পবিত্র আশুরা মহান আল্লাহর অভিষেকের দিন, রহমতপূর্ণ এ দিবসের গুরুত্ব অপরিসীম
মহান সংস্কারক, মোহাম্মদী ইসলামের পুনর্জীবনদানকারী সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহবুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (মা. আ.) হুজুর কেবলাজান
মহান রাব্বুল আলামিন সৃষ্টির সূচনা থেকেই সময় গণনার নিয়ম-পদ্ধতি চালু করেছেন। আর আল্লাহ্র সে সময় গণনার পদ্ধতিতে মাসের সংখ্যা বারোটি। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন- ‘‘নিশ্চয় মাসসমূহের সংখ্যা আল্লাহর কাছে বারো মাস, সুুনির্দিষ্ট রয়েছে আল্লাহ্র কিতাবে সেদিন থেকে যেদিন তিনি সৃষ্টি করেছেন আসমান ও জমিন, এর মধ্যে চারটি মাস সম্মানিত। এটিই সুপ্রতিষ্ঠিত ধর্মমত।’’ (সূরা আত তাওবাহ ৯ : আয়াত ৩৬) আর সম্মানিত এ চারটি মাস হলো- রজব, জিলকদ, জিলহজ ও মহররম মাস।
ইসলামি বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস মহররম। এ মাসের ১০ তারিখে পবিত্র আশুরার দিবসেই মহান আল্লাহ আসমান ও জমিনের সৃষ্টিকার্য সম্পাদন করে সৃষ্টিজগতের প্রতিপালক হিসেবে আরশে সমাসীন হয়েছিলেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন- ‘‘নিশ্চয় তোমাদের পালনকর্তা আল্লাহ, যিনি সৃষ্টি করেছেন আসমান ও জমিন ছয় দিনে, তারপর তিনি সমাসীন হন আরশে, তিনি পরিচালনা করেন প্রতিটি কাজ।’’ (সূরা ইউনুস ১০ : আয়াত ৩)
মহান আল্লাহ সর্বপ্রথম যেদিন আরশে সমাসীন হয়ে জগতসমূহ লালন পালনের মহান দায়িত্ব নিজগুণে দয়া করে গ্রহণ করেন, সেদিন সকল আদম সন্তানের রূহসমূহ মহান আল্লাহকে ‘রব’ অর্থাৎ ‘প্রতিপালক’ হিসেবে স্বীকার করে নেন। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে এরশাদ করেন- ‘‘স্মরণ করো, আদম সন্তানদের পৃষ্ঠদেশ থেকে তোমার রব বের করলেন তাদের বংশধরদের এবং তাদের থেকে স্বাীকারোক্তি নিলেন তাদেরই সম্মন্ধে এবং বললেন- ‘আমি কি তোমাদের প্রভু নই?’ তারা বলল : হ্যাঁ, আমরা সাক্ষী রইলাম! (তা এজন্য যে) তোমরা যেন কিয়ামতের দিন বলতে না পার যে, আমরা তো এ ব্যাপারে বেখবর ছিলাম।’’ (সূরা আল আ’রাফ ৭ : আয়াত ১৭২)
উল্লেখ্য, মহান রাব্বুল আলামিনের আরশে সমাসীন হওয়ার এ দিবসই ছিলো মহররমের ১০ তারিখ শুক্রবার। হযরত ইকরামা (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন- ‘‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা আসমান ও জমিন এবং এদু’য়ের মাঝে যা কিছু রয়েছে, তা (সবকিছু) সৃষ্টির সূচনা করেছেন রোববার দিন। অতঃপর তিনি (সৃষ্টিকার্য সমাপ্ত করে) শুক্রবার দিন (আশুরার দিনে) আরশে সমাসীন হয়েছেন।’’ (তাফসীরে দুররে মানছুর ৮ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪৭২)
