Cancel Preloader

সম্পাদকীয়


আত্মশুদ্ধি ও সংযমশীলতার প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য প্রতিবছর পবিত্র রমজান মাস আমাদের মাঝে ঘুরে ঘুরে আসে। এ বছর এপ্রিল মাসের ৩ তারিখ থেকে রোজা শুরু হয়ে গেছে। রমজান মাসব্যাপী আমরা রোজা পালন করে থাকি। রোজা ফারসি শব্দ। আরবি ভাষায় এই শব্দটিকে ‘সাওম’ বলা হয়। ‘সাওম’ শব্দের বহুবচন হলো ‘সিয়াম’। আরবি ‘সাওম’ শব্দের বাংলা আভিধানিক অর্থ বিরত থাকা, পানাহার পরিহার, উপবাস থাকা ইত্যাদি। আমাদের দেশে রোজা শব্দটি বহুল প্রচলিত। কেননা পাক-ভারত উপমহাদেশে পারস্য থেকে অলী-আল্লাহ্গণ এখানে আগমন করে ইসলাম ধর্ম প্রচার করেছেন। তাই আমাদের দেশে ইসলাম সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয়ে ফারসি শব্দের অধিক প্রচলন দেখা যায়।


ইসলাম পাঁচটি স্তম্ভের উপর সুপ্রতিষ্ঠিত, তন্মধ্যে রোজা মূল স্তম্ভের অন্যতম। মহাগ্রন্থ আল কুরআনে মহিমান্বিত আল্লাহ্ প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক নর ও নারীর জন্যে রোজা পালন করাকে ফরজ ঘোষণা করেছেন। এই প্রসঙ্গে আল্লাহ্ তায়ালা এরশাদ করেন, “হে মু’মিনগণ! তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হলো, যেরূপ ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের উপর, যেন তোমরা মোত্তাকি হতে পারো।” (সূরা আল বাকারাহ ২: আয়াত ১৮৩) মহান আল্লাহর এই বাণী মোবারক থেকে সুস্পষ্ট যে, রোজা শুধুমাত্র মোহাম্মদী ইসলামের বিধান নয়, অন্যান্য ধর্মেও রোজা পালনের বিধান রয়েছে। বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে রোজার বর্ণনা পাওয়া যায়। হযরত ঈসা (আ.)-এর নিকট সুরিয়ানি ভাষায় নাজিলকৃত ইনজিল কিতাবে রোজাকে ‘ত্বাব’ বলা হয়েছে। এই শব্দটির বাংলা অর্থ পবিত্র হওয়া, নির্মল হওয়া, কলুষমুক্ত হওয়া। হযরত দাউদ (আ.)-এর নিকট ইউনানি বা আরমাইক ভাষায় নাজিলকৃত জাবুর কিতাবে রোজাকে ‘কোরবত’ বলা হয়েছে, যার বাংলা অর্থ আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা। হযরত মুসা (আ.)-এর নিকট হিব্রু বা ইবরানি ভাষায় নাজিলকৃত তাওরাত কিতাবে রোজাকে ‘হাত্ব’ বলা হয়েছে, যার বাংলা অর্থ পাপ ধ্বংস করা।

সনাতন ধর্মে রোজা রাখাকে উপবাস বলা হয়, এই শব্দটির মধ্যে দুটি বিষয় আছে একটি হলো খাদ্য গ্রহণ থেকে বিরত থাকা এবং অপরটি কায়মনোবাক্যে সৃষ্টিকর্তার সান্নিধ্য অনুভব করা। এছাড়া নবি রাসুলগণের গৌরবদীপ্ত জীবন গবেষণা করলে দেখা যায় যে, সকল নবি-রাসুলের যুগে রোজার বিধান প্রচলন ছিল। এই প্রসঙ্গে হযরত রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, নূহ (আ.) ঈদুল ফিতরের দিন ও ঈদুল আজহার দিন ব্যতীত সারা বছর সিয়াম পালন করতেন। (ইবনে মাজাহ্, পৃষ্ঠা ১২৩) হাদিসে বর্ণিত আছে- আল্লাহর নিকট সবচেয়ে প্রিয় রোজা হযরত দাউদ (আ.)-এর রোজা, তিনি একদিন রোজা রাখতেন এবং একদিন বিনা রোজায় থাকতেন (মাসিক আত্মার বাণী-এপ্রিল ২০২১ সংখ্যা, পৃষ্ঠা ২০)। মূলত অতি প্রাচীনকাল থেকেই বিভিন্ন নবির আমলে মু’মিন বান্দাদের অন্তরের কলুষতা দূর করার জন্য রোজার বিধান চালু ছিল।


এবার আসা যাক মোহাম্মদী ইসলামে রোজার গুরুত্ব ও তাৎপর্য প্রসঙ্গে। ইসলামি পরিভাষায় মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য সুবহে সাদিক (প্রত্যুষ) হতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত যাবতীয় পানাহার ও কামাচার হতে বিরত থাকাকে রোজা বলে। রোজার হাকিকত হলো রোজা পালনের মাধ্যমে মানুষ লোভ-লালসা, হিংসা-বিদ্বেষ, ক্রোধ-ক্ষোভ ও কাম মানসিকতা পরিহারের মাধ্যমে আত্মিক দোষত্রুটি সংশোধন করে পরিশুদ্ধ হতে পারেন। রোজা হলো একজন ব্যক্তি ও তার মন্দ কাজের মাঝে ঢালস্বরূপ।

