Cancel Preloader

হযরত ইমাম হাসান ইবনে আলী (রা.)


মুহাম্মদ জহিরুল আলম
আল্লাহ্কে পেতে হলে যিনি আল্লাহ্কে পেয়েছেন এমন একজন মহামানবের সান্নিধ্যে গিয়ে তাঁর শিক্ষা লাভ করা অপরিহার্য। মহামানবগণ মানুষকে ইমানদার বা মু’মিন বানিয়ে হযরত রাসুল (সা.)-এর সাথে পরিচয় করে দিতে সক্ষম। তাই তাঁদের কাছ থেকেই ইমানের নুর ধারণ করতে হয়। আরবের কতিপয় নওমুসলমানদের প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ্ পবিত্র কুরআনে বলেন, “ইমান তোমাদের হৃদয়ে এখনও প্রবেশ করেনি।” (সূরা আল হুজুরাত ৪৯: আয়াত ১৪) ইমান ক্বালবে প্রবেশ করার বিষয় আর তা হলো- আল্লাহ্ শব্দের নুর। সাহাবায়ে কেরাম হযরত রাসুল (সা.)-এর সান্নিধ্যে যাওয়ার পর তাদের হৃদয়ে ইমানের নুর প্রবেশ করিয়ে দেওয়া হয়েছে, ফলে তাঁরা মু’মিন হয়েছেন। হযরত রাসুল (সা.)-এর ওফাতের পর আহলে বাইতের সম্মানিত সদস্যগণের মাধ্যমে পৃথিবীতে এ ধারা বহমান।


অত্যন্ত লজ্জা ও পরিতাপের বিষয়, হযরত রাসুল (সা.)-এর জাহেরিভাবে এ ধরা ত্যাগ করার পর থেকেই আহলে বাইতের সদস্যদের প্রতি নিষ্ঠুর আচরণসহ, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার পৃষ্ঠপোষকতায় তাঁদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে মিথ্যা রটনা শুরু হয়। ক্ষমতার মসনদ হাতছাড়া হওয়ার ভয়ে মুক্তিকামী মানুষকে আহলে বাইতের সদস্যদের হতে দূরে রাখাই ছিল এর মূল উদ্দেশ্য। ফলে সমাজে ধর্মের নামে মনগড়া শিক্ষার প্রচলন শুরু হয়। তাদের হীন চক্রান্তে মুসলমানগণ পথভ্রষ্ট হয়ে এখন বিজাতির হাতে মার খাচ্ছে। অথচ আজ বিশ্বে মুসলমানের সংখ্যা প্রায় ১৭০ কোটি। আহলে বাইতের সদস্য এবং তাঁদের অনুসারীদের প্রতি নির্মম ও নিষ্ঠুর আঘাতের মধ্যদিয়ে ইসলামের প্রাথমিক যুগেই উমাইয়াদের মাধ্যমে চক্রান্তের সূচনা। ক্ষমতা ও অর্থের লোভে মোহান্ধ এসব মানুষরূপী দানবের কাছে মনুষ্যত্ব, বিবেক, ধর্ম কোনোকিছুই বিন্দুমাত্র রেহাই পায়নি। শুরু হয় আহলে বাইতের সদস্যদের একের পর এক নির্মম ও নিষ্ঠুর হত্যা, যা ইতিহাসের গতিপথকে পাল্টে দেয়। হযরত রাসুল (সা.) বিদায় হজের দিন খুৎবা দিয়ে বলেছেন, “হে লোকসকল! আমি তোমাদের নিকট ঐ বস্তু রেখে যাচ্ছি, যা আঁকড়ে ধরলে তোমরা পথভ্রষ্ট (ধ্বংস) হবে না। আর তা হলো আল্লাহ্র কিতাব এবং আমার আহলে বাইত।” (তিরমিজি শরীফের সূত্রে মেশকাত শরীফ, পৃষ্ঠা ৫৬৯) অথচ রাসুল (সা.)-এর উম্মত দাবীদার মুখোশধারী মুসলমানদের কাছ থেকে তাঁরা কী পেয়েছেন। আল্লাহ্র রাসুল (সা.) হযরত আলী র্কারামাল্লাহু ওয়াজহাহু, হযরত ফাতেমা (রা.), হযরত ইমাম হাসান (রা.) ও হযরত ইমাম হুসাইন (রা.)-কে ডেকে নিজের কাছে এনে বললেন “হে আল্লাহ্! এঁরা আমার আহলে বাইত।” (মেশকাত শরীফ, পৃষ্ঠা ৫৬৮) আল্লাহ্র রাসুল (সা.) আরো এরশাদ করেন- জেনে রেখো, আমার আহলে বাইত তোমাদের জন্য হযরত নূহ (আ.)-এর কিস্তি বা নৌকাতুল্য। যে তাতে আরোহণ করেছে, সেই রক্ষা পেয়েছে। আর যে তাতে আরোহণ করতে পারেনি, সেই ধ্বংস হয়েছে।” (মেশকাত শরীফ পৃষ্ঠা ৫৭৩)। দশম হিজরির ১৮ জিলহজ হজের সকল আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে হযরত রাসুল (সা.) মক্কা ও মদীনার মাঝামাঝি গাদিরে খুম নামক স্থানে আল্লাহ্র নির্দেশে পাওয়ার পর সবাইকে সমবেত হতে বললেন। আল্লাহ্র রাসুল (সা.)-এর নির্দেশে কয়েকটি উটের জিনকে একত্রিত করে মঞ্চ তৈরি করলে, তিনি তাতে আরোহণ করেন। এরপর আল্লাহ্র রাসূল (সা.) হযরত আলী (কা.)-এর দুই হাত উত্তোলন করে বললেন, “আমি যার মাওলা (অভিভাবক), আলী-ও তার মাওলা।” (তিরমিজি শরীফ ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ২১২)। অথচ নবি পরিবারের সদস্যদের সাথে কী আচরণ করা হয়েছে।


আহলে বাইতের অন্যতম সদস্য হযরত ইমাম হাসান ইবনে আলী (রা.)। অত্যন্ত সুকৌশলে এ মহামানবের মর্যাদা, ত্যাগ ও অবস্থানকে ইতিহাসের পাতা হতে পরিকল্পনার মাধ্যমে আড়াল করার প্রচেষ্টা হয়েছে। কারবালার মর্মান্তিক ও হৃদয়বিদারক ঘটনার আগে হযরত আলী র্কারামাল্লাহু ওয়াজহাহু কর্তৃক মনোনীত ইমাম হযরত হাসান (রা.)-এর সাথে কী আচরণ করা হয়েছিল এবং তাঁকে চক্রান্ত করে কীভাবে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল, ইতিহাসে তা যে পরিসরে আলোচিত, আশেকে রাসুলগণের দৃষ্টিতে তা অবহেলার নামান্তর।
হযরত ইমাম হাসান ইবনে আলী (রা.)-এর ডাক নাম আবু মুহাম্মদ। পিতা আমিরুল মু’মিনিন হযরত আলী র্কারামাল্লাহু ওয়াজহাহু ও মাতা নবিনন্দিনী হযরত ফাতেমা (রা.)-এর প্রথম সন্তান হযরত ইমাম হাসান (রা.) হিজরতের ৩য় বৎসরে রমজান মাসের ১৫ তারিখ জন্মগ্রহণ করেন। নানা আল্লাহ্র হাবিব; সর্বকালের সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব দয়াল রাসুল হযরত মুহাম্মদ (সা.), নানি ছিলেন জগৎ জননী হযরত খাদিজা আত তাহেরা (রা.)। তাঁর দাদা হযরত আবু তালিব (রা.), দাদি হযরত ফাতেমা বিনতে আসাদ ইবনে হাসিম (রা.)। হযরত আবু তালিব (রা.) ও তাঁর স্ত্রী হযরত ফাতিমা বিনতে আসাদ (রা.) হযরত রাসুল (সা.)-কে অত্যাধিক ভালোবাসতেন। উভয়েই দ্বিনে হানিফের অনুসারী ছিলেন।


ইমাম হাসান (রা.)-এর জন্মের সময় হযরত জাফর ইবনে আবু তালিব (রা.)-এর স্ত্রী হযরত আসমা (রা.) সেবিকা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তিনি বর্ণনা করেন, আমি ফাতিমা (রা.)-এর সন্তান প্রসবকালীন কোনো রক্তপাত হতে দেখিনি, যা আমাকে বিস্মিত করেছে। বিষয়টি হযরত রাসুল (সা.)-এর দৃষ্টিগোচর করলে, তিনি বলেছিলেন, “ তোমরা কি জানো না যে, ফাতিমা (রা.) শুচিসিদ্ধ ও পবিত্র? তাঁকে কোনো অপবিত্রতা স্পর্শ করতে পারেনি, তাই তোমরা রক্ত দেখতে পাও নাই।” মাতৃগর্ভে তিনি ছয় মাস অবস্থান করেছিলেন। হযরত রাসুল (সা.) আনন্দে উদ্বেল হয়ে, নবজাতককে তাঁর বুকে চেপে ধরে মহান আল্লাহ্র কাছে প্রার্থনা করলেন। অতঃপর তিনি নবজাতকের ডান কানে আজান ও বাম কানে ইকামাত পাঠ করলেন। হযরত রাসুল (সা.) হযরত আলী (কা.)-কে জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি তোমার সন্তানের কী নাম রেখেছ?” হযরত আলী (কা.) জবাব দিলেন, “আপনার আগে তো আমি যেতে পারি না।” হযরত রাসুল (সা.) বললেন, “আমিও তো আমার প্রভুর আগে যেতে পারি না।” দয়াময় আল্লাহ্ জানিয়ে দেন- হারুন (আ.) যেমন মুসা (আ.)-এর নিকট ছিলেন, আলী আপনার নিকট তেমনই, পার্থক্য শুধু এই যে, আপনার পরে আর কোনো নবি নেই। আপনার সন্তানের নাম রাখুন ‘শাব্বার’, ঠিক যেমনটি হারুন (আ.)-এর জ্যেষ্ঠ পুত্রের ছিল। হিব্রু ভাষায় শাব্বার অর্থ সুন্দর; আরবিতে এর সমার্থক শব্দ হলো হাসান। হযরত হাসান (রা.)-এর পূর্বে আরবে কারো এই নাম ছিল না; এমনকি, ইতঃপূর্বে কখনো কেউ কারো নাম হাসান অথবা হোসাইন রাখেনি। (এ এম সানওয়ার হোসেন কর্তৃক লিখিত হাসান (আ.) ও ইসলাম, পৃষ্ঠা ২৫ )। ইমাম হাসান (রা.) ছিলেন অবিকল তাঁর নানা রাসুল (সা.)-এর প্রতিচ্ছবি তুল্য। হিজরি ৪র্থ বৎসরে শাবান মাসের ৫ তারিখ মা ফাতেমা (রা.)-এর দ্বিতীয় সন্তান হযরত ইমাম হোসাইন (রা.) এবং ৫ম হিজরির ৫ জমাদিউল আউয়াল কন্যা হযরত জয়নাব (রা.) জন্ম গ্রহণ করেন ।


পবিত্র কুরআনে দয়াময় আল্লাহ্ আহলে বাইতকে সর্বপ্রকার কলুষতা হতে মুক্ত রাখার ঘোষণা করেছেন এবং আহলে বাইতের (নিকট আত্মীয়) প্রতি ভালোবাসাকে প্রাধান্য দিয়েছেন। (সূরা আহযাব ৩৩: আয়াত ৩৩ এবং সূরা শূরা ৪২: আয়াত ২৩)। হযরত রাসুল (সা.) বলেছেন, “হে আল্লাহ্! আমি ইমাম হাসান (রা.)-কে ভালোবাসি, অতএব তুমিও তাঁকে তোমার ভালোবাসা দান করো। (মেশকাত শরীফ, পৃষ্ঠা ৫৬৮ ও ৫৬৯)। একদিন রাসুল (সা.) মিম্বরে উপবিষ্ট, তাঁর পার্শ্বে ইমাম হাসান (রা.) বসে ছিলেন, তখন আল্লাহ্র রাসুল (সা.) বলেন, “আমার এই নাতি জগদ্বাসীর সাইয়্যেদ বা নেতা।” (মেশকাত শরীফ, পৃষ্ঠা ৫৬৯)।
ইমাম হাসান (রা.) প্রায় ৮ বৎসর পর্যন্ত তাঁর নানা হযরত রাসুল (সা.)-এর স্বর্গীয় অভিভাবকত্বে লালিত-পালিত হয়েছেন। পিতা-মাতার কাছ থেকে যথার্থ শিক্ষাই তিনি পেয়েছিলেন, ছিলেন পিতার সার্বক্ষণিক সহচর, সম্পূর্ণভাবে ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত একজন মানুষ। ইমাম হাসান (রা.) অত্যন্ত কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করেছেন কীভাবে রাসুল (সা.)-এর ওফাতের পর পরই নবি পরিবারের সম্মানিত সদস্যদের বিরুদ্ধে চক্রান্ত শুরু হয়, গাদিরে খুমে রাসুল (সা.) যে স্পষ্ট ঘোষণা দিয়েছিলেন তা কীভাবে পাল্টে যায়। নানার ওফাতের কয়েক মাসের মাথায় মা ফাতিমা (রা.) পৃথিবী থেকে বিদায় নিলে দুই শিশু ইমাম হাসান (রা.) ও ইমাম হোসাইন (রা.) অসহায় হয়ে পড়েন। অন্যদিকে পিতা হযরত আলী (কা.) আগে থেকেই শোকে নির্বাক। হযরত রাসুল (সা.)-এর ওফাতের প্রায় ২৪ বছর পর মুসলিম জাহানের এক চরম অরাজগতাময় পরিস্থিতিতে ৬৫৬ খ্রিষ্টাব্দে হযরত আলী (কা.) সকলের অনুরোধে মুসলিম জাহানের খলিফা হন। তিনি ৫ বছর খিলাফতের দায়িত্ব পালন করেন। পিতার শাসনকালে ইমাম হাসান (রা.) সবকটি যুদ্ধেই অংশগ্রহণ করেন। ৬৬৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৪ জানুয়ারি খারিজি আবদুর রহমান ইবনে মুলজামের বিষাক্ত ছুরির আঘাতে কুফার মসজিদে ফজরের নামাজরত অবস্থায় শেরে খোদা হযরত আলী (কা.) আহত হন এবং দুই দিন পর তিনি শাহাদতবরণ করেন। মৃত্যুশয্যায় হযরত আলী (কা.) তাঁর দুই সন্তানকে শিয়রের কাছে বসিয়ে, কাগজ ও কলম চেয়ে নিয়ে নিজের শেষ অছিয়তনামা লিখিয়ে নেন। মৃত্যুশয্যায় তিনি উপস্থিত ব্যক্তিবর্গকে সাক্ষী রেখে তাঁর জ্যেষ্ঠ সন্তান হযরত ইমাম হাসান (রা.)-কে পরবর্তী খলিফা ও ইমাম মনোনীত করেন।


হযরত ইমাম হাসান (রা.) এমনই এক আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন, যাঁর খেলাফতের ব্যাপারে সমকালীন সময়ে সবাই মেনে নিয়েছিলেন; তিনিই সর্বাধিক যোগ্য। তখন মক্কা, মদীনা, বসরা, ইয়েমেন, হিজাজ, পারস্যসহ সকল প্রদেশেই তাঁকে খলিফা হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছিল, শুধুমাত্র মিশর ও সিরিয়ার কয়েকটি অঞ্চলের শাসক ও তাদের দ্বারা সুবিধাভোগী অনুচরগোষ্ঠী ছাড়া। মোহাম্মদী ইসলামের এ ইমামকে কিছু মুনাফেক মেনে নিতে পারেনি; তারা গুপ্তচরবৃত্তি, উৎকোচ প্রদান, প্রতারণা, ভীতি প্রদর্শন ও হত্যাকান্ডকে হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণ করে। হযরত আলী (কা.) এর শাহাদতের পর আমির মুয়াবিয়া নিজেকে খেলাফতের দাবীদার মনে করে। ইসলামের ইতিহাস প্রমাণ করে, আমির মুয়াবিয়া হযরত ইমাম হাসান (রা.)-এর খেলাফত মেনে নেয়নি এবং তাঁর নিকট বাইয়াত গ্রহণ করেনি, উপরন্তু নিজেকে ও পরবর্তীতে নিজ অযোগ্য পুত্র ইয়াজিদের নেতৃত্ব লাভের পথ সুগম করতে নিজেকে নানাবিধ বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে ফেলে। হযরত ইমাম হাসান (রা.) আমির মুয়াবিয়াকে এসকল বিষয়ে পত্র দিয়ে সতর্কও করেন। এক পত্রে হযরত ইমাম হাসান (রা.) লিখেন, “ওহে মুয়াবিয়া, মিথ্যা ও বিদ্রোহ থেকে নিবৃত্ত হও। এটা তুমিও নিশ্চিত যে, আল্লাহ্, ফেরেশতাকুল ও বিবেকবানদের দৃষ্টিতে খেলাফতের ব্যাপারে আমি তোমার চেয়ে যোগ্য। সুতরাং তোমার উচিত আল্লাহ্কে ভয় করা ও বিদ্রোহ পরিত্যাগ করা।” (ড. হুসাইন মুহাম্মদ জাফরি, ঞযব ঙৎরমরহ ধহফ ঊধৎষু উবাবষড়ঢ়সবহঃ ড়ভ ঝযরধ ওংষধস, ফরাসি অনুবাদ- আয়াত ইলাহি, পৃষ্ঠা ১৬৩)।


হযরত ইমাম হাসান (রা.) সর্বদা শান্তির দিকেই সবাইকে আহ্বান করতেন, কখনোই যুদ্ধকে সমাধানের পথ হিসেবে মনে করেননি। আমির মুয়াবিয়া ৬০ হাজার সৈন্য নিয়ে ইরাকের অভিমুখে রওনা করলে, হযরত ইমাম হাসান (রা.) প্রথমে যুদ্ধ এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেন, কিন্তু আমির মুয়াবিয়ার যুদ্ধের মনোভাব এবং সেনাবাহিনী নিয়ে ইসলামি হুকুমতের দিকে এগিয়ে আসায় তা আর সম্ভব হয়নি। সেই সময়ে কুফা ছিল গুরুত্বপূর্ণ এক কেন্দ্র। হিজরি ১৭ সালে এ নগরের গোড়াপত্তন। অনেক ঘটনার সাক্ষী এই কুফা নগরী। আমির মুয়াবিয়ার বাহিনীর অগ্রসরতাকে প্রতিহত করার জন্য হযরত ইমাম হাসান (রা.) উবায়দুল্লাহ্ বিন আব্বাসের নেতৃত্বে ১২ হাজার সৈন্যের একটি অগ্রবর্তী সেনাদল ইরাকের উত্তর সীমান্তে প্রেরণ করলেন। সেনাদলটি ফালুহা হয়ে মাসকিনে পৌঁছে। ইমামের নেতৃত্বে অন্য একটি দল মাসকিন হতে ১২০ কিমি. দূরে মাদায়েনে অবস্থান নেয়। ইতিহাসের এ অংশ মুসলমানদের জন্য বড়ই লজ্জাজনক। এ অংশ শুধু দয়াল রাসুল (সা.)-এর আহলে বাইতের সাথে প্রতারণা ও নির্লজ্জতার ইতিহাস। হযরত আলী (কা.)-এর সময়ে তৈরিকৃত ৪০ হাজার সৈন্যের চৌকষ বাহিনীর অবাধ্যতা, অগ্রবর্তী সেনাদলের প্রধান উবায়দুল্লাহ্ বিন আব্বাস চক্রান্তের ফাঁদে পা দিয়ে ৮ হাজার সৈন্য নিয়ে রাতের অন্ধকারে মুয়াবিয়ার সাথে হাত মেলানো। (বালাযুরি, আনসাব আল আশরাফ, খণ্ড ৩, পৃষ্ঠা ৩৮)। আরো অনেকে তাকে অনুসরণ করে। তারপরও হযরত ইমাম হাসান (রা.)-এর অগ্রবর্তী সেনাদল বাকি ৪ হাজার সৈন্য নিয়ে প্রাচীর তৈরি করে শক্তভাবেই অবস্থান নিয়েছিল। অন্যদিকে মাদায়েনেও চলে সন্ধির চক্রান্ত, মুনাফেকি, বেইমানি, মিথ্যা রটনার মহড়া। চক্রান্তকারীদের ফাঁদে পা দিয়ে মাদায়েনের প্রান্তরে হযরত ইমাম হাসান (রা.)-কে রেখে সকলেই পালিয়ে যায়, এমনকি তারা হযরত ইমাম হাসান (রা.)-এর তাঁবুতে থাকা সবকিছু লুট করে নিয়ে যায় এবং হযরত ইমাম হাসান (রা.) আক্রান্ত হন। মাদায়েনের গভর্নর সা’দ বিন মাসুদ সাকাফির সেবায় হযরত ইমাম হাসান (রা.) সুস্থ হয়ে উঠেন। হযরত ইমাম হাসান (রা.)-এর খেলাফত ৬ মাস স্থায়ী হয়েছিল। পরিবর্তিত অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ৪১ হিজরিতে হযরত ইমাম হাসান (রা.) ও মুয়াবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ানের মধ্যে সন্ধি সংগঠিত হয়। সন্ধির মূল কথা ছিল পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহ্র নির্দেশনাবলি অনুসরণ করা, পবিত্র আহলে বাইত সদস্য ও তাঁদের অনুসারীদের প্রতি প্রতিহিংসামূলক আচরণ না করা এবং সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। কিন্তু আমির মুয়াবিয়া ক্ষমতার মসনদে বসে সন্ধির এমন কোনো ধারা নেই যা ভঙ্গ করেনি।

হযরত ইমাম হাসান (রা.) মদিনায় চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। মদিনায় এসে তিনি যুগের পথপ্রদর্শক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। এদিকে কুরআন ও সুন্নাহ্র অবমাননা করে মুয়াবিয়া নিজ সন্তান ইয়াজিদকে উত্তরসূরি হিসেবে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করার উপায় খুঁজতে থাকে। সবচেয়ে নিকৃষ্ট যে প্রচলন চালু করে তা হলো হযরত আলী (কা.) ও নবি পরিবারের প্রতি মুয়াবিয়ার মিথ্যা দোষারোপ প্রচলন। (ইমাম জাফর সাদেক, মূল ড. আবূ যোহরা, অনুবাদ আব্দুল জলিল; ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ, পৃষ্ঠা ১৬৯-১৭০)। অথচ হযরত রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, “যে ব্যাক্তি হযরত আলী (রা.)-কে গালি দিলো, সে আমি রাসুলকেই গালি দিল।” (মুসনাদে আহমদের সূত্রে মেশকাত শরীফ, পৃষ্ঠা ৫৬৫)। শুরু হয় আহলে বাইতের অনুসারীদের উপর নির্মম নির্যাতন। ইসলামের ইতিহাসে হাজর ইবনে আদি (রা.), আব্দুর রহমান (রা.), সায়ফি বিন ফসিল (রা.), কুবায়সা বিন রাবিয়া (রা.)-এর উপর নিষ্ঠুর নির্যাতনের যে বর্ণনা আমরা পাই তা তারই সাক্ষ্য বহন করে।


হযরত ইমাম হাসান (রা.)-এর উপস্থিতির কারণে উমাইয়া খেলাফত নিষ্কন্টক হচ্ছিল না। তারা ইমামকে বাধা হিসেবে মনে করে। অনেকবার ইমামকে হত্যার চেষ্টা করে। তখনই করে ক্ষমার অযোগ্য এক অপরাধ, চক্রান্ত করে হযরত ইমাম হাসান (রা.)-কে স্ত্রী যায়েদার মাধ্যমে বিষ প্রয়োগে শহিদ করে। হযরত ইমাম হাসান (রা.) পঞ্চদশ হিজরির (৬৭০খ্রি.) সফর মাসের আটাশ তারিখে শাহাদতের সুধা পান করেন। তাঁকে জান্নাতুল বাকীতে সমাধিস্থ করা হয়। হযরত ইমাম হাসান (রা.) ওফাতের পূর্বে পিতা হযরত আলী (কা.) যেভাবে তাঁকে তাঁর স্থলাভিষিক্ত হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন, তাঁকে তাঁর উত্তরাধিকারী মনোনীত করেছিলেন, ঠিক তেমনিভাবে তিনিও হযরত ইমাম হোসাইন (রা.)-কে তাঁর উত্তরাধিকারী ও স্থলাভিষিক্ত হিসেবে ঘোষণা প্রদান করেন।


হযরত ইমাম হাসান (রা.) অতুলনীয় চরিত্রের অধিকারী ছিলেন। জ্ঞান, মেধা, মহানুভবতা, দানশীলতা, বিনম্রতা, প্রভু প্রেম সবকিছু যেন তাঁর মাঝে একাকার হয়ে মিশে আছে। পিতার শাসনামলে হযরত ইমাম হাসান (রা.)-কে বিচারকার্য পরিচালনার ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছিল, বাইতুল মালের দায়িত্বও তাঁর উপরেই ন্যাস্ত ছিল। পবিত্র ওহি অবতীর্ণ হলে, নানাজানের পবিত্র মুখ হতে শুনে, তা হৃদয়ে ধারণ করে বাসায় এসে মাকে শুনাতেন। তিনি কাউকে কখনো অতৃপ্ত অবস্থায় ফিরিয়ে দেন নাই। যখন তিনি হজ পালনের উদ্দেশ্যে যেতেন, তখন খালি পায়ে হেটে ভ্রমণ করতেন। হযরত ইমাম হাসান (রা.)-এর পনের জন সন্তান-সন্ততি ছিলেন। সন্তানদের মধ্যে যায়েদ বিন আল হাসান (রা.) ছিলেন জ্যেষ্ঠ, সমকালীন কবিরা তাঁকে নিয়ে কবিতা রচনা করতেন। বড়ো পির হযরত আব্দুল কাদের জিলানি (রা.) ইমাম হাসান (রা.)-এর বংশে জন্মগ্রহণ করেন। একটি বিষয় আশেকে রাসুলগণের হৃদয়ে প্রশ্নের সৃষ্টি করে, হযরত ইমাম হাসান (রা.)-এর শিক্ষা ও কর্মময় জীবন-ইতিহাস নিয়ে কেন এত শূন্যতা। গভীরভাবে চিন্তা করলে নিজেই এর উত্তর খুঁজে পাওয়া যায়; তা হলো, সে ইতিহাস সমকালীন শাসক দ্বারাই নির্মিত। পবিত্র কুরআন ও হযরত রাসুল (সা.)-এর নির্দেশ অবমাননা করে আহলে বাইতের সদস্যদের কচুকাটা করে উমাইয়ারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কুক্ষিগত করে এবং সে ক্ষমতা হারানোর ভয়ে নবি পরিবারের বিরুদ্ধে মসজিদের মিম্বরে বসে কুৎসা রটনা করত, বিষয়টিকে বর্বর শাসকেরা একটি জঘণ্য লোকাচারে পরিণত করতে চেষ্টা করেছিল, অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, রাষ্ট্রীয় অনুকম্পা ও ফায়দা লাভের আশায় অনেকেই