ইসলামের পঞ্চ স্তম্ভের গুরুত্ব ও তাৎপর্য
মো. মুযহারুল হান্নান
সারাবিশ্বের মালিক মহান আল্লাহ জাল্লা শানুহু তাঁর সৃষ্টি জগৎকে দুই ভাগে ভাগ করেছেন। একটি হচ্ছে আলমে আমর, যাকে সূক্ষ্ম জগত বা রূহানি জগত বলা হয়। অপরটি হচ্ছে আলমে খালক বা সৃষ্টি জগত, যাকে দৃশ্যমান জগত বলা হয়। প্রত্যেকটির উপাদান পাঁচটি করে।
মানব কেন্দ্রিক সূক্ষ্ম জগতের উপাদানগুলো হলো: ক্বালব, রূহ, ছের, খফি এবং আখফা। বস্তু জগতে বসবাসকারী মানব দেহের পাঁচটি বিভিন্ন স্থানে এদের রূহানিভাবে অবস্থান। অপর পক্ষে মানব দেহে অবস্থান করছে দৃশ্যমান আলমে খাল্কের পাঁচটি উপাদান: মাটি, বায়ু, পানি, বাতাস এবং নফস, যাকে মানুষের ইচ্ছা শক্তিও বলা যায়।
দৃশ্যমান জগতের এই পাঁচ উপাদানের পাঁচ প্রকার বিরুপ প্রতিক্রিয়া মানুষের দেহ জগতে সর্বদা কার্যকর রয়েছে। প্রথমে ধরা যাক নফস এর কথা। দেহ জগত এর বিরুপ প্রতিক্রিয়া খুব কঠিন। এটা মানুষকে সর্বদা খারাপ ও অন্যায় কাজে প্ররোচিত করে। মহান আল্লাহ সূরা ইউসুফের ৫৩ নম্বর আয়াতে এর স্বরূপ উল্লেখ করে এটাকে নফসে আম্মারা বলে অভিহিত করেছেন। পরবর্তীতে এই নফস নিজের অন্যায় কাজের জন্য অনুতপ্ত হয়ে ভালো কাজের দিকে অগ্রসর হয় এবং পূর্বের অন্যায় কাজের জন্য নিজেকে তিরস্কার করে। মহান আল্লাহ এই নফসকে নফসে লাওয়ামাহ বলে সূরা কিয়ামাহ-এর ২ নম্বর আয়াতে উল্লেখ করেছেন। অবশেষে এই নফস যাবতীয় পাপ, অন্যায় ও অবিচার থেকে নিজেকে মুক্ত করে পূত পবিত্র হয়ে যায়। তাই মহান আল্লাহ সূরা ফজর এর ২৭-৩০ নম্বর আয়াতে এর প্রশংসা করে তাকে নফসে মুতমায়িন্নাহ বলে অবহিত করেছেন এবং তাকে জান্নাত দানের ওয়াদাও করেছেন।
নফস প্রথম পর্যায়ে মানুষকে স্বেচ্ছাচারী করে তোলে। মানুষ মধুর নশ্বর পৃথিবীর মায়াজালে আবদ্ধ হয়ে পরকালের অবিনশ্বর জগতের ধারণা মনে আনতে পারে না। ফলে বিশ্ব জগতের একমাত্র উপাস্য যে মহান আল্লাহ তার পরিবর্তে সে নিজের খেয়াল খুশি বা প্রবৃত্তিতে তার ইলাহ বা উপাস্য বানিয়ে নেয়। মহা গ্রন্থ আল-কুরআনে মহান প্রভু আল্লাহ এই কথাই বলেছেন। ইসলামের প্রধান স্তম্ভ তাওহিদের কালিমা “আল্লাহ ছাড়া আর কোনো মাবুদ বা উপাস্য নেই” এর স্বীকৃতি ও অনুভূতি তার মধ্যে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে পারাই হলো কালিমার লক্ষ্য। এই লক্ষ্য অর্জনের মাধ্যমে তার মধ্যেকার স্বেচ্ছাচারীতার দোষ সমূলে ধ্বংস হয়।
মানুষের দেহ জগতে আর একটা দোষ রয়েছে। সেটা হচ্ছে তার মধ্যে অহংকার বোধ। এটা উৎপন্ন হয় দেহের একটা উপাদান আগুনের গুণ থেকে। আগুনের স্বাভাবিক ধর্ম উপর দিকে উঠা বা নিজেকে অপরের চেয়ে বড়ো বলে ধারণা করা। এ কুপ্রবৃত্তিকে দমন করার জন্য নামাজ কায়েম করার কথা ইসলাম বলে দিয়েছে। নামাজে মানুষ নিজেকে অত্যন্ত ছোটো ধারণা করে অতি বিনয়ের সহিত মহান আল্লাহর নুরের কদম মোবারকে মস্তক রেখে নিজের সবকিছুই অকাতরে সঁপে দেয়। নামাজের মাধ্যমে আগুনের গুণ থেকে উৎপন্ন অহংকারবোধ ধ্বংস হয়। মানুষ নিরঅহংকারী হয়ে স্বস্তি লাভ করে। এভাবে নামাজ মানুষকে অহংকারী হওয়ার দোষ থেকে মুক্ত রাখে।
মানবদেহ জগতে আরেকটা দোষ পরিলক্ষিত হয়ে থাকে, এটা হচ্ছে অসাম্য আচরণ, যা সবলে দুর্বলের প্রতি প্রদর্শিত হয়ে থাকে। এটা মানুষে মানুষে ভেদাভেদ বা অসাম্যের ধারণা থেকে উৎপন্ন হয়।
