যাঁকে পেয়ে ধন্য জীবন
অধ্যাপক ড. আবদুল মান্নান মিয়া
পর্ব-১৩
চট্টগ্রাম থেকে জনৈক ব্যক্তির দেওয়ানবাগে আকস্মিক আগমন
অলী-আল্লাহ্গণ হলেন আল্লাহর বন্ধু। তাঁরা আল্লাহর ইচ্ছাতেই সব কাজ করে থাকেন। আল্লাহ্ চাইলে তারা নিজ জন্মস্থানে থেকেই মানুষকে সত্যের পথ দেখান। আবার আল্লাহর ইচ্ছাতেই তাঁদেরকে স্বদেশভূমি ছেড়ে অন্যত্র হিজরত করতে হয়। নবুয়তের যুগেও এ ঘটানাই ঘটেছে। আমাদের প্রিয় নবি, বিশ্ব মানবতার মুক্তির অগ্রদূত, ইমামুল মুরসালিন হযরত রাসুল (সা.)-এর জীবনের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, আল্লাহর একত্ববাদের বাণী প্রচারের লক্ষ্যেই অত্যাচারী কাফেরদের অত্যাচারে তাঁকে মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করতে হয়েছে। আর শেষ জীবন পর্যন্ত তিনি মদীনায়ই ছিলেন। মদীনাতেই তাঁর রওজা শরীফ রয়েছে। অনুরূপভাবে অলী-আল্লাহ্গণের জীবনেও এ ঘটনা পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। প্রখ্যাত অলী-আল্লাহ্ হযরত শাহ্ জালাল (রহ.) সুদূর আরবের ইয়েমেনে থেকে এতদূর পথ পাড়ি দিয়ে এই বাংলাদেশের সিলেটে আগমন করেন। এদেশে ইসলাম ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে তাঁর ৩৬০ জন ভক্তসহ আগমন করে ইসলাম প্রচার করেছেন। আল্লাহর মহান বন্ধু এবং হযরত রাসুল (সা.)-এর সুযোগ্য উত্তরসূরি সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহ্বুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী হুজুর কেবলাজানের পূর্ব পুরুষও আরবের কাতার থেকে মদীনা হয়ে এই বাংলাদেশে ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে আগমন করেছেন।
সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান তৎকালীন যুগের শ্রেষ্ঠ অলী-আল্লাহ্, মোজাদ্দেদে জামান, ইমাম সৈয়দ আবুল ফজল সুলতান আহমদ (রহ.)-এর দরবারে দীর্ঘ ১২ বছর খেদমতে নিয়োজিত ছিলেন। ১৯৮৪ সালের ২৮ মার্চ ইমাম হুজুর (রহ.)-এর ওফাতের পর সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান আপন মোর্শেদের দরবারে থেকে তাঁর আহালবর্গ ও মুরিদের সার্বিক তদারকির দায়িত্ব পালন করেছেন। কিন্তু পরবর্তীতে ১৯৮৫ সালে সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান চন্দ্রপাড়া ত্যাগ করে ঢাকায় আরামবাগে চলে আসেন। ১ বছর গত না হতেই, সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান ধর্ম প্রচারের বৃহত্তর স্বার্থে একটি দরবার শরীফ প্রতিষ্ঠা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। কয়েকটা জায়গা দেখার পরে তিনি নারায়ণগঞ্জ জেলার বন্দর থানাধীন দেওয়ানবাগে ১৯৮৫ সালে ১০ কাঠা জমি