাখা মুখে দিয়ে তাকে অবিরাম বাতাস করছিল।”
তাফসীরে সূফী সম্রাট দেওয়ানবাগী ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা ১২৩