অতএব, পবিত্র কুরআন ও হাদিস শরীফের বাণী মোবারকের আলোকে বিষয়টি সুস্পষ্ট যে, মহান আল্লাহ মহররম মাসের ১০ তারিখে পবিত্র আশুরার দিবসে আরশে সমাসীন হয়েছিলেন। এ প্রসঙ্গে গুনিয়াতুত ত্বালিবীন কিতাবের ১ম খণ্ডের ৩২৬ পৃষ্ঠায় কাদেরিয়া তরিকার ইমাম বড়পীর মহিউদ্দীন হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রহ.) লিখেছেন- ‘‘আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আশুরার দিনে আরশে সমাসীন হয়েছেন। আর এ বিশ^জাহান ধ্বংসও হবে এ দিন। সর্বপ্রথম বৃষ্টি ও আল্লাহর রহমত দুনিয়াতে বর্ষিত হয় এ আশুরার দিন।’’
প্রকৃতপক্ষে ১০ই মহররম পবিত্র আশুরার দিবসটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যমণ্ডিত। আর এটি এজন্য যে, মহান আল্লাহ পবিত্র আশুরার দিনেই আসমান ও জমিন, আরশ, কুরসি, লউহ, কলম সবকিছু সৃষ্টি সুসম্পন্ন করে রাব্বুল আলামিন তথা জগতসমূহের প্রতিপালকরূপে আরশে অধিষ্টিত হয়েছিলেন। অতঃপর এ দিবসেই তিনি সকল রূহকে সামনে হাজির করে তাদের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করেছিলেন ‘আলাসতু বিরাব্বিকুম?’ অর্থাৎ ‘আমি কি তোমাদের প্রভু নই?’ ক্বালু বালা অর্থাৎ ‘রূহসমূহ জবাব দিয়েছিলো নিশ্চয়ই, আপনি আমাদের প্রতিপালক।’ ইতিপূর্বে উল্লেখিত সূরা আল আরাফের ১৭২ নম্বর আয়াতে এ বিষয়টি মহান আল্লাহর বাণী মোবারক থেকেই সুস্পষ্ট হয়েছে। সুতরাং বিষয়টি সুস্পষ্ট যে, পবিত্র আশুরা আল্লাহ তায়ালার অভিষেকের দিন, এ দিনে মহান আল্লাহ আরশে সমাসীন হয়ে রব বা প্রতিপালক হিসেবে সৃষ্টি জগতের সামনে নিজেকে প্রকাশ করেছিলেন। এ জন্য আশুরার দিবসের ফজিলত অপরিসীম। কোনো দেশের বা রাজ্যের রাজা যেদিন সিংহাসনে আরোহণ করেন, সে দিনটি ঐ রাজ্যের রাজা ও প্রজাদের কাছে বিশেষ স্মরণীয় ও সম্মানিত দিন। সেদিন প্রজাদের জন্য চাওয়া এবং পাওয়ার দিন। তেমনি আশুরা মহান আল্লাহ ‘রাব্বুল আলমিন’ হিসেবে অভিষেকের দিন হওয়ায় এ দিবসটি আল্লাহর বান্দাদের চাওয়া ও পাওয়ার দিন। ১০ই মহররম আশুরার দিবসে বান্দা আল্লাহর কাছে কিছু প্রার্থনা করলে, সে প্রার্থনা অপূর্ণ থাকে না।
মূলে আশুরার দিবসটি মহান আল্লাহর অভিষেকের দিন হওয়ায় এ দিবসের বরকতে অসংখ্য নবি-রাসুলের বিপদ-আপদ, বালা-মুসিবত দূর হয়েছে।
পবিত্র কুরআন ও হাদিস শরীফে আশুরার বর্ণনা
মহররমের ১০ তারিখে পবিত্র আশুরা মহান আল্লাহর অভিষেকের দিন হওয়ায় এ দশ তারিখ অর্থাৎ দশ সংখ্যাটির কসম করে মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে আয়াত নাযিল করেছেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন- ‘‘কসম ফজরের সময়ের, কসম দশ রাতের (অর্থাৎ মহররমের ১০ তারিখের)।’’ (সূরা আল ফাজর ৮৯ : আয়াত ১ ও ২) অত্র আয়াতে দশ তারিখকে দশ রাত বলা হয়েছে এজন্য যে, আরবি তারিখ গণনা করা হয় রাতের শুরুর সময় থেকে। এ আয়াতের ব্যাখ্যায় হযরত আব্দুলাহ ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন- ‘‘আল্লাহর বাণী- ‘আর কসম দশ রাতের।’ হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন- এর দ্বারা বছরের প্রথম মাস মহররমের দশ দিন অর্থাৎ পবিত্র আশুরাকে বুঝানো হয়েছে। অথবা জিলহজের দশদিন বুঝনো হয়েছে।’’ (তাফসীরে তাবারী ৩০নং খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৬৮)