কিনে দরবার শরীফ প্রতিষ্ঠা করেন। আর এই দেওয়ানবাগ দরবার শরীফের নামেই সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান ‘দেওয়ানবাগী’ নামে পরিচিতি লাভ করেন। আল্লাহর ইচ্ছায় ১৯৮৫ সালের ১০ মহররম, ১৪০৭ হিজরি বৃহস্পতিবার সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান দেওয়ানবাগে দরবার শরীফ প্রতিষ্ঠা করেন। ঠিক সেদিনই চট্টগ্রাম থেকে জনৈক ব্যক্তি দেওয়ানবাগ দরবারে হাজির হন। তিনি সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজানের কাছে এসে বলেন- আমার পিতা একজন সুফি সাধক ছিলেন। তিনি ১৯৭৫ সালে ইন্তেকালের সময় আমাকে অছিয়ত করে যান যে, ঢাকার নিকটে দেওয়ানবাগ শরীফে একজন অলী-আল্লাহর দরবার রয়েছে। তুমি তাঁর কাছে যাবে এবং তাঁর পরামর্শমত কাজ করবে। তবেই তোমার জীবনে আসবে সুখ ও কল্যাণ। একথা শুনে সূফী সম্রাট বললেন- আপনার পিতা বোধ হয় অন্য কোনো দরবারের কথা বলেছেন। কারণ আমিতো আজ আমার দরবার উদ্বোধন করলাম। আর আপনার পিতা বলে গেছেন কয়েক বছর আগে। সুতরাং আপনি ঢাকার আশে পাশে আরো কোনো দরবার খুঁজে দেখেন। হয়ত আপনার পিতার কথার সাথে সেখানে মিল পাবেন।
সূফী সম্রাটের কাছে একথা শোনার পরেও লোকটি জোড় দিয়েই বললেন- জি না হুজুর, আমার পিতা আমাকে যেভাবে নির্দেশনা দিয়ে গেছেন, তাতে আমি নিশ্চিত যে, আপনিই আমার পিতার সেই নির্দেশিত মহামানব। আমাকে আপনি সঠিক পথে চলার এবং আমার করণীয় সম্পর্কে নির্দেশনা দিন। তার কথা শুনে সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান তাকে নিকটে ডেকে নিলেন এবং প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা দিয়ে বিদায় দিলেন।
‘দেওয়ানবাগী’ হিসেবে পরিচিতি লাভ
সূফী সম্রাট হুজুর কেবলার শুভ জন্মের পর ৭ম দিবসে আকিকার অনুষ্ঠানে তদানীন্তন প্রখ্যাত আলেম ফখরে বাংলা মাওলানা তাজুল ইসলাম সাহেব তাঁর নাম রেখেছিলেন ‘মাহ্বুব-এ-খোদা’। এ কারণে শৈশব ও কৈশোরে তিনি সবার কাছে এ মধুমাখা নাম ‘মাহবুব ’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। যৌবনে তিনি মাদ্রাসা শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ায় সবাই তাঁকে মাওলানা মাহ্বুব-এ-খোদা হিসেবে চিনতেন। কর্মজীবনে সেনাবাহিনীর রিলিজিয়াস টিচারের দায়িত্ব পালনকালে সূফী সম্রাট হুজুর কেবলা জয়দেবপুর সেনানিবাসে ‘বড়ো হুজুর’ নামে পরিচিত ছিলেন। যদিও তখন তাঁর অফিসিয়াল নাম ছিল মাওলানা মাহ্বুব-এ-খোদা। তিনি তাঁর মোর্শেদ ইমাম সৈয়দ আবুল ফজল সুলতান আহমদ (রহ.)-এর দরবার শরীফে যাওয়ার পর মাওলানা মাহ্বুব-এ-খোদা হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় তরিকা প্রচারের জন্য যখন মাহ্ফিলে যেতেন, তখন তাঁকে বলা হতো হযরত মোজাদ্দেদ শাহ্ চন্দ্রপুরী (রহ.)-এর প্রধান খলিফা মাওলানা মাহ্বুব-এ-খোদা। মোর্শেদের দরবার থেকে ঢাকায় চলে আসার পরও তিনি এই নামেই পরিচিত ছিলেন।