এই প্রসঙ্গে হযরত রাসুল (সা.) ফরমান, “রোজা হচ্ছে ঢালস্বরূপ।” (বোখারী শরীফ ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৫৪) রোজা আমাদের আত্মশুদ্ধির প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। রোজা পালনের মাধ্যমে যারা আত্মশুদ্ধি লাভ করে আদর্শ চরিত্রের অধিকারী হতে পারেন, তারাই সফলতা অর্জন করে থাকে। হাদিসে কুদসিতে রোজা সম্পর্কে মহান আল্লাহ্ বলেন, “রোজা আমার জন্য এবং আমিই এর প্রতিদান দেবো।” (আর প্রতিদান হলো মহান আল্লাহ্ নিজেই)।” (বোখারী শরীফ ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৫৪)


আমার মহান মোর্শেদ সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহ্বুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (রহ.) বলেন, “রোজা মানুষের আমিত্বকে দূর করে আল্লাহর চরিত্রে চরিত্রবান হওয়ার শিক্ষা দেয়। রোজার মাধ্যমে আল্লাহকে পাওয়ার অর্থ হলো নিজের মাঝে আল্লাহর চরিত্র বিকশিত হওয়া। তাই অন্তরের পাপকালিমা বিদূরিত করে হৃদয় মাঝে বিরাজমান আল্লাহর সুপ্ত নুর বিকশিত করার লক্ষ্যে মোর্শেদের দেখানো পথে শুদ্ধভাবে রোজা পালনের গুরুত্ব অপরিসীম।” (মাসিক আত্মারবাণী- এপ্রিল ২০২১ সংখ্যা, পৃষ্ঠা ৭)

রোজার আত্মিক বা ধর্মীয় গুরুত্ব যেমন রয়েছে, তেমনি এর সামাজিক গুরুত্ব অপরিসীম। রোজা পালনের মাধ্যমে রোজাদার ব্যক্তি ক্ষুধার যন্ত্রণা উপলব্ধি করতে পারে, ফলে তার মধ্যে গরিব-দুঃখী মানুষের প্রতি সহানুভূতি ও ভালোবাসা সৃষ্টি হয়। রোজা পালনকারী ব্যক্তি অন্যায়-অশ্লীল কথাবার্তা পরিহার করে চলে এবং হানাহানি থেকে দূরে থাকে। ফলে সমাজে শান্তি বিরাজ করে। এছাড়া আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় একে অপরকে সাহরি ও ইফতার করিয়ে থাকে এবং অভাবীকে আর্থিক সহযোগিতা করে থাকে। এর ফলে পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ববোধ সৃষ্টি হয় এবং সামাজিক বন্ধন আরও মজবুত ও শক্তিশালী হয়। চিকিৎসা বিজ্ঞানও রোজা রাখার উপকারীতা স্বীকার করে নিয়েছে। রোজা এক মাসের জন্য হজম প্রক্রিয়ায় নিয়োজিত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গসমূহের আরামের সুব্যবস্থা করে। হজমের ক্ষেত্রে লিভারের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ লিভার খাদ্য হজম করা ছাড়াও আরো পনেরটি অতিরিক্ত কাজ সম্পন্ন করে। ফলে লিভার ক্লান্ত হয়ে পড়ে। রোজার মাধ্যমে এই হজম প্রক্রিয়া চার থেকে ছয় ঘন্টা বিশ্রাম লাভ করে।

বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে বলা হয়- লিভারের জন্য কমপক্ষে বিশ্রামের সময়কাল একমাস হওয়া উচিৎ। লিভারের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য যে সময়টা প্রয়োজন, তা রমজান মাসে নিহিত রয়েছে।


উল্লেখ্য যে, রমজান মাসের মধ্যেই মহান আল্লাহ্ উম্মতে মোহাম্মদীর জন্য এমন একটি পূণ্যময় রজনি রেখেছেন, যার মর্যাদা হাজার মাসের চেয়েও বেশি। এ মহতী রাতের বর্ণনায় সূরা ক্বদর নাজিল করা হয়েছে। আমি মহান আল্লাহর দরবারে লাখো শুকরিয়া জ্ঞাপন করছি, কেননা তিনি দয়া করে আমাকে শবে কদরের মহিমান্বিত রজনিতে জগতের বুকে প্রেরণ করেছেন। এই বরকতময় রজনিতে জন্মগ্রহণের জন্য বাবা দেওয়ানবাগী ও হযরত দয়াল মা (রহ.) আমাকে আদর করে ‘কদর’ বলে ডাকতেন। আমি নিজেকে সর্বদা ধন্য মনে করি এই জন্য যে, মহান আল্লাহ্ দয়া করে আমাকে বেলায়েতের যুগে সর্বশ্রেষ্ঠ অলী-আল্লাহ্ সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজানকে ‘পিতা’ হিসেবে এবং মহীয়সী মাতা কুতুবুল আকতাব হযরত দয়াল মা (রহ.)-কে ‘মা’ হিসেবে পাওয়ার সৌভাগ্য দান করেছেন।


পরিশেষে মহান আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা- তিনি যেন দয়া করে আমাদেরকে সঠিকভাবে রোজা পালনের মাধ্যমে তাঁর সন্তুষ্টি অর্জন করার তৌফিক দান করেন। আমিন।.

সম্পর্কিত পোস্ট