মানব দেহের একটা উপাদান হচ্ছে পানি। পানির মধ্যে রয়েছে অসমতা বা অসাম্যের দোষ। সমতা লাভের জন্য পানির গতি সব সময় নিচের দিকে। মানুষেরও স্বাভাবিক মন মানসিকতা হচ্ছে তার চেয়ে দুর্বলের প্রতি অনীহা-অসাম্য প্রদর্শন করা। এটা শেষ পর্যায়ে অত্যাচারের রূপ লাভ করতে এগিয়ে যায়। পানির স্বাভাবিক গুণ অসমতা বা অসাম্য। এটা আমরা পেয়ে থাকি দেহের উপাদান পানির গুণ থেকে। সেটা ঠেকাবার বা দূর করার জন্য আমরা ইসলামের আর একটা স্তম্ভ হজের সাহায্য নিয়ে থাকি। হজ অনুষ্ঠানের এক পর্যায়ে পবিত্র আরাফাতের মাঠে লক্ষ লক্ষ মুসলমান নর-নারী একই পোষাকে এহরামের সাজে লক্ষ লক্ষ কণ্ঠে মহান আল্লাহর একত্ববাদ তালবিয়া পাঠের মাধ্যমে ঘোষণা করে এবং প্রমাণ করে যে, মানুষে মানুষে কোনো ভেদাভেদ নেই। সবলের দুর্বলের অতি অত্যাচার করার অধিকার নেই। সমান অধিকার ও সাম্যের এই ধারণা হজব্রত উদযাপনের মাধ্যমে লাভ হয়। এই ভাবে ইসলামে হজ অনুষ্ঠানে মানুষে মানুষে অসাম্য নিরসনে কার্যকর ভূমিকা পালন করে থাকে।
মানবদেহ জগতে আরেকটা দোষ কৃপণতা। এটার উৎপত্তি হয় দেহের এক উপাদান মাটির ধর্ম থেকে। মাটির স্বাভাবিক ধর্ম হচ্ছে সবকিছু নিজের মধ্যে গ্রাস করে নেওয়া। মানুষও এই নশ্বর পৃথিবীর ধন-মাল সঞ্চয় করে কুক্ষিগত করত আঁকড়ে রাখতে চায়। এটা মানুষের স্বভাবগত দোষ। মহান আল্লাহ মানুষের এই স্বভাবের কথা সূরা হুমাযার ২-৩ নম্বর আয়াতে ও সূরা মা’আরিজের ১৮ নম্বর আয়াতে উল্লেখ করেছেন। কৃপণতার এই দোষ দূর করার জন্য ব্যবস্থা করা হয়েছে, জাকাত প্রদান প্রথা প্রবর্তন করে। সমাজে এই প্রথা নিয়মিত চালু হলে ব্যক্তিগত কৃপণতা দূর হয়ে আর্থিক সাম্য গড়ে উঠবে। ধনী ও গরিবের মধ্যে আর্থিক ব্যবধান বহুলাংশে কমে গিয়ে তাদের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হবে সৌহার্দ, প্রীতি ও সমবেদনার অনুভূতি। তাই জাকাত প্রদান প্রথা যথাযথ চালু হলে মাটির গুণ কৃপণতা মানুষের মধ্য থেকে বিদায় নিবে।
মানুষের দেহ জগতে আরেকটা দোষ হচ্ছে আত্ম প্রচারণা। এর ফলে শুধু নিজের প্রচার ও প্রসার ঘটাতে চায় মানুষ। নিজের প্রচার ও প্রসার ঘটনার লক্ষ্য হচ্ছে নিজের সুখ সুবিধায় বিস্তার বা বৃদ্ধি সাধন। মানব দেহের একটা উপাদান হচ্ছে বাতাস। বাতাসের ধর্ম হচ্ছে প্রসারণ। মানুষ তার দেহের এই উপদানের গুণ আয়ত্ত করে নিজের সুখের প্রসারণ ঘটাতে উদ্বুদ্ধ হয়। মানুষের এই আরাম প্রিয়তার দোষ দূর করার জন্য ইসলামের একটা স্তম্ভ রোজার বিধান এসেছে। রোজা পালনে অভ্যস্ত হলে বাতাসের গুণ থেকে প্রাপ্ত মানুষের স্বাভাবিক দোষ সুখলাভের ইচ্ছা কমে গিয়ে মানুষের মাঝে প্রতিষ্ঠিত হবে কষ্ট সহিষ্ণুতার মতো এক মহৎ গুণ। রোজা পালনে অভ্যস্ত মানুষের মাঝে আসবে পরদুঃখকাতরতা ও সহানুভুতি। তাই রোজার বিধান চালু করে ইসলাম মানুষের আত্মকেন্দ্রিকতা বা আত্মপ্রচারণার দোষ দূর করে থাকে এবং তাকে প্রশান্ত-হৃদয় মুমিন বান্দা রূপে গড়ে তুলে।
এইভাবে মানব দেহে বিদ্যমান পাঁচটি দোষ দূরীভূত হবে এবং ইসলামের পঞ্চ স্তম্ভকে এদের অন্তর্নিহিত লক্ষ্য-সহ জীবনে প্রতিষ্ঠিত করলে মানুষ আল্লাহর প্রিয় বান্দারূপে প্রতিষ্ঠিত হবে নিঃসন্দেহে।
পরিশেষে অপার করুণার আধার দয়াময় আল্লাহর নিকট আমাদের আকুল আবেদন, আমরা যেন ইসলামের পঞ্চ কল্যাণী পঞ্চ স্তম্ভ জীবনে সুপ্রতিষ্ঠা করে তার কল্যাণ ও সন্তুষ্টি লাভে ধন্য হতে পারি। আমিন।
[লেখক: প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক, বাসুদেবপুর হাইস্কুল, গোদাগাড়ী থানা, রাজশাহী]