কিন্তু সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান রাজধানী ঢাকার অদূরবর্তী নারায়ণগঞ্জের বন্দর থানাধীন দেওয়ানবাগে দরবার শরীফ প্রতিষ্ঠার পর থেকে তিনি ‘দেওয়ানবাগী’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। বিশেষ করে দেওয়ানবাগ দরবার শরীফের প্রথম মহাপবিত্র ওরস মোবারকের মিছিল, মাহ্ফিল ও বিভিন্ন প্রচারপত্রে তাঁকে ‘হযরত শাহ্ দেওয়ানবাগী’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। এমনকি ওরছ মোবারকের শ্রদ্ধাঞ্জলিতেও তাঁকে ‘সুলতানিয়া-মোজাদ্দেদিয়া তরিকার কর্ণধার মাওলানা মাহ্বুব-এ-খোদা ‘দেওয়ানবাগী’ হিসেবে প্রচার করা হয়। এরপর থেকে তিনি সর্বত্রই ‘দেওয়ানবাগী’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। বাংলাদেশে এ মহামানবের জন্ম হলেও আজ বিশ্ববাসী সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহ্বুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী হুজুর কেবলাজানকে ‘শাহ দেওয়ানবাগী’ হিসেবে শ্রদ্ধা করে থাকে।
দেওয়ানবাগ দরবার ভাঙ্গতে এসে শত্রুরা ভয়ে পালিয়ে গেল
মহান আল্লাহর দ্বিন প্রচার করার কারণে পূর্বযুগে বহু নবি-রাসুলকে শত্রুরা নানাভাবে কষ্ট দিয়েছে। আল্লাহ্র প্রিয় হাবিব হযরত রাসুল (সা.)-এর মতো বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানবকেও আরবের বর্বর মানুষগুলো নানাবিধ অত্যাচার করেছে। শুধু তাই নয়, তাঁকে হত্যা করার গভীর ষড়যন্ত্র পর্যন্ত করতেও শত্রুরা কুণ্ঠিত হয়নি। হযরত রাসুল (সা.)-এর উত্তরসূরি অলী-আল্লাহ্গণকেও অনেক সময় দুরাচারী লোকদের শত্রুতার কবলে পড়তে হয়েছে। আল্লাহর মহান বন্ধু যুগের ইমাম সূফী সম্রাট হযরত দেওয়ানবাগী হুজুরকেও এক শ্রেণির দুষ্ট প্রকৃতির মানুষ বিভিন্ন সময়ে কষ্ট দিয়েছে। তাঁর মহান মোর্শেদের তরিকা প্রচার করতে বাঁধা দিয়েছে। এমনকি তাঁকে হত্যা করার গভীর ষড়যন্ত্র পর্যন্ত করেছে। ইমাম হুজুর (রহ.)-এর জীবদ্দশায় যেমন ঘটেছে, তাঁর ওফাৎ লাভের পর থেকে তা আরো ব্যাপকতা লাভ করে। ইমাম হুজুর ১৯৮৪ সালের ২৮ মার্চ ওফাৎ লাভ করেন। আর সেই সুযোগে ইমাম হুজুরের এক শ্রেণির মুরিদ সূফী সম্রাটের বিরুদ্ধে দুশমনি শুরু করে দেয়। সূফী সম্রাট দেওয়ানবাগী (মা. আ.) হুজুর আপন মোর্শেদের সান্নিধ্যে তাঁর দরবার শরীফে দীর্ঘ ১১ বছর এবং তাঁর ওফাতের পরে আরো এক বছর, মোট ১২ বছর মোর্শেদের দরবারে সার্বিক দায়িত্ব পালন করেন। ইমাম হুজুর (রহ.)