এলমুল ক্বালব ও এলমে কিতাব
মহান সংস্কারক, মোহাম্মদী ইসলামের পুনর্জীবনদানকারী, সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহ্বুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (মা. আ.) হুজুর কেবলাজান
বিশ্বজাহানের অগণিত সৃষ্টিরাজির মাঝে প্রসারিত রয়েছে এক অনন্ত ও অসীম জ্ঞানের ভাণ্ডার। প্রতিটি সৃষ্টির বাহিরে ও অভ্যন্তরে লুকায়িত এক একটি বিস্ময়কর রহস্যের মাধ্যমে সর্বশক্তিমান আল্লাহ্ তায়ালার শ্রেষ্ঠত্ব ও মহিমা প্রকাশিত হচ্ছে।
মানুষ বিশ্বচরাচরের বহিরাবরণের অনুপম সৌন্দর্য দেখে যেমন বিমোহিত হয়, অন্তর্জগতের রহস্যলোকের আলোকচ্ছটায় তেমনি হয় হতবাক ও অভিভূত। সমগ্র নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডল ব্যাপৃত স্থূল, সূক্ষ্ম ও সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম জগতের সমস্ত জ্ঞান ভাণ্ডার মহান আল্লাহ্ তাঁর সবচেয়ে প্রিয় হাবিব হযরত রাসুল (সা.)-এর জন্য উন্মোচিত করে দিয়েছেন।
হযরত রাসুল (সা.) ঊর্ধ্বলোকের সিদরাতুল মুনতাহায় উপনীত হয়ে স্বর্গ-নরকসহ সৃষ্টিজগতের সমস্ত রহস্য সম্পর্কে অবগত হয়েছেন। ফলে বিশ্বজাহানের আদি-অন্ত, প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সমস্ত বিষয়াবলি তাঁর কাছে দিবালোকের মত সুস্পষ্টভাবে প্রতিভাত হয়ে উঠেছে। এজন্যই তিনি আলাহ্ তায়ালার পরিচয় প্রকাশের পাশাপাশি সৃষ্টিজগতের সামগ্রিক পরিচয় মানব জাতির কাছে তুলে ধরে মানুষকে প্রকৃত সত্য ও কল্যাণের পথ নির্দেশনা দান করেছেন।
হযরত রাসুল (সা.) যে মানবজাতিকে অনন্ত জ্ঞানের সন্ধান দিয়ে আল্লাহর প্রতিনিধিত্বের মর্যাদায় উন্নীত করার জন্য এ ধূলির ধরায় আগমন করেছিলেন, এ কথা তাঁর বাণী থেকেই বুঝা যায়। হাদিস শরীফে বর্ণিত হয়েছে, হযরত রাসুল (সা.) ফরমান, ‘বু‘ইসতু মু‘আল্লিমান।’ অর্থাৎ, আমি শিক্ষক হিসেবে প্রেরিত হয়েছি।
বিশ্বনবি হযরত রাসুল (সা.) একদিকে যেমন আধুনিক মানব সভ্যতার স্থপতি ছিলেন, অন্যদিকে অন্তর্জগতের পরম উৎকর্ষ লাভের আলোর দিশারি ছিলেন। তিনি অনুধাবন করেছিলেন বাহিরের জগতের চেয়ে অন্তর্জগতের ব্যাপকতা যেমন অনেক বেশি, তেমনি গুরুত্বও অপরিসীম। এ প্রসঙ্গে হযরত হাসান (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেন“এলেম হলো দু’প্রকার। যথা- ১। ক্বালবি এলেম, আর এ এলেমই হচ্ছে পরম উপকারী এলেম; ২। মুখের এলেম তথা কিতাবি এলেম, আর এ এলেমই মাখলুকাতের উপর আল্লাহর দলিল।” (তাফসীরে দুররে মানছুর, ২২নং খণ্ড, পৃষ্ঠা ২১)
এলমুল ক্বালব হলো সেই বিজ্ঞান, যার মাধ্যমে স্রষ্টা ও সৃষ্টিজগতের সমস্ত ভেদ ও রহস্য সম্পর্কে অবগত হওয়া যায়। মহান আল্লাহ্ হযরত আদম (আ.)-কে এ জ্ঞানের শিক্ষা দিয়েই ফেরেশতাদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ বলে প্রমাণ করেছিলেন। পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে, “ওয়া ‘আল্লামা আদামাল আসমাআ কুল্লাহা” অর্থ- আর তিনি (আল্লাহ্) আদমকে যাবতীয় নাম শিক্ষা দিলেন।” (সূরা বাকারাহ-২: আয়াত ৩১) মহান আল্লাহ্ প্রদত্ত এ জ্ঞানকেই বলা হয়, এলমুল ক্বালব। কখনো কখনো এই জ্ঞান এলমে লাদুন্নি, এলমে মোকাশেফা, এলমে তাসাউফ হিসেবেও পরিচিত। হযরত আদম (আ.) থেকে শুরু করে হযরত রাসুল (সা.) পর্যন্ত এ পৃথিবীতে যত নবি-রাসুল এসেছিলেন, তাঁরা সবাই এ জ্ঞানের সাধনার মাধ্যমে আল্লাহর সাথে যোগাযোগ স্থাপন করত তাঁর প্রতিনিধির মর্যাদা লাভ করে মানুষের কাছে তাওহিদের বাণী