সূফী সম্রাট দেওয়ানবাগী মানুষকে সিরাতুল মুস্তাকিমের পথ দেখান
আশেকে রাসুল এস এ সুলতান
যুগে যুগে পথহারা মানুষকে আলোর পথ, সিরাতুল মুস্তাকিমে পরিচালিত করার জন্য মহান রাব্বুল আলামিন তাঁর মনোনীত মহামানবদের প্রেরণ করেন। এই মহামানবগণ আল্লাহর নুরের আলোতে আলোকিত তাই তাঁরা অন্ধাকারে নিমজ্জিত মানুষকে, তাঁদের হৃদয়ের আলো তথা নুরে মোহাম্মদীর নুর দ্বারা হেদায়েতের পথে পরিচালিত করেন। এ সমস্ত মহামানব নবুয়তের যুগে নবি-রাসুল ও বেলায়েতের যুগে ইমাম, মোজাদ্দেদ হিসাবে পরিচিত। যারা তাঁদের সিনা মোবারকে ধারণ করা নুরে মোহাম্মদীর নুর দ্বারা পথহারা মানুষকে আলোর পথে তুলে আনেন এবং তাদেরকে চির শান্তির পথে পরিচালিত করেন। আল্লাহ যাদের খাস দয়া করেন তারা আল্লাহর মনোনীত নুরে মোহাম্মদীর ধারক বাহক মহামানবগণের পরিচয় লাভ করে হেদায়েতের পথে পরিচালিত হতে সক্ষম হন।
বর্তমান জামানার ইমাম, মোজাদ্দেদ, নুরে মোহাম্মদীর ধারক ও বাহক হচ্ছেন, আমাদের মহান মোর্শেদ সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহবুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (মা. আ.) হুজুর কেবলাজান। তাঁর সংস্পর্শে অসংখ্য পাপাচারী পথহারা মানুষ হেদায়েতের আলোকময় পথে নিজেকে পরিচালিত করতে সক্ষম হয়েছে। প্রকৃত হেদায়েত তথা নুরে হিদায়েত কাকে বলে- এই জামানায় যারা এই আলোকময় মহামানবের সান্নিধ্য লাভ করেছে তারা তা সুস্পষ্ট ও সুদৃঢ়ভাবে বুঝে হেদায়েতের পথে নিজেকে পরিচালিত করতে সক্ষম হয়েছেন। সূফী সম্রাট দয়াল বাবাজান প্রণীত পুস্তাকাদিতে প্রকৃত হেদায়েত সম্পর্কে সুস্পষ্ট আলোকপাত করা হয়েছে।
মহান রাব্বুল আলামিন পবিত্র কুরআনে মানুষকে আলোর পথে পরিচালিত হওয়ার জন্য বিভিন্নভাবে উৎসাহিত করেছেন। পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে- “হে মুমিনগণ! তোমরা (প্রতিযোগিতার মনোভাব নিয়ে ) ধাবমান হও তোমাদের প্রতিপালকের কাছ থেকে ক্ষমা লাভ করার জন্য এবং জান্নাত পাওয়ার জন্য, যার প্রশস্ততা আসমান ও জমিনের ন্যায়, যা প্রস্তুত রাখা হয়েছে মোত্তাকিদের জন্য।” (সূরা আলে ইমরান ৩ : আয়াত ১৩৩)
তাফসীরে সূফী সম্রাট দেওয়ানবাগী চতুর্থ খণ্ডে এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বিভিন্ন তাফসীরের কিতাব ও হাদিসের কিতাব হতে মারফূ হাদিস সন্নিবেশ করে এর অপরূপ ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
তাফসীরে ইবনে কাছির-এর ১ম খণ্ডের ৫৮৮ পৃষ্ঠায় বোখারীর সূত্রে হযরত আবূ হুরায়রাহ (রা.) হতে বর্ণনা হয়েছে। তিনি বলেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেন- “যখন তোমরা জান্নাতের জন্য প্রার্থনা করবে, তখন জান্নাতুল ফিরদাউসের জন্য প্রার্থনা করবে। কেননা এটি হচ্ছে, উচ্চ মর্যাদার জান্নাত এবং মধ্যস্থানে অবস্থিত। যার থেকে জান্নাতের নদীসমূহ প্রবাহিত হচ্ছে। আর এ জান্নাতের ছাদই হচ্ছে রাব্বুল আলামিনের আরশ।
