Cancel Preloader

মহামানবদের জীবনী থেকে


মহান আল্লাহ্ কর্তৃক কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হযরত ইউনুস (আ.)

হযরত ইউনুস (আ.) ছিলেন হযরত হুদ (আ.)-এর অধঃস্তন বংশধর। ইরাকের বিখ্যাত ও সুপ্রসিদ্ধ জনপদ মুসেলের নিনাওয়া নামক স্থানের লক্ষাধিক অধিবাসীর হিদায়েতের জন্য মহান আল্লাহ্ তাঁকে প্রেরণ করেন। নিনাওয়ার অধিবাসীরা ছিল মূর্তিপূজক। আল্লাহর নবি হযরত ইউনুস (আ.) স্বীয় কওমের সামনে মহান রাব্বুল আলামিনের পরিচয় তুলে ধরলেন। জানিয়ে দিলেন- হে আমার কওম! তোমাদের প্রতিপালক এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহ্। তাঁর কোনো অংশীদার নেই। তোমরা মূর্তিপূজা থেকে ফিরে এসো। কেবলমাত্র আল্লাহর ইবাদত করো। আমি আল্লাহর রাসুল। সুদীর্ঘ ৪০ বছর হযরত ইউনুস (আ.) এভাবেই স্বীয় জাতিকে মহান আল্লাহর পথে তুলে আনতে সচেষ্ট ছিলেন। কিন্তু নিনাওয়ার লক্ষাধিক মানুষ মহাসত্যের আহ্বানকে প্রত্যাখ্যান করে।


এদিকে মহান আল্লাহ্ পূর্বেই হযরত ইউনুস (আ.)-কে জানিয়ে দেন- “হে ইউনুস! তোমার কওমের লোকেরা হিদায়েত কবুল না করলে আমি তাদেরকে সেভাবে ধ্বংস করে দেবো, যেভাবে আমি অবাধ্য আদ ও সামুদ জাতিকে ধ্বংস করেছি।” ইউনুস (আ.) স্বীয় কওমকে শেষবারের মতো সতর্ক করলেন যে, যদি তোমরা দেবদেবীর উপাসনা পরিত্যাগ করে একমাত্র উপাস্য আল্লাহর ইবাদত না করো, তবে তোমাদের উপর আল্লাহর আজাব ও গজব নাজিল হবে। পরিশেষে তিনি দিনক্ষণ ঠিক করে জানিয়ে দিলেন, হে আমার কওম! আল্লাহ্ ও তাঁর রাসুলকে বিশ্বাস করে তোমাদের অবস্থান পরিবর্তন না করলে এখন থেকে তৃতীয় দিনে তোমাদের উপর আল্লাহর আজাব নেমে আসবে। এরূপ সতর্কবার্তা শুনে কওমের কিছু জ্ঞানী লোক বলল- এই লোক তো কখনো মিথ্যা বলে না। সুতরাং তোমরা সতর্ক থাকো। তবে ঐ রাতে তিনি যদি তোমাদের মাঝেই রাত্রি যাপন করেন, তবে বুঝবে যে, কিছুই ঘটবে না। আর তিনি যদি তোমাদের মাঝে রাত্রি যাপন না করেন, তবে নিশ্চিত যে, ভোরে তোমাদের উপর আজাব পতিত হবে। এদিকে মহান আল্লাহ্ই হযরত ইউনুস (আ.)-কে তৃতীয় দিন শেষে এ গজব নাজিল হওয়ার সংবাদ দিয়েছিলেন। ফলে হযরত ইউনুস (আ.) তৃতীয় দিনের রাতের মধ্যভাগে তাদের থেকে বেরিয়ে গেলেন। এ সময় তাঁর হৃদয় চরম দুঃখ কষ্টে জর্জরিত হয়ে ওঠে। তিনি আল্লাহর গজবের উপযোগী কওমকে ত্যাগ করে পার্শ্ববর্তী এলাকায় চলে যান। এদিকে ভোরবেলা নিনাওয়ার জনপদে আল্লাহর আজাবের চিহ্ন ফুটে উঠল। দিনের আলো যত বাড়ছিল গজবের প্রকাশ ততই পরিস্কার হচ্ছিল। আর তা হলো নিনাওয়ার জনপদের অনতিদূরে কালো মেঘের ন্যায় কৃষ্ণকায় আভায় আকাশ ছেয়ে ফেলে। অতঃপর এ থেকে কালো ধোঁয়া নিনাওয়া জনপদকে আচ্ছাদিত করতে লাগল। এটি দেখে তাদের স্থির বিশ্বাস জন্মায় যে, ধ্বংস অনিবার্য। তারা তখন হযরত ইউনুস (আ.)-এর খোঁজে বের হলো। কিন্তু কোথাও তাঁকে খুঁজে পেল না।