এমনিভাবে হযরত ইবনে যায়েদ (রহ.) হতে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন- ‘‘আল্লাহর বাণী- ‘আর কসম দশ রাতের।’ ইবনে যায়েদ (রহ.) বলেন, এর দ্বারা মহররমের প্রথম ১০ দিন (আশুরার দিন) বুঝানো হয়েছে অথবা জিলহজের দশ দিন বুঝানো হয়েছে।’’ (তাফসীরে তাবারী ৩০নং খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৬৯)
মহান আল্লাহ আশুরার দিবসে জমিনে তাঁর প্রতিনিধি করে হযরত আদম (আ.)-কে যেমন সৃষ্টি করেন, তেমন এ দিবসেই তাঁকে বেহেশতেও প্রবেশ করান। অতঃপর এ দিবসেই তাঁকে দুনিয়াতে প্রেরণ করা হয়। আর আশুরার পবিত্র দিবসেই হযরত আদম (আ.)-এর অপরাধ ক্ষমা করা হয়। এ পবিত্র দিনেই হযরত নূহ (আ.)-এর নৌকা মহাপ্লাবন শেষে জুদী পাহাড়ের পাদদেশে এসে থেমেছিল। পবিত্র আশুরার দিনেই হযরত ইব্রাহীম (আ.) যেমন ভূমিষ্ঠ হন, তেমনি এদিনেই তিনি নমরুদের অগ্নিকুণ্ড থেকে মুক্তি পান। পাশাপাশি কলিজার টুকরো সন্তান হযরত ইসমাঈল যবীহুল্লাহ (আ.)-কে আল্লাহর নামে কোরবানি করে আশুরার এ দিবসেই হযরত ইব্রাহীম (আ.) ‘খলীলুল্লাহ্’ বা আল্লাহর বন্ধু খেতাবে ভূষিত হন। আশুরার এ দিবসেই হযরত আইউব (আ.) রোগমুক্ত হন। হযরত ইদ্রিস (আ.)-কে এ দিবসেই জান্নাতে উঠিয়ে নেওয়া হয়। (খুৎবায়ে ইবনে নোবাতা, পৃষ্ঠা ১৬) আশুরার এ দিবসেই হযরত দাউদ (আ.) আল্লাহর কাছ থেকে ক্ষমা লাভ করেন এবং হযরত সোলায়মান (আ.) হারানো রাজত্ব পুনরুদ্ধারে সক্ষম হন। এ দিবসেই হযরত ইউনুস (আ.) মাছের পেট থেকে মুক্তি লাভ করেন। আশুরার এ দিবসেই হযরত ইয়াকুব (আ.) তাঁর হারানো পুত্র হযরত ইউসুফ (আ.)-কে চল্লিশ বছর পর ফিরে পান।
যেহেতু এ দিবসে আল্লাহ তায়ালা সমগ্র সৃষ্টির রব হিসেবে নিজেকে প্রকাশ করেছিলেন, সেহেতু এ দিনের সম্মানের খাতিরে অসংখ্য নবি, রাসুল ও মহামানবগণের বিভিন্ন সমস্যা আল্লাহ দূর করেছেন। মহাকালের ধারাবাহিকতায় বছর ঘুরে যখনই মহররমের ১০ তারিখ অর্থাৎ পবিত্র আশুরা এসেছে, তখনই বিশ^ জগত আল্লাহর বিশেষ দয়া লাভ করে ধন্য হয়েছে। আশুরার এ পবিত্র দিবসেই কাফির ফেরাউনের মুমিন স্ত্রী হযরত বিবি আছিয়া (আ.) শিশু মুসা (আ.)