রূহ ও নফস
মো. মুযহারুল হান্নান:
সকল প্রকার প্রশংসা করুণাময় আল্লাহর জন্য এবং শত কোটি দরুদ ও সালাম হযরত রাসুল (সা.)-এর উপর বর্ষিত হোক।
মাটি, পানি, বায়ু ও আগুন এই প্রাকৃতিক চার উপাদান দ্বারা মানুষের এই দৃশ্যমান জড় দেহ গঠিত। মানুষের এই দৃশ্যমান দেহ ছাড়াও মানুষের আরও এক অদৃশ্য সূক্ষ্ম দেহ রয়েছে। এই দেহকে বলা হয় নফস।
মানুষের এই নফসকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালানার জন্য মহান আল্লাহ্ তাঁর নিজের সংগে সম্পর্কযুক্ত তাঁর হুকুম বা রূহ মানুষের মাঝে ফুঁকে দিয়েছেন।
দেহের জীবন নফসের উপর এবং নফসের জীবন রূহের উপর নির্ভরশীল। রূহকে নফসের জীবনও বলা হয়। নফস ও রূহের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে, যার স্বরূপ আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না।
নফস রূহের আয়নার মতো। আয়নায় সূর্যের আলো ও তাপ প্রতিফলিত হয়ে আয়না উজ্জ্বল হয়ে উঠে। তদ্রুপ নফসের আয়নার রূহের গুণাবলি ও প্রতিক্রিয়া প্রতিফলিত হয়। নফস রূহের গুণাবলি অর্থাৎ অহি সংবলিত শরিয়তি আইন কানুন অনুসরণ ও অনুকরণ করে নিজেকে আলোকিত করে। অথচ এই শরিয়তি বিধান অমান্য করে এই নফসই হয়ে যায় কলুষিত।
আল কুরআনে নফসের সফলতা ও বিফলতার কথা ব্যক্ত করে সূরা শামস-এর ৭-১০নং আয়াতগুলি নাজিল হয়েছে। (৭) শপথ নফসের যিনি তাকে বিন্যন্ত করেছেন (৮) তাকে অসৎ কর্ম ও সৎকর্মের জ্ঞান দান করেছেন (৯) যে নিজেকে শুদ্ধ করে সে, সফলকাম হয় (১০) যে নিজেকে কলুষিত করে সে ব্যর্থ মনোরথ হয়।
নফসের সাথে দেহের যোগাযোগ দেহের হৃৎপিণ্ডের মাধ্যমে সচল রয়েছে। এই জড় দেহের সাথে নফসের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হলেই জড় দেহের মৃত্যু ঘটে। এই বিচ্ছিন্নতা হচ্ছে নফসের মানব জড় দেহ থেকে। রূহের বিচ্ছিন্নতা নেই। রূহ সর্বদা বিরাজমান। রূহের মৃত্যু নেই। মৃত্যুর কষ্ট, কবরের কষ্ট, সবই নফসের সংগে জড়িত। মানবত্মা, যাকে নফস বলাই সঙ্গত।
মৃত্যুর ফেরেশতা কর্তৃক এই নফসকে মানব দেহ থেকে বিচ্ছিন্নতা করার সময় সে দুঃখ বা আনন্দ অনুভব করে। সূরা নাজিয়াতের প্রথম আয়াতে কাফেরদের নফসকে কষ্ট দিয়ে বের করার কথা বলা হয়েছে। দ্বিতীয় আয়াতে মুমেনের নফস অতি সহজে বের করার কথা বলা হয়েছে।
অতঃপর ভারপ্রাপ্ত ফেরেশতারা উভয় প্রকার নফসকে তাদের কর্মফল অনুযায়ী কষ্ট অথবা আরাম দেওয়ার জন্য অতি দ্রুতগতিতে একজন অপরজনকে পিছনে ফেলে আসমানের দিকে গমন করে। আসমানের ফেরেশতারা মুমেন বান্দার আলোকিত নফসকে সাদরে গ্রহণ করার জন্য আসমানের দরজা খুলে দেয়। সপ্তম আসমানে এই নফসের আমলনামা আরশের নিচে রেখে দেওয়া হয় এবং এই নফসকে অতি আরামের সাথে সওয়াল জওয়াবের জন্য দুনিয়ার জমিনে কবরে
রাখা হয়। অপরদিকে কাফের বান্দার অন্ধকার ও দুর্গন্ধময় নফসের জন্য আসমানের দরজা বন্ধ রাখা হয়। তাকে উপরে উঠার বদলে নিচে সজোরে নিক্ষেপ করা হয়।
নফস আলমে খালক বা সৃষ্টজগতের পার্থিব উপাদানে গঠিত। অপরপক্ষে রূহ আলমে আমর বা হুকুমি জগতের সৃষ্টি। তাই তাদের অবস্থান ভিন্ন ভিন্ন। নফসের অবস্থান এই দৃশ্যমান জগতে কবরের সাথে সংশ্লিষ্ট এবং রূহের অবস্থান আল্লাহর সান্নিধ্যে রয়েছে।
মুমেন বান্দার রূহের অবস্থান ইল্লিনে আরশের নিচে এবং এই রূহ জান্নাতের সুখ অনুভব করে থাকে। কাফের বান্দার রূহ সপ্ত জমিনের নিচে সিজ্জিনে অবরুদ্ধ অবস্থায় সেখানে অবস্থিত জাহান্নামের তাপ ও কষ্ট ভোগ করে থাকে। রূহ যেখানেই থাকুক না কেন সেখানে থেকেই নফসের সুখ বা দুঃখ অনুভব করে থাকে আল্লাহর দেওয়া বিশেষ ক্ষমতা বলে।
এই পর্যন্ত যা আলোচনা করা হলো, তা এই জগৎ ও আলমে বারযাখ বা মধ্যবর্তী জগতকে কেন্দ্র করে। আখেরাতের যে প্রতিদান জগত, মহান আল্লাহ্ সৃষ্টি করবেন, তা তাঁর ইচ্ছানুযায়ী অন্যরূপ হবার কথা আল কুরআন থেকে আমরা জানতে পেরেছি।
[লেখক: প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক, বাসুদেবপুর উচ্চ বিদ্যালয়, গোদাগাড়ী, রাজশাহী]