পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবি (সা.): সৃষ্টিকুলে আনন্দ জোয়ার
ড. পিয়ার মোহাম্মদ:
‘ঈদ’ শব্দের অর্থ খুশি এবং ‘মিলাদ’ অর্থ জন্মবৃত্তান্ত বা জীবন কাহিনী। সেই হিসাবে ঈদে মিলাদুন্নবি (স.)-এর অর্থ আমাদের প্রিয় নবি হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর শুভ জন্ম দিনের খুশি। এ খুশির দিনটির সূচনা হয় হিজরিপুর্ব ৫৩ সালে ১২ রবিউল আউয়াল মোতাবেক ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দের রোজ সোমবার। ঐ দিন সুবেহ সাদেকের সময় আরবের সম্ভ্রান্ত কোরাইশ বংশে হযরত আবদুল্লাহ্ (আ.)-এর শাহি প্রাসাদে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মহামানব এবং সর্বশেষ নবি ও রাসুল হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর শুভ জন্ম হয়।
ধুলির ধরায় হযরত রাসুল (সা.)-এর জন্ম সকল নবি ও রাসুলের পরে হলেও প্রকৃতপক্ষে, তাঁর নুরময় সত্তা সৃষ্টির মধ্য দিয়েই আল্লাহ্ পাক সৃষ্টি লীলা সূচনা করেন। হযরত রাসুল (সা.)-এর সেই নুরময় সত্তা থেকে সমস্ত সৃষ্টি সৃজিত হয়েছে।
তিনি কুল কায়েনাতের রহমত এবং তাঁর সংস্পর্শে সৃষ্টির মাঝে প্রাণের সঞ্চার ঘটে। তিনি এক অনন্ত রহস্যের আধার। তাঁকে সৃষ্টি করা না হলে জগতের কোনো কিছুই সৃষ্টি করা হতো না। সৃষ্টি হতো না এ নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের কোনো সৃষ্টিরাজি।
হযরত রাসুল (সা.)-এর জন্মের সেই ঊষালগ্নটি তাই বুকে ধারণ করে এ দিবসটি হয়েছে সমগ্র সৃষ্টিজগতের জন্য এক মহিমান্বিত ও তাৎপর্যপূর্ণ দিন, যা পরিচিতি লাভ করেছে ঈদে মিলাদুন্নবি (সা.) হিসেবে।
আল্লাহ তায়ালা ঘোষিত সর্বকালের ও সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হলেন হযরত রাসুল (সা.)। তাঁর সৃষ্টি সম্পর্কে হাদিসে কুদসিতে মহান আল্লাহ্ বলেন- “হে রাসুল (সা.)! যদি আমি আপনাকে সৃষ্টি না করতাম, তবে সৃষ্টিকুলের কোনো কিছুই সৃজন করতাম না।” (তাফসীরে মাজহারী, ১০ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৮০)” সেজন্য তাঁর আবির্ভাব ক্ষণে বিশ্ব জাহানের সর্বত্রই নেমে এসেছিল আনন্দের জোয়ার। বিশ্ব প্রকৃতিতে বয়ে গেছে এক অজানা আনন্দের হিল্লোল। মৃদু মন্দ বাতাসের ভিতরে বয়ে গেছে উল্লাসের ঝংকার। ঘটে গেছে অসংখ্য অলৌকিক ঘটনা। সব কিছুই যেন এক মহান অতিথিকে বরণ করে নেওয়ার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষমান ছিল। তাঁ
কে আপনরূপে পাওয়ার জন্য যুগ-যুগান্তরের প্রতিক্ষায় পুঞ্জীভূত বেদনা ও ক্লান্তিতে সমগ্র বিশ্ব প্রকৃতি উতলা হয়ে উঠেছিল। পাপপঙ্কিলতার অন্ধকার হতে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য পৃথিবীর সর্বত্র সব কিছুই তাঁর আগমন পানে অধীর আগ্রহে চেয়ে ছিল।