অবশেষে অনন্যেপায় হয়ে নিনাওয়াবাসী তাদের স্ত্রী, ছেলে- মেয়ে, পরিবার-পরিজন এমনকি পশু, প্রাণীসহ এক উন্মুক্ত ময়দানে গিয়ে সমবেত হয়। তাদের পরিধানে ছিল চটের আবরণ। তারা শিশুদেরকে এবং পশু-প্রাণীর বাচ্চাগুলোকে তাদের মায়েদের কাছ থেকে পৃথক করে দেয়। অতঃপর তারা প্রত্যেকে একাকী হয়ে কায়মনোবাক্যে পরম করুণাময় আল্লাহর কাছে তওবা করে। এমনিভাবে একান্ত মনে আল্লাহর কাছে কৃত অপরাধের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে। মহান রাব্বুল আলামিন তাদের অন্তরের অবস্থা দেখে দয়াপরবশ হলেন এবং তাদের প্রার্থনাা কবুল করেন। অতঃপর তিনি তাদের মাথার উপর অবস্থানকারী আজাব প্রত্যাহার করে নেন।


মহান রাব্বুল আলামিন জগদ্বাসীর মুক্তির দুয়ার খুলে দেওয়ার জন্য হযরত ইউনুস (আ.)-এর জীবনে এক কঠিন পরীক্ষা চাপিয়ে দেন। নজিরবিহীন এক বিপদ তাঁর জীবনকে ঘিরে ফেলে। আর তা হলো- হযরত ইউনুস (আ.) যখন নিজের আবাসভূমি থেকে বেরিয়ে এসে স্বীয় কওমের অনিবার্য ধ্বংসের জন্য অপেক্ষা করছিলেন, অথচ তিনি যখন দেখলেন কওমের একটি লোকও ধ্বংস হয়নি, তখন হযরত ইউনুস (আ.) চিন্তা করলেন, তাহলে আমার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কওমের উপর যখন আজাব আসেনি, আমি কোন মুখে পুনরায় কওমের কাছে ফিরে যাব। তাদের কাছে তো আমি এখন মিথ্যাবাদী। অতঃপর তিনি স্বীয় কওম থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে ভিনদেশের উদ্দেশে যাত্রা করেন। সাথে ছিলেন তাঁর স্ত্রী ও দ্ইু পুত্র। যেতে যেতে হযরত ইউনুস (আ.) একটি নদীর তীরে গিয়ে পৌঁছলেন। সকলকে নিয়ে নদী পার হওয়ার মানসে তিনি বড়ো ছেলেকে নদীর এপারে বসিয়ে স্ত্রীসহ ছোটো ছেলেটিকে নিয়ে নদী পার হতে সচেষ্ট হলেন। কিছুদূর যাওয়ার পর হঠাৎ তাঁর স্ত্রী নদীতে ডুবে যেতে লাগল। হযরত ইউনুস (আ.) তাড়াতাড়ি স্ত্রীকে ধরতে গেলে তাঁর কাঁধ হতে ছোটো ছেলেটিও নদীর পানিতে পড়ে ডুবে যায়। সঙ্গে সঙ্গে নদীর প্রবল স্রোতে ছেলেটি হারিয়ে যায়। এদিকে তিনি স্ত্রীকেও ধরতে পারলেন না। তিনিও নদীর স্রোতে ভেসে নিখোঁজ হয়ে গেলেন। এবার স্ত্রী ও ছোটো ছেলেকে হারিয়ে তিনি নদীর তীরে বড়ো ছেলের কাছে ছুটে আসলেন। কিন্তুু বিধি বাম! জলের ন্যায় স্থলেও বিপদ নেমে আসল। তিনি তীরে পৌঁছার পূর্বেই দেখতে পেলেন তাঁর বড়ো ছেলে হিংস্র বাঘের রাহুঘ্রাসে পরিণত হয়েছেন। অতঃপর বাঘটি বড়ো ছেলেকে মুখে নিয়ে আপন গন্তব্যে চলে গেল। এবার ইউনুস (আ.) স্ত্রীসহ ২ পুত্রকে হারিয়ে শোকে বিহ্বল হয়ে পড়লেন। ভগ্ন হৃদয়ে নদী পার হয়ে সামনে চলতে লাগলেন। দীর্ঘপথ অতিক্রম করে তিনি যখন তাইগ্রীস (ফোরাত) নদীর কাছে উপস্থিত হলেন, তখন একখানি জাহাজকে নোঙ্গরকৃত অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেন। জাহাজে বহুযাত্রী পূর্বেই আরোহণ করেছিল। তিনিও তাতে আরোহণ করলেন। কিছুক্ষণ পরেই জাহাজটি নোঙ্গর তুলে ছেড়ে দিলো। এদিকে জাহাজটি অল্প কিছু পথ নদীতে চলে সাগরে গিয়ে উপনীত হলেই মহাবিপত্তি দেখা দেয়। এক অজানা কারণে জাহাজ তার গতি হারিয়ে ফেললো। এটি সামনে অগ্রসর না হয়ে একই জায়গায় ঘুরতে লাগলো। এ সময় বিরাট বিরাট সামুদ্রিক মাছ জাহাজের চারপার্শ্বে প্রচণ্ড গতিতে আঘাত করতে শুরু করল। প্রবল ধাক্কায় জাহাজ ডুবে যাওয়ার উপক্রম হলো। জাহাজের নাবিক ও আরোহীদের দুশ্চিন্তার অন্ত রইলো না। এ মহাবিপদে আরোহীদের মধ্যে জনৈক ধর্মভীরু আল্লাহ্ওয়ালা ব্যক্তি বললেন- নিশ্চয় এ জাহাজে এমন কোনো গোলাম আছে, যে তাঁর মুনিবের অনুমতি না নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। সেই কারণেই জাহাজ এ সংকটের সম্মুখীন হয়েছে।

