অলী-আল্লাহগণের সান্নিধ্য লাভের প্রয়োজনীয়তা
ইমাম ড. আরসাম কুদরত এ খোদা
মহান আল্লাহ সৃষ্টির শুরু থেকে আজ অবধি পাপী-তাপী মানুষকে সিরাতুল মুস্তাকিম তথা আলোর পথে আনার জন্য দুনিয়াতে অসংখ্য মহামানব প্রেরণ করছেন। তাঁরা সমকালীন যুগের মানুষকে আল্লাহ তায়ালার সাথে যোগাযোগের শিক্ষা দিয়ে থাকেন। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে- “আমার সৃষ্টির মাঝে একটি সম্প্রদায় রয়েছে যারা মানুষকে সৎ পথ দেখান এবং ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করেন।” (সূরা আল আরাফ ৭ : আয়াত ১৮১)
এ সকল মহামানব মোর্শেদরূপে নবুয়তের যুগে নবি-রাসুল এবং বেলায়েতের যুগে অলী-আল্লাহ হিসেবে পৃথিবীতে প্রেরিত হয়েছেন। বিশ^নবি হযরত রাসুল (সা.) ফরমান- “আনা খাতামুন নাবিয়্যিন, লা নাবিয়্যা বাদি।” অর্থাৎ “আমি শেষ নবি আমার পরে আর কোনো নবি আসবেন না।” হযরত রাসুল (সা.)-এর পর থেকেই নবুয়তের ধারা সমাপ্ত হয়েছে শুরু হয়েছে বেলায়েতের যুগ। তাইতো আল্লাহর রাসুল (সা.) ফরমান- “আল ওলামাউ ওয়ারাছাতুল আম্বিয়া।” অর্থাৎ “হক্কানী আলেম (অলী-আল্লাহগণ) হচ্ছেন রাসুল (সা.)-এর উত্তরসূরী।” অর্থাৎ যারা এলমে শরিয়ত, তরিকত, হাকিকত ও মারেফতের বিদ্যায় বিদ্বান।
কিতাবে বর্ণিত হয়েছে- “আশশাইখু ফি কাউমিহি কান্নাবিয়্যু ফি উম্মাতিহি।” অর্থাৎ “নবি-রাসুলগণ তাঁর উম্মতের কাছে যেরূপ, মোর্শেদ তথা অলী-আল্লাহগণ তাঁর কওমের জন্য তদ্রুপ।” সুতরাং পরবর্তীতে অলী-আল্লাহগণই মোর্শেদ রূপে বেলায়েতের যুগে মানুষকে হেদায়েতের পথ দেখাচ্ছেন।
‘অলী’ আরবি শব্দ, যার অর্থ বন্ধু। সুতরাং অলী-আল্লাহ হচ্ছেন আল্লাহর বন্ধু। অলীর বহুবচন হচ্ছে আউলিয়া। নবির সাথে যেমন আল্লাহর যোগাযোগ থাকায় নবীউল্লাহ এবং রাসুলের সাথে আল্লাহর যোগাযোগ থাকায় তাদেরকে রাসুলুল্লাহ বলা হয়। তেমনি অলীর সাথে আল্লাহর যোগাযোগ থাকায় তাদেরকে অলী-আল্লাহ বলা হয়। কারণ তাঁরা প্রত্যেকেই আল্লাহকে ক্বালবে ধারণ করেই মহামানব হয়েছেন। এ সকল মহামানব যুগে যুগে ধর্মকে সজীব এবং সতেজ করে তোলার জন্য নবুয়তের যুগে নবি-রাসুলরূপে মোর্শেদ তথা শিক্ষকরূপে সমকালীন যুগের মানুষকে হেদায়েতের পথ দেখিয়েছেন, তদ্রƒপ বেলায়েতের যুগে অলী-আল্লাহগণ এরই ধারাবাহিকতায় ধর্মকে সজীব ও সতেজ করে তোলেন। তাঁদের মধ্য থেকেই যুগের ইমাম, মোজাদ্দেদ বা সংস্কারক হিসেবে অলী-আল্লাহগণ পৃথিবীতে আগমন করে থাকেন।
এ প্রসঙ্গে হযরত আবু হুরায়রা (রা.) কর্তৃক বর্ণিত হাদিসে হযরত রাসুল (সা.) ফরমান- “নিশ্চয়ই মহাপরাক্রমশালী সম্ভ্রান্ত আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেক শতাব্দীর শিরোভাগে এ উম্মতের জন্য এমন এক ব্যক্তিকে প্রেরণ করেন, যিনি ধর্মকে সংস্কার অর্থাৎ- সজীব ও সতেজ করে তোলেন (মেশকাত শরীফ; পৃষ্ঠা ৩৬, আবু দাউদ শরীফ)।
এ কারণেই মহান আল্লাহ হযরত রাসুল (সা.)-এর ওফাতের পরে ধর্মকে পুনর্জীবিত করার জন্য মোজাদ্দেদ হিসেবে বড় পির হযরত মহিউদ্দিন আব্দুল কাদের জিলানি (রহ.), পরবর্তীতে হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতি আজমিরি (রহ.), হযরত খাজা বাহাউদ্দিন নকশবন্দ (রহ.), হযরত মোজাদ্দেদ আলফেসানি (রহ.), ইমাম সৈয়দ আবুল ফজল সুলতান আহমদ (রহ.)-এর মতো অসংখ্য অলী-আল্লহগণকে পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন।
বর্তমান একবিংশ শতাব্দীর শিরোভাগে এরই ধারাবাহিকতায় মহান সংস্কারক মোহাম্মদী ইসলামের পুনর্জীবনদানকারী যুগের ইমাম সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহবুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (মা. আ.) হুজুর কেবলাজানকে ধর্মকে সজীব ও সতেজ করে তোলার জন্য বাংলাদেশে প্রেরণ করেছেন। যাঁর জীবদ্দশায় আজ মোজাদ্দেদ হিসেবে তাঁর বহু সংস্কার বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক এবং আন্তর্জাতিকভাবে দেশ-বিদেশে স্বীকৃতি পেয়েছে।
পৃথিবীতে তিন শ্রেনীর অলী- আল্লাহ রয়েছেন। যথা-
১. হাদী তথা হেদায়েতকারী অলী-আল্লাহ: হাদী শ্রেণীর অলী-আল্লাহর মধ্যে চারটি শ্রেণী রয়েছে। যথা-
ক. অলী-আল্লাহ
খ. অলীয়ে কামেল
গ. অলীয়ে মোকাম্মেল এবং
ঘ. মোজাদ্দেদে জামান বা যুগের ইমাম।
