যাঁকে পেয়ে ধন্য জীবন
অধ্যাপক ড. আবদুল মান্নান মিয়া
[বিশ্ব জগতের স্রষ্টা ও প্রতিপালক মহান আল্লাহ্ নিরাকার নন। তিনি আকার, তবে মহান আল্লাহ্ মানুষের মতো রক্ত মাংসের দেহধারী নন, তিনি নুরের। এই মহাসত্যটি পবিত্র কুরআন ও হাদিসের অকাট্য দলিল দিয়ে যিনি প্রমাণ করেছেন, তিনি হলেন মহান সংস্কারক, মোহাম্মদী ইসলামের পুনর্জীবনদানকারী সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহ্বুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (মা. আ.) হুজুর কেবলাজান। এটিই তাঁর শতাধিক সংস্কারের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ সংস্কার। তিনি তাঁর মহান মোর্শেদের দরবারে থাকা অবস্থায় এবং পরবর্তী সময়ে তাঁর জীবনে সংঘটিত হওয়া বহুল ঘটনাপঞ্জির মধ্য থেকে আমার দেখা, শোনা এবং জানা ঘটনাগুলো থেকে নিম্নের ঘটনা উপস্থাপন করা হলো]।
সূফী সম্রাটের নির্দেশে জিনেরা চলে গেল
মহান আল্লাহ্ ফরমান- আমি মানুষ এবং জিন জাতিকে আমার ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছি। মানুষ মাটির তৈরী কিন্তু জিন আগুনের তৈরী। মানুষের মতো জিনেরও সমাজ ব্যবস্থা রয়েছে। রাজা বাদশার অধীনে থেকে তারাও নিজেদের সমাজ জীবন পরিচালনা করে। তবে জিনদেরকে আল্লাহ্ এমন এক শক্তি দিয়েছেন যে, তারা ইচ্ছা করলে অতি ক্ষুদ্র আবার বিশাল কোনো জীবের আকার ধারণ করতে পারে।
আসলে জিনের জীবন সত্যিই বৈচিত্র্যময়। তারা দীর্ঘ জীবন লাভ করে। জিনেরা যেমন নবি-রাসুলদের যুগে তাঁদের উম্মত ছিল। অনুরূপভাবে বর্তমান এই বেলায়েতের যুগেও বহু জিন অলী-আল্লাহর ভক্ত অনুসারী রয়েছে। এই জিনদের মধ্যেও মানুষের মতো স্ত্রী ও পুরুষ রয়েছে। এদের স্ত্রীদের পরী নামে অভিহিত করা হয়। কথিত আছে-তারা দেখতে খুবই সুশ্রী হয়ে থাকে। তাইতো কোনো মেয়েকে দেখতে সুশ্রী হলে বলা হয়, মেয়েটি পরীর মতো সুন্দরী। হাদিস শরীফ থেকে জানা যায়, হযরত রাসুল (সা.)-এর জামানায় অনেক জিন সাহাবি ছিলেন। তাদের মধ্যে অনেকে এখনও বেঁচে আছেন। তাদের আয়ুষ্কাল দেড় হাজার দুই হাজার বছর পর্যন্ত হয়ে থাকে।
সুলতানিয়া মোজাদ্দেদিয়া তরিকার ইমাম সৈয়দ আবুল ফজল সুলতান আহমদ (রহ.) হুজুরের বহু জিন মুরিদান ছিল বলে জানা যায় ।
মহান সংস্কারক, মোহাম্মাদী ইসলামের পুনর্জীবনদানকারী সূফী সম্রাট হযরত দেওয়নবাগী (মা. আ.) হুজুর কেবলাজানের কাছে বহু সংখ্যক জিন মুরিদ হয়ে মোহাম্মদী ইসলামের অনুসারী তথা আশেকে রাসুলে পরিণত হচ্ছে। জিনদের নিয়ে সূফী সম্রাটের জীবনে অনেক ঘটনা রয়েছে। ১৯৮২ সালে সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান হয়রত দয়াল মা (রহ.)