হযরত ইউনুস (আ.)-এর বুঝতে আর অসুবিধা হলো না। তিনি ভাবলেন, হায়রে আমিই সেই ব্যক্তি! তিনি দাঁড়িয়ে নিজের অবস্থান ব্যক্ত করলেন। এদিকে আরোহীদের মধ্যে কিছু সংখ্যক লোক হযরত ইউনুস (আ.)-এর পূর্ব পরিচিত ছিলেন। তারা বললেন- আপনি আল্লাহর রাসুল, এ কাজ আপনার দ্বারা কীভাবে হতে পারে? তাছাড়া আপনাকে তো কোনো মানুষের গোলামি করতে দেখিনি। অবশেষে তারা তাদের নিয়ম অনুযায়ী সকল যাত্রীর নাম লিখে লটারি করল। পরপর তিনবারই লটারিতে হযরত ইউনুস (আ.)-এর নাম উঠল। এ অবস্থায় যাত্রীরা অনন্যোপায় হয়ে হযরত ইউনুস (আ.)-কে সমুদ্রে ফেলে দেয়। সাথে সাথে জাহাজের চতুষ্পার্শ্ব হতে মৎস্যরাজি চলে গেল। জাহাজ স্বাভাবিক গতিতে আপন গন্তব্যে ছুটে চলল। এদিকে ইউনুস (আ.) সমুদ্রে নিক্ষিপ্ত হওয়ার সাথে সাথে একটি মাছ তাঁকে গিলে ফেললো। তারপরের ঘটনা মহান আল্লাহ্ নিজেই পাক জবানে ব্যক্ত করেছেন।
পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে- ‘‘আর হযরত ইউনুস (আ.)-ও ছিলেন রাসুলগণের একজন। স্মরণ করুন, যখন তিনি পালিয়ে নৌযানে গিয়ে পৌঁছলেন। অতঃপর তিনি লটারিতে শরীক হলেন এবং অপরাধী সাব্যস্ত হলেন। তারপর একটি মাছ তাঁকে গিলে ফেলল। তখন তিনি নিজেকে তিরস্কার করতে লাগলেন। সুতরাং যদি তিনি আল্লাহর তাসবিহ পাঠকারী না হতেন, তবে তিনি অবশ্যই থেকে যেতেন মাছের পেটে পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত। অতঃপর আমি তাকে নিক্ষেপ করলাম এক ময়দানে আর সে তখন পীড়িত ছিল। আমি উৎপন্ন করলাম তার উপর এক লাউ গাছ। আমি তাকে রাসুল করে পাঠিয়েছিলাম এক লক্ষ বা ততোধিক লোকের প্রতি। তারা ইমান এনেছিল। ফলে আমি তাদেরকে এক নির্দিষ্টকাল পর্যন্ত জীবন উপভোগ করতে দিয়েছিলাম।’’ (সূরা আস সাফফাত ৩৭: আয়াত ১৩৯ থেকে ১৪৮)


