আশেকে রাসুলেরা অলৌকিকভাবে মৃত্যুকূপ থেকে বেঁচে গেলেন
আশেকে রাসুল মো. শফিউদ্দীন, ঢাকার মতিঝিলের আরামবাগে বসবাস করেন। ঘটনাটি ১৯৮৯ খ্রিষ্টাব্দের। তার মহান মোর্শেদ, যুগের ইমাম, সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহবুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (মা. আ.) হুজুর কেবলাজান ১ম বিশ্ব সূফী সম্মেলনের আহ্বান করেন। সেই লক্ষ্যে মহান মোর্শেদের নির্দেশে দেশে বিদেশে বিশ্ব সূফী সম্মেলনের প্রস্তুতিকল্পে পরামর্শ সভার আয়োজন করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় মহান মোর্শেদ সূফী সম্রাট দেওয়ানবাগী (মা. আ.) দয়াল বাবাজান নরসিংদী জেলার চালাকচরে সেখানকার জাকের ভাইদের নিয়ে একটি পরমার্শ সভা করার নির্দেশ দেন। উক্ত পরামর্শ সভায় দরবার শরীফের পক্ষ থেকে আশেকে রাসুল শফিউদ্দীন-সহ আরো চারজন জাকের ভাইকে যাওয়ার জন্য দয়াল বাবাজান নির্দেশ প্রদান করেন। আর তারা হলেনÑ আশেকে রাসুল অধ্যাপক ড. আব্দুল মান্নান মিয়া, আশেকে রাসুল সৈয়দ মো. শাহ আলম, আশেকে রাসুল লুৎফুর রহমান ফরিদপুরী এবং আশেকে রাসুল হাজী রকিবুল্লাহ। এদিকে নির্দিষ্ট দিনে পরামর্শ সভায় যোগদানের উদ্দেশ্যে হাজী রকিবুল্লাহর প্রাইভেট গাড়িতে তারা রওনা হলেন। গাড়িটি হাজী রকিবুল্লাহ নিজেই চালাচ্ছিলেন। কিন্তু সমস্যা হলো নরসিংদী যাওয়ার রাস্তা তাদের পরিচিত হলেও চালাকচরের ভিতরের রাস্তা তাদের পূর্বপরিচিত ছিল না। এদিকে নরসিংদী শহর এলাকা অতিক্রম করার পর হঠাৎ করেই গাড়ির গতি কমতে শুরু করলো। হাজী রকিবুল্লাহ জানালেন, গাড়ি পিকআপ নিচ্ছে না। গাড়ির গতি এতটাই কমে গেলো যে, এ গাড়ি নিয়ে চালাকচরে পৌঁছা সম্ভব নয়। উপায়ান্তর না দেখে তারা অনেক কষ্টে গাড়ি নিয়ে নরসিংদী শহরের একটি গ্যারেজে গেলেন। এদিকে লুৎফুর রহমানকে বাসযোগে পাঠিয়ে দিলেন, যেন সে পরামর্শ সভার কাজ যথাসময়ে শুরু করতে পারে। আর তারা গাড়ি ঠিক করে নরসিংদী শহর থেকে পুনরায় চালাকচরের উদ্দেশ্যে রওনা করলেন। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, পূর্বে যে স্থানে গাড়িটি নষ্ট হয়েছিল সেই একই স্থানে গাড়িটি পুনরায় একই রকম সমস্যা শুরু করলো। এর ফলে পরামর্শ সভায় পৌঁছতে পারবে কিনা সে ব্যাপারে তারা দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন। এ কঠিন অবস্থায় তারা আল্লাহর সাহায্য পাওয়ার আশায় মানত করলেন এবং মহান মোর্শেদের চেহারা মোবারক স্মরণ করে আজিজি করতে শুরু করলেন। কিন্তু কোনো ফল হলো না। আশেকে রাসুল শফিউদ্দীন মানতের পরিমাণও বাড়িয়ে দিলেন। এদিকে তাদের গাড়ি তখন বিশ্বরোড পার হয়ে মনোহরদীর পথে থাকার কারণে যান চলাচলও তেমন একটা দেখা যাচ্ছিল না। আর মানুষের চলাচলও ছিল খুবই সীমিত। তাদের দুশ্চিন্তার যেন শেষ নেই। যাত্রাপথের এ বিপদ কতটাই যে অশান্তির, ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ জানে না। এদিকে মনোহরদীর পথে কিছুদূর অগ্রসর হওয়ার পর হঠাৎ করেই গাড়ির স্টার্ট বন্ধ হয়ে গেলো। ইঞ্জিন কোনো কাজ করছে না। তারা সবাই গাড়ি থেকে নামলেন। হাজী রকিবুল্লাহ বললেন, ‘আর কিছুই করার নেই। সত্যিই আমরা মহাবিপদে পড়ে গেলাম।’ এমন সময় উঠতি বয়সের একটি যুবক দূর থেকে তাদেরকে লক্ষ্য করে ছুটে আসল, যুবকটি জানতে চাইলো তাদের গাড়ির কী সমস্যা? সমস্যা জানার পর সে বলল, ‘আপনারা বললে আমি একটু চেষ্টা করে দেখতে পারি, আমি একজন মেকানিক।’ আর তারাও এমনটি চেয়েছিলো। তারপর যুবকটি গাড়ির ইঞ্জিনের কভার উঠিয়ে সমস্যাটি চিহ্নিত করার চেষ্টা করল। তারা জিজ্ঞেস করলো, সমস্যা কি? যুবকটি সন্তোষজনক কোনো উত্তর দিতে পারলো না এবং কোনো ফলাফলও দিতে পারলো না। তবে গাড়িটি স্টার্ট নিলো এবং পূর্বের ন্যায় খুবই ধীর গতিতে চলা শুরু করলো। কিন্তু তাদের অস্বস্তিকর অবস্থার মোটেও অবসান হলো না। মনোহরদীর রাস্তাঘাট তাদের কাছে একেবারেই নতুন, কিছুই চিনে না, শুধু এতটুকু জানে এটি মনোহরদীর রাস্তা।
এদিকে তাদের গাড়ি যখন খুবই ধীরগতিতে চলছে তখন অনতিদূরেই ছিল একটি ভাঙ্গা ব্রিজ। কোনো যান চলাচল তো দূরের কথা মানুষের পক্ষেও এ ব্রিজ পার হওয়া সম্ভব নয়। ভাঙ্গা এ ব্রিজের নিচে ৩০ থেকে ৪০ ফুট গভীর গর্ত। তার মধ্যে আবার অথৈ পানি। স্থানীয় লোকেরা ভাঙ্গা ব্রিজের পাশ দিয়ে নির্মিত বিকল্প পথে চলাফেরা করে। তারা নতুন হওয়ায় এ বিকল্প রাস্তা সম্পর্কে কিছুই জানে না। উপরন্ত রাত হওয়ায় চর্তুদিকেই ছিল ঘোর অন্ধকার। হাজী রবিবুল্লাহ সোজা পথেই গাড়ি চালাচ্ছিলেন। যেইমাত্র তারা ব্রিজের কাছাকাছি চলে এসেছে, তখনও রাস্তার এ বেহাল অবস্থা তাদের কাছে পরিষ্কার ছিল না। ব্রিজের মুখোমুখি গর্তের প্রান্তে উপনীত হয়ে হাজী সাহেব অনেকটা অস্বাভাবিকভাবেই গাড়ির ব্রেক করলেন। তারা বললেন কি হয়েছে? এ কথা বলে তাকানো মাত্রই লক্ষ্য করলেন, সামনেই ছিল তাদের জন্য মৃত্যুকূপ। গাড়িটি ব্রেক করতে যদি আর এক মুহুর্তকাল বিলম্ব হতো তবে নিশ্চিত তারা পাঁচজন প্রাণ হারাতেন আর গাড়িও চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যেত। ঘটনার ভয়াবহতা প্রত্যক্ষ করে তাদের আর বুঝতে বাকি রইল না মহান মোর্শেদের বরকতে আল্লাহ তাদেরকে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করেছেন। তারা লক্ষ্য করলেন গাড়িটি যদি পথিমধ্যে নষ্ট না হয়ে স্বাভাবিক গতিতে চলতো তবে কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই তাদের গাড়ি গর্তে পড়ে যেত। কারণ যে গতিতে গাড়ি ইতিপূর্বে ঢাকা থেকে ছুটে আসছিল সে গতিকে নিয়ন্ত্রণ করা কিছুতেই সম্ভব ছিল না। অবস্থা এতটাই ভয়াবহ ছিল যে, এলাকাটি জনমানবশূন্য, দুর্ঘটনার শিকার হলে হয়তো বা তাদের মৃত্যুর খবরও