হাদী শ্রেণীর অলী-আল্লাহগণের প্রধান হলেন-যুগের ইমাম বা মোজাদ্দেদে জামান। তিনিই সকল অলী-আল্লাহগণের বাদশাহ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
২. মাজ্জুব শ্রেণীর অলী-আল্লাহ : যাঁরা আল্লাহর এশকে দেওয়ানা থাকেন। মহান রাব্বুল আলামিনের নির্দেশে মাজ্জুব শ্রেণীর অলী-আল্লাহগণ খোদায়ি প্রশাসনের বিশেষ কাজে নিয়োজিত থাকেন।
৩. দেশরক্ষক অলী-আল্লাহ্ : তাঁরা জাগতিক সরকারের সেনাবাহিনীর ন্যায়। এ শ্রেণীর অলী-আল্লাহর মধ্যে ৪০টি পদবী আছে।
এ তিন শ্রেণীর অলী-আল্লাহগণের প্রধান হলেন হাদী শ্রেণীর যিনি প্রধান অর্থাৎ- যুগের ইমাম বা মোজাদ্দেদে জামান। যুগের ইমামের কাছ থেকে হাদী, মাজ্জুব ও দেশরক্ষক অলী-আল্লাহগণ ফায়েজ লাভ করে থাকেন। আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন, যুগের ইমাম তাঁর বাহিনী অর্থাৎ- হাদী, মাজ্জুব ও দেশরক্ষক অলী-আল্লাহগণকে নিয়ে আল্লাহ্র সে ইচ্ছা বাস্তবায়ন করেন। এই মহামানবের অধীনেই সকল অলী- আল্লাহ থাকেন। যুগের ইমামকে আল্লাহর নির্দেশে সকল প্রকার সাহায্য করার জন্য হাদী, মাজ্জুব ও দেশরক্ষক অলী-আল্লাহগণ নিয়োজিত আছেন।
এজন্য আল্লাহ্র রাসুল (সা.) ফরমান- যে ব্যক্তি তার জামানার ইমামকে চিনেত পারল না, আর এমতাবস্থায় যদি তার মৃত্যু ঘটে তবে তার মৃত্যু জাহেলী অবস্থায় অর্থাৎ সে ইমান হারা হয়ে মৃত্যুবরণ করবে। (মেশকাত শরীফ, পৃষ্ঠা ৩৬)
কেউ যদি জামানার ইমামের কাছে না যায়, তাহলে সে ইমানের নুরের বীজ হৃদয়ে ধারণ করতে সক্ষম হবে না। যার কারণে সে অন্ধকার বা কাফের হয়ে মৃত্যুবরণ করবে। অলী-আল্লাহগণের হৃদয়ে আল্লাহর সত্তা জাগ্রত অবস্থায় বিরাজ করে। এজন্য তাঁদের সান্নিধ্যে আসলে সাধারণ মানুষের হৃদয়ে আল্লাহর প্রতি গভীর অনুরাগ সৃষ্টি হয় এবং নিজ হৃদয়কে আলোকিত করতে সক্ষম হন। অর্থাৎ-তারাই হন আলোকিত মানুষ। যেমনিভাবে হযরত রাসুল (সা.)-এর সোহবতে এসে সাহাবায়ে কেরাম নিজের হৃদয়কে প্রজ¦লিত করে আশেকে রাসুলে পরিণত হয়েছিলেন। অলী-আল্লাহ্গণ নুরে মোহাম্মদীর নুর দ্বারা মানুষের ক্বালবে ইসমে আজম (আল্লাহ) শব্দের বীজ বপন করে ইমানদার তথা মুমেনে কামেলে পরিণত করেন। মহান আল্লাহ নামের ইসমে আজম হচ্ছে আল্লাহর জাত বা সত্তাগত নামকে বুঝায়। যখন কোনো ব্যক্তি মোর্শেদ তথা অলী-আল্লাহর সান্নিধ্যে যান, মোর্শেদ দয়া করে শাহাদাৎ অঙ্গুলি মোবারক দ্বারা তার ক্বালবে স্পর্শ করে আল্লাহ নামের বীজ বপন করে দেন। তখন সে সাধনা করে আল্লাহর চরিত্রে চরিত্রবান হতে পারে।
সূফী সম্রাট হযরত দেওয়ানবাগী (মা. আ.) হুজুর কেবলাজান বলেন, ‘‘আল্লাহর সিফাতী গুণ তথা ইমানের জন্ম নুরে মোহাম্মদী হতে। যুগে যুগে মহামানবগণ মানুষের হৃদয়ে ইমানের নুর বপন করতে আসেন। অলী-আল্লাহগণের সাহচর্যে গিয়ে সেই নুর নিজের সিনায় (ক্বালব) ধারণ না করা পর্যন্ত মুমেন হওয়া যাবে না।’’
অলী-আল্লাহগণই হচ্ছেন এ সিফাতের (গুণের) অধিকারী। তাঁদের সান্নিধ্যে গিয়েই মানুষ ইনসানে কামেলে পরিণত হতে পারে। কারণ আল্লাহর জাত সত্তার বীজ যখন কোনো সাধক নিজ হৃদয়ে ধারণ করেন, তখন ধীরে ধীরে তাঁর থেকে আল্লাহর সিফাতের গুণগুলো প্রকাশ পেতে থাকে। কারণ মহান আল্লাহ তায়ালা প্রতিটি মানুষের ভিতরেই অবস্থান করে থাকেন। যার কারণে মানুষ আশরফুল মাখলুকাত। পবিত্র কুরআন থেকে জানা যায়, মহান আল্লাহ নিজেকে প্রকাশ করার লক্ষ্যে মানুষকে তাঁর খলিফা বা প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত করেছেন। আল্লাহ তাঁর পরিচয় দিয়ে পবিত্র কুরআনে বলেন- “আল্লাহু নুরুছ ছামাওয়াতি ওয়াল আরদ্ব।” অর্থাৎ “আল্লাহ আসমান ও জমিনের নুর। (সূরা নুর ২৪ : আয়াত ৩৫)
তাঁর নুরের মেছাল একটা জ¦ালানো বাতির মতো। আল্লাহ যাকে চান তাকে তাঁর নুরময় সত্তার দিকে তুলে আলোকিত মানুষে পরিণত করেন। আল্লাহ তাঁর রাসুলের শানে বলেছেন-
অর্থাৎ হে রাসুল! আমিতো আপনাকে প্রেরণ করেছি সুসংবাদদাতা, সাক্ষীদাতা ও সতর্ককারী এবং তাঁর (আল্লাহর) দিকে আহবানকারী প্রজ¦লিত প্রদীপরূপে।’’ (সূরা আহ্যাব ৩৩ : আয়াত ৪৫-৪৬)