প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে আল্লাহ্ তায়ালার অশেষ কৃপায় হযরত রাসুল (সা.) জন্মেছিলেন বিশ্ব জাহানের রহমত ও করুণা স্বরূপ। তাঁর আগমনে সারা বিশ্ব জাহানে যেন রহমতের ফোয়ারা বয়ে গেছে। সৃষ্টিকুল সেই রহমতের ফোয়ারা থেকে সংগ্রহ করেছে জীবন সুধা।
বিশ্বনবির জন্মদিনে মানব জাতির মাঝে খুশিতে আনন্দিত হওয়ার ধারা মহানবি (সা.)-এর জীবদ্দশায়ই শুরু হয়েছিল। বিশিষ্ট সাহাবি হযরত আবু আমের আনসারী (রা.) একদিন তার পরিবার পরিজন ও আত্মীয় স্বজনদের নিয়ে রাসুল (সা.)-এর জন্ম বৃত্তান্তের আলোচনা করছিলেন। এতে হযরত রাসুল (সা.) অত্যন্ত খুশি হয়ে বলেছিলেন “হে আমের! নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তায়ালা তোমাদের জন্য রহমতের দরজা খুলে দিয়েছেন এবং ফেরেশতারা তোমাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করছেন।”
আর এক হাদিস থেকে পাওয়া যায়, হযরত আব্দুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস (রা.) কর্তৃক রাসুল (সা.)-এর জন্মদিনের ইতিবৃত্ত প্রতিবেশীদের নিয়ে আলোচনাকালে রাসুল (সা.) তাঁকে বলেন- “তোমাদের শাফায়াত করা আমার জন্য ওয়াজিব হয়ে গেছে। অন্যান্য যারা এরূপ কাজ করবে তারাও শাফায়াত পাবে।”
যে মহামানবের জন্মদিন পালন করলে মহান আল্লাহর রহমতের দরজা খুলে যায়, ফেরেশতারা ক্ষমা প্রার্থনা করে এবং তাঁর শাফায়েত পেয়ে মুক্তি অর্জন করা যায়, তাঁর জন্মদিন পালন ও আনন্দ করার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর কি হতে পারে?
কাফের আবু লাহাবের মৃত্যুর পর হযরত আব্দুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস (রা.) স্বপ্নে দেখেন যে, আবু লাহাব তাকে বলছে- “প্রতি সোমবার আমার আজাব লাঘব করা হয়।” আবু লাহাব সারাজীবন ছিলেন নবি করিম (সা.)-এর আদর্শ বিরোধী। কিন্তু নবি করিম (সা.)-এর জন্মের কথা শুনে সে খুবই খুশি হয়েছিল এবং এই জন্মের সংবাদ দেওয়ায় দাসীকে মুক্ত করে দিয়েছিল। এ অসিলায় সে ঐ মহান দিনের জন্য আজাব মাফ পেয়েছে।
আমরা যত ইবাদতই করি, মহান আল্লাহর করুণা ছাড়া মুক্তি পাওয়া কঠিন। হযরত রাসুল (সা.)-এর জন্মের সংবাদ শুনে খুশি হয়ে তার ফজিলত পাচ্ছেন একজন কাফের। আমরাও হযরত রাসুল (সা.)-এর জন্মদিন পালন করে, খুশি হয়ে এবং অন্তর নিংড়ানো আনন্দে ভেসে আল্লাহ্ তায়ালার করুণা পেতে পারি। হযরত রাসুল (সা.)-এর জন্মদিন ঈদে মিলাদুন্নবি (সা.) এতটাই তাৎপর্যপূর্ণ।