প্রচার করেছেন। তাসাউফের জ্ঞান দিয়েই হযরত নুহ (আ.) আল্লাহর কাছ থেকে নির্দেশ লাভ করেছিলেন। তাসাউফের জ্ঞানে জ্ঞানী ছিলেন বলেই হযরত ইব্রাহীম (আ.) আগুনে নিক্ষিপ্ত হয়েও অক্ষত অবস্থায় রক্ষা পেয়েছিলেন, হযরত দাউদ (আ.) পশু-পাখির ভাষা বুঝতেন; হযরত সোলায়মান (আ.) আকাশ পথে উড়ে বেড়াতেন; হযরত মুসা (আ.) লাঠির আঘাতে লোহিত সাগরের পানিতে রাস্তা তৈরি করেছিলেন; হযরত ঈসা (আ.) মৃতকে জীবিত করেছিলেন; হযরত মুহাম্মদ (সা.) শাহাদত অঙ্গুলির ইশারায় চাঁদকে দ্বিখণ্ডিত করেছিলেন এবং তিনি সুদূর অতীত ও ভবিষ্যতে ঘটনাপ্রবাহের নিখুঁত বর্ণনা দিয়েছিলেন।
এলমে তাসাউফের মাধ্যমে সৃষ্টিজগতের ভেদ ও রহস্য সম্পর্কে জানা যায় বলেই মহান আল্লাহ্ হযরত মুসা (আ.)-কে তাসাউফের জ্ঞানে জ্ঞানী হযরত খিজির (আ.)-এর সাহচর্যে গিয়ে তাঁকে জ্ঞানার্জনের নির্দেশ দিয়েছিলেন। তাসাউফের সাহায্যে কিভাবে রহস্য জগতের জ্ঞান অর্জন করা যায়, পবিত্র কুরআন ও হাদিস শরীফে বর্ণিত হযরত মুসা (আ.) ও খিজির (আ.)-এর সাক্ষাতের নিম্নলিখিত ঘটনা থেকে তা জানা যায়।
হযরত মুসা (আ.) ও হযরত খিজির (আ.)-এর ঘটনা ইতিহাসে এলমে মারেফাতের একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। কেননা হযরত মুসা (আ.) আল্লাহর প্রেরিত রাসুল হওয়া সত্ত্বেও এলমে মারেফাতের শিক্ষা গ্রহণ করার জন্য মহান আল্লাহর নির্দেশে তিনি হযরত খিজির (আ.)-এর নিকট গমন করেন এবং তাঁকে তাঁর খেদমতে কিছুদিন রাখার জন্য অনুরোধ করেছিলেন।
গুরুত্বপূর্ণ এ ঘটনাটি পবিত্র কুরআন ও হাদিসের আলোকে এখানে উল্লেখ করা হলো হযরত উবাই ইবনে কা’ব (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেন- ‘‘একদিন হযরত মুসা (আ.) বনি ইসরাঈলের এক সভায় বক্তব্য রাখছিলেন। তখন জনৈক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করল, বর্তমান যুগে সর্বাধিক জ্ঞানী ব্যক্তি কে? হযরত মুসা (আ.) বললেন- আমি। এরূপ জবাব আল্লাহ্ তায়ালার পছন্দ হলো না। তাই তিনি মুসা (আ.)-কে তিরস্কার করলেন। কেননা হযরত মুসা (আ.) বিষয়টি আল্লাহর উপর ছেড়ে দেননি। আল্লাহ্ তায়ালা হযরত মুসা (আ.)-কে ওহির মাধ্যমে জানিয়ে দিলেন যে, দুই সমুদ্রের মিলন স্থলে অবস্থানকারী আমার এক বান্দা আপনার চেয়ে অধিক জ্ঞানী। একথা শুনে হযরত মুসা (আ.) প্রার্থনা করলেন- হে আমার প্রতিপালক! তাঁর কাছে আমি যাবো কীভাবে? আল্লাহ্ বললেন- থলের মধ্যে একটি ভাজা (শোল) মাছ নিয়ে নিন এবং দুসমুদ্রের মিলন স্থলের উদ্দেশে রওনা করুন। যেখানে পৌঁছানোর পর (শোল) মাছটি হারিয়ে যাবে, সেখানেই আমার এই বান্দার সাক্ষাৎ পাবেন। হযরত মুসা (আ.) থলের মধ্যে একটি ভাজা (শোল) মাছ নিয়ে রওনা করলেন। তাঁর সাথে তাঁর খাদেম ইউশা ইবনে নুনও ছিল। পথিমধ্যে একটি পাথর খণ্ডের নিকট তাঁরা যাত্রা বিরতি করলেন। হযরত মুসা (আ.) পাথরটির উপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে গেলেন। এখানে হঠাৎ মাছটি নড়াচড়া করতে লাগল এবং থলে থেকে বের হয়ে সমুদ্রে চলে গেলো। ইউশা ইবনে নুন বিস্ময়কর এই ঘটনা দেখছিলেন। আর হযরত মুসা (আ.) ঘুমিয়ে ছিলেন। যখন জাগ্রত হলেন, তখন ইউশা ইবনে নুন এই বিস্ময়কর ঘটনা হযরত মুসা (আ.)-কে বলতে ভুলে গেলেন এবং তাঁরা সেখান থেকে সামনে রওনা হয়ে পূর্ণ একদিন এক রাত চলার পর, সকাল বেলায় হযরত মুসা (আ.) তাঁর খাদেমকে বললেন- ‘আমাদের নাশতা আন। এই সফরে যথেষ্ট ক্লান্ত হয়ে পড়েছি।’ হযরত রাসুল (সা.) বলেন-দুসমুদ্রের মিলনস্থল অতিক্রম করার আগ পর্যন্ত হযরত মুসা (আ.)-এর ক্লান্তি অনুভব হয়নি। নাশতা চাওয়ার পর তাঁর খাদেম ইউশা ইবনে নুন বললেন- ‘আপনি কি লক্ষ্য করেছেন, আমরা যখন পাথর খণ্ডে বিশ্রাম নিয়েছিলাম, তখন আমি মাছটির কথা ভুলে গিয়েছিলাম। শয়তানই আমাকে এ কথা স্মরণ রাখতে ভুলিয়ে দিয়েছিল। মাছটি বিষ্ময়করভাবে সমুদ্রে নিজের পথ করে নিয়েছে (তখন হযরত মুসা (আ.) বললেন-সে স্থানটিই তো আমাদের গন্তব্যস্থল ছিল)।’