আর সেই প্রজ¦লিত প্রদীপ হচ্ছেন হযরত রাসুল (সা.)। তাঁর ওফাতের পরবর্তীতে নুরে মোহাম্মদীর ধারক ও বাহকগণের মাধ্যমেই জগতে হেদায়েতের চিরন্তন ধারা পরিচালিত হচ্ছে। মূলত ঐ প্রজ¦লিত প্রদীপ যখন যে মহামানবের সান্নিধ্যে গিয়ে তাঁর প্রজ¦লিত প্রদীপের আলো দ্বারা হৃদয়কে আলোকিত করে মুমেন হতে হয়। সর্বযুগে মুমেন হওয়ার এটাই চিরন্তন বিধান। একটি জ¦লন্ত প্রদীপ থেকে যদি লক্ষ কোটি প্রদীপ জ¦ালানো হয়, তাতে প্রদীপের আলোর কোনোরূপ পরিবর্তন হয় না। তেমনি পৃথিবীতে যত নবি-রাসুল ও অলী-আল্লাহ এসেছেন তাঁদের সোহবতে গিয়েই সাধারণ মানুষ সেই আলো নিজ হৃদয়ে ধারণ করে আল্লাহর চরিত্রে চরিত্রবান হতে পারেন।
তাই কোনো এক শায়েক বলেছেন- ‘‘মিটাদে আপনি হাস্তিকো আগর তু মর্তবা চাহে, কে দানা খাক মে মিলকার গুলে গুলজার হোতাহ্যায়।’’
অর্থাৎ- “চরিত্রবান বা মর্যাদাবান হতে চাও তবে আপন সত্তাকে বিলীন করে দাও, বীজ মাটিতে নিঃশেষ হয়ে গেলেই যেমন উদ্যান ফলে ফুলে সুশোভিত হয়।”
যখন একজন সাধক তাঁর ক্বালবে কোনো অলী-আল্লাহর ক্বালব থেকে আল্লাহ শব্দের বীজ বপন করে নেন, তখন সে নিজের অস্তিত্বকে মোর্শেদের কাছে বিলীন করে দেন। যেমন- একটি বীজ মাটির সাথে নিজেকে বিলীন করে দেয়, তেমনি সে বীজকে যত্ন করলে অর্থাৎ তাতে পানি, রোদ, বাতাস এবং সঠিক পরচর্যা করলে সেই বীজ গাছে পরিণত হয়ে তা থেকে ফুলে ফলে সুশোভিত হয়। তেমনি একজন সাধককে মোর্শেদের কাছ থেকে বায়াত গ্রহণ করে আল্লাহ নামের বীজ বপন করে নিয়মিত তরিকার আমল তথা ওয়াজিফা, মোরাকাবা-মোশাহেদা এবং মোর্শেদের দরবারে গোলামী করে নিজের আমিত্বকে বিসর্জন দিতে হয়। মহান আল্লাহ ও হযরত রাসুল (সা.)-এর প্রেমের ফায়েজে দিওয়ানা বেকারার হয়ে নিজের জীবনের গুনাহর কথা স্মরণ করে চোখের পানি ফেলতে হয়। অতঃপর এভাবে সাধনার মাধ্যমে অন্তর চক্ষু জাগ্রত করতে পারলেই আল্লাহর সাথে যোগাযোগ স্থাপন করা সম্ভব।
সৃষ্টির শুরু হতে সকল যুগে আল্লাহকে পাওয়ার জন্য সমকালীন যুগের মানুষকে মোর্শেদ তথা নবি-রাসুল ও আউলিয়ায়ে কেরামের কাছে শপথ বাক্য পাঠ করত বায়াত গ্রহণ করে মুমেন হতে হয়। এ প্রসঙ্গে এরশাদ হয়েছে- “হে রাসুল! যারা আপনার হাতে হাত দিয়ে বায়েত গ্রহণ করেছে তারা আল্লাহ্র হাতে হাত দিয়ে বায়েত গ্রহণ করেছে।” (সূরা ফাতহ ৪৮ : আয়াত ১০)
আর তা এজন্য যে, মানুষ সাধনার মাধ্যমে ফানাফিল্লাহ্র স্তরে পৌঁছে আল্লাহর সাথে মিশে একাকার হতে পারে। মূলত বায়েত বলতে বুঝায় মহান আল্লাহকে পাওয়ার জন্য মোর্শেদের কাছে আনুগত্যের শপথ বাক্য পাঠ করে যাবতীয় পাপ কর্ম হতে বিরত থেকে মোর্শেদের মাধ্যমে আল্লাহতে আত্মসমর্পিত হওয়া।
অলী-আল্লাহগণের মর্যাদা সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে এরশাদ করেন- “সাবধান! আল্লাহর বন্ধুদের কোনো ভয় ভীতি নেই এবং তাঁরা কোনোরূপ দুঃখিতও হবেন না।” (সূরা ইউনুস ১০ : আয়াত ৬২)
এ প্রসঙ্গে হাদিস শরীফে বর্ণিত হয়েছে- “আলা ইন্না আউলিয়াল্লাহি লা ইয়ামুতু।” অর্থাৎ “সাবধান! নিশ্চয়ই আল্লাহর অলীগণ অমর।”
আল্লাহ তাঁর বন্ধুগণকে যে কতো বেশি ভালোবাসেন এবং তাঁদেরকে যে কতো উচ্চ মর্যাদার অধিকারী করেছেন, তা ভাষায় ব্যক্ত করা কঠিন। আল্লাহ প্রেমিক সাধকগণের সাধনালব্ধ জ্ঞান থেকে অলী-আল্লাহগণের সাথে আল্লাহর নিগূঢ় সম্পর্কের বর্ণনা পাওয়া যায়। সাধক যখন সম্পূর্ণ আল্লাহর চরিত্রে চরিত্রবান হন এবং নিজের আমিত্বকে সম্পূর্ণরূপে বিসর্জন দিতে সক্ষম হন, তখন মহান প্রভু আল্লাহ এরূপ সাধকের পরিশুদ্ধ ক্বালবে আসন গ্রহণ করেন। এ প্রসঙ্গে হাদিস শরীফে হযরত রাসুল (সা.) ফরমান- অলী-আল্লাহগণ আল্লাহর আরশ।
যিনি প্রকুত মুমেন হতে পেরেছেন তাঁর হৃদয়ে আল্লাহ অবস্থান করেন। সাধক নিজেকে পরিশুদ্ধ করে আল্লাহর সাথে এমনভাবে মিশে একাকার বা ফানা হয়ে যান যে, তাঁকে আল্লাহ থেকে আলাদা করা কঠিন। যেমন- চিনি দুধের সাথে মিশে সম্পূর্ণ একাকার হয়ে গেলে দুধের ভিতরে চিনির অস্তিত্ব চোখে দেখা যায় না। অথচ এর প্রতিটি বিন্দুতে চিনি মিশে থাকে। এ অবস্থায় দুধের প্রতিটি বিন্দুতে চিনির স্বাদ বিদ্যমান, তদ্রুপ আল্লাহ তাঁর বন্ধুর সাথে পূর্ণাঙ্গভাবে মিশে থাকেন। কঠোর সাধনার মাধ্যমে মানুষ নিজের অস্তিত্বকে আল্লাহতে বিলীন করে দিয়ে ফানাফিল্লাহর স্তরে পৌঁছতে পারে। তার জ¦লন্ত দৃষ্টান্ত সাধক প্রবর হযরত মনসুর হাল্লাজ (রহ.)। তাইতো তাঁর মুখ থেকে আল্লাহর এ কথা বেরিয়ে এসেছে- ‘আনাল হক’ অর্থাৎ আমিই সত্য অথচ সমাজের মানুষ এর রহস্য বুঝতে না পেরে তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে।
বিখ্যাত সুফি সাধক হযরত বায়েজীদ বোস্তামি (রহ.) আল্লাহতে সম্পূর্ণ বিলীন বা ফানা অবস্থায় বলেছেন-]“আমার জামার নীচে যা আছে, তা আল্লাহ ছাড়া আরকিছু নয়।”
আল্লাহতে এরূপ বিলীন বা ফানা অবস্থায় ইমামে তরিকত হযরত মোজাদ্দেদ আলফেসানি (রহ.) বলেছেন- ‘‘আমার প্রশংসা করাই আল্লাহ্র প্রশংসা।’’
মূলত কঠোর সাধনার মাধ্যমে আমিত্বকে বিসর্জন দিয়ে আল্লাহকে নিজের মধ্যে ধারণ করার জন্যই অলী-আল্লাহগণের মর্যাদা এত বেশি। আল্লাহ্ তাঁর বন্ধুর দেহ এবং আত্মার সাথে এমন নিবিড়ভাবে মিশে থাকেন, যার ফলে অলী-আল্লাহগণের দেহ ও আত্মা সমানভাবে পবিত্র ও সম্মানিত হয়ে যায়। তাইতো হাদিস শরীফে বর্ণিত হয়েছে- “আল মুমিনু আকরামু হুর মাতাম মিনাল কাবাতি।” অর্থাৎ মুমেন ব্যক্তি কাবাঘরের চেয়ে অধিক সম্মানিত। (ইবনে মাজাহ শরীফ)
আল্লাহ যেহেতু নুরের, তাই পাথরের তৈরি কাবাঘর তাঁকে ধারণ করতে অক্ষম। আল্লাহর নুর দ্বারা পরিশুদ্ধ মুমেন ব্যক্তির হৃদয় কেবল তাঁকে ধারণ করতে সক্ষম। এ প্রসঙ্গে জগৎবিখ্যাত সুফি সাধক জালাল উদ্দিন রুমী (রহ.) বলেন- “মাননা গুনজাম দার জমিনু আছমা, লেকে গুনজাম দার কুলুবি মুমিনা।” অর্থাৎ সমস্ত আসমান ও জমিনের কোথাও আল্লাহর সংকুলান হয় না, একমাত্র মুমেন ব্যক্তির হৃদয়েই তাঁর সংকুলান হয়ে থাকে।
বর্ণিত আছে- একদা হযরত রাবেয়া বসরি (রহ.) হজ করার জন্য কাবার উদ্দেশে রওনা হন। মহান রাব্বুল আলামিন হযরত রাবেয়া বসরি (রহ.)-কে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য কাবাঘরকে প্রেরণ করেন। যাত্রা পথে হঠাৎ হযরত রাবেয়া বসরি (রহ.) অন্তর চক্ষু দিয়ে দেখতে পেলেন তাকে অভ্যার্থনা জানানোর জন্য কাবাঘর তাঁর দিকে এগিয়ে আসছে। এ দৃশ্য দেখে তিনি বললেন, হে দয়াময় খোদা! এ ঘর দিয়ে আমি কি করবো? আমি যে এ ঘরের মালিকেরই প্রত্যাশী। যে মালিক বলেছেন, ‘যে বান্দা আমাকে পাওয়ার জন্য এক বিঘত অগ্রসর হয়, আমি তার দিকে এক হাত এগিয়ে যাই।’ সুতরাং হে দয়াময় খোদা! আমি শুধু কাবাঘর ও এর শোভায় কীভাবে খুশী হতে পারি?
জানা যায়, ঐ বছরই বলখের বাদশাহ হযরত ইব্রাহীম বিন আদহাম (রহ.) মক্কা শরীফে হজ করতে গিয়েছিলেন। তিনি স্বীয় বাসস্থান থেকে রওনা করে প্রত্যেক পদক্ষেপে দুরাকাত করে নফল নামাজ আদায় করছিলেন। আর মক্কার উদ্দেশে পায়ে হেঁটে তিনি অগ্রসর হচ্ছিলেন। এ কারণে মক্কায় পৌঁছতে তার দীর্ঘ ১২ বছর অতিবাহিত হয়েছিল। সেখানে গিয়ে তিনি মোরাকাবায় বসেন এবং দেখতে পান যে, কাবা শরীফ নেই। এ অবস্থা দেখে তিনি সেজদায় পড়ে চিৎকার করে বললেন, হে দয়াময় খোদা! এত সাধনা- রিয়াজত করে তোমার ঘর তাওয়াফ করতে আসলাম অথচ কাবাঘর দেখারও সৌভাগ্য হলো না। তৎক্ষণাৎ এলহাম এলো, হে ইব্রাহীম! অধৈর্য হয়ো না। তোমার ইচ্ছা পূর্ণ হবে। কাবাঘর যথাস্থানেই ছিল, কিন্তু আমিই তাকে পাঠিয়েছি আমার এক প্রিয় আশেক রাবেয়া বসরিকে অভ্যর্থনা জানিয়ে নিয়ে আসার জন্য। মহান রাব্বুল আলামিনের পক্ষ থেকে এলহামের মাধ্যমে এ সংবাদ পেয়ে হযরত ইব্রাহীম বিন আদহাম (রহ.)-এর জজবা হয়ে গেল। তিনি উচ্চ আওয়াজে কাঁদতে লাগলেন। ইতিমধ্যে কাবাঘর হযরত রাবেয়া বসরি (রহ.)-কে অভ্যর্থনা জানিয়ে বায়তুল্লাহ চত্বরে পৌঁছে যায়। হযরত ইব্রাহীম বিন আদহাম (রহ.) জিজ্ঞেস করলেন, হে রাবেয়া! কোন সাধনা বলে আপনি এত উচ্চ মর্যাদা লাভ করলেন? হযরত রাবেয়া বসরি (রহ.) বললেন, হে ইব্রাহীম! আপনি এখানে কেনো এসেছেন? জবাবে হযরত ইব্রাহীম বিন আদহাম (রহ.) বললেন, আমি তো কাবা শরীফের জিয়ারতেই এখানে এসেছি। হযরত রাবেয়া বসরি (রহ.) বললেন, আমি তো এসেছি কাবার মালিক মহান আল্লাহর জিয়ারতে। তাই কাবার মালিক দয়া করে আমার অভ্যর্থনায় কাবাকে পাছিয়েছেন। হযরত ইব্রাহীম বিন আদহাম (রহ.) লজ্জিত হয়ে পড়লেন। নিজের অজ্ঞতার জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। (তথ্য সূত্র : তাযকেরাতুল আউলিয়া)