ইমানদার হওয়ার প্রথম শর্ত-বিশ্বনবি হযরত রাসুল (সা.)-কে পার্থিব জীবনের সবকিছুর চেয়ে অধিক ভালোবাসা। হাদিস শরীফে বর্ণিত হয়েছে, হযরত রাসুল (সা.) বলেন, “যে ব্যক্তি নিজের পিতা-মাতা, সন্তান-সন্ততি ও অন্য সকল মানুষ অপেক্ষা আমাকে বেশি ভালো না বাসবে, সে মু’মিন হতে পারবে না।” (বোখারী শরীফ, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৭; মুসলিম শরীফ, পৃষ্ঠা ৪৯)
তাহলে মু’মিন হতে হলে আমাদের সবার জন্মদিনের চেয়ে হযরত রাসুল (সা.)-এর জন্মদিন বেশি গুরুত্ব দিয়ে পালন করা পূর্বশর্ত। অন্যদের জন্মদিনে আমরা যতটা না খুশি হই, তার চেয়ে রাসুল (সা.)-এর বেশি খুশি না হতে পারলে ইমানদার হওয়া যায় কীভাবে? প্রকৃতপক্ষে, হযরত রাসুল (সা.)-এর সাথে যার আত্মিক বা অন্তরের সম্পর্ক সৃষ্টি হয়, তিনি এ দিনেআনন্দিত না হয়ে পারেন না। আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর প্রেমের ধারা যার হৃদয়ে বইছে, তিনিতো রাসুল (সা.)-এর জন্মদিনে আনন্দে অবগাহন করবেনই।
এমন দিনে তার হৃদয় ভেসে যাবে আনন্দ জোয়ারে, এটাই স্বাভাবিক। এ আনন্দ আপনা আপনি এসে যাবে তার অন্তরে। সৃষ্টিকুলের আনন্দের সাথে তিনিও সীমাহীন আনন্দে দিন পার করবেন। এটা কোনো লোক দেখানো আনন্দ নয়, বরং হৃদয় উৎসারিত আবেগসিক্ত আনন্দ। এই দিনে ইমানদারের হৃদয়ে আনন্দ আসবেই। কুলকায়েনাতের রহমতে ইমানদার সিক্ত হবেনই।
হযরত রাসুল (সা.) বলেছেন, যারা তাঁর জন্মদিনে আলোচনা ও আনন্দ করবে তাদের শাফায়াত দেওয়া আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর জন্য ওয়াজিব হয়ে যাবে। কাজেই ঈদে মিলাদুন্নবি (সা.) পালন করা এবং এ আনন্দ করা অতি তাৎপর্যপূর্ণ এবং এটি মানব জীবনের মুক্তির সোপান।
হযরত রাসুল (সা.)-এর শাফায়াত লাভের আরেক উপায় হলো- আল্লাহর রাসুল (সা.)-কে ভালোবাসা এবং তাঁর আদর্শ অনুসরণ করা। হযরত রাসুল (সা.)-এর চিন্তা-চেতনা, মন-মানসিকতা, কথা-বার্তা, আচার-আচরণ, রীতি-নীতি সবই ছিল অপুর্ব সুন্দর। তিনি মানবজাতিকে দিয়ে গেছেন সর্বোত্তম জীবন বিধান। তাইতো হযরত রাসুল (সা.)-এর শানে পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে, “তোমাদের জন্য রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর মাঝে রয়েছে সুন্দরতম আদর্শ।” (সূরা আহযাব-৩৩: আয়াত ২১) মহান আল্লাহ্ আরো বলেছেন- “আমি আপনাকে জগৎসমূহের প্রতি কেবল রহমতস্বরূপই প্রেরণ করেছি।’’ (সূরা আল আম্বিয়া-২১: আয়াত ১০৭)