আর তখনই তাঁরা ফিরে চললেন এবং স্থানটি পাওয়ার জন্য পূর্বের পথ ধরেই চললেন। পূর্বের স্থানে পৌঁছে তাঁরা দেখতে পেলেন যে, মাছটি সমুদ্রের যে পথ দিয়ে চলে গেছে, সেখানে একটি সুড়ঙ্গের মতো হয়ে গেছে। এই ঘটনাটি খাদেম ইউশা ইবনে নুনের জন্য ছিল বিস্ময়কর এবং মাছটির জন্য ছিল একটি সুড়ঙ্গ মাত্র। আর পাথর খণ্ডের নিকট পৌঁছে দেখলেন, এক ব্যক্তি আপাদমস্তক চাদরে আবৃত হয়ে শুয়ে আছেন। মুসা (আ.) সেই অবস্থায়ই সালাম দিলে, হররত খিজির (আ.) বললেন-
এই (জনমানবহীন) প্রান্তরে সালাম কোথা থেকে আসলো? হযরত মুসা (আ.) বললেন- আমি মুসা। হযরত খিজির (আ.) জানতে চাইলেন, বনি ইসরাঈলের মুসা? তিনি জবাব দিলেন- হ্যাঁ, আমি বনি ইসরাঈলের মুসা। হযরত মুসা (আ.) তাঁকে বললেন- ‘আমি কি এই শর্তে আপনার অনুসরণ করতে পারি যে, সত্য পথের যে জ্ঞান আপনাকে শেখানো হয়েছে, সেই থেকে আমাকে কিছু শিক্ষা দেবেন? হযরত খিজির (আ.) বললেন- হে মুসা (আ.)! আল্লাহ্ তায়ালা আপনাকে এমন জ্ঞান শিক্ষা দিয়েছেন, যা আমি জানি না; অন্যদিকে আল্লাহ্ তায়ালা আমাকে এমন জ্ঞান শিক্ষা দিয়েছেন, যা আপনি জানেন না। হযরত মুসা (আ.) বললেন- আমি আপনার সাথে থাকব। হযরত খিজির (আ.) বললেন- ‘যদি আপনি আমার সাথে থাকতেই চান, তবে কোনো বিষয়ে আমাকে প্রশ্ন করবেন না, যে পর্যন্ত না আমি নিজেই সে বিষয়টি বলে দেই।’ এ কথা বলার পর উভয়ে সমুদ্রের তীর ধরে চলতে লাগলেন। ঘটনাক্রমে তাদের সামনে একটি নৌকা উপস্থিত হলো। মাঝিরা হযরত খিজির (আ.)-কে চিনে ফেলল এবং কোনো রকম পারিশ্রমিক ছাড়াই তাদেরকে নৌকায় তুলে নিল। হযরত রাসুল (সা.) বলেন- ইতোমধ্যে একটি পাখি এসে নৌকার এক প্রান্তে বসল এবং সমুদ্র থেকে এক ঠোঁট পানি তুলে নিলো। হযরত খিজির (আ.) হযরত মুসা (আ.)-কে বললেন-আমার জ্ঞান, আপনার জ্ঞান এবং পুরো সৃষ্টি জীবের জ্ঞান মিলে আল্লাহ্ তায়ালার জ্ঞানের মোকাবিলায় এমন তুলনাও হয় না, যেমনটি এ পাখির ঠোঁটের পানির সাথে রয়েছে সমুদ্রের পানি। নৌকায় চড়েই হযরত খিজির (আ.) কুড়ালের সাহায্যে নৌকার একটি তক্তা তুলে ফেললেন। এতে হযরত মুসা (আ.) স্থির থাকতে পারলেন না। তিনি হযরত খিজির (আ.)-কে বললেন-তারা কোনো প্রকার পারিশ্রমিক ছাড়াই আমাদেরকে নৌকায় তুলে নিয়েছে। আর আপনি কিনা এ প্রতিদানে তাদের নৌকা ভেঙে দিলেন, যেন সবাই ডুবে যায়? এতে আপনি অতি মন্দ কাজ করলেন। খিজির (আ.) বললেন- আমি কি বলিনি আপনি আমার সাথে কিছুতেই ধৈর্য ধারণ করতে পারবেন না। মুসা (আ.) বললেন- আমার বিষয়ে কঠোরতা অবলম্বন করবেন না।
অতঃপর তাঁরা নৌকা থেকে নেমে সমুদ্রের তীর ধরে চলতে লাগলেন। হঠাৎ খিজির (আ.) একটি বালককে অন্যান্য বালকদের সাথে খেলা করতে দেখলেন। হযরত খিজির (আ.) স্বহস্তে বালকটির দেহ থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন করে দিলেন। বালকটি মরে গেলো। হযরত মুসা (আ.) বললেন- ‘আপনি একটি নিষ্পাপ প্রাণকে বিনা অপরাধে হত্যা করলেন। এ যে বিরাট গুনাহর কাজ করলেন।’ হযরত খিজির (আ.) বললেন- আমি তো পূর্বেই বলেছিলাম, আপনি আমার সাথে ধৈর্য ধরতে পারবেন না। হযরত মুসা (আ.) বললেন- এরপর যদি আমি আপনাকে কোনো বিষয়ে প্রশ্ন করি, তবে আপনি আমাকে আপনার সাথে রাখবেন না। আপনি আমার পক্ষ থেকে অভিযোগ মুক্ত হয়ে যাবেন।