-কে নিয়ে ঢাকার ৯৮ আরামবাগে আশেকে রাসুল সফিউদ্দীন সাহেবের বাসায় কিছুদিন অবস্থান করেন। সেই বাসায় ১২’শ জিন ছিল। এটা অন্য কেউ জানতো না । সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান বাসায় আসার পরে সফি সাহেবকে ডেকে বললেন- আপনার বাসায় জিন আছে। সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান নিশ্চিত হয়ে ঐ জিনদের নেতার সাথে কথা বলেন। সে জানালো- ইমাম মাহ্দীর সাক্ষাৎ লাভের জন্যই তারা এখানে দীর্ঘদিন পর্যন্ত অপেক্ষা করছে । সূফী সম্রাট হুজুর কেব্লাজান তাদেরকে ঐ বাসা ছেড়ে অন্য জায়গায় চলে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। জিনেরা তখন দাবী জানালো যে, তারা মানুষ সুরত ধারণ করে, পাঞ্জাবী ও টুপি পড়ে সূফী সম্রাটের নামে ঢাকার রাজপথে শ্লোগান দিবে। সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান তাতে নিষেধ করলেন । পরবর্তীতে মহান মোর্শেদের কাছে তাদের কিছু দাবী দাওয়া ছিল। আল্লাহর মহান বন্ধু সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান তাদের দাবি দাওয়ার কথা শুনলেন এবং তা পূরণ করে তাদেরকে চলে যেতে বললেন । মোর্শেদের নির্দেশ পেয়ে ঐ ১২’শ জিন সফি সাহেবের বিল্ডিং ছেড়ে চলে যায়।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ১৯৮৬ সালে ঢাকার একটি নামকরা মাদ্রাসার একজন মোহাদ্দেস আরামবাগে সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজানের সঙ্গে দেখা করতে এলেন। তিনি সূফী সম্রাট দেওয়ানবাগী হুজুর কেবলাজানের সাথে আলাপ করার এক পর্যায়ে দারূণভাবে কাঁদতে কাঁদতে বলেন- হুজুর! আমার এক পুত্রবধুকে জিন আসর করেছে। যারা জিন ছাড়ায় এমন লোকের কাছ থেকে তদবির নিয়েছি কিন্তু কিছুতেই কাজ হচ্ছে না, জিন ছাড়ানো যাচ্ছে না। এখন আমার সংসারে চরম অশান্তি বিরাজ করছে। এ থেকে রক্ষা পাওয়ার কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছি না। এ কথা বলেই মোহাদ্দেস সাহেব পুনরায় কাঁদতে লাগলেন। তখন সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান বললেন- এত বড়ো আলেম আপনি, ছাত্রদের হাদিস পড়ান, জিন ছাড়াতে পারছেন না? সূফী সম্রাটের জবানীতে একথা শুনে মোহাদ্দেস সাহেব নীরব রইলেন। কোনো কথা বললেন না। সূফী সম্রাট দেওয়ানবাগী হুজুর আরো বললেন- জিনে ধরা রোগীর কাছে গিয়ে আমার নাম বললে, জিন ছেড়ে চলে যায়। এ কথার বাস্তব প্রমাণ দিয়েছেন -দেওযানবাগ শরীফের ওলামা মিশনের সদস্য আশেকে রাসুল হয়রত আতাউর রহমান চাঁদপুরি। তিনি যখন সাভার নবীনগর খানকা শরীফের ইমাম ছিলেন, সে সময়কার একটি ঘটনা আমাকে জানালেন যে, সাভারের কোনো এক বাড়িতে একটি মেয়েকে জিনে ধরেছে, অনেক তদবির ও তাবিজ কবজ করেছে, কিন্তু তাতে কোনো ফল হয়নি। অতঃপর জনৈক ব্যক্তি মাওলানা আতাউর রহমান চাঁদপুরিকে ঐ বাড়িতে নিয়ে গেলেন। তিনি ঐ জিনকে লক্ষ্য করে বললেন- হে জিন ! সূফী সম্রাটর দোহাই, এই রোগিকে ছেড়ে চলে যা। তা না হলে আমি সূফী সম্রাট দয়াল বাবাজানের কাছে তাঁর বিরুদ্ধে নালিশ দেবো । এই কথা বলা মাত্রই, জিন চিৎকার করে বলে উঠলো- আমি মাফ চাই; সূফী সম্রাট হুজুরের কাছে আমার বিরুদ্ধে নালিস দিবেন না। তা হলে আমি ধ্বংস হয়ে যাব। আমি এখনি এই রোগিকে ছেড়ে চলে যাচ্ছি। আশ্চর্য়েব বিষয়! এই কথা বলে জিন রোগিকে ছেড়ে চলে যায় এবং ঐ মেয়েটি সম্পূর্ন সুস্থ হয়ে যায় ।