কেউ পেত না। এদিকে গাড়ির গতি বাড়ানোর জন্য যে মানত ও আজিজি করেছিলেন মহান মোর্শেদ যদি তা কবুল করতেন তবে নিশ্চিত দুর্ঘটনার শিকার হতেন। আসলে আল্লাহর চরিত্রে চরিত্রবান তাঁর বন্ধুগণও যে সূক্ষ্মদর্শী তার জীবন্ত প্রমাণ তারা প্রত্যক্ষ করলো। এ ঘটনায় তারা কেউই চোখের পানি ধরে রাখতে পারেনি। বারবার তারা আল্লাহ ও তাঁর বন্ধুর কদমে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছিলেন।
তারপরের ঘটনা বাস্তবতা উপলব্ধি করতে তাদেরকে আরো সাহায্য করলো। আর তা হলোÑ তারা বিকল্প সড়ক ব্যবহার করে মনোহরদীর পরামর্শ সভায় পৌঁছলেন এবং গভীর রাত পর্যন্ত পরামর্শ সভার কর্মসূচি সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে একে একে সম্পন্ন করলেন। তারপর ঐ রাতেই তারা আবার ঢাকায় ফিরে আসলেন। পথিমধ্যে গাড়ির আর কোনো সমস্যা নেই, গাড়ির মন্থর গতি নেই, সবকিছুই স্বাভাবিক এবং ঠিকমত চলল। কোনো অজানা কারণে গাড়ির গতি কমে গিয়েছিল আবার কোনো অজানা কারণে গাড়ি স্বাভাবিক হলো, আর কেনইবা মানত ও আজিজি কবুল হলো না, সূক্ষ্মদর্শী আল্লাহর এ অপার দয়ার রহস্য সেদিন আর তাদের কাছে গোপন ছিল না। এদিকে পরামর্শ সভা শেষ করে পরের দিন তারা মহান মোর্শেদের পরশময় কদম মোবারকে হাজির হলেন। উদ্দেশ্য মহান মোর্শেদের নির্দেশে যে পরামর্শ সভায় গিয়েছিলেন তার বিষয়বস্তু জানানো। আসলে সর্বদ্রষ্টা আল্লাহ যে মোর্শেদকে প্রয়োজনীয় সবই জানিয়ে দেন তারও প্রমাণ পেলেন। তারা হুজরা শরীফে মহান মোর্শেদের কদম পাকে হাজির হওয়া মাত্রই মহান মোর্শেদ আশেকে রাসুল শফিউদ্দীনকে লক্ষ্য করে বললেনÑ ‘কি মরার জন্য মানত করেছিলেন নাকি?’ মহান মোর্শেদের এ কথা শুনে তারা সবাই বাবাজানের কদম মোবারকে লুটিয়ে পড়লেন এবং তাদের ভুল বেয়াদবির জন্য ক্ষমা চাইলেন। তখন দয়াল বাবাজান বললেন, আমার সমস্ত শরীর ব্যাথা হয়ে গেছে, মানতের একটা অ্যাকশন আছে না। বাবাজান বললেন, “যেহেতু আপনারা আমার নির্দেশে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের ধর্মের কাজে গিয়েছিলেন, সেহেতু বিপদ-আপদে আল্লাহর সাহায্য পাওয়ার কথা। আর আল্লাহ করেছেনও তাই। কারণ আপনাদের জানা ছিল না সামনে আপনাদের জন্য ভয়াবহ বিপদ অপেক্ষা করছে। কিন্তু সূক্ষ্মদর্শী আল্লাহ তা দেখেছেন, তাই তিনি আপনাদের গাড়ির গতি কমিয়ে দিয়েছেন। এদিকে আপনারা যখন গাড়ির গতি বাড়ানোর জন্য মানত করে আজিজি শুরু করে দিয়েছেন তখন বিষয়টি আল্লাহর পক্ষ থেকে আমাকে জানানো হয়েছে। আপনাদের এ মানতের অ্যাকশন ফেরাতে গিয়ে আমি তো প্রায় অসুস্থই হয়ে পড়েছি।” মহান মোর্শেদের পাক জবানে এ কথা শুনে তারা আবারো তাদের ভুল বেয়াদবির জন্য ক্ষমা ভিক্ষা চাইলেন। এ ঘটনায় তাদের আর বুঝতে বাকি রইলো না যে, সূক্ষ্মদর্শী আল্লাহ মোর্শেদের মাধ্যমে কিভাবে তাদেরকে সাহায্য করেছেন।