অতঃপর তারা চলতে লাগলেন। অবশেষে যখন একটি গ্রামের অধিবাসীদের কাছে পৌঁছে, তাদের নিকট খাবার চাইলেন, তখন তারা খাবার দিতে সরাসরি অস্বীকার করল। হযরত খিজির (আ.) এই গ্রামে একটি দেওয়ালকে ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম দেখতে পেলেন। তিনি নিজ হাতে দেওয়ালটি সোজা করে দিলেন। হযরত মুসা (আ.) তাঁকে বললেন- আমরা এই গ্রামে প্রবেশ করেছিলাম। অতঃপর তারা আমাদের আতিথেয়তা করেনি এবং আমাদেরকে খাদ্য পরিবেশন করেনি, অথচ আপনি তাদের এত বড়ো কাজ করে দিলেন; ইচ্ছা করলে এর পারিশ্রমিক তাদের কাছ থেকে আদায় করতে পারতেন।
হযরত খিজির (আ.) বললেন- হাযা ফিরাকু বাইনী ওয়া বাইনিকা অর্থাৎ- ‘এখন শর্ত পূর্ণ হয়ে গেছে। এটিই আমার ও আপনার মধ্যে বিচ্ছেদের সময়।’ এখন যে বিষয়ে আপনি ধৈর্য ধরতে পারেননি, আমি সেগুলোর তাৎপর্য বলে দিচ্ছি। আর সে তাৎপর্য মহান আল্লাহ্ পবিত্র কুরআনে বলে দিয়েছেন। এরশাদ হচ্ছে- ‘হযরত খিজির (আ.) বললেন- হে মুসা (আ.)! সর্বপ্রথম নৌকাটির বিষয় ধরুন, সেটি ছিলো কতিপয় দরিদ্র লোকের। তারা সাগরে জীবিকা অন্বেষণ করত। আমি নৌকাটি (তক্তা উঠিয়ে) খুঁত বিশিষ্ট করে দিয়েছি, কেননা তাদের সামনে ছিল এক রাজা, যে (রাজা নির্দেশ জারি করেছিল যে, রাজ্যের সকল নতুন নৌকা রাষ্ট্রের মালিকানায় নিয়ে আসা হোক, ফলে রাজার লোকেরা) সব নিখুঁত নৌকা বল প্রয়োগ করে ছিনিয়ে নিয়ে যেতো। আর বালকটির বিষয়ে ছিলো এরূপ যে, তার পিতামাতা ছিল মু’মিন (অথচ বালকটি ছিলো কাফির)। আল্লাহ্ প্রদত্ত এলেম দ্বারা জানতে পেরে), আমি আশঙ্কা করলাম সে অবাধ্যতা এবং কুফুরি দ্বারা পিতামাতাকে ভীষণ কষ্ট দেবে (অতঃপর আমি এরূপ করি যে, বালকটিকে হত্যা করে ফেলি)। তারপর আমি চাইলাম তাদের রব তাদেরকে এর বদলে এমন এক সন্তান দান করবেন, যে হবে পবিত্র, মহৎ ও ভালোবাসায় পিতামাতার অধিকতর ঘনিষ্ঠ (অতঃপর মহান আল্লাহ্ ঐ পিতা মাতাকে আবেদা, সালেহা ও চক্ষুশীতলকারিণী এক কন্যা সন্তান দান করেন)। আর (ভেঙ্গে পড়া) দেয়ালের ব্যাপারটি ছিল এরূপ-এটির মালিকানা ছিল দুএতিম বালকের এবং এর নিচে ছিল তাদের জন্য লুকিয়ে রাখা পৈতৃক কিছু ধন সম্পদ; আর তাদের পিতা ছিলেন একজন নেককার লোক। [অতএব হে মুসা (আ.)!] আপনার রব দয়াপরবশ হলেন এবং ইচ্ছা করলেন যে, এতিম বালকদ্বয় যৌবনে উপনীত হবে এবং (স্বপ্নে দেখা) নিজেদের ধনভাণ্ডার সুরক্ষিত অবস্থায় বের করে নেবে (আর এ কারণেই আমি কাত হয়ে পড়ে যাওয়া দেওয়ালটি সোজা করে মেরামত করে দিয়েছি)। [হে মুসা (আ.)!] আমি এসবের কিছুই নিজ থেকে করিনি (বরং এ সবকিছুই আমি আল্লাহর ইচ্ছায় দিব্যজ্ঞানে করেছি)। হে মুসা (আ.)! আপনি যে বিষয়ে ধৈর্যধারণ করতে পারেননি, এ হলো তার প্রকৃত রহস্য বা তত্ত্ব কথা।’এভাবেই আল্লাহর রাসুল (সা.) সম্পূর্ণ ঘটনা বর্ণনা করেন।
অতঃপর তিনি এরশাদ করেন- আমার ইচ্ছা হচ্ছিল যে, যদি হযরত মুসা (আ.) আরো কিছু সময় ধৈর্যধারণ করতে পারতেন, তাহলে আমরা আল্লাহ্ তায়ালার সৃষ্টি রহস্যের আরো কিছু নিগূঢ় তত্ত্ব জানতে পারতাম।’’ (সূরা আল কাহ্ফ-১৮ : আয়াত ৭৯ থেকে ৮২; এবং বোখারী শরীফ-২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৬৯০)