সূফী সম্রাটের প্রতি আজরাইলের সম্মান প্রদর্শন
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ্ ফরমান ‘কুল্লু নাফসীন জায়েকাতুল মাউত’। অর্থাৎ- সকল প্রাণীকেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। মানুষের জন্মের সাথে রয়েছে মৃত্যুর সম্পর্ক। এ পৃথিবীতে একটি চিরন্তন সত্য হচ্ছে মৃত্যু। আমরা প্রত্যেকেই জানি, জন্ম যখন নিয়েছি তখন মৃত্যু আমাদের অনিবার্য। আর এই চিরন্তন ধারাটি জগতে চলছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত চলবে।
মহান আল্লাহ্ তাঁর সৃষ্টিজগত পরিচালনার জন্য অসংখ্য ফেরেস্তা সৃষ্টি করেছেন। তাদের মধ্যে ৪ জন সর্বশ্রেষ্ঠ। তারা হলেন- আজরাইল, জিব্রাইল , মিকাইল ও ইস্রাফিল। আজরাইলের নাম জানে না এমন মানুষ জগতে নেই। কারণ আজরাইল মানুষের প্রাণ সংহার করে। সে বিকট চেহারা নিয়ে মানুষের সামনে এসে হাজির হয়। তার রুদ্রমূর্তি দেখলে মানুষের আন্তরাত্মা কেঁপে উঠে। তবে যারা আল্লাহ্ওয়ালা, আল্লাহর অলীদের সান্নিধ্যে গিয়ে সাধনার মাধ্যমে মহান আল্লাহ্ ও হযরত রাসুল (সা.)-এর দিদার ও নৈকট্য লাভ করেছেন, তাঁদের মৃত্যুর সময় আজরাইল স্বাভাবিক ও সুন্দর চেহারা নিয়ে সামনে হাজির হয় এবং শিশু যেমন মায়ের কোলে দুধ পান করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ে, ঠিক তদ্রূপ, কোনো নেককার ব্যক্তির মৃত্যুও শান্তভাবে সংঘটিত হয়ে থাকে। মানুষের মৃত্যুর সময় এলেই আজরাইল জান কবজ করে তা কার্যকরী করে থাকে। তবে আল্লাহর প্রেরিত নবি-রাসুল ও অলী আল্লাহ্গণের জান কবজ করার পূর্বে আজরাইল তাঁদের অনুমতি নিয়ে থাকে, এমন অনেক ঘটনা আমরা শুনতে পেয়েছি। তবে কোনো অলী-আল্লাহর মুরিদ সন্তানের জান কবজ করার জন্য আজরাইল এসে তার মোর্শেদের অনুমতি প্রার্থনা করে, এমন ঘটনা ইতিপূর্বে শুনে থাকলেও বাস্তবে তা দেখার সুযোগ আমার হয়েছে।
ঘটনাটি ঘটেছে ১৯৮৫ সালের ৪ঠা জানুয়ারি, শুক্রবার। সূফী সম্রাট হযরত দেওয়ানবাগী (মা. আ.) হুজুর কেবলাজান তখন ১৫৪ আরামবাগ, ঢাকায় থাকতেন। বর্তমান শরীয়তপুরের চরচান্দা নামক স্থানে এক বিরাট ওয়াজ মাহ্ফিলের আয়োজন করা হয়। সেখানকার মানুষ সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহ্বুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (মা. আ.) হুজুর কেবলাজান তাদের এলাকায় শুভাগমনের খবর পেয়ে অত্যন্ত আনন্দিত হন। ঢাকার সদরঘাট থেকে লঞ্চ রিজার্ভ করা হয়েছে সূফী সম্রাটের জন্য। সফরসঙ্গী হিসেবে আমিও সূফী সম্রাটের সাথে রিজার্ভ লঞ্চের কেবিনে বসাছিলাম। সকাল ৮ টার দিকে সদরঘাট থেকে লঞ্চটি চরচান্দার উদ্দেশ্যে ছেড়ে দিল। আমরা