এমনিভাবে মহান আল্লাহ্ হযরত ইউনুস (আ.)-এর ঘটনা পাক জবানে ব্যক্ত করতে গিয়ে হযরত রাসুল (সা.)-কে আরো বলেন- ‘‘হে রাসুল (সা.)! স্মরণ করুন, যুন-নুন তথা মাছওয়ালা ব্যক্তির কথা, যখন সে ক্রোধভরে বের হয়ে গিয়েছিল এবং ধারণা করেছিল যে, আমি তাঁকে পাকড়াও করব না। তারপর তিনি (মাছের পেটের) অন্ধকারের মধ্যে থেকে আমাকে ডাকলেন- আপনি ছাড়া কোনো উপাস্য নেই। আপনি পবিত্র, মহান। আমি তো জুলুম করে ফেলেছি। তখন আমি তার দোয়া কবুল করলাম এবং তাকে দুশ্চিন্তা হতে উদ্ধার করলাম। এভাবেই আমি মু’মিনদের উদ্ধার করে থাকি।’’ (সূরা আল আম্বিয়া ২১: আয়াত ৮৭ ও ৮৮)

ফিরে আসি ধারাবাহিক ঘটনায়, এদিকে সমুদ্রে নিক্ষিপ্ত হয়ে চল্লিশ দিন পর্যন্ত হযরত ইউনুস (আ.) মাছের পেটে অবস্থান করেন। একদিকে সমুদ্র বক্ষের গহীন অন্ধকার, অন্যদিকে মাছের পেটের অন্ধকার। তবে এ অবর্ণনীয় অনিশ্চয়তার জীবনে নিক্ষিপ্ত হয়েও হযরত ইউনুস (আ.) তাঁর পরম প্রেমাস্পদ আল্লাহ্কে ভুলেননি। স্ত্রী হারালেন, ২ পুত্র হারালেন, নিজে মাছের পেটে চলে গেলেন, তাতে কী! এ যে আশেক ও মাশুকের মান-অভিমান! মাছ যেমন পানি বিহনে বেঁচে থাকতে পারে না, তদ্রƒপ আম্বিয়ায়ে কেরাম ও আওলিয়ায়ে কেরামও আল্লাহর স্মরণ বিহনে থাকতে পারেন না। হযরত ইউনুস (আ.) মাছের পেটের গহীন অন্ধকারে থেকেও আপন ক্বালবে খেয়াল ডুবিয়ে মহান প্রভুকে ডাকতে থাকেন এবং পরম প্রেমাস্পদের সাড়া কামনা করেন। অবশেষে মহান রাব্বুল আলামিন প্রিয় বন্ধুর ডাকে সাড়া দিলেন। ফলে মাছ তাঁকে নদীর তীরে উগলে ফেলে চলে গেল। এ সময় হযরত ইউনুস (আ.) খুবই পীড়িত ছিলেন। মহান রাব্বুল আলামিনের অপার দয়ায় কিছুদিন পরে সুস্থ ও স্বাভাবিক হলে তিনি আপন অন্তরে আল্লাহর প্রত্যাদেশ লাভ করেন যে, আপনি এ এলাকায় মানুষের কাছে আমার পরিচয় তুলে ধরুন। তাদেরকে আমার পথে তুলে আনুন। আল্লাহর নির্দেশ পেয়ে হযরত ইউনুস (আ.) ঘুরে ঘুরে ওয়াজ-নসিহত শুরু করলেন। এদিকে যে মহান আল্লাহ্ তাঁর আশেক মাহবুবের উপর অভিমান করে তাঁকে সর্বহারা করেছিলেন, এবার তিনিই সবকিছুই ফিরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন।


একদা হযরত ইউনুস (আ.) একটি মাহ্ফিলে সমবেত শ্রোতামণ্ডলীর সামনে মহান আল্লাহর পরিচয় তুলে ধরে ওয়াজ করছিলেন, এমন সময় ঐ এলাকায় এক ধর্মভীরু জেলে একজন মহিলাসহ মাহফিলে উপস্থিত হয়। আল্লাহর ইচ্ছায় ইউনুস (আ.) মহিলার দিকে তাকানো মাত্র লক্ষ্য করলেন, এ যে তাঁরই সহধর্মিণী! লোকটি জানায়, হে আল্লাহর নবি! কিছুদিন পূর্বে আমি সমুদ্র উপকূলে মাছ ধরতে গিয়ে এ নারীকে অর্ধমৃতাবস্থায় চরের উপর পড়ে থাকেত দেখি। এ অবস্থায় তাকে সংগে নিয়ে আসলে আমার স্ত্রী বহু সেবা-শুশ্রুষা করে তাকে সুস্থ করে তোলেন। অতঃপর সে সুস্থ হলে জানতে পারি, এ কোনো সাধারণ নারী নন, এ যে আপনার স্ত্রী। দয়া করে আপনার আমানত আপনি গ্রহণ করুন। স্বামী-স্ত্রী উভয়ে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলেন। এ ঘটনার দু’দিন পরে হযরত ইউনুস (আ.) পার্শ্ববর্তী একটি গ্রামে মাহ্ফিলে বয়ান করছিলেন। এমন সময় মাহফিলে এক কাঠুরে হাজির হয়ে বলল- হুজুর! কিছুদিন পূর্বে আমরা আট দশ জনের একটি দল জঙ্গলের ভিতর কাঠ কাটছিলাম। এ সময় দেখি, একটি বাঘ মুখে একটি বালককে নিয়ে দ্রুত জঙ্গলের ভিতরে ঢুকে যাচ্ছে। আমরা তখন সবাই মিলে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বাঘটিকে ধাওয়া করলে বাঘটি বালকটিকে ফেলে স্বীয় প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে পালিয়ে যায়। বালকটিকে মুমূর্ষু অবস্থায় উদ্ধার করে আমরা সেবা-শুশ্রুষা করি। অতঃপর সে সুস্থ হলে জানতে পারি যে আপনারই বড়ো সাহেবজাদা। হযরত ইউনুস (আ.) ঘটনা শুনে আল্লাহর দয়া প্রত্যক্ষ করে আনন্দে কেঁদে ফেলেন। অতঃপর পুত্রকে ফিরে পেয়ে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরে চুমু খান এবং আল্লাহ্র শুকরিয়া আদায় করেন।


এমনিভাবে নবি পরিবারের মহামিলনের শেষ ঘটনাটি তার পরের দিনের। হযরত ইউনুস (আ.) শত সহস্র লোকের সামনে আল্লাহর একত্ববাদের পরিচয় তুলে ধরে নসিহত করছিলেন। মাহফিল শেষ হলে এক জেলে দাঁড়িয়ে বললো, ভাইসব! কয়েকদিন পূর্বে নদীতে একটি জীবন্ত শিশুসন্তান পাওয়া গেছে। যদি কারো সন্তান হারিয়ে থাকে, তবে তাকে নিয়ে যাবেন। এই বলে সে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তির কোলের শিশুর দিকে ইশারা করলেন। হযরত ইউনুস (আ.) তাকিয়ে দেখেন, এ যে তাঁর কাঁধ থেকে পড়ে যাওয়া তাঁরই ছোটো সাহেবজাদা। মহান আল্লাহর কুদরতের এ অপার ঘটনা দর্শনে হযরত ইউনুস (আ.) আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না। অশ্রুশিক্ত নয়নে কৃতজ্ঞচিত্তে মুহূর্তেই তিনি পরম প্রেমাস্পদ মহান রাব্বুল আলামিনের নুরের কদম মোবারকে সিজদায় লুটিয়ে পড়েন এবং তাঁর শুকরিয়া আদায় করেন। পরিশেষে হযরত ইউনুস (আ.) আল্লাহর নির্দেশে স্ত্রী ও দু’সন্তানসহ স্বজাতির কাছে ফিরে যান এবং সবাইকে আল্লাহর ধর্মের পতাকা তলে সমবেত করে মহান আল্লাহ্ ও আল্লাহর রাসুলের আনুগত্য নির্ভর জীবনে অভ্যস্ত করে তোলেন।


এভাবেই মহান রাব্বুল আলামিন হযরত ইউনুস (আ.)-কে সুকঠিন পরীক্ষায় নিপতিত করেন, অতঃপর তাঁকে উত্তীর্ণও করেন। প্রকৃতপক্ষে মহান আল্লাহ নবি, রাসুল ও আওলিয়ায়ে কেরামকে পরীক্ষা করেন, তাদের জীবনে দৃষ্টান্ত স্বরূপ ঘটনা সংঘটিত করেন, মানবমুক্তির সংবিধান দেওয়ার জন্য। আর এই কঠিন বিপদে আল্লাহ্ তাঁর বন্ধুদেরই নিপতিত করেন এ দৃষ্টান্ত কায়েম করার জন্য যে, মানবজাতির যে কেউ মহাবিপদে আক্রান্ত হলে কীভাবে উদ্ধার পাবে? কীভাবে আল্লাহ্কে ডাকলে আল্লাহর সাহায্য পাবে? উপমাস্বরূপ বলা যায়, গর্ভধারিণী মা কষ্টের পর কষ্ট সহ্য করেন, অবশেষে চূড়ান্ত প্রসব যাতনার মধ্য দিয়ে সন্তানের মুখ দেখেন। আল্লাহর মনোনীত মহামানবগণের জীবনে কষ্টের পর কষ্ট, দুঃখের পর দুঃখ নেমে আসে; অতঃপর চূড়ান্ত পর্বে তাদের মাধ্যমে মানব মুক্তির সংবিধান রচিত হয়।

সুতরাং আম্বিয়ায়ে কেরামের জীবনে আপতিত বিপদাপদ তাদের কোনো ক্রটির জন্য নয়, বরং এটি মানব মুক্তির বিধান দেওয়ার জন্য, একইভাবে এটি খোদায়ী সংবিধান প্রণয়নের অংশ বিশেষ। এজন্য আজও উম্মতে মোহাম্মদী মহাবিপদে পড়লে দোয়ায়ে ইউনুস সোয়া লক্ষ বার পাঠ করে আল্লাহর কাছে বিপদ থেকে পরিত্রাণের জন্য রোনাজারী করে থাকে। আর মহান আল্লাহ্ও দয়া করে তার বিপদগ্রস্ত বান্দাকে নবির দোয়ার বরকতে উদ্ধার করেন।
সূত্র: তাফসীরে সূফী সম্রাট দেওয়ানাবাগী ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৯৭৩-৯৭৭

সম্পর্কিত পোস্ট