এভাবেই মহান রাব্বুল আলামিন হযরত রাবেয়া বসরি (রহ.)-কে উচ্চস্তরের অলীত্বের মর্যাদা দিয়ে সম্মানিত করেছেন। আসলে সাধারণ মানুষ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কাবার জিয়ারতে যায়। আর আল্লাহ কাবাঘরকে অলী-আল্লাহগণের অভ্যর্থনার জন্য পাঠিয়ে তাঁদেরকে সম্মানিত করেন। এজন্য হযরত জালাল উদ্দিন রুমী (রহ.) বলেন- “দিলবদস্তে আরকে হজে আকবারাস্ত; ছাদহাজারা কাবা ইয়েক দিল বেহেতেরাস্ত।” অর্থাৎ- হে আশেক! তুমি যদি আল্লাহর বন্ধুকে ভালোবাসতে পারো, আকবরি হজের চেয়ে উত্তম ও বেশি ফলদায়ক হবে। লক্ষ কাবার চেয়ে আল্লাহকে ধারণকারী একটি পুতঃ পবিত্র হৃদয়ের মর্যাদা অনেক বেশি। আর এ মর্তবা বেশি হওয়ার কারণ প্রসঙ্গে হযরত জালাল উদ্দিন রুমী (রহ.) বলেন- “ইয়ে কাবা বেনায়ে আবো গেলাস্ত; আকাবা বেনায়ে আজ নুরে খোদাস্ত।” অর্থাৎ- বায়তুল্লাহ্ শরীফের কাবাঘরকে পানি ও পাথর দিয়ে তৈরি করা হয়েছে, আর মুমেন ব্যক্তির দিল কাবাকে আল্লাহর খাছ নুর দিয়ে তৈরি করা হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, “ইয়ে কাবা ওজার গাহে খালিলাস্ত; আকাবা গুজারগাহে রাব্বি জালিলাস্ত।” অর্থাৎ এ কাবায় হযরত ইব্রাহীম (আ.) বসবাস করতেন, আর মুমেন ব্যক্তির দীল কাবাতে আল্লাহ নিজে বসবাস করেন।
অলী-আল্লাহ্গণের সান্নিধ্য লাভের জন্য পবিত্রকুর আনে এরশাদ হয়েছে- “হে বিশ^াসীগণ! তোমরা আল্লাহকে পাওয়ার জন্য অসিলা অন্বেষণ কর।’ (সূরা মায়েদা ৫ : আয়াত ৩৫)
এ অসিলা হচ্ছে নবুয়তের যুগে নবি-রাসুলগণ এবং বেলায়েতের যুগে অলী-আল্লাহগণ। নবি-রাসুলগণের উদ্দেশ্যই ছিল সমকালীন যুগের মানুষের চরিত্রের উৎকর্ষ সাধন করা। হযরত আনাস বিন মালিক (রা.) বলেন যে, আল্লাহর রাসুল (সা.) ফরমান, ‘‘উত্তম চরিত্রকে পূর্ণতা দানের জন্য আমাকে পাঠানো হয়েছে।’’ অন্যত্র আল্লাহর রাসুল বলেন- “ইন্নামা বুয়িসতু মুয়াল্লিমান।” অর্থাৎ আমি মানবজাতির শিক্ষক রূপে প্রেরিত হয়েছি।
পরবর্তীতে নায়েবে রাসুল অর্থাৎ অলী-আল্লাহগণ রাসুলের সেই রূহানি শক্তিতে বলীয়ান হয়ে মানবজাতিকে রাসুলের আদর্শে আদর্শবান করে যাচ্ছেন। বিশ^নবি হযরত রাসুল (সা.) দীর্ঘ ১৫ বছর জাবালে নুরের হেরা গুহায় মোরাকাবা করে ঐশী শক্তি তথা এলমে তাসাউফ অর্জনের মাধ্যমে বর্বর আরব জাতিকে সভ্য জাতিতে এবং উত্তম চরিত্রাদর্শে পরিণত করেছেন। যার ফলে তাঁরা উত্তম চরিত্রের অধিকারী হয়ে আল্লাহর সাথে যোগাযোগের শিক্ষা পেয়েছেন। হযরত রাসুল (সা.) কোনো মাদ্রাসা, স্কুল, কলেজ বা বিশ^বিদ্যালয়ে পড়েননি অথচ মহান আল্লাহ তাঁকে মানবজাতির জন্য শ্রেষ্ঠ শিক্ষক হিসেবে প্রেরণ করেছেন।
কিতাব পড়ে আমরা আল্লাহ সম্বন্ধে জানতে পারি কিন্তু আল্লাহকে পেতে হলে যিনি আল্লাহকে পেয়েছেন, এমন একজন মহামানবের কাছে গিয়ে এলমে তাসাউফের শিক্ষা অর্জন করতে হয়। যুগে যুগে এটাই হচ্ছে আল্লাহকে পাওয়ার একমাত্র পদ্ধতি। যেমন- ড্রাইভিং শিখতে হলে ড্রাইভিং শিখা যায় সে সম্পর্কিত বই মুখস্ত করে গাড়ি চালানো সম্ভব নয়। বই পড়ে গাড়ি চালানোর যে বিষয়গুলো প্রয়োজন যেমন- এক্সেলেটার, ব্রেক, ক্লাচ ইত্যাদি সম্বন্ধে জানা যায় কিন্তু গাড়ি চালানো সম্ভব নয়। সেজন্য প্রয়োজন একজন দক্ষ চালকের। তার নিকটে গিয়ে অনুশীলন করে ড্রাইভিং শেখা সম্ভব।
পৃথিবীতে প্রতিটি শিক্ষা অর্জন করতে হলে একজন শিক্ষকের প্রয়োজন। এজন্যই মহান আল্লাহ যুগে যুগে পথহারা মানুষকে তাঁর পথে আনার জন্য শিক্ষক তথা মোর্শেদ হিসেবে নবুয়তের যুগে ১ লক্ষ ২৪ হাজার নবি-রাসুল এবং বেলায়েতের যুগে অসংখ্য আউলিয়ায়ে কেরাম পাঠিয়েছেন। যদি কিতাব পড়ে আল্লাহকে পাওয়া যেতো, তাহলে এত নবি-রাসুল আল্লাহ দুনিয়াতে পাঠাতেন না। নবি-রাসুলগণ সাধনা করে আল্লাহর সাথে যোগাযোগ করে নবুয়তি লাভ করে আল্লাহর পক্ষ থেকে কিতাব অর্জন করেছিলেন।
তাইতো কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন, ‘‘মানুষ এনেছে গ্রন্থ; গ্রন্থ; আনেনি মানুষ কোনো।’’ অর্থাৎ- মহামানবগণের সুমহান শিক্ষা ও আদর্শ নিজ হৃদয়ে ধারণ করার নামই ধর্ম। তাঁদের অনুসরণই সত্যিকার ধর্ম। আল্লাহর রাসুল (সা.) ফরমান- “তাখাল্লাকু বিআখলাকিল্লাহ।” অর্থাৎ- তোমরা আল্লাহর চরিত্রে চরিত্রবান হও।
(শরহে আক্বীদাতুত তাহাবিইয়্যাহ, ১ম খণ্ড, ১৭৭ পৃষ্ঠা)