উল্লিখিত হাদিসে একটি বিষয় সুস্পষ্টভাবে লক্ষ্যণীয় যে, আল্লাহর রাসুল (সা.) মুমিনদের জান্নাতুল ফিরদাউসের জন্য প্রার্থনা করতে বলেছেন। অতঃপর হযরত রাসুল (সা.) এ জান্নাতের চারটি অনন্য বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করেছেন। তা হলো- ১। এ জান্নাতের মর্যাদা সকল জান্নাত অপেক্ষা বেশি, ২। সর্বশ্রেষ্ঠ এ জান্নাত মধ্যখানে অবস্থিত, ৩। এখান থেকেই নহর বা নদীসমূহ প্রবাহিত হয়, এবং ৪। এ জান্নাতের ছাদই রাব্বুল আলামিনের আরশ।
মহান সংস্কারক, যুগের ইমাম সূফী সম্রাট হযরত দেওয়ানবাগী ( মা. আ.) হুজুর কেবলাজান বলেন, এ হাদিসটি রহস্যে পরিপূর্ণ। মহান রাব্বুল আলামিনের অপার দয়ায় এই হাদিসের ব্যাখা করতে গিয়ে তিনি বলেন- মুমিন জীবনের একমাত্র লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে- মহান আল্লাহর দিদার লাভ ও তাঁর চিরসন্তুষ্টি অর্জন। হাদিস শরীফে আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেন- মুমিনের ক্বালবই হচ্ছে আল্লাহর আরশ। (তাফসীরে ইবনে আরাবী- ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৮৯)
এ আরশ ছিলেন নবুয়তের যুগে নবি ও রাসুলগণ, আর বেলায়েতের যুগে যুগের ইমাম মোজাদ্দেদ ও আওলিয়ায়ে কেরাম। মহান আল্লাহ এই মহামানবগণের হৃদয়ে অবস্থান করেন। আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেন- এ জান্নাতের ছাদই হচ্ছে দয়াময়ের আরশ। আর এ ক্বালব মোবারক হতে মুমিনদের ক্বালবে ফায়েজ ওয়ারিদ হয় বলে আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেন- এখান থেকেই জান্নাতের নদীসমূহ প্রবাহিত হচ্ছে। আর ক্বালব মানবদেহের মধ্যখানে অবস্থিত বিধায় আল্লাহর রাসুল (সা.) ফরমান- এ জান্নাত মধ্যখানে অবস্থিত। এমনিভাবে যে ক্বালবকে আল্লাহ তাঁর আরশ হিসাবে গ্রহণ করে নিয়েছেন সে মহামানবের মর্যাদা সবচেয়ে বেশি। এজন্য রাসুল (সা.) মুমিনদের উদ্দেশ্য করে বলেন- তোমরা জান্নাতুল ফিরদাউসের জন্য প্রার্থনা করো, এটিই সর্বশ্রেষ্ঠ জান্নাত। মূলে আল্লাহকে পাওয়ার জন্য আল্লাহকে হৃদয়ে ধারণকারী মহামানবের সান্নিধ্য লাভ করা শর্ত। এ জন্যই আল্লাহর রাসুল (সা.) প্রার্থনার এই রীতি শিক্ষা দিয়েছেন। এমনিভাবে হাদিসে কুদসিতে মহান আল্লাহ নিজেই এরশাদ করেন- আমার জমিন আমাকে ধারণ করতে পারে না, আমার আসমানও আমাকে ধারণ করতে পারে না। কেবল আমার মুমিন বান্দার ক্বালব আমাকে ধারণ করে থাকে। (তাফসীরে মাজহারী ৭ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৬০)