-এর এক শ্রেণির মুরিদান গদিনিসিন প্রশ্নে সূফী সম্রাটের তীব্র বিরোধিতা শুরু করে দেয়। ইমাম হুজুরের একমাত্র নাবালক পুত্রকে গদ্দিনসীন বানানোর জন্য যারা তৎপর ছিল, তারাই সূফী সম্রাটের তীব্র শত্রুতা শুরু করে দেয়। আর তাদের নেতৃত্বে ছিলেন ইমাম শাহ্ চন্দ্রপুরী (রহ.)-এর মেজো জামাতা ঢাকার মাতুয়াইলের মাওলানা কুতুবউদ্দীন। তার পুত্র এবং ইমাম হুজুরের বেশ কিছু সংখ্যক মুরিদান সূফী সম্রাটের সাথে প্রকাশ্যে শত্রুতা শুরু করে। এদিকে সূফী সম্রাট দেওয়ানবাগী হুজুর মোর্শেদের দরবার থেকে ঢাকায় চলে আসার পরে, তাঁর দুশমনেরা আর বসে রইলো না। তারা তাঁকে হত্যা করার জন্য গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে পড়ে। তারা যখন কোনো অবস্থাতেই সূফী সম্রাটের সাথে পেরে উঠল না, তখন তারা গোপন পরামর্শের ভিত্তিতে দেওয়ানবাগ দরবার শরীফ ভেঙ্গে দেওয়ার জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। আর সেই মোতাবেক তারা গোপন স্থানে একত্রিত হতে থাকে।
১৯৮৫ সালের ঘটনা। হঠাৎ করে শুনতে পেলাম চন্দ্রপাড়ায় মুরিদ দাবীদার কিছু ব্যক্তি দেওয়ানবাগ দরবার শরীফের মসজিদের সামনে এক মাহ্ফিলের আয়োজন করেছে। দেওয়ানবাগের স্থানীয় কিছু অলী-আল্লাহ্ বিরোধী ওহাবি আকিদার লোক, চন্দ্রপাড়ার ঐ বিদ্রোহী গ্রুপের সাথে হাত মিলিয়ে সূফী সম্রাটের বিরুদ্ধে মাহ্ফিলের আয়োজন করে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল, মাহ্ফিলের নামে লোকজন জমা করে নানাবিধ মিথ্যা প্রচারণার মাধ্যমে মানুষকে সূফী সম্রাটের বিরুদ্ধে উস্কে দেয়। আর সেই মোতাবেক বিরোধিদের প্রচারণা ব্যাপকভাবে চলতে থাকে। আমি তখন মিরপুরে থাকি। আরামবাগে দয়াল বাবাজানের সাথে দেখা করতে এসে দেওয়ানবাগে শত্রুদের কর্মসূচি সম্পর্কে অবহিত হলাম। ফলে মনে চরম ক্ষোভের সৃষ্টি হলো। এত বড় আস্পর্ধা! আমাদের দরবার শরীফে হামলা চালাবে শত্রুরা। আর দরবার শরীফ ভেঙ্গে ফেলবে। আমাদের শরীরে রক্ত থাকতে আমরা তা হতে দিতে পারি না। আরামবাগে আমরা বেশ কিছু সংখ্যক জাকের পরিস্থিতি সম্পর্কে জরুরি মিটিংয়ে বসলাম। দরবার শরীফের তৎকালীন ম্যানেজার জনাব বদরুজ্জামান সাহেব এবং আরাম বাগের বিশিষ্ট শিল্পপতি জনাব শফিউদ্দীন সাহেবও উপস্থিত ছিলেন। অপরদিকে আরামবাগের জাকের ভাইদের নেতৃত্বে ছিলেন জনাব খালেদ আদেল খান। সিদ্ধান্ত হলো আমরা রিজার্ভ বাসে করে মাহ্ফিলের নির্ধারিত দিনে সকালে দেওয়ানবাগ দরবার শরীফে যাব। সেই মোতাবেক গাড়ি রিজার্ভ করা হলো। সূফী সম্রাট দয়াল বাবাজান আমাদের আগ্রহ এবং দেওয়ানবাগ শরীফে যাওয়ার সিদ্ধান্তের কথা শুনে সম্মতি প্রদান