যথাসময়ে চরচান্দা লঞ্চঘাটে পৌঁছে গেলাম। সেখানে বিপুল পরিমাণ মানুষ সূফী সম্রাটকে স্বাগত জানানোর জন্য জমায়েত হয়েছেন। তারা আল্লাহর মহান বন্ধু সূফী সম্রাটকে তাদের মাঝে পেয়ে যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছেন। তাদের মনে আনন্দ যেন আর ধরে না । জনগণ লঞ্চঘাটে এসে বিশাল মিছিল করে সূফী সম্রাটকে নিয়ে, শ্লোগান দিতে দিতে এলাকার বিশিষ্ট ব্যক্তি ডা. কবিরের বাড়িতে এসে পৌঁছলো। সূফী সম্রাট দয়াল বাবাজান যথেষ্ট পরিশ্রম করে যখন গন্তব্যস্থলে পৌঁছলেন, তখন তাঁকে বিশ্রামের জন্য আলাদা ঘরে থাকার ব্যবস্থা করা হয়। সূফী সম্রাট হুজুর যথারীতি দুপুরের খাবার খেয়ে বিশ্রাম করছেন, এদিকে আমরাও দুপুরের খাবার খেয়ে কিছুটা বিশ্রাম করার জন্য প্রস্তুতি নিলাম। বিভিন্ন এলাকায় সূফী সম্রাটের আগমন বার্তা পৌঁছে গেলো। আস্তে আস্তে লোকজন এসে জড়ো হতে লাগলো। বিকেলে দয়াল বাবাজান লোকদের সাথে তরিকার আলাপ করলেন। সকলেই যেন তাঁর কথা শুনে মন্ত্র মুগ্ধের মতো নীরব হয়ে সূফী সম্রাটের দিকে তাকিয়ে রইলো। সন্ধ্যা হলো এবং আস্তে আস্তে রাত গভীর হতে চললো। আমরা রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। শেষ রাতে রহমতের সময় আমরা ঘুম থেকে উঠে তরিকার নিয়ম অনুযায়ী মোরাকাবায় বসলাম।
রহমতের ফায়েজ বাতানোর সময় আবু সাঈদ নামে একজন জাকের ভাই অর্ন্তদৃষ্টিতে দেখতে পেলেন, একটা নৌকায় করে মালাকুল মউত হযরত আজরাইল (আ.) দরজায় এসে বলছেন, কবির ডাক্তারের হায়াত শেষ। আমি গতকাল তার রূহ কবজ করতে এসেছিলাম। কিন্তু সে তখন কান্নাকাটি করে বলেছিল, “আগামীকাল আমার মহান মোর্শেদ সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান আমার বাড়ীতে আসবেন। তাঁর নুরানিময় চেহারা মোবারক দেখার আগে আপনি আমাকে নিবেন না।” সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজানের দোহাই দেওয়াতে গতকাল তার জান কবজ করা হয়নি। এখন আমি কবির ডাক্তারকে নিয়ে যেতে হুজুর কেবলাজানের অনুমতি চাইছি। মালাকুত মউতকে দেখে ওই জাকের ভাই জজ্বাহ্র বেখুদি অবস্থায় চিৎকার করতে করতে সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান যে ঘরে অবস্থান করছিলেন, ওই ঘরের দরজায় সজোরে ধাক্কা দিতে শুরু করেন। তাঁর চিৎকার শুনে সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান দরজা খুলে বাইরে বের হলেন। এদিকে ওই বাড়ীর সকল লোকজনও সেখানে ছুটে যান। তখন ওই জাকের ভাই সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজানকে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, মালাকুল মউত কবির ডাক্তারের জান কবজ করতে এসেছে। সে আপনার অনুমতি চায়।