-কে গ্রহণ করেন। অতঃপর এ পবিত্র দিবসেই আল্লাহর রাসুল হযরত মুসা (আ.) স্বীয় অনুসারী বনী ইসরাঈলদের নিয়ে লোহিত সাগর অতিক্রম করেন। পক্ষান্তরে মুসা (আ.) ও তাঁর অনুসারীদের পশ্চাদ অনুসরণ করা খোদাদ্রোহী ফেরাউন সদলবলে লোহিত সাগরে ডুবে মৃত্যুবরণ করেন। বিষয়টির বিবরণ আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর মারফু হাদিসে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট সাহাবি- হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন- ‘‘আল্লাহর রাসুল (সা.) পবিত্র মদীনায় আগমন করে দেখলেন ইহুদি সম্প্রদায় আশুরার দিন রোজা রাখে। তিনি তাদেরকে জিজ্ঞেস করেন, এ দিনে তোমরা কেন রোজা পালন করো? তারা বলল- এটি এক মহান দিন। এ দিনে আল্লাহ হযরত মুসা (আ.)-কে রক্ষা করেছেন আর ফেরাউনের দলবলকে ডুবিয়ে মেরেছেন। সেজন্য হযরত মুসা (আ.) আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বরূপ এ দিনে রোজা রেখেছেন। আল্লাহর রাসুল (সা.) শুনে বললেন- হযরত মুসা (আ.)-এর প্রতি সম্মান প্রদর্শনে তোমাদের থেকে আমরাই বেশি অগ্রগামী। সুতরাং তিনি আশুরার রোজা রাখেন এবং মুসলমানদের (২টি) রোজা পালনের নির্দেশ দেন।’’( বোখারী, মুসলিম ও বায়হাকী শরীফের সূত্রে তাফসীরে দুররে মানছুর ৩০নং খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪৯৮)
এভাবে যুগে যুগে অনেক নবি ও রাসুলের অনুসারীরা রোজা রেখে ও নফল ইবাদত বন্দেগির মধ্য দিয়ে এ দিবসটি পালন করে থাকেন। এ দিবসের ফজিলত আসলেই অফুরন্ত। এক দিকে আশুরা যেমনি আল্লাহর অভিষেকের দিন, তেমনি এ দিবসেই দুই হাজার শান্তির দূত নবি ও রাসুলের শুভ জন্মদিন।
আশুরার দিবসটি আল্লাহর অভিষেকের দিন হওয়ায় সকল নবি ও রাসুল এ দিনে রোজা রাখতেন। এ প্রসঙ্গে হযরত আবু হুরায়রাহ (রা.) হতে বর্ণনা করা হয়েছে। আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেন- ‘‘আশুরার দিনটি এমন একটি দিন যে, সমস্ত নবি-রাসুল এ দিনে রোজা রাখতেন। সুতরাং তোমরাও এ দিনে রোজা রাখ।’’ (তাফসীরে দুররে মানছুর ৩০নং খণ্ড পৃষ্ঠা ৪৯৯)
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণনা করা হয়েছে। আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেন- ‘‘রমজান মাস এবং আশুরার দিন ব্যতীত রোজা রাখার ব্যাপারে অন্য কোনো দিন বেশি ফজিলতের দাবী রাখে না। (অর্থাৎ অন্য সব দিন থেকে রমজান মাস ও আশুরার রোজার বেশি ফজিলত রয়েছে)।’’ (তাফসীরে দুররে মানছুর ৩০নং খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪৯৯) এমনিভাবে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) হতে আরো বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেন- ‘‘তোমরা আশুরার রোজা রাখ। ইহুদিদের বিপরীত কাজ করো। তোমরা আশুরার রোজার সাথে আগের দিন অথবা পরের দিন আরেকটি রোজা রাখ।’’ (তাফসীরে দুররে মানছুর ৩০নং খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪৯৯)
হযরত জাবের (রা.), হযরত আব্দুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস (রা.), হযরত আবু সাইদ আল খুদরী (রা.) ও হযরত আবু হুরায়রাহ (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেন- ‘‘যে ব্যক্তি আশুরার দিন নিজ পরিবারের জন্য পর্যাপ্ত ভালো খাবারের ব্যবস্থা করবে, আল্লাহ তায়ালা তার জন্য সারা বছর পর্যাপ্ত রিজিকের ব্যবস্থা করবেন।’’ (তাফসীরে দুররে মানছুর ৩০নং খণ্ড, পৃষ্ঠা ৫০০)