সুতরাং তাঁর জন্মদিন আল্লাহ্ তায়ালার এক বিশেষ নিয়ামত প্রাপ্তির দিন। তাছাড়া আল্লাহ্ ঘোষণা করেন- তোমরা ইমানদার হতে চাইলে এবং আমার সন্তুষ্টি অর্জন করতে চাইলে রাসুলকে ভালোবাসো। ইমানদার হতে হলে যাঁকে ভালোবাসা পূর্বশর্ত হিসেবে মহান আল্লাহ্ ঘোষণা করেছেন, তাঁর জন্মদিনে সৃষ্টিকুলের মাঝে খুশির হিল্লোল বইবে, এটাই স্বাভাবিক। কেউ যদি আনন্দিত না হতে পারেন, তাহলে এটা তার দুর্ভাগ্য ছাড়া আর কিছু নয়। এই আনন্দ কারো একার নয়, বরং সৃষ্টিকুলের সবার। ঈদে মিলাদুন্নবি (সা.) সৃষ্টিকুলের সবার। সবার মুক্তির অসিলা হিসেবে এসেছে ঈদে মিলাদুন্নবি (সা.)।
হযরত রাসুল (সা.)-এর শুভ জন্মের বরকতেই যেহেতু এই পৃথিবীতে আঠারো হাজার মাখলুকাত সৃষ্টি হয়েছে, তিনিই যেহেতু বিশ্বের সর্বকালের সর্ব যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব এবং তাঁর আবির্ভাব না হলে আমরা যেহেতু কোনো কিছুই পেতাম না, সেহেতু তাঁর জন্মদিনের চেয়ে আনন্দের বিষয় আর কী হতে পারে।
তাঁকে ছাড়া তো কারো মুক্তি নেই। কেউ আল্লাহ্ তায়ালার প্রিয় হাবিব হযরত রাসুল (সা.)-এর শুভ জন্মদিন ধুমধামের সাথে পালন করলে স্বয়ং আল্লাহ্ পাক অত্যন্ত খুশি হন। মহান আল্লাহ কারো উপর খুশি হলে তার আর চিন্তা কী? আসলে বিশ্ব নবির শুভ জন্মদিনটি এতই তাৎপর্যপূর্ণ যে, এই দিবসে যদি কোনো মানুষ আন্তরিকভাবে খুশি হয়, তাহলে মহান আল্লাহ্ তার প্রতি অত্যন্ত সদয় হন এবং অবারিত রহমত দান করে থাকেন।
মহান আল্লাহ্ তাঁর প্রিয় হাবিবকে ভালোবাসেন এবং তিনি চান সৃষ্টিকুল তাঁকে ভালোবাসুক। সেজন্য হযরত রাসুল (সা.)-এর জন্মদিনে খুশি হওয়ার অর্থ আল্লাহর ইচ্ছা বাস্তবায়ন করা। এই দিনের আনন্দ এমনই গুরুত্বপূর্ণ।
আমাদের মহান মোর্শেদ সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহ্বুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (মা. আ.) হুজুর কেবলাজান ঘোষণা করেছেন- ‘সৃষ্টিকুলের শ্রেষ্ঠ ঈদ, দয়াল রাসুলের জন্ম ঈদ’। তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে সরকার এবং বিশ্বের আপামর জনগোষ্ঠী যথাযোগ্য মর্যাদায় পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবি (সা.) উদ্যাপনের মাধ্যমে এক উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি করেছেন। আনন্দ করে ফজিলত পাওয়ার এত বড়ো সুযোগ তিনি আমাদের করে দিয়েছেন। তাঁর ধর্মীয় সংস্কারের ফসল হিসেবেই আমরা পেয়েছি ঈদে মিলাদুন্নবি (সা.)-এর ফজিলত অর্জনের সুযোগ।
আজ আনন্দে ভাসছে সৃষ্টিকুল, আর আনন্দে ভাসছি আমরা সারাজাহানের মানব জাতি। মহান আল্লাহ্ আমাদের সবাইকে ঈদে মিলাদুন্নবি (সা.)-এর তাৎপর্য উপলদ্ধি করার তৌফিক দিন।
আমরা যেন এই দিবসটিতে আরো বেশি আনন্দ জোয়ারে ভেসে মুক্তির অসিলা খুঁজে পাই। আমিন।
[লেখক: অতিরিক্ত সচিব, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার]