Cancel Preloader

ক্বালবে জিকিরের প্রয়োজনীয়তা


ড. মো. আরিফ হোসেন
মহান রাব্বুল আলামিন সর্বপ্রথম হযরত আদম (আ.)-কে সৃষ্টি করলেন। তারপর তাঁর ভিতরে স্বীয় রূহ ফুঁকে দিলেন। পবিত্র কুরআনে এ প্রসঙ্গে বর্ণিত হয়েছে, “আমি (আল্লাহ্) আমার রূহ থেকে আদমের ভিতরে রূহ ফুঁকে দিলাম।” (সূরা হিজর ১৫: আয়াত ২৯) আত্মা বা রূহ আল্লাহর নুরময় সত্তা। মানুষের মূল চালিকা শক্তিই হলো আত্মা। আত্মা ২ ভাগে বিভক্ত। যথা-জীবাত্মা ও পরমাত্মা। পিতার শুক্রকীট থেকে যে সত্তার জন্ম হয় এবং যা দেহের ষড়রিপুতে পরিণত হয়, তা জীবাত্মা বা নফস। আর মায়ের উদরে সন্তান মানবাকৃতি লাভ করার পর আল্লাহর যে সত্তা রূহ হিসেবে মানব দেহের ভিতরে ফুঁকে দেওয়া হয় তাই পরমাত্মা। (মুক্তি কোন পথে? পৃ. ৬১) মানব দেহের বাম স্তনের দুই আঙ্গুল নিচে যে ক্বালব আছে, সেথায় আল্লাহর জিকির জারি না থাকায় মৃত অবস্থায় আছে। যদিও মানুষ খাবার খায়, কথা বলে, হাঁটা-চলা করে, নিদ্রা যায়। কিন্তু যাদের ক্বালব জাগ্রত নেই সুফিরা বলেন তাদের ক্বালব মৃত। কারণ তাদের দিলে আল্লাহ্ নামের জিকির জারি নেই। মানুষ যখন একটা পাপ করে তার অন্তরে একটা কালো দাগ পড়ে যায়। এরকম অসংখ্য পাপ করতে করতে অন্তরটা কলুষিত হয়ে যায়। ঐ ব্যক্তির তখন ভালো কর্ম করার কোনো ইচ্ছা জাগে না। শুধু খারাপ কর্মের দিকে ধাবিত হয়। এ অবস্থায় যদি কোনো ইবাদত করে আল্লাহর দরবারে তা পৌছায় না। নামাজে দাঁড়ালে শয়তান তাকে ধোঁকা দেয়। অর্থাৎ দুনিয়াবি চিন্তা-ভাবনা এসে উপস্থিত হয়। এ অবস্থায় যদি নামাজ পড়ে সেই নামাজ আল্লাহর দরবারে কবুল হয় না। প্রত্যেকটি মানুষের জাহের এবং বাতেন আছে। মানুষের জাহের হলো দেহ আর বাতেন হলো রূহ বা আত্মা। মানব দেহের যেমন পঞ্চেন্দ্রিয় আছে তদ্রুপ আত্মারও পঞ্চেন্দ্রিয় আছে।