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) হতে আরো বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেন- ‘‘যারা আশুরার দিন চোখে সুরমা বা কাজল লাগাবে তারা কখনো চোখে উঠা রোগে আক্রান্ত হবে না। (তাফসীরে দুররে মানছুর ৩০নং খণ্ড, পৃষ্ঠা ৫০০)
উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন- ‘‘পবিত্র রমজানের পূর্বে আশুরার রোজা রাখা হতো। যখন রমজানের রোজা ফরজ হলো, আল্লাহর রাসুল (সা.) ঘোষণা করেন- যে ব্যক্তি আশুরার রোজা রাখতে চায়, রাখতে পারে। আর যে ঐ দিন রোজা না রাখে, তাতেও অসুবিধা নেই।’’(বোখারী শরীফ ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৬৪৬)
আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর সকল মারফু হাদিস এ কথা প্রমাণ করে যে, আশুরা সৃষ্টির সূচনা থেকে উদযাপিত হওয়া এক ঐতিহাসিক দিন। হযরত আদম (আ.) থেকে শুরু করে রাহমাতুল্লিল আলামিন হযরত রাসুল (সা.) পর্যন্ত সকল নবি ও রাসুল এ দিবসটি উদযাপন করেছেন।
নবুয়ত পরবর্তী বেলায়েতের যুগে পবিত্র আশুরার এ দিবসটি বিশ^ মুসলিম উম্মাহর কাছে যে কারণে সবচেয়ে স্মরণীয় ও হৃদয়বিদায়ক তা হলো, এ দিনেই সাইয়্যেদুল আম্বিয়া, কুল-কায়েনাতের রহমত হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর প্রাণপ্রিয় দৌহিত্র, আমিরুল মুমিনীন শেরে খোদা হযরত আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহু ও খাতুনে জান্নাত হযরত ফাতেমা (রা.)-এর হৃদয়ের ধন মোহাম্মদী ইসলামের অকুতোভয় বীর সেনানী ইমাম হোসাইন (রা.) মাত্র ৭২ জন সহযোগী নিয়ে দুরাচার এজিদের ২২ হাজার সৈন্যের এক বিশাল বাহিনীর বিরুদ্ধে জিহাদ করে শাহাদত বরণের মাধ্যমে সত্য ও ন্যায়ের জন্য আপোষহীন সংগ্রাম করার এক মহান আদর্শ স্থাপন করে গেছেন।
তবে আফসোস ও পরিতাপের বিয়য় এই যে, পবিত্র আশুরাকে অনেক মুসলমান শিয়াদের অনুষ্ঠান বলে মনে করে থাকেন। অথচ এ ধারণাটি সম্পূর্ণ ভুল। কেননা ইতিপূর্বে উল্লেখিত পবিত্র কুরআন, হাদিস ও ইতিহাস বিশ্লেষণে এ বিষয়টি সুস্পষ্ট হয়েছে যে, এটি শিয়াদের অনুষ্ঠান নয়। বরং এটি স্বয়ং মহান রাব্বুল আলামিনের অনুষ্ঠান। আশুরার এ দিবসে মহান আল্লাহ জগৎ সৃষ্টি করে আরশে সমাসীন হন এবং রাব্বুল আলামিন হিসেবে জগত লালন-পালন কাজ শুরু করেন। প্রকৃতপক্ষে ধর্ম না জানার ফলে আমরা সত্যকে মিথ্যা আর মিথ্যাকে সত্য বলে ধরে নিয়েছি। সৃষ্টিজগতের সমস্ত মানুষের জন্য আশুরার দিন সবচেয়ে সম্মানিত ও পবিত্র মহান আল্লাহ দশ জন নবিকে আশুরার দিনে শ্রেষ্ঠ সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত করেছেন।