মহান আল্লাহ তাঁর আল-গাফুর অর্থাৎ মহা ক্ষমাশীল নামের যে গুণ প্রকাশ করেছেন তা হলো, যে সকল মুমিনগণ আল্লাহ্ ও রাসুলের আনুগত্য করে, আর এ আনুগত্যের ক্ষেত্রে আপন অন্তরে প্রতিযোগিতার মনোভাব লালন করে যে, অবশ্যই আমি সকলের চেয়ে বেশি আনুগত্য করব, বেশি খেদমত ও দাসত্ব করব, আল্লাহ ও রাসুলকে বেশি ভালোবাসব, সকলের চেয়ে বেশি আত্মোৎসর্গ করব আর এর বিনিময়ে এই আশা করব যে, আল্লাহ ও রাসুলের সন্তুষ্টি অর্জন করে তাদের দয়া লাভ করব, এ সমস্ত আশেকে রাসুলদের প্রতি মহান আল্লাহ পরম ক্ষমাশীল। এরূপ মুমিনগণ আল্লাহর পক্ষ হতে যেমন ক্ষমা লাভ করবে, তেমনি জান্নাত লাভ করবে।
নবুয়ত পরবর্তী বেলায়েতের যুগে যে সমস্ত আশেকে রাসুল রাহমাতুল্লিল আলামিন হযরত রাসুল (সা.)-এর রেখে যাওয়া শান্তির ধর্ম মোহাম্মদী ইসলামের অনুসারী হয়ে আদব, বিশ্বাস, সাহস ও মহব্বতের সাথে মোর্শেদের অনুসরণ করে ও মোর্শেদকে ভালোবেসে মঞ্জিলে মকসুদের দিকে এগিয়ে যায়, তারাও আল্লাহর ক্ষমা লাভ করে জান্নাত লাভ করবে।
তাফসীরে ইবনে কাছীরে একখানা হাদিসে বর্ণিত হয়েছে- আল্লাহর রাসুল (সা.) বাদশাহ হিরাক্লিয়াসের কাছে চিঠি পাঠিয়েছিলেন। পত্রের উত্তরে হিরাক্লিয়াস লিখে দিলেন- ‘হে আল্লাহর রাসুল (সা.)! আপনি আমাকে পত্রের মাধ্যমে আসমান ও জমিনের ন্যায় প্রশস্ত জান্নাতের দিকে আহবান করেছেন। তাহলে জাহান্নাম কোথায়? এ প্রশ্নের উত্তরে হযরত রাসুল (সা.) বলেছিলেন- সুবহানাল্লাহ। দিনের উদয় হলে রাত কোথায় যায়?” (তাফসীরে ইবনে কাছীর ১ম খণ্ড পৃষ্ঠা ৫৮৮) অর্থাৎ -আল্লাহ যখন দয়া করে কারো জন্য জান্নাততুল্য আলোর জগৎ উন্মোচন করে দেন, তখন তাকে তো জাহান্নামতুল্য অন্ধকার জগৎ স্পর্শ করতে পারে না। তবে এ অন্ধকার বলতে হৃদয়ের অন্ধকার আর আলো বলতে হৃদয়ে ইমানের আলোর কথা বুঝানো হয়েছে। বিষয়টি মহান আল্লাহ পরিষ্কার করেছেন। পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে- “কাফিরদের চক্ষুতো অন্ধ নয় বরং তাদের অন্তরের চক্ষু অন্ধ (এ জন্য তারা অন্ধকারে ডুবে আছে)।” (সূরা আল হাজ্জ ২২ : আয়াত ৪৬) এমনিভাবে যারা দুনিয়াতে অন্ধকারে নিপতিত এটি তাদের জন্য এক প্রকার জাহান্নাম। এরূপ লোকেরা পরকালেও অন্ধকারতুল্য জাহান্নামের অধিকারী হবে। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন- “যে ব্যক্তি এ দুনিয়াতে অন্ধ ছিল, সে আখিরাতেও অন্ধ হয়ে থাকবে এবং অধিক পথভ্রষ্ট হবে; তথা সে আল্লাহ থেকে আরো বেশি দূরে সরে পড়বে।” (সূরা বনি ইসরাইল ১৭ : আয়াত ৭২) অন্যত্র এরশাদ হয়েছে-আর অন্ধ ও চক্ষুস্মান যেমন সমান নয়, তেমনি আল্লাময় আলোকজ্জ্বল জগৎ আর কুফুরির অন্ধকারের জগতও সমান নয়। (সূরা রাদ ১৩: আয়াত ১৬)