উল্লিখিত ঘটনাগুলো থেকে একটি বিষয় সুস্পষ্ট হয়ে উঠে যে, শরিয়তের দৃষ্টিতে হযরত খিজির (আ.)-এর প্রতিটি কাজ ত্রুটিপূর্ণ মনে হলেও আসলে তা সঠিক ছিল। হযরত খিজির (আ.)-এর তাসাউফের জ্ঞান ছিল বলেই তিনি আগে থেকেই তা আল্লাহ্ তায়ালার কাছ থেকে অবহিত হতে পেরেছিলেন।
বিশ্বনবি হযরত রাসুল (সা.) জীবনে কখনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ করেননি। তিনি দীর্ঘ পনের বছর হেরা গুহায় তাসাউফের সাধনা তথা মোরাকাবা-মোশাহেদার মাধ্যমে মহান আল্লাহর পরিচয় লাভ করত তাঁর সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করে অসীম জ্ঞানের অধিকারী হয়েছিলেন। হযরত রাসুল (সা.) আক্ষরিক জ্ঞান অর্জন না করলেও তাসাউফের সাধনার মাধ্যমে জ্ঞানের সর্বোচ্চ সীমানায় আরোহণ করেছিলেন। ফলে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে পৃথিবীর সমস্ত জ্ঞানী, গুণী ও পণ্ডিতগণ তাঁকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞানী হিসেবে স্বীকার করে নিয়েছেন। হযরত রাসুল (সা.)-এর পরবর্তী বেলায়েতের যুগে মানুষ এলমে তাসাউফের সাধনা করেই আল্লাহর নৈকট্য লাভ করে অলী-আল্লাহর মর্যাদায় উপনীত হয়ে থাকেন। এলমে তাসাউফের জ্ঞান ছিল বলেই হযরত ওমর ফারুক (রা.) অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে ৯০০ মাইল দূরবর্তী সেনাপতি শারিয়ার বিপদ থেকে তাঁকে সতর্ক করেছিলেন; শেরে খোদা হযরত আলী র্কারামাল্লাহু ওয়াজহাহু খায়বরের কামুস দুর্গের সাড়ে ৮শ’ মণ ওজনের লৌহ কপাট বাম হাতে নিয়ে ঢাল বানিয়ে যুদ্ধ করেছিলেন; বড়ো পির হযরত আব্দুল কাদের জিলানি (রহ.) ১২ বছর পূর্বে নৌকা ডুবে নদীতে মৃত্যুবরণকারী বরযাত্রীসহ বর-বধূকে জীবিত করেছিলেন; হযরত খাজা মঈনউদ্দিন চিশতি (রহ.) একটি ঘটিতে পানি তুলে ‘আনা সাগর’শুকিয়ে দিয়েছিলেন; হযরত মোজাদ্দেদ আলফেসানি (রহ.) বাদশাহ্ আকবরের ‘দ্বীনে এলাহী’কে তছনছ করে দিয়েছিলেন; হযরত শাহ্জালাল (রহ.) জায়নামাজ বিছিয়ে সিলেটের সুরমা নদী পার হয়েছিলেন। বস্তুত এলমে তাসাউফের সাধনার সাহায্যে মানুষ আত্মিক পরিশুদ্ধতা অর্জন করে আল্লাহর গুণে গুণাণ্বিত হতে সক্ষম হয়। এ প্রসঙ্গে বোখারী শরীফে বর্ণিত হয়েছে, মহান আল্লাহ্ হাদিসে কুদসিতে এরশাদ করেন, “আমার বান্দা নফল ইবাদত দিয়ে আমার এত নিকটবর্তী হয়ে যায় যে, আমি তাকে ভালোবাসতে বাসতে তার কর্ণ হয়ে যাই, যে কর্ণ দিয়ে সে শোনে; চক্ষু হয়ে যাই, যে চক্ষু দিয়ে সে দেখে; হাত হয়ে যাই, যা দিয়ে সে ধরে; পা হয়ে যাই, যা দিয়ে সে হাঁটে। অবশ্য যখন কোনো বিষয়ে প্রার্থনা করে, তখনই তা দান করে থাকি এবং যখন কোনো বিষয় ক্ষমা চায়, তখন মাত্র তা মাফ করে থাকি।” (বোখারী শরীফ-২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৯৬৩)
বস্তুত এলমে তাসাউফের সাধনার মাধ্যমে মানুষ আল্লাহর সত্যিকার প্রতিনিধির মর্যাদা লাভ করতে সক্ষম হয় বলেই হযরত রাসুল (সা.) এ জ্ঞানকে মানুষের জন্য পরম উপকারী হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। মানব জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষক বিশ্বনবি হযরত রাসুল (সা.) ফরমান, “লিকুলি শাইয়িন জ্বাহিরুও ওয়া বাত্বিনুন।” অর্থাৎ- প্রত্যেকটি বস্তুর জাহের ও বাতেন আছে। সুতরাং মানুষেরও জাহের ও বাতেন আছে। মানুষের জাহের হলো- দেহ, আর বাতেন হলো রূহ্ বা আত্মা। মানব দেহের যেমন পঞ্চইন্দ্রিয় চক্ষু, কর্ণ, জিহ্বা, নাসিকা ও ত্বক আছে, তদ্রুপ আত্মারও চক্ষু, কর্ণ, জিহ্বা, নাসিকা ও ত্বক আছে। এর প্রমাণ হলো- কোনো এক ব্যক্তি তার ঢাকার বাসায় ঘুমিয়ে স্বপেড়ব দেখে সে চট্টগ্রামের বাড়িতে গিয়ে তার আত্মীয় স্বজনদের সাথে কথা বলছে, তারা কী বলছে তা সে শুনতে পায়। এখন প্রশ্ন হলো- সে ব্যক্তিটিতো ঢাকায় ঘুমিয়ে আছে, তাহলে কোন চোখ দিয়ে চট্টগ্রামের আত্মীয়কে দেখতে পেল? কোন কান দিয়ে চট্টগ্রামের আত্মীয়ের কথা শুনলো। এই চক্ষুই হলো অন্তরের চক্ষু; এই কর্ণই হলো অন্তরের কর্ণ।
যেমন, হযরত রাসুল (সা.) মজলিসে বসে সাহাবায়ে কেরামকে নিয়ে আলোচনারত অবস্থায় কখনো কখনো ওহি নাজিল হতো। হযরত রাসুল (সা.) ওহির কথা শুনতেন। অথচ মজলিসের অন্য কোনো ব্যক্তি ওহি আসতে দেখেননি এবং ওহির কথাও শুনেননি। তাহলে হযরত রাসুল (সা.) কোন চোখ দিয়ে ওহি আসতো দেখতেন?
কোন কান দিয়ে ওহির কথা শুনতেন? এটাই ছিলো হযরত রাসুল (সা.)-এর অন্তরের চক্ষু, অন্তরের কর্ণ। সুতরাং প্রত্যেক মানুষেরই অন্তরের পঞ্চইন্দ্রিয় তথা: চক্ষু, কর্ণ, জিহ্বা, নাসিকা ও ত্বক আছে।
মানুষ মাদ্রাসা, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দেহের পঞ্চইন্দ্রিয়ের সাহায্যে এলমে কিতাবের জ্ঞান অর্জন করে মুফতি, মোহাদ্দিস, মোফাচ্ছির, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, জজ, ব্যারিস্টার, বিদ্বান, পণ্ডিত হতে পারে। পক্ষান্তরে এলমে তাসাউফের সাধনা করে অন্তরের পঞ্চইন্দ্রিয়ের সাহায্যে মানুষ মহান স্রষ্টা আল্লাহ্ তায়ালা ও তাঁর সৃষ্টিরাজির অপরিসীম জ্ঞান অর্জন করে নবুয়তের যুগে নবি ও রাসুলের মর্যাদা লাভ করতেন। আর এ বেলায়েতের যুগে অলী-আল্লাহর মর্তবা লাভ করে থাকেন। তাসাউফের সাধনার মাধ্যমে অন্তরের পঞ্চইন্দ্রিয়কে জাগ্রত করতে সক্ষম হলে মানুষের কাছে সৃষ্টিজগতের ভেদ ও রহস্য প্রকাশ্য দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে যায়। তখন তাঁর কাছে অতীত-ভবিষ্যৎ সর্বকিছুই বর্তমানের মতো বাস্তবরূপ ধারণ করে।
তাসাউফ এমনই এক বিজ্ঞান যার সাহায্যে মানুষ আত্মিক পঞ্চইন্দ্রিয় জাগ্রত করে মহান আল্লাহর দিদার লাভ করে তাঁর সাথে কথোপকথন করতে পারে। মানুষ যে মহান আল্লাহর সাথে যোগাযোগ করে কথোপকথন করতে পারে, সে সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে, “মানুষের এমন মর্যাদা নাই যে, আল্লাহর সাথে কথা বলবেন ওহির মাধ্যম ব্যতিরেকে, অথবা পর্দার অন্তরাল ব্যতিরেকে, অথবা এমন দূত প্রেরণ ব্যতিরেকে, যেই দূত তাঁর অনুমতিক্রমে তিনি যা চাহেন, তা ব্যক্ত করেন; তিনি সমুন্নত, প্রজ্ঞাময়। (সূরা আশ শূরা-৪২: আয়াত ৫১) অর্থাৎ, মানুষ আল্লাহর সাথে ফায়েজ, এলহাম ও কাশফের- এ তিন পদ্ধতির মাধ্যমে যোগাযোগ করতে পারে। মানুষ এলমে তাসাউফের সাধনা করে অন্তরের পঞ্চইন্দ্রিয় জাগ্রত করতে পারলে তখন সে অন্তরের ত্বক দিয়ে আল্লাহর পক্ষ থেকে ফায়েজ প্রাপ্ত হয়ে আল্লাহ্ তায়ালার ইচ্ছা বা অভিপ্রায় বুঝতে পারে; অন্তরের কর্ণ সক্রিয় করে এলহামের মাধ্যমে আল্লাহর বাণী শুনতে পারে; অন্তরের চক্ষু সক্রিয় করে কাশ্ফ বা অন্তর্দৃষ্টির মাধ্যমে আল্লাহর দিদার লাভসহ রহস্য জগতের বিভিন্ন বিষয় দেখতে পারে। তখনই মানুষ আল্লাহ্ তায়ালার সম্পূর্ণ পরিচয় লাভ করে আল্লাহর
গুণে গুণান্বিত হয়ে সত্যিকার আল্লাহর প্রতিনিধি হয়ে সমস্ত সৃষ্টির শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদায় উপনীত হন। এলমে তাসাউফের সাধনা করে আত্মার পঞ্চইন্দ্রিয়কে জাগ্রত করে আল্লাহর নৈকট্য হাসিল করতে না পারলে মানুষের মনুষ্যত্ব বিকশিত হয় না। ফলে তার জন্য রয়েছে মহান আল্লাহ্ তায়ালার কঠোর শাস্তি। পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে: মহান আল্লাহ্ এরশাদ করেন, “আমি তো বহু জিন ও মানবকে জাহানড়বামের জন্য সৃষ্টি করেছি; তাদের হৃদয় আছে, কিন্তু তা দিয়ে তারা উপলব্ধি করে না (ফায়েজ বুঝে না); তাদের চক্ষু আছে, তা দিয়ে দেখে না (কাশফ নেই) এবং তাদের কর্ণ আছে, তা দিয়ে শ্রবণ করে না (এলহাম শুনে না); এরা পশুর ন্যায়; বরং এর চেয়ে অধিক নিকৃষ্ট। তারাই উদাসিন।” (সূরা আ‘রাফ-৭: আয়াত ১৭৯)
এলমে তাসাউফের জ্ঞান দিয়ে নবুয়তের যুগে নবি-রাসুলগণ যেমনিভাবে আল্লাহর সাথে যোগাযোগ করে ধর্ম প্রচার করেছেন, বেলায়েতের যুগে অলী-আল্লাহ্গণ তেমনিভাবে আল্লাহ্ ও হযরত রাসুল (সা.)-এর সাথে যোগাযোগ করে তাঁদের নির্দেশানুযায়ী ইসলাম ধর্ম প্রচার করে থাকেন। বিশ্বজাহানের সৃষ্টি রহস্য বুঝতে হলে আমাদের জানা প্রয়োজন- অলী-আল্লাহ্গণ বিশ্বজাহানকে ৩ ভাগে বিভক্ত করেছেন। যথা- স্থূল, সূক্ষ্ম ও সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম। স্থূল হলো- যা দেখা যায় ও ধরা যায়; সূক্ষ্ম হলো- যা দেখা যায়
না, ধরাও যায় না, কিন্তু অনুভব করা যায়। আর সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম হলো- যা দেখা যায় না, ধরা যায় না, এমনকি অনুভবও করা যায় না। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়- মানুষের দেহ হলো- স্থুল দেহের শান্তি-অশান্তির অনুভূতি হলো সূক্ষ্ম, আর মানুষের মধ্যস্থিত রূহ বা আত্মা হলো সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম। অনুরূপভাবে- মহাবিশ্বের জড়জগৎ হলো স্থুল, বেহেশত-দোজখ হলো সূক্ষ্ম; আর আল্লাহময় জগৎ হলো সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম। বিশ্বজাহনের ৩টি স্তরের মধ্যে সূক্ষ্ম জগৎকে আধ্যাত্মিক জগৎ বা রূহানি জগৎ বলা হয়।
মানবদেহের সূক্ষ্ম স্তর অর্থাৎ- মনের ইচ্ছা বা অভিপ্রায়কে যেমন দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সাহায্যে বাস্তবায়ন করা হয়। তদ্রুপ বিশ্বজাহানের সূক্ষ্ম স্তর অর্থাৎ- রূহানি জগতের পরিকল্পনাই জড়জগতে বিভিন্ন সৃষ্টির সাহায্যে বাস্তবায়িত হয়।
রাষ্ট্র পরিচালনা করার জন্য যেমন সরকার আছে, প্রশাসন আছে। তদ্রুপ রূহানি জগৎ পরিচালনা করার জন্য আল্লাহ্ তায়ালার মনোনীত অলী-আল্লাহ্গণের রূহানি প্রশাসন রয়েছে। অলী-আল্লাহ্গণ এলমে তাসাউফের সাধনার মাধ্যমে তাঁদের আত্মার পঞ্চইন্দ্রিয় জাগ্রত করে রূহানি জগতে বিচরণ করেন এবং আল্লাহর সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রেখে তাঁর নির্দেশ অনুযায়ী রূহানি জগৎ পরিচালনা করেন। মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে রূহানি জগৎ পরিচালনাকারী অলী-আল্লাহ্গণের মধ্যে তিনটি শ্রেণি রয়েছে। যথা- হাদি, মাজ্জুব ও দেশরক্ষক অলী-আল্লাহ্। হাদি শ্রেণির অলী-আলাহ্ বলা হয় তাঁদের, যাঁরা মানুষকে হেদায়েত করার দায়িত্ব পালন করে থাকেন। হাদি শ্রেণির অলী-আল্লাহ্গণের মধ্যে চারটি শ্রেণি রয়েছে। যথা- অলী-আল্লাহ্, অলীয়ে কামেল, অলীয়ে মোকাম্মেল ও মোজাদ্দেদে জামান বা যুগের ইমাম।
আর মাজ্জুব শ্রেণির অলী-আল্লাহ্ বলা হয় তাঁদের, যাঁরা জাগতিক কামনা-বাসনা, আশা-আকাঙ্খা, সুখ-শান্তি পরিত্যাগ করে একমাত্র আল্লাহ্ তায়ালার এশ্কে দেওয়ানা থাকেন। এ শ্রেণির অলী-আল্লাহ্গণ সামাজিক কর্মের প্রতি কোনোরকম সম্পর্ক বজায় রাখেন না, লোকচক্ষুর অন্তরালে লুকিয়ে জীবন-যাপন করে থাকেন। এছাড়া দেশরক্ষক অলী-আল্লাহ্গণ হলেন তাঁরা, যাঁরা আল্লাহর ইচ্ছা মোতাবেক সমগ্র সৃষ্টিজগৎ পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত থাকেন।