আশুরা নামকরণ করা হয়েছে আশারা শব্দ থেকে, যার অর্থ হলো দশ, একে তো মাসের দশ তারিখ, তদুপরী দশ জন নবিকে এদিনে শুভ সংবাদ প্রদান করার জন্য দিনটিকে আশুরা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। আমরা মুসলমান, আমাদের ধর্ম ইসলাম। আমাদের রাসুল হলেন হযরত মোহাম্মদ (সা.)। যে তারিখে আল্লাহ ‘রব’ হিসেবে আসন গ্রহণ করেছেন, যেদিন আল্লাহর অভিষেক হয়েছে, মুসলমান হয়ে মুসলমানের ঘরে জন্ম নিয়ে আমরা সেদিনের পরিচয় হারিয়ে ফেলেছি। আমরা মনে করছি- এদিন খ্রিষ্টানরা পালন করবে, কেননা হযরত ঈসা (আ.) এ দিন জন্ম লাভ করেছিলেন। অথবা এ দিন ইহুদিরা পালন করবে, কেননা হযরত মুসা (আ.) এদিন লোহিত সাগর পাড়ি দিয়ে ফেরাউনের অত্যাচার থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন। কিংবা এ দিন শিয়ারা পালন করবে, কেননা হযরত আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহু এর প্রাণপ্রিয় পুত্র হযরত ইমাম হোসাইন (রা.) এদিন কারবালার প্রান্তরে শহিদ হয়েছিলেন। তাহলে প্রশ্ন জাগে- আল্লাহ কি শুধু ইহুদি, খ্রিষ্টান বা শিয়াদের প্রতিপালক? না। বরং মহাবিশে^ এমন কেউ নেই, যার প্রতিপালক তিনি নন। তাহলে আল্লাহ যদি সমগ্র মানব জাতির, সমগ্র মাখলুকাতের প্রতিপালক হয়ে থাকেন, তবে আল্লাহর অভিষেকের দিন ১০ই মহররম পবিত্র আশুরার এ দিবসকে জাতীয়ভাবে মুসলিম উম্মাহ পালন না করার কী কারণ থাকতে পারে? মূলত ধর্ম না জানার ফলে আমরা সত্য থেকে দূরে সরে পড়েছি, মিথ্যাকে সত্য বলে গ্রহণ করেছি। ফলে ধর্মপালন করেও আমরা রিপুর তাড়না থেকে মুক্তি পাচ্ছি না, জীবনে শান্তি পাচ্ছি না।
পূর্বেই উল্লেখ করেছি, পবিত্র আশুরার দিনের ইজ্জতের খাতিরে মহিমান্বিত আল্লাহ্ এ দিবসে অসংখ্য নবি-রাসুলকে কঠিন কঠিন বিপদ থেকে মুক্তি দিয়েছেন। এ পবিত্র দিনের বুজুর্গি সম্পর্কে অসংখ্য ঘটনার বর্ণনা রয়েছে। আল্লাহর মহাসত্য যেন, আল্লাহর পরিচয় লাভ করে এ পবিত্র দিনে আমরা যদি মুক্তির জন্যে তাঁর হুজুরে রোনাজারী করি, তিনি কী আমাদের মুুক্তি দেবেন না? আমরা যদি আল্লাহর অভিষেক অনুষ্ঠানকে সত্য জেনে মহব্বতের সাথে আল্লাহর বন্ধুগণের প্রদর্শিত নিয়ম মোতাবেক এ দিবসটি পালন করতে পারি, অবশ্যই তিনি আমাদের প্রতি দয়া করার কথা।
আমরা যে আল্লাহর সাথে ওয়াদা করেছিলাম তাঁকে আমাদের প্রতিপালক বলে স্বীকার করে তাঁর কাছে যে আত্মসমর্পণ করেছিলাম, সে কথা কি আমাদের মনে আছে? দুনিয়াতে এসে আল্লাহকে বেমালুম ভুলে ফেলেছি, আল্লাহর পরিচয় সম্পূর্ণ হারিয়ে বসেছি।