যারা নুরের আলোর সাহায্যে অন্তরের চোখ দিয়ে দেখে, অন্তরের কান দিয়ে এলহামের বাণী শুনে, অন্তরের ত্বক দিয়ে ফায়েজ অনুভব করে- এমনিভাবে যে সকল মুমিন সাধনার মাধ্যমে অন্তরের পঞ্চ ইন্দ্রিয় জাগ্রত করতে পেরেছে এবং আল্লাহর নির্দেশে নিজেকে পরিচালিত করতে পেরেছে, তারাই দুনিয়া ও আখিরাতে জান্নাতের অধিকারী। পক্ষান্তরে যারা ইমানের নুর লাভ করতে ব্যর্থ হয়েছে অন্তরের চোখ, কান ও জবানসহ আত্মিক পঞ্চ ইন্দ্রিয় জাগ্রত করতে পারেনি বরং কুফুরির অন্ধকারে হাবুডুবু খাচ্ছে তারাই দুনিয়া ও আখিরাতে জাহান্নামের অধিবাসী। এ জাতীয় মানুষকে বাহ্যিক আকৃতিতে মানুষের মতো দেখালেও তাদের চরিত্র পশুর ন্যায়, ফলে তাদের কর্মও পশুর ন্যায়। আর এ জাতীয় পশুদের দ্বারাই জাহান্নাম পূর্ণ হবে। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ এরশাদ করেন- “আমি জাহান্নামের জন্য এমন অনেক জিন ও মানুষকে সৃষ্টি করেছি, যাদের অন্তর আছে, কিন্তু তা দিয়ে তারা সত্যকে উপলদ্ধি করতে করে না, তাদের অন্তরের চোখ আছে কিন্তু তা দিয়ে তারা দেখে না। এমনিভাবে তাদের অন্তরের কান আছে কিন্ত তা দিয়ে তারা সত্য বাণী শোনে না । তারা চতুষ্পদ জন্তুর ন্যায়, বরং তারা তার চেয়েও নিকৃষ্টতর। এরাই গাফেল সম্প্রদায়।” (সূরা আরাফ ৭: আয়াত ১৭৯) সুতরাং জান্নাত ও জাহান্নামের বিষয়টি আখিরাতের সাথে যেমন সম্পৃক্ত, তেমনি জগতের সাথেও সম্পর্কিত। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। আল্লাহ তায়ালা বলেন- জান্নাত ও জাহান্নাম বহাল থাকবে ততদিন, যতদিন আসমান ও জমিন বহাল থাকবে। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে এরশাদ হচ্ছে- “অতএব যারা দুর্ভাগা তারা জাহান্নামে যাবে, সেখানে তাদের চিৎকার ও আর্তনাদ চলতে থাকবে। সেখানে তারা অনন্তকাল থাকবে, যতদিন আসমান ও জমিন বহাল থাকবে; অবশ্য যদি আপনার রব অন্যকিছু ইচ্ছে করেন তবে ভিন্ন কথা। কেননা আপনার রব যা ইচ্ছে করেন তা-ই করেন। আর যারা ভাগ্যবান তারা থাকবে জান্নাতে, সেখানে তারা অনন্তকাল থাকবে, যতদিন আসমান ও জমিন বহাল থাকবে; অবশ্য যদি আপনার রব অন্য কিছু ইচ্ছে করেন তবে ভিন্ন কথা। এ দান অফুরন্ত নিরবচ্ছিন্ন।” (সুরা হুদ ১১ : আয়াত ১০৬-১০৮)
সুতরাং মহান আল্লাহ ও রাসুলের বাণী দ্বারা এই কথা সুস্পষ্ট যে পৃথিবীতে যেমন দিন আছে তেমনি রাতও আছে, একইভাবে জান্নাততুল্য যেমন নুরে হিদায়েত আছে তেমনি জাহান্নামতুল্য কুফুরির অন্ধকার মানুষের হৃদয় এ দুনিয়াতেই বর্তমান। প্রকৃতপক্ষে আলোর জগতের মানুষ আল্লাহর নুর দ্বারা আলোকিত, আর অন্ধকার জগতের মানুষ আল্লাহর নুর হারিয়ে চির অন্ধকারে নিপতিত।
মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদের তাঁর প্রিয় বন্ধু ,এই যুগের ইমাম সূফী সম্রাট হযরত দেওয়ানবাগী (মা. আ.) হুজুর কেবলাজানের পরিচয় লাভ করে, তাঁর শিক্ষা গ্রহণ করে নুরে হেদায়েতের পথে পরিচালিত হওয়ার তৌফিক দান করুন। আমিন।
তথ্যসূত্র: তাফসীরে সূফী সম্রাট দেওয়ানবাগী চতুর্থ খণ্ড
[লেখক: গবেষক ও প্রাবন্ধিক]