বিশ্বনবি হযরত রাসুল (সা.) এলমে তাসাউফের অনন্তজ্ঞানের দ্বার চিরউন্মুক্ত করে বেলায়েতের যুগের সূচনা করেছেন। এ জন্যই বেলায়েতের যুগে হাদি, মাজ্জুব ও দেশরক্ষক অলী-আল্লাহ্ সবাইকেই এলমে তাসাউফের গভীর জ্ঞান অর্জন করতে হয়। অধিকন্তু হাদি শ্রেণির অলী-আল্লাহ্গণ মানব জাতিকে এলমে তাসাউফের শিক্ষা দিয়ে থাকেন বিধায় তাঁদেরকে তা পরিপূর্ণভাবে আয়ত্ব করতে হয়। ফলে হাদি শ্রেণির অলী-আলাহ্গণ রূহানি জগৎ বা এলমে তাসাউফের শীর্ষস্থানে অবস্থান করেন এবং হাদি শ্রেণির অলী-আল্লাহ্গণের মধ্যে সর্বোচ্চ মাকাম হাসিলকারী অলী-আল্লাহ্ হযরত রাসূল (সঃ)-এর সিরাজুম মুনিরার ধারক ও বাহক হয়ে থাকেন এবং সমকালীন যুগের সব শ্রেণির অলীগণের বাদশাহ্ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
তাঁর ফায়েজের দ্বারাই সব শ্রেণির অলী-আল্লাহ্গণ নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করে থাকেন। তিনি কখনো ইমাম, কখনো মোজাদ্দেদ, আবার কখনো সূফী সম্রাট হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। প্রত্যেক যুগেই যে একজন করে ইমাম থাকেন; আর তিনি যে সৃষ্টিজগতের উপর বিশেষ ভূমিকা পালন করেন, তা বুঝাতে গিয়ে হাদিস শরীফের বর্ণিত হয়েছে- হযরত রাসুল (সা.) ফরমান, “যে ব্যক্তি তার জামানার ইমামকে (আধ্যাত্মিক নেতা) চিনতে পারে না এবং এ অবস্থায় যদি মৃত্যু ঘটে, তবে তার মৃত্যু অন্ধকারে নিমজ্জিত ও নিপতিত হবে।” (মুসনাদে ইমাম সাদেক, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৫১৯ ও ৫৩৩) আর এই ইমামগণের মধ্য থেকেই যে প্রত্যেক শতাব্দিতে একজন মোজাদ্দেদ বা সংস্কারকের আবির্ভাব হবে এবং তিনি স্বধর্মীদের অজ্ঞতা ও বিধর্মীদের চক্রান্তের ফলে ইসলামের নামে পবিত্র কুরআন ও হাদিস বহির্ভূত যেসব বিষয় মুসলিম সমাজে প্রচলিত রয়েছে, সেগুলোর সংস্কার সাধন করে বিশ্বনবি হযরত রাসুল (সা.)-এর প্রকৃত আদর্শ ও শিক্ষা মানবজাতির কাছে তুলে ধরবেন, এ সম্পর্কে হযরত রাসুল (সা.) ফরমান, “নিশ্চয় মহান ও মহিমান্বিত আল্লাহ্ এই উম্মতের জন্য প্রত্যেক শতাব্দীর শিরোভাগে এমন এক ব্যক্তিকে পাঠাবেন, যিনি তাদের ধর্মকে সংস্কার করে সজীব ও সতেজ করবেন।” (আবু দাউদ শরীফের সূত্রে মেশকাত শরীফ, পৃষ্ঠা ৩৬)
বিশ্বনবি হযরত রাসুল (সা.)-এর পরবর্তীতে সিরাজুম মুনিরার ধারক ও বাহক হিসেবে যুগপরিক্রমায় ইমামগণের মধ্য থেকে মহান সংস্কারকরূপে বড়ো পির মহিউদ্দীন হযরত আবদুল কাদের জিলানি (রহ.), হযরত খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি (রহ.), হযরত বাহাউদ্দিন নকশবন্দি (রহ.), হযরত শায়খ আহমদ সেরহেন্দি (রহ.)-এর মতো মোজাদ্দেদগণের আবির্ভাব ঘটেছে।
তাঁরা প্রত্যেকেই সমকালীন যুগে কুসংস্কারাচ্ছন্ন মুসলিম সমাজে প্রকৃত ইসলামি আদর্শ ও শিক্ষা তুলে ধরে মানুষকে মহান আল্লাহ্ ও হযরত রাসুল (সা.)-এর শিক্ষা দিয়ে গেছেন।
বর্তমান পাপসংকুল পৃথিবীতে মহান আল্লাহ্ ও হযরত রাসুল (সা.)-এর শান্তির ধর্ম প্রতিষ্ঠার জন্য পবিত্র কুরআন ও হাদিসের আলোকে মুসলিম সমাজে প্রচলিত কুসংস্কার দূর করতে সচেষ্ট হয়েছি। আল্লাহর অপার দয়ায় মানুষও তা সাদরে গ্রহণ করেছে।
[লেখক: প্রতিষ্ঠাতা ও স্বত্বাধিকারী; দেওয়ানবাগ শরীফ]