প্রিয় পাঠক! মহান রাব্বুল আলামিনের পক্ষ থেকে ১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ ডিসেম্বর আমার উপর জামানার মোজাদ্দেদ বা মহান সংস্কারকের দায়িত্ব অর্পিত হয়। এ দায়িত্ব অর্পিত হওয়ার পর থেকে আমাকে ইসলাম ধর্মে মিশে যাওয়া কুসংস্কার ও অন্ধ বিশ^াস দূর করে ধর্ম পালনের সঠিক পদ্ধতি পবিত্র কুরআন ও হাদিসের আলোকে খুঁজে বের করার দায়িত্ব এসে যায়। এরই ধারাবাহিকতায় বর্তমান বিশে^র মুসলিম উম্মাহর কাছে আমি পবিত্র আশুরার গুরুত্ব ও তাৎপর্য তুলে ধরেছি। পূর্বে আমাদের ধারণা ছিলো পবিত্র আশুরা শুধুমাত্র শিয়া সম্প্রদায়ের অনুষ্ঠান। আমি সর্বোতভাবে চেষ্টা করেছি- এ ভুল ধারণা সংশোধন করে পবিত্র কুরআন ও হাদিসের আলোকে আশুরার প্রকৃত গুরুত্ব, তাৎপর্য, হাকিকত ও রহস্য মুসলিম উম্মাহসহ জগৎবাসীর কাছে তুলে ধরতে। এক্ষেত্রে আমি এ মহাসত্যটি সুস্পষ্ট করতে সক্ষম হয়েছি যে, পবিত্র আশুরার দিবসে মহান আল্লাহ আরশে সমাসীন হয়েছিলেন, যে কারণে আল্লাহর অভিষেক উদযাপন উপলক্ষ্যে এ দিবসে অপরিসীম রহমত ও বরকত অবর্তীণ হয়।
আর এ বিষয়টি দেশ ও জাতির কাছে তুলে ধরার লক্ষ্যে আমিই সর্বপ্রথম ১৯৮৫ খ্রিষ্টাব্দে পবিত্র আশুরার গুরুত্ব ও তাৎপর্য সম্বলিত লক্ষ লক্ষ হ্যান্ডবিল তৈরি করি এবং দেশ ও জাতির কাছে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করি। মহান রাব্বুল আলামিনের অপার দয়ায় আমার এ অক্লান্ত পরিশ্রম ও প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখার ফলে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ১৯৯৫ খ্রিষ্টাব্দে পবিত্র আশুরার গুরুত্ব ও তাৎপর্য তুলে ধরে তথ্য বিবরণী প্রকাশ করে এবং দেশবাসীকে এ দিনটি অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে পালন করার জন্য আহবান জানায়। সে থেকে অদ্যাবধি বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে পবিত্র আশুরা উদযাপন হয়ে আসছে।
প্রিয় পাঠক! পবিত্র আশুরার রহমত ও বরকত পূর্বেও যেমন ছিলো, বর্তমানেও তেমনি রয়েছে। আমরা যদি অলী-আল্লাহর পরামর্শ অনুযায়ী এ দিবসটি পালন করি এবং মনেপ্রাণে বিশ^াস করি যে, মহান আল্লাহ নিরাকার নন, তিনি আকার, তাঁর অপরূপ সুন্দর নুরের সুরত আছে, তিনি সৃষ্টির আদিতে বিশ^জগৎ সৃষ্টি করে আরশে সমাসীন হয়েছিলেন এবং সে থেকে অদ্যাবধি তিনি আরশে আজীমে স্বরূপে বিদ্যমান থেকেই বিশ^জগতের প্রতিটি সৃষ্টিকে লালন-পালন করছেন- তাই বর্তমান সময়েও আমরা আশুরা দিবসের রহমত ও বরকত লাভ করতে পারব।
প্রিয় পাঠক! ২০২০ খ্রিষ্টাব্দের ৮ আগস্ট শনিবার যখন মাসিক আত্মার বাণী, আগষ্ট সংখার জন্য, এ লেখা প্রস্তুত করছি, তখন আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ ও দেশের মানুষ একটি কঠিন সময় অতিক্রম করছে। আজ থেকে ৫ মাস পূর্বে অর্থাৎ গত ৮ মার্চ প্রথম করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ বাংলাদেশে ধরা পড়ে। অতঃপর দীর্ঘ ৫ মাসে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত সংখ্যা আড়াই লাখ ছাড়িয়ে গেছে। আল্লাহ বলেন- ‘‘স্থলভাগে ও জলভাগে মানুষের কৃর্তকর্মের দরুন ফ্যাসাদ ছড়িয়ে পড়েছে, যার ফলে আল্লাহ তাদেরকে তাদের কিছু কিছু কাজের শাস্তি আস্বাদন করাতে চান, যাতে তারা ফিরে আসে।’’ (সূরা আর রূম ৩০ : আয়াত ৪১) প্রকৃতপক্ষে করোনা ভাইরাসের এ মহামারি মানবজাতির কর্মের ফসল। সুতরাং আমরা যদি মহান রাব্বুল আলামিনের অভিষেকের দিবস পবিত্র আশুরা পালন করি, এ দিবসে তাঁর শ্রেষ্ঠ মাহবুব হযরত রাসুল (সা.)-এর অসিলা ধরে আল্লাহর হুজুরে তওবা করি এবং ক্ষমা প্রার্থনা করি, তবে গাফুরুর রাহীম আল্লাহ দয়া করে নিজগুণে আমাদের প্রতি দয়াপরায়ন হবেন এবং আমাদেরকে ক্ষমা করবেন। হযরত নূহ (আ.)-এর যুগে অবাধ্য জাতিকে শাস্তি দেওয়ার জন্য মহান আল্লাহ নজিরবিহীন মহাপ্লাবনের যে গজব দিয়েছিলেন, ৬ মাস ১০ দিন পর মহান আল্লাহ ঐ গজব থেকে পৃথিবীবাসীকে মুক্তি দিয়েছিলেন। আর ঐ মুক্তির দিবসটি ছিলো ১০ মহররম পবিত্র আশুরার দিন। মহান রাব্বুল আলামিনের অপার দয়ায় মহাকালের ধারাবাহিকতায় বছর ঘুরে আবার আমাদের মাঝে মুক্তির সে পবিত্র আশুরা সমাগত। এটি আমাদের জন্য আল্লাহর ক্ষমা লাভের এক মোক্ষম সুযোগ। আমাদেরকে স্মরণ রাখতে হবে-
১. আশুরার দিবসে আল্লাহ বসেন আরশে
২. আশুরার উসিলায় পাপী-তাপী মুক্তি পায়
৩. আশুরার উসিলায় রহমত বর্ষে দুনিয়ায়
এমনিভাবে আশুরার দিবসে আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর আহলে বাইতের সদস্য সাইয়্যেদেনা হযরত ইমাম হোসাইন (রা.)-এর শাহাদতের ঘটনা স্মরণ করে আহলে বাইতের মহব্বতে অশ্রুবিসর্জন দিতে পারলে, এটিও মানবজাতির মুক্তির কারণ হবে ইনশাআল্লাহ।
প্রিয় পাঠক! পরিশেষে ১০ মহররম পবিত্র আশুরা দিবসের সাথে সংশ্লিষ্ট দুটি বিষয় আপনাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। আর তা হলো-
১. ১৯৮৮ খ্রিষ্টাব্দের ২৪ আগষ্ট- এ দিবসটি ছিলো পবিত্র আশুরা। এ দিবসেই মহান রাব্বুল আলামিন দয়া করে আমাকে যুগের ইমামের দায়িত্ব প্রদান করেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেন- ‘‘যে ব্যক্তি (যুগের) ইমামের আনুগত্য না করে মৃত্যুবরণ করেছে, সে জাহেলী অবস্থা তথা ধর্মহীন বেইমান হয়ে মৃত্যুবরণ করেছে।’’ (মুসনাদে আহমদ ১৩নং খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৮৮)
২. রাহমাতুল্লিল আলামিন হযরত রাসুল (সা.)-এর রেখে যাওয়া মোহাম্মদী ইসলাম বিশ^ময় পুনপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আমি ১৯৮৫ সালের ১০ মহররম আশুরার দিবসেই কোটি কোটি আশেকে রাসুলের প্রাণের প্রতিষ্ঠান দেওয়ানবাগ শরীফ প্রতিষ্ঠা করি।
এ বছর পবিত্র আশুরায় দেওয়ানবাগ শরীফের ৩৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পূর্ণ হবে ইনশাআল্লাহ। পরিশেষে মহান রাব্বুল আলামিনের সাহায্য চাই, তিনি যেন আমাদেরকে যথাযথ মর্যাদার সাথে তাঁর মহিমান্নিত অভিষেকের দিন উদযাপনের তৌফিক দান করেন। আমিন!!
[ লেখক : প্রতিষ্ঠাতা ও স্বত্বাধিকারী : দেওয়ানবাগ শরীফ]