করলেন। নির্ধারিত দিনে আমি সকাল বেলা মিরপুর থেকে আরামবাগে এসে পৌঁছি। এসে দেখি, আরামবাগের জাকের ভাইয়েরা দেওয়ানবাগ যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। এদিকে মিরপুরের গিয়াসউদ্দিন ভাইও আরামবাগে এসে উপস্থিত হলেন। তিনি আমাকে দেখে কাঁদতে লাগলেন। আমিও অনেকটা আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লাম। একটু পড়েই গিয়াস ভাই আমাকে জড়িয়ে ধরে বলতে লাগলেন- মান্নান ভাই! বাসা থেকে আসার সময় আমার স্ত্রীর কাছ থেকে দাবী ছাড়িয়ে বিদায় নিয়ে এসেছি। দেওয়ানবাগ দরবার শরীফে যাব। হয়তো শত্রুরা হামলা চালাবে। কিন্তু আমরাও তাদের মোকাবেলা করব। আর তাতে আমার মৃত্যুও হতে পারে। আমার মুখে একথা শুনে আমার স্ত্রীও কেঁদেছে। তাকে কাঁদিয়ে আমি বিদায় নিয়ে এসেছি। গিয়াস ভাইয়ের মুখে এমন কথা শুনে আমিও আর কান্না থামিয়ে রাখতে পারিনি। এদিকে আমরা প্রস্তুত হয়েছি দেওয়ানবাগে যাওয়ার জন্য। সকাল প্রায় ৮ টা। যদি আমাদের দুশমনেরা দরবার শরীফের বিরুদ্ধে কথা বলে তবে আমরা তার তীব্র প্রতিবাদ করব। অর্থাৎ কোনো অবস্থাতেই আমরা বাবাজানের সমালোচনামূলক কোনো কথাই বলতে দিবো না। তীব্র প্রতিবাদ জানাবো। আমরা আরামবাগ থেকে রওয়ানা করার জন্য দয়াল বাবাজানের কাছে বিদায় নিতে গেলাম। নীরব নিস্তব্ধ পরিবেশ। সূফী সম্রাট দয়াল বাবাজান বসা রয়েছেন। আমরা তাঁর কাছে গিয়ে কদমবুসি করে বিদায় নিতে প্রস্তুত হয়েছি। পরিস্থিতি অত্যন্ত শান্ত ও নীরব। কারো মুখে কোনো কথা নেই। আমাদের কদমবুসি করা শেষ হওয়ার পর দয়াল বাবাজান আমাদেরকে লক্ষ্য করে বললেন- আপনারা কেউ দেওয়ানবাগে যাবেন না। এটা আমার হুকুম। আমি দেখতে চেয়েছিলাম শত্রুরা দেওয়ানবাগ দরবার শরীফে হামলা চালালে- তাদের প্রতিরোধ করার জন্য আপনারা কতটুকু প্রস্তুত আছেন। আমার দেখা হয়ে গেছে। এখন আমি দেখতে চাই- আমার আল্লাহ্ কী করতে পারেন। সূফী সম্রাট দয়াল বাবাজান একথা বলার সাথে সাথে আমরা অবাক হয়ে গেলাম। এমন একটা পরিস্থিতিতে বাবাজান আমাদেরকে দেওয়ানবাগে যেতে নিষেধ করছেন- কেন? সবাই নীরব হয়ে আছে, এমন সময় আদিল ভাই কান্না শুরু করে দিলেন এবং দেওয়ালের সাথে নিজের মাথা ঠুকতে লাগলেন। তার মাথা ফেঁটে রক্ত বের হতে লাগলো। এমন একট চরম অবস্থা, যা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। বাবাজানের হুকুম না পেয়ে আমরা মনক্ষুন্ন হয়ে পড়লাম। দেওয়ানবাগ দরবার শরীফে মাত্র ৪/৫ জন খাদেম ছাড়া আর কোনো লোক নেই। বাদ আছর দেওয়ানবাগ জামে মসজিদের সামনে ওয়াজ শুরু হবে। চন্দ্রপাড়ার মুরিদান দেওয়ানবাগে সমবেত হতে শুরু করেছে। সবার মনে একটি কথা ঘুরপাক খাচ্ছিল। আর তা হলো- আজকে দেওয়ানবাগ দরবার শরীফ সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। কেউই তা রোধ করতে পারবে না। এই ওয়াজ মাহ্ফিলের নেতৃত্বে ছিল মাওলানা কুতুবউদ্দীনের ছেলেরাসহ অন্যান্যরা।
আছরের নামাজের পরে অর্থাৎ সন্ধ্যার পূর্বেই ওয়াজ শুরু হয়ে গেল। তারা মনে মনে ভাবতে লাগলো- দেওয়ানবাগী হুজুরের বদনাম করে এলাকাবাসীকে তাঁর বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলবে। এরই এক পর্যায়ে উস্কানি দিয়ে তারা দরবার শরীফ ভেঙ্গে চুড়মার করে দিবে। কিন্তু কুচক্রীরা জানে না যে, আল্লাহ্ যার সহায়, তাঁর বিন্দুমাত্র ক্ষতি করার ক্ষমতা কারো নেই। তাছাড়া সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান যুগের মহান ইমাম এবং একজন সংস্কারক। মহান আল্লাহ্ তাঁর সঙ্গে রয়েছেন। সূফী সম্রাটের ভালো মন্দ সকল কাজে মহান আল্লাহ্ই তাঁকে সাহায্য করে থাকেন। একটি মুহূর্তের জন্যও আল্লাহ্ তাঁকে ছেড়ে যান না। দেওয়ানবাগে সেদিন তারই প্রমাণ পাওয়া গেল। সূফী সম্রাট এবং তাঁর ভক্তবৃন্দ রয়েছেন আরামবাগে। আমিও সেদিন আরামবাগে থেকে দেওয়ানবাগের ঘটনার জন্য অত্যন্ত উৎকণ্ঠিত ছিলাম। কারণ, আমাদের দরবার শরীফ দুশমনরা ভেঙ্গে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিবে, তা কী করে সহ্য করব। তাছাড়া বাবাজান আমাদেরকে দেওয়ানবাগে শত্রুদের মোকাবেলা করতে যেতে দেননি।
এখন বিনা বাধায় তারা বাবাজানের বদনাম করবে এবং কুৎসা রটাবে, আর সেই সুযোগে আমাদের দরবার শরীফ ধ্বংস করে দিবে, এটা যেন কোনোভাবেই আমরা মেনে নিতে পারিনি। এদিকে মাগরিবের নামাজ পড়ে আমরা দেওয়ানবাগের ঘটনা নিয়ে চিন্তা করছিলাম। হঠাৎ করে এক জাকের ভাই দেওয়ানবাগ থেকে আরামবাগে এলো। অত্যন্ত ব্যতিব্যস্ত হয়ে তিনি বাবাজানের কাছে গিয়ে উপস্থিত হলেন। বাবাজান তাকে দেওয়ানবাগের খবরাখবর জিজ্ঞেস করতে না করতেই ঐ জাকের ভাই বাবাজানের কদম মোবারক ধরে আবেগাপ্লুত হয়ে বলতে লাগলেন- বাবা! আপনার দয়ায় দুশমনের দেওয়ানবাগ দরবার ছেড়ে পালিয়েছে। তারা ভয়ে সাড়ে ৫শ জোড়া জুতা এবং রান্না করা প্রায় ২৫ পাতিল খাবার ফেলে যেদিকে পেরেছে পালিয়ে গেছে। তাদের মাহ্ফিলের সব কিছু ঐ ভাবেই পড়ে রয়েছে। সত্যিই আল্লাহ্ তাঁর বন্ধুর দরবার বিনা বাধায় নিজেই রক্ষা করেছেন। ঐ জাকেরের মুখে একথা শুনে দয়াল বাবাজান আমাদেরকে ডাকলেন এবং সব ঘটনা খুলে বললেন। বাবাজানের কাছে ঘটনা শুনে আমি চোখের পানি আর ধরে রাখতে পারিনি। তখন বুঝতে পারলাম- দয়াল বাবাজান আমাদেরকে দেওয়ানবাগে শত্রুর মোকাবেলা করতে যেতে কেন নিষেধ করেছেন। কারণ, সূফী সম্রাট আল্লাহর প্রিয় বন্ধু