পবিত্র কুআনের মহান আল্লাহ বলেন- “ছিবগাতাল্লাহ।” অর্থাৎ- তোমরা আল্লাহর রঙে রঙিন হও। হযরত রাসুল (সা.)-এর চরিত্র সম্বন্ধে আল্লাহ তায়ালা ফরমান- “তোমাদের জন্য রাসুলুল্লাহ্ (সা.)-এর মধ্যেই রয়েছে উত্তম আদর্শ।” (সূরা আয্হাব ৩৩ : আয়াত ২১)
হযরত রাসুল (সা.)-এর সুমহান আদর্শ আমরা কোথায় পাবো? মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে এ সম্পর্কে সুস্পষ্ট দিক নির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি এরশাদ করেন- “আতিউল্লাহা ওয়া আতিউর রাসুলা ওয়া উলিল আমরি মিনকুম।” অর্থাৎ- তোমরা আল্লাহর আনুগত্য করো, রাসুলের আনুগত্য করো এবং তোমাদের মধ্যে যিনি উলিল আমর তাঁর আনুগত্য করো। (সূরা নিসা ৪ : আয়াত ৫৯) এখানে উলিল আমর বলতে হুকুমদাতা তথা আধ্যাত্মিক নেতাকে বুঝানো হয়েছে। মহামানবগণের সোহবত লাভের কথা পবিত্র কুরআন ও হাদিসে বহুবার বর্ণিত হয়েছে।
হযরত জালাল উদ্দিন রুমী (রহ.) বলেছেন- “সোহবতে ছালেহ তোরা ছালেহ কুনাদ, সোহবতে তালে তোরা তালে কুনাদ।” অর্থাৎ- সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ। তিনি আরও বলেন- “ইয়েক জামানা সোহবতে বা আউলিয়া, বেহতর আজ সাদ সালাতা-আত বেরিয়া।” অর্থাৎ- আল্লাহর বন্ধুর এক মুহুর্তের সংসর্গ, একশত বছরের নিরহংকার ইবাদতের চেয়েও উত্তম।
সোহবতের উপকারিতা লাভ করার জন্যই পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে- “ইয়া আইয়্যুহাল্লাজিনা আমানুত্তাকুল্লাহা ওয়াকুনু মাআছ সাদেকিন।” অর্থাৎ- হে বিশ^াসীগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং সত্যাশ্রয়ীদের (সাদেকীন) সঙ্গ লাভ করো। (সূরা তওবা ৯ : আয়াত ১১৯)
এ সাদেকীন হচ্ছে নবি-রাসুলগণ এবং বেলায়েতের যুগে অলী-আল্লাহগণ। সোহবত বা সংসর্গের প্রভাব অবশ্যই আছে। যে কোনো অসৎ ব্যক্তি যদি সৎ লোকের সঙ্গ অবলম্বন করে তবে তার সৎ স্বভাব অর্জনের সম্ভাবনাই বেশি। অনুরূপভাবে, কোনো পুণ্যবান ব্যক্তি যদি অসৎ লোকের সঙ্গ অবলম্বন করে তাহলে অন্যকে সে তাই দিতে পারে বা দেওয়ার চেষ্টা করে। সৎ বা পুণ্যবান লোকের ভিতরে, সততা, সদাচার, ন্যায়নিষ্ঠা, ধর্মপরায়ণতা ইত্যাদি সৎগুণ বিদ্যমান থাকে। অসৎ বা বদকার লোক সৎ লোকের সংস্পর্শে গেলে সে তাকে অসৎ পরামর্শ ও সদুপদেশ দিয়ে সৎগুণ অর্জনে উদ্ধুদ্ধ করতে পারেন। পক্ষান্তরে, অসৎ লোকেরা খারাপ এবং শয়তানী মনোভাবাপন্ন। তারা কোনো পুণ্যবান লোককে পেলে খারাপ পরামর্শ দিয়ে কু-পথে পরিচালিত করার চেষ্টা করে। সাধারণ মানুষের তুলনায় অলী-আল্লাহগণের সংস্পর্শে বা সোহবতের প্রভাব ভিন্নভাবে কাজ করে। সূর্য থেকে যেমন সর্বক্ষণ আলো বিকিরণ হয়, যে আলোর সাহায্য ছাড়া পৃথিবীর বুকে প্রাণের সঞ্চার হওয়া সম্ভব নয়, তেমনি এত্তেহাদি তাওয়াজ্জোহর অধিকারী মহামানবগণের অসামান্য ক্ষমতাধর আত্মা থেকে সর্বক্ষণ সূর্যের আলোর ন্যায় ফায়েজ ওয়ারেদ (বর্ষিত) হয়। মানুষসহ অন্যান্য সকল মাখলুকাত সেই ফায়েজের সূক্ষ্ম শক্তি থেকে নানাভাবে উপকৃত হয়, যা ভাষায় বর্ণনা করে শেষ করা যায় না। এরূপ অলী-আল্লাহগণের মাধ্যমে আল্লাহর রহমত ও বরকত জগতে বর্ষিত হয়। পরশ পাথরের স্পর্শ যেমন লোহাকে স্বর্ণে রূপান্তরিত করার জন্য যথেষ্ট, তেমনি আল্লাহর প্রিয় বন্ধু মহামানবগণের সান্নিধ্য একজন মানুষের চরিত্র ও ভাগ্য পরিবর্তন করে দিতে সক্ষম।
হযরত রাসুল (সা.)-এর ফায়েজ ও তাওয়াজ্জোহর দ্বারা বর্বর পাপাচারী আরবজাতি আদর্শ চরিত্রের অধিকারী হয়েছিল। আর এ আদর্শ নিজ হৃদয়ে ধারণ করার জন্য আল্লাহর প্রিয় বন্ধুর সান্নিধ্যে যাওয়া শর্ত। তাঁর রূহানি ফায়েজ হাসিল করার চেষ্টা থাকা প্রয়োজন। তবেই পাপাচারী মানুষ ইমানদার এমনকি আউলিয়ার মর্তবা লাভে সক্ষম হয়। তাই অলী-আল্লাহগণের সোহবতে গিয়ে কোনো মানুষ যদি তাঁর নেক নজরে পড়ে, তখন সে লোকটি পরিশুদ্ধ চরিত্রের অধিকারী হতে পারে।
এ প্রসঙ্গে সুলতানিয়া মোজাদ্দেদিয়া তরিকার ইমাম সৈয়দ আবুল ফজল সুলতান আহমদ (রহ.) বলেন, ‘‘কামেল অলীর এক তাওয়াজ্জোহতে মানুষের অন্তরের মন্দ দোষগুলি যেরূপ দূরীভূত হয়, শত ওয়াজ নছিয়ত ও শত কিতাব পাঠেও উহার সমান হয় না।’’
তাইতো জনৈক সাধক বলেন- মোর্শেদের নেকদৃষ্টিতে (তাওয়াজ্জোহ্তে) যত পাপ ঝরে, মুরিদের কি সাধ্য আছে তত পাপ করে!