শাসকের দরবারে গিয়ে নবি পরিবারের বিরুদ্ধে মিথ্যা রটনা করত (শরহে নাহজুল বালাগা, ইবনে আবিল হাদিদ, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ৩৫৬), ইসলামের নামে এমন কোনো কাজ নেই যে উমাইয়ারা করেনি, তারা নবি পরিবার ও তাঁদের গৌরবোজ্জল ইতিহাসকে পৃথিবী থেকে মুছে দিতে চেয়েছিল, তাই এই শূন্যতা। তারা চেয়েছিল সিরাজুম মুনিরার প্রদীপকে নিভিয়ে দিতে, যা অসম্ভব। প্রভুর শক্তিতে বলিয়ান, উম্মতে মোহাম্মদীর কান্ডারী হযরত ইমাম হাসান (রা.)-এর জীবনাদর্শ, বিশ্বের বুকে সত্য ও মিথ্যার পার্থক্য স্পষ্ট করে, যা আমাদের মুক্তির পথ নির্দেশনা দেয়। এ প্রদীপের আলোয় আশেকে রাসুলগণের হৃদয় যুগ যুগ ধরে আলোকিত থাকবে। মহাকাল যতই সামনে এগিয়ে যাবে তা আরো স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হবে।


একবিংশ শতাব্দীর শিরোভাগে এসেছিলেন মহান সংস্কারক, মোহাম্মদী ইসলামের পুনর্জীবনদানকারী, যুগের ইমাম, আম্বিয়ায়ে কেরামের ধর্মের দায়িত্ব ও বেলায়েত লাভকারী, আল্লাহ্র দেওয়া পুরস্কার: পূর্ণিমার চাঁদে বাবা দেওয়ানবাগীর জীবন্ত প্রতিচ্ছবি সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহ্বুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (রহ.)। তিনি ১৪০০ বছরে ধর্মে প্রবিষ্ট কুসংস্কার ও মিথ্যাচারগুলো সংস্কার করে সমাজ থেকে হারিয়ে যাওয়া মোহাম্মদী ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা, আদর্শ ও তাৎপর্য জগদ্বাসীর সামনে পুনরায় উপস্থাপন করেছেন। বিশ্বময় উত্তোলন করেছেন মোহাম্মদী ইসলামের গৌববোজ্জ্বল পতাকা। জগদ্শ্রেষ্ঠ এ মহামানব ২৮ ডিসেম্বর ২০২০ খ্রি., সোমবার ওফাত লাভ করেন। তিনি সঠিকভাবে মোহাম্মদী ইসলাম পরিচালনার জন্য তাঁর মেজো সাহেবজাদা ইমাম প্রফেসর ড. কুদরত এ খোদা (মা. আ.) হুজুরকে মোহাম্মদী ইসলামের নেতৃত্ব দেওয়ার দায়িত্ব প্রদান করেছেন। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ্ বলেন, “তিনিই রাহমান, তাঁর সম্বন্ধে যিনি অবগত আছেন, তাঁকে জিজ্ঞেস করে দেখো।” (সূরা ফুরকান ২৫: আয়াত ৫৯)। যুগে যুগে যাঁরা মুক্তির মোহনায় সামিল হয়েছিল তাঁরা সকল প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করেই মহামানবগণের কাছে ছুটে এসেছিলেন। আর তাই চিরন্তন সত্য। মহান মালিকের নিকট প্রার্থনা তিনি যেন দয়া করে সেই সত্যের উপর কায়েম থাকার তাওফিক দান করেন। আমিন।
[লেখক: পিএইচ.ডি গবেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়]

সম্পর্কিত পোস্ট