ঘটনাটি আরো সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করছি। ডা. কবিরের বাড়ীতে আমরা রহমতের সময় মোরাকাবা রত অবস্থায় ছিলাম। এমন সময় আমাদের পিছনের সারিতে বসা ছিলেন আবু সাঈদ ভাই। আমরা ঢাকা থেকে দয়াল বাবাজানের সাথে একত্রে রিজার্ভ লঞ্চে গিয়েছি। আমাদের সাথে দরবার শরীফের তখনকার ম্যানেজার বদরুজ্জামান সাহেব ও মুক্তিযোদ্ধা খোরশেদ আলম ভাইও ছিলেন। রহমতের ফায়েজ তখনো শেষ হয়নি। হঠাৎ পিছনের সারিতে বসা আবু সাঈদ ভাই পিছন থেকে পাখির মতো উড়ে ‘বাবা বাবা’ বলে চিৎকার দিতে দিতে নামাজ কক্ষ ত্যাগ করে বাইরে চলে গেলেন। শুধু তাই নয়, সূফী সম্রাট যে ঘরে শায়িত আছেন, আবু সাঈদ ভাই পূর্ণ জজবাহ হালতে সেখানে গিয়ে ঘরের বাহির থেকে টিনের বেড়ার উপর সজোরে ধাক্কা দিতে লাগলেন। তার চিৎকার ও বেড়া ধাক্কানোর শব্দে সূফী সম্রাট দয়াল বাবাজান দরজা খুললে আবু সাঈদ চিৎকার করে বলতে লাগলেন- বাবা! ঐ দেখেন, বাড়ীর দক্ষিণ দিক খালের পাড়ে নৌকায় বসে আজরাইল বড়ো বড়ো চোখ মেলে তাকিয়ে আছে। সে বলছে- আমি কবিরের জান কবজ করতে এসেছি। এখন হুজুর কেবলাজানের অনুমতি চাইছি। তাঁর নির্দেশ পেলেই আমি কবিরের জান কবজ করে নিয়ে যাব। আবু সাঈদ ভাই যখন চিৎকার করে বারবার সূফী সম্রাটের সামনে একথাগুলো বলছিলেন। তখন সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান ডাক্তার কবিরকে ডাকতে বললেন। আবু সাঈদের চিৎকার এবং আজরাইল বাড়ীতে প্রবেশ করার জন্য অপেক্ষায় আছে, একথা শুনে আমিও সূফী সম্রাটের রুমের সামনে হাজির হয়েছি। এরই মধ্যে ডা. কবির মহান মোর্শেদ সূফী সম্রাটের কাছে এসে উপস্থিত হলেন। সূফী সম্রাট তাকে লক্ষ্য করে বললেন- কবির মিয়া! কি হয়েছে? সমস্ত ঘটনা আমাকে খুলে বলুন। আমার সামনেই ডা. কবির সূফী সম্রাট দয়াল বাবাজানের কদম মোবারক জড়িয়ে ধরে বলতে লাগলেন- বাবা! গতকাল সকালে আমি মারাত্মকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ি। মনে মনে ভাবলাম, এই বুঝি আমার জীবন শেষ হয়ে যাবে। এমন সময় আমি আজরাইলকে আমার সামনে দাঁড়ানো দেখে ভয়ে আতকে উঠলাম। তখন তাকে বললাম- আমার মোর্শেদ আজ আমার বাড়ীতে আসবেন, আমি তাঁকে একনজর দেখতে চাই। একটু সময় দিলে দয়াল মোর্শেদকে একনজর দেখলেই আমার জীবন সার্থক হবে। আমি একথা বলে যখন আজরাইলকে অনুরোধ করলাম, আল্লাহর কি ইচ্ছা- আজরাইল চলে গেল। আমি তখন থেকে সুস্থ হতে লাগলাম। আপনি আসার পর আমার কোনো রকমের রোগ যন্ত্রণা অথবা শারীরিক কষ্ট নেই। আমি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে গেলাম। একথা শুনে সূফী সম্রাট দয়াল বাবাজান বললেন- আপনার এমন একটা কঠিন অবস্থা গেল, আজরাইলকে দেখলেন, কিন্তু কই! আমাকেতো কিছুই জানালেন না। এই অবস্থায় আবু সাঈদ ভাই বললেন- ঐ যে আজরাইল চলে যাচ্ছে। অতঃপর সূফী সম্রাট সবাইকে নিজ নিজ কাজে যেতে বললেন। কেননা, আজ বিকালে চরচান্দা বাজারে বিশাল জনসভা অনুষ্ঠিত হবে। আর তাতে বক্তব্য রাখবেন- সূফী সম্রাট দয়াল বাবাজান। সারাদিনভর প্যান্ডেল তৈরীর কাজ, মাইক বাঁধা, স্টেজ তৈরীসহ সকল কাজ চলছে দ্রুত গতিতে। অনেক বড়ো অনুষ্ঠান, তাই আলোর জন্য জেনারেটরের ব্যবস্থা করা হয়েছে। যথারীতি বাদ আছর ওয়াজ মাহ্ফিলের কাজ শুরু হলো। আমি অনুষ্ঠান পরিচালনার দায়িত্বে ছিলাম। সূফী সম্রাটের সম্মানে এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে মানপত্র তৈরি করা হলো। বাদ মাগরিব সূফী সম্রাট দয়াল বাবাজানকে বহুসংখ্যক লোক মিছিল করে মাহ্ফিলেরর স্টেজে নিয়ে গেল। সূফী সম্রাট তাঁর জন্য রাখা কুরসি মোবারকে তশরিফ গ্রহণ করলেন। তাঁকে শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ করার জন্য লেখা মানপত্র পাঠ করে শোনালেন ডাক্তার কবির ভাই। আল্লাহর কি অপার মহিমা, একদিন আগে যে ব্যক্তি মারাত্মক অসুস্থ হয়ে আজরাইলকে পর্যন্ত দেখতে পেলেন, সেই ব্যক্তি অর্থাৎ ডা. কবিরই সূফী সম্রাটের উদ্দেশ্যে লেখা মানপত্র পাঠ করেন।
সূফী সম্রাট দয়াল বাবাজান চরচান্দা মাহ্ফিলে আসবেন একথা শুনে বৃহত্তর ফরিদপুরের বিভিন্ন উপজেলা এমনকি গ্রামগঞ্জ থেকেও প্রায় ১০/১২ হাজার লোক মাহ্ফিলে যোগদান করেন। সূফী সম্রাট দয়াল বাবাজানের অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী ফায়েজপূর্ণ ওয়াজ শুনে উপস্থিত সকল মানুষই একেবারে নীরব, নিস্তব্ধ হয়ে তাঁর বক্তব্য শুনেছেন। সূফী সম্রাটের মহামূল্যবান বাণী মোবারক শুনে উপস্থিত সকলেই এমনভাবে নিশ্চুপ হয়ে গেলেন, যেন পিনপতন নীরবতা নেমে এলো। মাহ্ফিল ও মোনাজাত শেষ করার পরে যখন লোকদেরকে তরিকা নেওয়ার জন্য ডাকা হলো- তখন সহস্রাধিক মানুষ এগিয়ে এসে সূফী সম্রাটের কাছে তরিকা গ্রহণ করলেন। সেদিন গোটা চরচান্দা এলাকা জুড়ে সর্বমহলে সূফী সম্রাট দেওয়ানবাগী দয়াল বাবাজানের প্রশংসা চলছিল। চরচান্দায় সূফী সম্রাটকে নিয়ে যে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল, তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। অনুষ্ঠানের পরের দিন আমরা ঢাকায় ফিরবো। পুনরায় লোকজন জড়ো হয়েছে। তারা সূফী সম্রাটকে বিদায় দিতে চাচ্ছে না। রিজার্ভ লঞ্চ প্রস্তুত। সূফী সম্রাট দয়াল বাবাজান এবং সফর সঙ্গী হিসেবে আমরা যারা ছিলাম, আমাদের জন্যও খাবার রান্না করে লোকজন অনেক দূর পর্যন্ত পায়ে হেঁটে লঞ্চে খাবার পৌঁছিয়ে দিয়েছেন। সূফী সম্রাট হুজুর কেব্লাজানকেও দীর্ঘপথ পায়ে হেঁটে লঞ্চঘাটে আসতে হয়েছে। সূফী সম্রাট লঞ্চে আসার পর আস্তে আস্তে লোকজন লঞ্চ ঘাটের চারিদিকে দাঁড়িয়ে যায়। সূফী সম্রাট হুজুর কেব্লাজানের সম্মানে রাস্তায় দাঁড়ানো হাজার হাজার মানুষ তাঁকে বিদায়ী সংবর্ধনা জানাতে গিয়ে মুহুর্মূহূ শ্লোগান দিয়ে আকাশ বাতাস মুখরিত করে তোলে। যথাসমসয়ে লঞ্চ ছেড়ে দেওয়া হলো। এ অবস্থা দেখে আমাদেরও বেশ খারাপ লেগেছিল। কারণ চরচান্দার মানুষগুলো যেন দুই দিনেই আমাদের অতি আপনজনে পরিণত হয়েছে। লঞ্চ নদীতে চলছে, কিন্তু যতদূর চোখে দেখা যাচ্ছিল , সবাই নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে লঞ্চের গতিবিধি লক্ষ্য করছিল। যাই হোক, বিকেল বেলা আমরা ঢাকার সদরঘাটে এসে পৌঁছি। সন্ধ্যার পূর্বেই আরামবাগে পৌঁছে গেলাম। আমি রাতেই মিরপুরের বাসায় চলে যাই। চরচান্দার ঘটনা সবার মনেই একটা দারুণ প্রেম ভালোবাসার সঞ্চার করেছে।