এবং রাসুলের উত্তরসূরি। আল্লাহ্ এবং রাসুল (সা.) তাঁর সঙ্গে আছেন। সুতরাং যাঁর সঙ্গে আল্লাহ্ ও রাসুল (সা.) থাকেন, তাঁর আর মানুষের সাহায্যের প্রয়োজন কী? আর দেওয়ানবাগে তাই ঘটেছে। সেখানে স্বয়ং আল্লাহ্ তাঁর মহান বন্ধুর দরবার শরীফ শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করেছেন। সেদিনকার ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে আশেকে রাসুল আবু সাঈদ ভাই বলেছেন- আমি সেদিন দেওয়ানবাগ দরবার শরীফে ছিলাম। সন্ধ্যার আগেই সূফী সম্রাট দয়াল বাবাজানের বিরোধিরা মসজিদের সামনে জমায়েত হয়ে ওয়াজ করার নামে সূফী সম্রাটের বিরুদ্ধে নানাবিধ কুৎসা রটনা করতে লাগলো। শুনে খুবই খারাপ লাগছিল। কিন্তু কী করব, আমরা মাত্র ৪/৫ জন খাদেম দরবার শরীফে রয়েছি। আমাদের চরম অস্বস্তি লাগছিল। কিন্তু তবুও অনেকটা শরীর কামড়িয়ে দুশমনদের কথা বার্তা সহ্য করে যাচ্ছিলাম, আর ভাবছিলাম- বাবাজান এত বড় মহান অলী-আল্লাহ্ হয়েও, কী করে দুশমনদের এই কার্যাবলি সহ্য করছেন? একথা ভাবতে না ভাবতেই হঠাৎ তাকিয়ে দেখি- দয়াল বাবাজান আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। আমাকে ডাক দিয়ে বললেন- আবু সাঈদ! তাড়াতাড়ি বিদ্যুতের মেইন সুঁইচ বন্ধ করে দাও। আবু সাঈদ ভাই জানিয়েছেন- বাবাজান স্বশরীরে আমার সামনে উপস্থিত হয়ে আমাকে যখন মেইনসুঁইচ বন্ধ করে দিতে বললেন- আমি কালবিলম্ব না করে সুঁইচটি এক চাপে বন্ধ করে দিলাম। সাথে সাথে গোটা দেওয়ানবাগ এলাকা অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে গেল। মনে হলো- যেনো ভুতুরে পরিবেশ। আমি যেই সুঁইচটি বন্ধ করে দিলাম- তখনি শুনতে পেলাম, মাইকে বলা হচ্ছে- আপনারা যে যেখানে আছেন, যেমন করে হোক তাড়াতাড়ি চলে যান। তা না হলে রক্ষা পাবেন না। দরবারের পাশে আরামবাগ থেকে আসা লোকজন লুকিয়ে আছে। এখনই তারা হামলা চালাবে। সুতরাং আপনারা তাড়াতাড়ি পালান। একথা ঘোষণা দেওয়া মাত্রই হুড়মুড় করে যে যেখান থেকে পেরেছে দৌঁড়ে পালিয়েছে। কারো দিকে কারো ফিরে তাকাবার পর্যন্ত সুযোগ নেই। মুহূর্তেই যেন গোটা দেওয়ানবাগ এলাকা পূর্বের ন্যায় খালি হয়ে গেল। জনৈক ল্যাংড়া ব্যক্তি চিৎকার করে বলছিল- আমি দৌঁড়াতে পারছি না, তোমরা আমাকে নিয়ে যাও। অল্প সময়ের মধ্যেই সবাই পালিয়ে গেল। সেদিন সাড়ে ৫শত জোড়া জুতা এবং ২৫ ড্যাগ খাবার দেওয়ানবাগে পড়ে ছিল। জুতা নেওয়ার এবং খাবার খাওয়ার কোনো লোক খুঁজে পাওয়া যায়নি। আরামবাগ থেকে একটি মানুষও না যাওয়া সত্ত্বেও মহান আল্লাহ্ তাঁর বন্ধুর দরবার শরীফ অলৌকিভাবে রক্ষা করেছেন।
[লেখক: সাবেক ভাইস প্রিন্সিপাল, জাতীয় আইন কলেজ, ঢাকা]