Cancel Preloader

যাঁকে পেয়ে ধন্য জীবন


আত্মার বাণী প্রকাশ ও কিছু কথা
অধ্যাপক ড. আবদুল মান্নান মিয়া
পর্ব-৯

মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিনের প্রিয়জন যাঁরা, তাঁদেরকে বলা হয় অলী-আল্লাহ্। তাঁদের মর্যাদা অপরিসীম। তাঁরা যে কোনো বিষয়ে চিন্তা করলে, আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিনের দয়ায় সেটাই বাস্তবায়িত হয়ে থাকে। আর যা বলেন, তা কখনো রদ হয় না।
১৯৮১ সালের ঘটনা। আল্লাহ্র মহান বন্ধু, যুগের ইমাম সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহ্বুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (মা. আ.) হুজুর কেব্লাজান তখন ইমাম সৈয়দ আবুল ফজল সুলতান আহমদ (রহ.)-এর দরবারে অবস্থান করছিলেন। সেই বছর রমজান মাসের শেষ দিকে ওজুর হাউজ নির্মাণ কাজ তদারকি করার সময় একদিন হঠাৎ সূফী সম্রাট হুজুর কেব্লাজানের বাম কদম মোবারকে একটি রড ৩/৪ ইঞ্চি ভিতরে ঢুকে যায়। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় তিনি কষ্ট পাচ্ছিলেন। এদিকে ইমাম হুজুর সূফী সম্রাটকে
ডেকে বললেন, “মাহ্বুব মিয়া! আগামীকালতো আপনার ঢাকা যেতে হবে, সুতরাং কাপড় চোপড় গুছিয়ে তৈরি থাকেন।” একথা শুনে সূফী সম্রাট স্বীয় মোর্শেদ ইমাম হুজুরকে বললেন, “বাবা! আমার পায়ে প্রচণ্ড ব্যথা। আমিতো হাঁটতে পারি না।” একথা শুনে ইমাম হুজুর বললেন, “আপনার হাঁটা লাগবে কেন?” অতঃপর সূফী সম্রাট পুনরায় মোর্শেদকে বললেন, “বাবা! আমিতো জুতা পায়ে দিতে পারি না।” তখন ইমাম হুজুর বললেন, “জুতা পায়ে দেওয়ার দরকার কী? ভাইয়ের বাসায় যাবেন, জুতা দিয়ে কী করবেন?” একথা শুনে সূফী সম্রাট হুজুর কেব্লাজান একটু চিন্তায় পড়ে গেলেন। কিন্তু তাঁর কদম মোবারকে রড ঢুকে একেবারে ফুলে গেছে। মাটিতে কদম রেখে হাটতে পারেন না। এদিকে ঈদুল ফিতর এসে গেল। ঈদের দিন সকালে ইমাম হুজুর তাঁকে ডেকে বললেন- মাহ্বুব মিয়া! ঈদের নামাজ পড়াতে পারবেন না? সূফী সম্রাট হুজুর কেব্লাজান বললেন জি বাবা পারবো! ইমাম হুজুর বললেন- তাহলে ঈদের নামাজ পড়ান। সূফী সম্রাট হুজুর কেব্লাজান ব্যথায় অতি কষ্টে ঈদগাহে
গেলেন এবং ঈদের নামাজে ইমামতি করলেন। আশ্চর্যের বিষয় এই যে, ঢাকার জনৈক ব্যবসায়ী আবদুর রহমান কন্ট্রাক্টর। তিনি একটা নতুন গাড়ি কিনেছেন এবং মনে মনে নিয়ত করেছেন, এই গাড়িতে চড়িয়ে সূফী সম্রাট হুজুরকে চন্দ্রপাড়া থেকে ঢাকা নিয়ে আসবেন। তাই তিনি ঐ নতুন গাড়িটি নিয়ে চন্দ্রপাড়া দরবার শরীফে হাজির হয়েছেন। চন্দ্রপাড়া দরবার শরীফে ঐ নতুন গাড়ি দেখে এবং তাতে সূফী সম্রাটকে চড়িয়ে ঢাকায় নিয়ে আসবেন শুনে দরবারের সকলেই অবাক হয়ে যান। সুতরাং
ঈদের পরের দিন সূফী সম্রাট হুজুর কেব্লাজান ঢাকার উদ্দেশে রওয়ানা করলেন। গাড়িটি ছিল নতুন, তাই খুব দ্রুতই তিনি ঢাকায় এসে পৌঁছেন এবং বড়ো ভাইয়ের বাসায় তার মেয়ের বিয়েতে অংশগ্রহণ করেন। অনুষ্ঠান শেষে সেখান থেকে রাত ১১টায় সদরঘাটের সিমসন রোডস্থ দরবার শরীফের কেন্দ্রীয় প্রচার দপ্তরে যান।
সূফী সম্রাট হুজুর কেব্লাজান ভাবলেন, মোর্শেদ যখন আমাকে ঢাকায় পাঠিয়েছেন, তখন নতুন কিছু সৃষ্টি করেই তবে মোর্শেদের দরবারে ফিরে যাব। তিনি চিন্তা করতে লাগলেন- কী করবেন? তাঁকে এমন একটা কিছু করে মোর্শেদের দরবারে যেতে হবে, যা দেখে ইমাম হুজুর খুশী হন। তিনি চিন্তা করলেন, একটা ধর্মীয় মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করবেন। চিন্তা অনুযায়ী পত্রিকা প্রকাশের সিদ্ধান্তও নিলেন। উল্লেখ্য যে, পত্রিকা প্রকাশের পূর্বে তিনি চন্দ্রপাড়ায় লোক পাঠিয়ে পত্রিকা প্রকাশের জন্য ইমাম হুজুরের ইজাজত চাইলেন। ইমাম হুজুর সূফী সম্রাট দেওয়ানবাগী হুজুরকে পত্রিকা প্রকাশের অনুমতি প্রদান করলেন
এবং সূফী সম্রাট দেওয়ানবাগী কর্তৃক প্রেরিত কয়েকটি নামের মধ্য থেকে ইমাম হুজুর ‘আত্মার বাণী’ নামটি পছন্দ করলেন।
তাই পত্রিকার নামকরণ করা হয় ‘আত্মার বাণী’। আর সে মোতাবেক সূফী সম্রাট হুজুর কেব্লা মাসিক ‘আত্মার বাণী’ নামক ধর্মীয় পত্রিকা প্রকাশ করে, তা নিয়ে স্বীয় মোর্শেদের দরবারে উপস্থিত হন। ইমাম সৈয়দ আবুল ফজল সুলতান আহমদ (রহ.) ‘আত্মার বাণী’ পত্রিকাটি দেখে অত্যন্ত খুশি হন। ঢাকায় আসার মাত্র ১৮ দিন পর সূফী সম্রাট হুজুর কেব্লা ‘আত্মার বাণী’
পত্রিকাটি প্রকাশ করে মোর্শেদের দরবারে ফিরে যান। ১৯৮১ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে শুরু করে আজও মাসিক ‘আত্মার বাণী’ পত্রিকাটি নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে। আর এই পত্রিকার মাধ্যমে মোহাম্মদী ইসলামের আদর্শ দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ছে। ‘আত্মার বাণী’ এমনই একটি রহমত ও বরকতের পত্রিকা, যা চুবিয়ে পানি পান করলে মানুষের কঠিন রোগ আল্লাহ্র রহমতে ভালো হয়ে যায়। এ প্রসঙ্গে সূফী সম্রাট দেওয়ানবাগী বলেন, “চন্দ্রপাড়া থেকে ঢাকায় চলে আসার পর, আমি মতিঝিলের ১৫৪ আরামবাগে থাকতাম। তখন মানুষ প্রতিদিন দল বেঁধে আমার কাছে আসতো পানি পড়া নিতে। আমি পানি পড়া দিলে মানুষ উপকার পেতো। একদিন আমি কার সাথে যেন আল্লাহ্ সম্বন্ধে আলাপ করছিলাম। সে সময় আবু সাঈদ নামে আমার এক খাদেম এসে বলল, বাবাজান! মানুষ লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছে পানি পড়া নেওয়ার জন্য। তখন আমি খাদেমকে বললাম, এক কাজ করো, ‘আত্মার বাণী’ চুবিয়ে তাদেরকে পানি দিয়ে দাও। আবু সাঈদ বলল, ‘বাবাজান! লোকগুলোতো বিভিন্ন রোগ নিয়ে এসেছে।’ আমি বললাম, ‘সব রোগের জন্যই এই ‘আত্মার বাণী’ চুবিয়ে পানি পান করতে
বলো।’ সেই থেকে ‘আত্মার বাণী’ চুবিয়ে পানি দেওয়া শুরু হয়। এরপর থেকেই ‘আত্মার বাণী’ চুবানো পানি খেলে মানুষের রোগ-ব্যাধি ভালো হয়ে যায়।”
এখানে স্মরণ করা যেতে পারে যে, ১৯৮১ সালে ‘আত্মার বাণী’ পত্রিকাটি প্রকাশ লাভ করে। কিন্তু আমি চন্দ্রপাড়া দরবার শরীফে গমন করি ১৯৮২ সালে। আমি যেহেতু বিভিন্ন পত্রিকায় কিছুটা লেখালেখি করতাম, আমার লেখা দুটি বই ও দুটি কাব্যগ্রন্থ ছিল। একথা জানার পর সূফী সম্রাট হুজুর কেব্লাজান আমাকে বললেন, “আপনি ‘আত্মার বাণী’ পত্রিকায় আর্টিকেল লিখবেন।” আমি বললাম, “জি হুজুর, চেষ্টা করব।” আমি ‘আত্মার বাণী’ পত্রিকা পড়ে দেখেছি যে, এ পত্রিকায় এলমে তাসাউফের যে সকল তথ্যাবলি লেখা হয়, এ সম্পর্কে আমার কোনো জ্ঞান নেই। সুতরাং আমি ‘আত্মার বাণী’ পত্রিকায়
লিখতে অপারগ। আর সেই অপারগতার কারণেই সূফী সম্রাট হুজুর কেব্লাজান আমাকে বারবার ‘আত্মার বাণী’ পত্রিকায় লিখতে বলেছেন বটে, কিন্তু আমি সাহস পাইনি। এভাবে বেশ কিছুদিন কেটে যাওয়ার পর এক অনুষ্ঠানে আমি চন্দ্রপাড়া দরবার শরীফে গেলাম। তখন সূফী সম্রাট হুজুর কেব্লাজান আমাকে দেখেই বললেন, “মান্নান সাহেব! আমি ‘আত্মার বাণী’ পত্রিকায় প্রতি মাসেই আপনার লেখা দেখতে চাই।” এ সময় সূফী সম্রাট হুজুর কেব্লাজান স্বীয় মোর্শেদ ইমাম হুজুরের কাছে
ছিলেন। আমি দেখলাম, তিনি ইমাম হুজুরের সাথে আমার লেখার বিষয় নিয়ে কী যেন আলাপ করছেন। তখন ইমাম হুজুর আমার দিকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘ভাল লেখকতো!’ ইমাম হুজুরের পবিত্র জবানে একথা শুনে আমি কাকুতি মিনতি করেবললাম, “আত্মার বাণী পত্রিকায় লেখার কোনো যোগ্যতা আমার নেই। আপনি দয়া করুন, যেন আমি লিখতে পারি।”
এরপরে সূফী সম্রাট হুজুর কেব্লাজানের কাছে লেখার ব্যাপারে দয়া চেয়ে নিলাম।
উল্লেখ্য যে, চন্দ্রপাড়া দরবার শরীফের এক অনুষ্ঠানে ‘আত্মার বাণী’ পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগের প্রায় সকলেই উপস্থিত ছিলেন। সূফী সম্রাট হুজুর কেব্লাজান কাজী আবেদ উদ্দিন ভাইকে পাঠিয়ে আমার সাথে সম্পাদকসহ সকলের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। তাদের হাবভাব দেখে মনে হয়েছিল- আমি যে কিছু লিখতে পারবো, এটা যেন তারা বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। সূফী সম্রাটের দয়ার বরকতে আমি ১৯৮৩ সালে ‘আত্মার বাণী’ পত্রিকায় তৃতীয় বর্ষ থেকে অদ্যাবধি নিয়মিত লিখে যাচ্ছি।
১৯৮৫ সালে সূফী সম্রাট হুজুর কেব্লাজান চন্দ্রপাড়া থেকে ঢাকায় চলে আসার পর ‘আত্মার বাণী’ পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগে ব্যাপক পরিবর্তন আনেন। আমাকে ‘আত্মার বাণী’র নির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্ব প্রদান করেন। আমি এ দায়িত্ব পালনে নিজের অপারগতা ও অক্ষমতার কথা জানিয়ে সূফী সম্রাট দয়াল বাবাজানের কাছে ক্ষমা চাইলাম। আমার মনের অবস্থা দেখে
দয়াল বাবাজান বললেন- আপনাকে ‘আত্মার বাণী’র নির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্ব আমি দিয়েছি। তখন আমি সূফী সম্রাট দয়াল বাবাজানের কদম মোবারক জড়িয়ে ধরে দয়া ভিক্ষা চাইলাম। আর তখন থেকে ‘আত্মার বাণী’ পত্রিকায় লেখার সাথে নির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেছি। এভাবে দীর্ঘদিন আমি নির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করি।
পরবর্তীতে ২০১৯ সালের নভেম্বর মাসে পূর্ববর্তী সম্পাদককে অবসর দেওয়ায় ‘আত্মার বাণী’ পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব লাভ করেন সূফী সম্রাট দেওয়ানবাগী হুজুর কেব্লাজানের মেজো সাহেবজাদা, বিশিষ্ট ইসলামি লেখক ইমাম ড. আরসাম কুদরত এ খোদা (মা. আ.) সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব লাভের পর তিনি ‘আত্মার বাণী’র ২০১৯ সালের ডিসেম্বর সংখ্যায় তাঁর লিখিত ‘আত্মার বাণী প্রকাশের স্বর্ণালী ইতিহাস’ প্রবন্ধে উল্লেখ করেন, “এতো অল্প সময়ে এমন নির্ভুল ও পরিমার্জিত একটি পত্রিকা প্রকাশ করা মোটেও সহজসাধ্য বিষয় ছিল না। মূলত আমার মহান মোর্শেদ সূফী সম্রাট হুজুর
কেব্লাজান পত্রিকাটি প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছেন বলেই, মহান আল্লাহ্ তাঁর প্রিয় বন্ধুর অসিলায় বিশ্ববাসীকে তাসাউফ সমৃদ্ধ একটি যুগান্তকারী পত্রিকা পাঠের সুযোগ করে দিয়েছেন।”
[লেখক: সাবেক ভাইস প্রিন্সিপাল, জাতীয় আইন কলেজ, ঢাকা]

সম্পর্কিত পোস্ট