ইবাদত বন্দেগির মধ্যে জিকির একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। নামাজ, রোজা, হজ ও জাকাত এগুলো অত্যাবশ্যকীয় ইবাদত। এই ইবাদতগুলো পরিশুদ্ধ অন্তঃকরণে করার জন্য প্রয়োজন ক্বালবে জিকির। এ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে, “তারাই সফলকাম, যে পবিত্রতা অর্জন করে ও তাঁর প্রভুর নামে (অন্তরে) জিকির করে এবং (একাগ্রচিত্তে) নামাজ আদায় করে।” (সূরা আল আ‘লা ৮৭: আয়াত ১৪ ও ১৫) মাহান রাব্বুল আলামিন আরও এরশাদ করেন, তোমরা নামাজ সমাপনান্তে দাঁড়ানো, বসা ও শায়িত অবস্থায় আল্লাহর জিকির করো।” (সূরা নিসা ৪: আয়াত ১০৩) পবিত্র কুরআনে আরও এরশাদ হয়েছে- “যাদের ক্বালব আল্লাহর জিকির থেকে গাফেল রয়েছে, তারা প্রকাশ্য গোমরাহিতে রয়েছে।” (সূরা যুমার ৩৯: আয়াত ২২) এমনিভাবে মহান আল্লাহ্ বারংবার মানুষকে ক্বালবে জিকির জারি করার ব্যাপারে তাগিদ দিয়েছেন। আরবিতে জিকির শব্দের অর্থ-স্মরণ করা। আর স্মরণ হলো- অন্তরের বিষয়। আল্লাহ্ এরশাদ করেন- “তোমরা আমাকে স্মরণ করো, আর আমিও তোমাদেরকে স্মরণ করব।” (সূরা আল-বাকারা ২: আয়াত ১৫২) কোনো মানুষ যদি মুখে মুখে আল্লাহর জিকির করে তবে সে কারও সাথে কথা বলতে পারবে না, কোনো কাজ করতে পারবে না। আর যদি অন্তরে জিকির থাকে তাহলে আল্লাহ্কে স্মরণ করা হয়। অন্তরে আল্লাহর জিকির করা অবস্থায় কাজও করা যায়, কথাও বলা যায়, এমনকি ঘুমন্ত অবস্থায় অন্তরে জিকির হয়। মুখ দিয়ে যে জিকির করা হয় তাকে মৌখিক জিকির বা জিকরে লেছানি অথবা জলি জিকির বলা হয়। আর ক্বালব দিয়ে যে জিকির করা হয় তাকে ক্বালবে জিকির বা খফি জিকির বলা হয়। ক্বলবি জিকির জারি হলে দিন-রাত চব্বিশ ঘন্টাই অন্তরে ‘আল্লাহ্’ ‘আল্লাহ্’ জিকির থাকে। এ জিকিরই মানুষের জন্য পরম শান্তি। ক্বালবে জিকিরের নির্দেশ দিয়েই আল্লাহ্ তায়ালা এরশাদ করেন, ‘‘তোমরা দাঁড়ানো, বসা ও শায়িত অবস্থায় আল্লাহর জিকির করো।’’


এ প্রসঙ্গে দেওয়ানবাগ শরীফের প্রতিষ্ঠাতা মহান সংস্কারক মোহাম্মদী ইসলামের পুনর্জীবনদানকারী সূফী সম্রাট হযরত দেওয়ানবাগী (রহ.) হুজুর কেবলাজান বলেন, ‘‘মোহাম্মদী ইসলামের শিক্ষা গ্রহণ করে নিয়মিত আমল করলে মৃত দিল জিন্দা হয়ে যায়। অর্থাৎ অন্তরে আল্লাহ নামের জিকির জারি হয়।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘সমাজ ব্যক্তিকে শুদ্ধ করতে পারে না। আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে ব্যক্তি শুদ্ধ হয়, আর ব্যক্তি শুদ্ধির মাধ্যমে সমাজ শুদ্ধ হয় এবং সমাজ শুদ্ধির মাধ্যমে দেশ বা জাতি শুদ্ধ হয়।’’ ক্বালবে জিকির ব্যতীত মানুষ ইমানদার হতে পারে না। অধিকাংশ মানুষই মনে করে থাকেন, শুধু নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত আদায় করলেই প্রকৃত ইমানদার হওয়া যায়। বিষয়টি তেমন নয়। যিনি নামাজ পড়েন তাকে সমাজের লোকেরা নামাজি বলে থাকে। যিনি রোজা রাখেন তাকে রোজাদার বলে। যিনি হজ করেন তাকে হাজি সাহেব বলে। মূলত এগুলো হলো টাইটেল। ইমানদার হতে হলে ক্বালব বা অন্তরে আল্লাহ্ নামের জিকির জারি করে ইবাদত করতে হয়। আর এ শিক্ষা দিয়ে গেছেন আল্লাহর বন্ধু সূফী সম্রাট হযরত দেওয়ানবাগী (রহ.) হুজুর কেবলাজান। তাঁর অন্যতম শিক্ষাই হলো ক্বালবে আল্লাহ্ নামের জিকির জারি করা। আল্লাহর জিকিরের মাধ্যমে ক্বালবকে পবিত্র করতে হলে মোর্শেদের সান্নিধ্যে যেতে হয়। মোর্শেদের এত্তেহাদি তাওয়াজ্জুহ ব্যতীত ক্বালবে আল্লাহর জিকির জারি করা কখনই সম্ভব নয়। ক্বালবে আল্লাহর জিকির জারি না হলে অন্তর থেকে শয়তান দূর হবে না।

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেন- ‘‘শয়তান আদম সন্তানের ক্বালব বা দিলের মাঝে অবস্থান করে। যখন সে আল্লাহর জিকির করে, শয়তান তখন সরে যায়। আর যখন সে (আল্লাহর জিকির থেকে) গাফেল হয়, তখন শয়তান তার দিলে ওয়াসওয়াসা বা কুমন্ত্রণা দিতে থাকে।’’ (বোখারীর সূত্রে মেশকাত শরীফ, পৃষ্ঠা ১৯৯) রহস্যজনক বিষয় হচ্ছে ক্বালবের প্রথম স্তর সুদুরের মাকামে থাকে শয়তান আর সপ্তম স্তর নাফসির মাকামে থাকেন মহান রাব্বুল আলামিন। একই অন্তরে যেমন মহান প্রভু থাকেন তেমনি থাকে শয়তানও থাকে। তাই সাধনা ও মোরাকাবা করে সুদুরের মাকাম থেকে শয়তানকে বিতাড়িত করতে হবে। একজন মানুষ সাধনা করে ছুদুরের মাকাম থেকে নশর, শামসি, নুরি, কোরব, মাকিম ও নাফসির মাকামে উন্নীত হলে সে তার মহান রাব্বুল আলামিনকে দর্শন করতে পারে।


সূফী সম্রাট দেওয়ানবাগী হুজুর বলেন, “আল্লাহ্কে পেতে হলে অলী-আল্লাহ্গণের সান্নিধ্যে যেতে হবে। অর্থাৎ- যিনি আল্লাহ্কে পেয়েছেন এমন একজন মোর্শেদের নিকট যেতে হবে। মোর্শেদের শিক্ষা নিয়ে অন্তরে আল্লাহর জিকির পয়দা করে অন্তর থেকে শয়তান দূরীভুত করতে পারলে শয়তান আর ওয়াসওয়াসা দিতে পারবে না।” এ শয়তান প্রসঙ্গে আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেন- ‘‘তোমাদের প্রত্যেকের সাথেই শয়তান নিযুক্ত রয়েছে। এ কথা শ্রবণ করে সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করলেন- ইয়া রাসুলাল্লাহ্ (সা.)! আপনার সাথেও কি আছে? আল্লাহর রাসুল (সা.) বললেন- হ্যাঁ, আমার সাথেও। তবে মহান আল্লাহ্ আমাকে সাহায্য করেছেন, ফলে শয়তান আমার অনুগত হয়ে গিয়েছে। সে কেবল ভালো কাজেরই পরামর্শ দিয়ে থাকে।’’ (বোখারী ও মুসলিমের সূত্রে তাফসীরে ইবনে কাছীর ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৮১২) তাই ভিতরের শয়তানকে মুসলমান করতে হলে অধিক পরিমাণে মোরাকাবা করতে হবে।

সূফী সম্রাট দেওয়ানবাগী (রহ.) বলেন, “ক্বালবকে পবিত্র করার শিক্ষা হিসেবে মোহাম্মদী ইসলামে প্রথম ছবক দেওয়া হয় ক্বালবে, যার ক্বালবে আল্লাহ আল্লাহ জিকির জারি হবে, সে বেইমান হয়ে কবরে যাবে না। যার ক্বালবে আল্লাহর জিকির জারি হবে, তিনি হবেন মু’মিন। আর মু’মিনের অবিভাবক হলেন মহান আল্লাহ্। আল্লাহ্ যার অবিভাবক তার কোনো বিষয়ে চিন্তা করতে হয় না।” তাই ক্বালবে জিকির করা প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর একান্ত প্রয়োজন।


পরিশেষে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, আমরা যারা মুসলমান পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করি, হালাল রুজি উপার্জন করি, মানুষের সাথে সৎ ব্যবহার করি, মিথ্যা কথা না বলি, অন্যের হক নষ্ট না করি, চলাফেরা, কথাবর্তা, ওজু- গোসল, খাওয়া এবং ঘুমানো পর্যন্ত সর্বাবস্থায় আল্লাহ্ নামের জিকির চালু রাখার বিধান মহান দয়াময় খোদাই পবিত্র কালামে বলেছেন। অতএব আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী সারাক্ষণ ক্বালবে আল্লাহ্ নামের জিকির জারি করতে হলে যিনি জগতের বুকে আল্লাহর মনোনীত মহামানব তাঁর সান্নিধ্য লাভ করে মোহাম্মদী ইসলামের শিক্ষা গ্রহণ করে ক্বালবে আল্লাহ নামের জিকির চালু করা সম্ভব। এই জিকির চালু হলে ভয় নেই তার ইহকাল ও পরকালে।
[লেখক: ইসলামি গবেষক]

সম্পর্কিত পোস্ট