সুতরাং চরিত্রবান হওয়ার জন্য আত্মার চিকিৎসক অলী-আল্লাহগণের সোহবতে গিয়ে তাঁদের কাছ থেকে আধ্যাত্মিক শিক্ষা অর্জন করত ফায়েজ হাসিলের মাধ্যমে নিজের ভিতরের ষড়রিপুকে পরিশুদ্ধ করে আত্মশুদ্ধি লাভ করতে হয়। তাই হযরত রাসুল (সা.) সাহাবিদেরকে প্রথমেই তাঁদের ক্বালবে আল্লাহ নামের জি¦কির স্থাপন করে আত্মশুদ্ধির শিক্ষা দিয়েছিলেন। এ আত্মশুদ্ধির মাধ্যমেই তৎকালীন আরবজাতি শান্তিপূর্ণ সমাজ গড়তে সক্ষম হয়েছিলেন। হযরত রাসুল (সা.)-এর প্রধান শিক্ষাই ছিল আত্মশুদ্ধি, ক্বালবে আল্লাহর জি¦কির জারি এবং একাগ্রচিত্তে নামাজ আদায় করা। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘‘সেই সফলকাম যে আত্মশুদ্ধি লাভ করেছে, ক্বালবে আল্লাহ নামের জি¦কির জারি করেছে এবং একাগ্রচিত্তে নামাজ আদায় করেছে।’’ (সূর আলা ৮৭ : আয়াত ১৪-১৫)
বর্তমানে এই একই শিক্ষা দিচ্ছেন মহান সংস্কারক মোহাম্মদী ইসলামের পুনর্জীপনদানকারী সূফী সম্রাট হযরত দেওয়ানবাগী (মা. আ.) হুজুর কেবলাজান। তিনি এ তিনটি শিক্ষা দেওয়ার পাশাপাশি আশেকে রাসুল হওয়ার শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছেন। তাঁর সোহবতে এসে লক্ষ লক্ষ মানুষ হযরত রাসুল (সা.)-এর দিদার লাভ করত আশেকে রাসুল হওয়ার গৌরব অর্জন করছেন।
সূফী সম্রাট হযরত দেওয়ানবাগী (মা. আ.) হুজুর কেবলাজান বলেন, ‘‘সমাজ ব্যক্তিকে শুদ্ধ করতে পারে না। আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে ব্যক্তি শুদ্ধ হয়, ব্যক্তি শুদ্ধির মাধ্যমে সমাজ শুদ্ধ হয় এবং সমাজ শুদ্ধির মাধ্যমেই দেশ বা জাতি শুদ্ধ হয়।’’
হযরত রাসুল (সা.)-এর সোহবতে থেকে সাহাবিরা বিশে^র শ্রেষ্ঠ জাতিতে পরিণত হয়েছিলেন। তাঁরা রাহমাতুল্লিল আলামিন হযরত রাসুল (সা.)-কে জীবনের চেয়ে বেশি ভালোবাসতেন। যারা কারণে রাসুলের প্রেমে দেওয়ানা হয়ে পরিবার-পরিজন, সহায়-সম্পদ, বাড়ি-ঘর সবকিছু ত্যাগ করে মক্কা থেকে হিজরত করে মদিনায় হযরত রাসুল (সা.)-এর সোহবতে হাজির হয়েছিলেন। তাঁদেরকে মোহাজের (হিজরতকারি) বলা হয়েছে। আর যারা মদিনায় হযরত রাসুল (সা.)-কে ভালোবেসে তাঁর কদমে নিজেদেরকে উৎসর্গ করেছিলেন, তাঁরা হলেন আনসার (সাহায্যকারী)। তখন মদিনার আনসাররা হযরত রাসুল (সা.)-কে সম্পদ ভাগাভাগি করে দিয়েছেন, এমনকি তাঁরা নিজের দুই বা ততোধিক স্ত্রীর মধ্যে একজনকে মোহাজের ভাই-এর নিকট বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করেছিলেন। রাসুরে প্রেমে দেওয়ানা হয়ে হাবসী ক্রীতদাস হযরত বেলাল (রা.)-কে উত্তপ্ত বালুর মধ্যে চাপা দেওয়ার পরও তিনি রাসুলের প্রেম থেকে দূরে সরে যাননি। তাই হযরত বেলাল (রা.)-কে আজও সারাবিশে^র মানুষ আশেকে রাসুল হিসেবে চিনে থাকেন।
হযরত রাসুল (সা.)-কে ভালোবাসার গুরুত্বের বর্ণনা দিতে গিয়ে মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে এরশাদ করেন- “ক্বুল ইন কুনতুম তুহিব্বুনাল্লাহা ফাত্তাবিয়ুনি ইউহবিব কুমুল্লাহু ওয়া ইয়াগফিরলাকুম জুনুবাকুম।” অর্থাৎ- ‘‘হে রাসুল! আপনি বলে দিন, তোমরা যদি আল্লাহকে ভালোবাসতে চাও, তাহলে আমাকে অনুসরণ কর, তবেই আল্লাহ্ তোমাদের ভালোবাসবেন এবং তোমাদের যাবতীয় পাপসমূহ ক্ষমা করবেন।’’ (সূরা আলে ইমরান ৩ : আয়াত ৩১)
এ প্রসঙ্গে হযরত রাসুল (সা.) ফরমান- “লা ইউমিনু আহাদুকুম হাত্তা আকুনা আহাব্বা ইলাইহি মিউ ওয়ালাদিহি ওয়া ওয়ালিদিহি ওয়ান্নাছি আজমাইন।” অর্থাৎ- যে ব্যক্তি নিজের পিতা-মাতা, সন্তান-সন্ততি ও সব মানুষের চেয়ে আমাকে বেশি ভালো না বাসবে, সে মু’মেন হতে পারবে না। (বুখারী ও মুসলিম শরীফ)
যারা প্রকৃত মুমেন তারা রাসুল (সা.)-কে নিজের জীবন ও পিতা-মাতার চেয়েও বেশি ভালোবাসেন। তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত সাহাবায়ে কেরাম। পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে- ‘‘নবি মুমেনদের নিকট তাদের জীবনের চেয়েও অধিক শ্রেয়।’’ (সূরা আহযাব ৩৩ : আয়াত ৬)