একবছর পরের ঘটনা। আমি মিরপুর থেকে আরামবাগ দরবার শরীফে এলাম। এমন সময় দেখি ডা. কবির ভাইও আরামবাগে উপস্থিত। আমাকে দেখেই তিনি এগিয়ে এলেন এবং বলতে লাগলেন- মান্নান ভাই! আমাদের বাড়ীতে বাবাজানের সাথে আপনিও গিয়েছিলেন। আমার জান কবজ করতে আজরাইল এসেছিল। বাবাজানের দয়ায় আজরাইল ফিরে যায়। আর আমি বেঁচে যাই। এখন মাত্র ১ বছরের মধ্যে আবার আমার শারীরিক অবস্থা অত্যন্ত খারাপ হয়ে পড়ে। তাহলে বাবাজান কি আমাকে মাত্র ১ বছরের জন্য হায়াত বাড়ালেন? কিছুক্ষণের মধ্যে বাবাজান তাঁর হুজরা শরীফে এসে কুরছি মোবারকে বসলেন। আমি বাবাজানের সাথে দেখা করতে গেলে বাবাজান বললেন- ডা. কবির মিয়া আমার এখানে এসেছে। সে মিরপুরে থাকে এবং সেখানে বসে নাকি হাড় ভাঙ্গার চিকিৎসা করে। আবার হায়াতের দোষ দেখা দিয়েছে। এখন তার ভাইয়েরা আমার এখানে রেখে চলে গেছে। একথা বলার কিছুক্ষণের মধ্যেই ডা. কবিরও বাবাজানের কাছে এলেন। তার অবস্থা তেমন ভালো নয়। খুবই অসুস্থ। তাকে দেখে দয়াল বাবাজান বললেন- কবির মিয়া! আপনাকে যে আল্লাহ্ মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করলেন, একটি বছর বেঁচে রইলেন, আপনি আল্লাহর জন্য কী করেছেন? এখন দেখি দুনিয়াদারী কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। একথা শোনার পরে কবির ভাই খুবই আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন এবং বলেন- বাবাজান! আপনি দয়া করে আমাকে মাফ করে দিন। আমি আর দুনিয়াদারী কাজে জড়াবো না। আমি তরিকা প্রচারের কাজ করবো। কবির ভাই এভাবে যখন বাবাজানের কাছে ক্ষমা চাইলেন- বাবাজান তাকে বললেন, যান মিয়া! সব সময় আল্লাহ্কে স্মরণ রাখবেন। আল্লাহ্ই দয়া করবেন। মোর্শেদের সাথে সাক্ষাৎ করে ক্ষমা চাওয়ার পর থেকে ডা. কবির ভাই সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠলেন। তিনি ঢাকা ছেড়ে দেশের বাড়ীতে চলে গেলেন এবং তরিকা প্রচারের কাজে আত্মনিয়োগ করলেন। এ ঘটনার পরে কবির ভাইকে যখনই দরবার শরীফে আসতে দেখেছি, তখনই শুনেছি এলাকা হতে লোক নিয়ে বাবাজানের সাথে সাক্ষাৎ করতে এসেছেন। সূফী সম্রাটের দয়ায় যেদিন আজরাইল চলে গেল, তার পরে সুস্থ হয়ে ডা. কবির ভাই আরো প্রায় ২২ বছর বেঁচে ছিলেন। এরপরে তার মৃত্যু হয়। আসলে সূফী সম্রাট হযরত দেওয়ানবাগী দয়াল বাবাজান এমনই একজন মহামানব, যাঁর ভক্ত মুরিদান যে কোনো সমস্যায়ই পড়ুক না কেন, তিনি তা থেকে তাকে উদ্ধার করে থাকেন। ডা. কবিবের ঘটনাই তার জ্বলন্ত প্রমাণ।
[লেখক: ভাইস প্রিন্সিপাল, জাতীয় আইন কলেজ, ঢাকা]