বেলায়েতের যুগে বাহ্যিকভাবে হযরত রাসুল (সা.) উপস্থিত না থাকলেও তাঁর সিরাজাম মুনিরার নুর অর্থাৎ নুরে মোহাম্মদী সিনায় ধারণ করে নায়েবে রাসুল বা অলী-আল্লাহগণ মানুষকে মুমেন এবং আল্লাহ ও রাসুলের আশেকে পরিণত করেন। মুমেনদের জন্য তা রাসুল (সা.)-এর পক্ষ থেকে রহমত স্বরূপ। হযরত রাসুল (সা.)-এর পক্ষ থেকে প্রাপ্ত রহমত লাভকারীরাই রাসুলের আশেক হন, যা বর্তমানে আশেকে রাসুলদের মাঝে লক্ষ্য করা যায়। রাসুলের যুগেও সাহাবাগণ পিতা-মাতার চেয়ে হযরত রাসুল (সা.)-কে অনেক বেশি ভালোবাসতেন। এ প্রসঙ্গে হযরত রাসুল (সা.)-এর মহিলা সাহাবি হযরত আফিফা (রা.)-এর একটি ঘটনা উল্লেখ করা হলো-
৩য় হিজরিতে কাফেরদের সাথে উহুদ প্রান্তরে যুদ্ধ সংঘটিত হয়। খালিদ ইবনে ওয়ালিদের নেতৃত্বে কাফেরেরা পশ্চাদ দিক হতে মুসলিম বাহিনীর উপর আক্রমণ চালায়। এতে উতবা ইবনে আবি ওয়াক্কাস কর্তৃক নিক্ষিপ্ত পাথরের আঘাতে দয়াল রাসুল (সা.)-এর নীচের মাড়ির একটি দাঁত মোবারক ভেঙে যায়। কুরায়েশদের বিখ্যাত বীর আবদুল্লাহ ইবনে কামিয়্যার তরবারির আঘাতে আল্লাহর হাবিবের গাল মোবারক কেটে পরিহিত লৌহ শিরস্ত্রাণের দুটি শলাকা ভিতরে ঢুকে যায়। আবদুল্লাহ্ ইবনে শিহাব সুহরির নিক্ষিপ্ত পাথরের আঘাতে হযরত রাসুল (সা.)-এর কপাল মোবারক ফেটে রক্ত প্রবাহিত হতে থাকে। আল্লাহর হাবিব উপর্যুপরি পাথরের আঘাতে সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেন। হযরত আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহু ও হযরত তালহা (রা.) দয়াল রাসুলকে ধরাধরি করে নিকটস্থ পাহাড়ের চূড়ায় নিয়ে যান। এমন সময় কাফেরেরা ঘোষণা করল, ‘মোহাম্মদ নিহত হয়েছেন।’ সংবাদ পেয়ে রাসুল (সা.)-এর আশেক প্রেমিকগণ ঘরে থাকতে পারলেন না। মদীনার মহিলারা পর্যন্ত রাহমাতুল্লিল আলামিন হযরত রাসুল (সা.)-এর মহব্বতে রাস্তায় বেরিয়ে পড়লেন। আফিফা নামে এক মহিলা সাহাবি রাসুল (সা.)-এর শাহাদতের কথা শুনে সহ্য করতে না পেরে পাগলিনীর মতো উহুদের দিকে দৌড়াচ্ছিলেন। পথে এক সাহাবির সাথে দেখা হয়, তিনি বললেন, আফিফা কোথায় যাচ্ছ? এ যুদ্ধে তোমার স্বামী শাহাদত বরণ করেছে, আফিফা বলেন, ইন্নালিল্লাহ। বলো, দয়াল রাসুল (সা.) কেমন আছেন? কিছু দূর গেলে অন্য এক সাহাবি বলেন, হে মহিলা! পাগলের মতো কোথায় যাচ্ছ? তোমার পিতা এ যুদ্ধে শাহাদত বরণ করেছে। মহিলা বলেন, ইন্নালিল্লাহ্। বলো, দয়াল রাসুল (সা.) কেমন আছেন? আরও কিছুদূর অগ্রসর হলে এক সাহাবি বলল, হে আফিফা! পাগল হয়ে কোথায় যাচ্ছ? তুমি জান না এ যুদ্ধে তোমার সন্তান ও ভাই শাহাদত বরণ করেছে। মহিলা বলেন, ইন্নালিল্লাহ। বলো আমার দয়াল রাসুল (সা.) কোথায় আছেন? কেমন আছেন? ঐ সাহাবি বললেন- বোন! তোমাদের মতো আশেকদের জন্যই আল্লাহ তাঁর রাসুলকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। সাহাবির কাছে সংবাদ পেয়ে আফিফা (রা.) পাগলের মতো দৌড়িয়ে পাহাড়ের চূড়ায় গিয়ে বললেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! এ যুদ্ধে আমার স্বামী, আমার পিতা, আমার সন্তান, আমার ভাই শহিদ হয়েছে সেজন্য আমার মনে দুঃখ নেই, আপনাকে দেখে আমার মনের সকল জ¦ালা-যন্ত্রণা দূর হয়ে গেছে।
সাহাবায়ে কেরাম হযরত রাসুল (সা.)-কে যে কতো বেশি ভালোবাসতেন, আশেকা রাসুল হযরত আফিফা (রা.)-এর ঘটনায় তা সুস্পষ্ট হয়ে উঠে। আল্লাহর মনোনীত নবি-রাসুল ও অলী-আল্লাহগণও ঐ প্রেমের মাধ্যমে মানুষের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করেন। যে কারণে মানুষ নিজের জীবনকে উৎসর্গ করতেও দ্বিধাবোধ করে না। হযরত রাসুল (সা.)-এর সাথে মুমেনের সম্পর্ক প্রেম-ভালোবাসার।
বর্তমান যুগে আশেকে রাসুলগণ রাসুলের সিরাজাম মুনিরার ধারক-বাহক সূফী সম্রাট হযরত দেওয়ানবাগী (মা. আ.) হুজুর কেবলাজানকে হৃদয় দিয়ে ভালোবাসেন। এভাবে মোর্শেদের মাধ্যমে রাসুলের আদর্শে উজ্জীবিত হতে পারলেই সত্যিকার রাসুল প্রেমিক হওয়া সম্ভব। আমাদের মহান মোর্শেদ সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজানের সোহবত লাভ করে আমরা যদি সাহাবায়ে আজমাইনদের মতো নিজের জীবনকে উৎসর্গ করতে পারি, তাহলেই হবে আমাদের জীবনের সার্থকতা এবং মোহাম্মদী ইসলামের জন্য উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। আল্লাহ আমাদের সবাইকে সেই তৌফিক দান করুন। আমিন।
[লেখক: পরিচালক, সমন্বয়ক ও সমস্যার ফয়সালাকারী, দেওয়ানবাগ শরীফ; সহকারী অধ্যাপক, ফারইস্ট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি]