মানবতার কবি শেখ সাদি (রহ.)
ড. সৈয়দ মেহেদী হাসান
পর্ব-০১
শেখ সাদি (রহ.) ছিলেন ফারসি সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি। তিনি বিশ্ব সাহিত্য পরিমণ্ডলেরও একজন অমর কবি। তাঁর নৈতিক শিক্ষা ও মানবিকতা সবার কাছে গ্রহণীয়, যা এশিয়া, আমেরিকা, ইউরোপসহ বিশ্ববাসীকে সুপথের সন্ধান দিয়েছে। শেখ সাদি (রহ.) একমাত্র ব্যক্তিত্ব, যাঁর গ্রন্থাদি দেশ, জাতি, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষ কর্তৃক গৃহীত এবং পঠিত হয়ে আসছে। তাঁর অমর সৃষ্টি ‘গুলিস্তান’ ও ‘বুস্তান’ গ্রন্থদ্বয় বাংলা ভাষায় বহুবার অনূদিত ও মুদ্রিত হয়েছে।
ইরানের বিখ্যাত শহর সিরাজে ১১৮৪ সালে মানবতার কবি শেখ (শায়েখ) সাদি (রহ.) জন্মগ্রহণ করেন, যা বহু বছর পর্যন্ত ইরানের রাজধানী ছিল। শেখ সাদি (রহ.)-এর মূল নাম- ‘মুসলেহ’, মোশাররফ উদ্দীন’ এবং কাব্য নাম ‘সাদি’। তাঁর পিতার নাম হযরত আবদুল্লাহ শাহ (রহ.) এবং মাতা হযরত মাইমুরা খাতুন (রহ.)। পারস্যের রাজধানী সিরাজের রাজ দরবারের কবি ছিলেন শেখ সাদি (রহ.)। তাঁর কবি নাম ‘সাদি’ গ্রহণ করেন সিরাজের শাসক সাদ ইবনে আবুবকর ইবনে সাদ-এর নামানুসারে। কিন্তু তখনকার দিনের সভাকবিদের মতো সাহিত্য চর্চা তিনি করেননি। তিনি পূর্ববর্তী রাজা বাদশাহদের জীবনচিত্র তুলে ধরেছেন নানা কাহিনির অবতারণা করে। তাঁর মাধ্যমে বর্তমান শাসক শ্রেণিকে ভালো কাজে অনুপ্রাণিত করেছেন, আর মন্দ কাজ হতে বিরত থাকার তাগিদ দিয়েছেন।
কবির পিতা হযরত আবদুল্লাহ শাহ (রহ.) ছিলেন একজন উচ্চ শ্রেণির আবেদ। পুত্রকে তিনি বাল্যকাল থেকেই পার্থিব শিক্ষার চাইতে ইবাদত, রিয়াজত, সংযম, সবর ও তাওয়াক্কাল প্রভৃতি নৈতিক শিক্ষার দিকে অধিকতর আকৃষ্ট করেছিলেন। ফলে কবি ছোটোবেলা থেকেই রাত জেগে ইবাদত বন্দেগি করতে অভ্যস্ত ছিলেন। পিতার তত্ত¡াবধানে থেকেই তিনি প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। পিতার ইন্তেকালের পর কবির জীবনে সুখ শান্তি ও পড়াশোনার ব্যাঘাত ঘটে। বাল্যকাল থেকেই তাঁর অসাধারণ প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায়। তাই তাঁর পিতার মৃত্যুর পর সিরাজের রাজা সাদ ইবনে আবু বকরের সহায়তায় তাঁকে উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্য সমকালীন শ্রেষ্ঠ জ্ঞান চর্চাকেন্দ্র বাগদাদের নিজামিয়া মাদ্রাসা থেকে পবিত্র কুরআন, তাফসীর, হাদিস, ফিকাহ শাস্ত্র, আকাইদ, যুক্তিবিদ্যা, দর্শন, সাহিত্য, ইতিহাস ও এলমে তাসাউফ বিষয়ে ব্যুৎপত্তি লাভ করেন।
কথিত আছে তিনি ১২০ বছর মতান্তরে ১১৬ বছর বেঁচে ছিলেন। তাঁর এই দীর্ঘ জীবনে প্রথম ৩০ বছর জ্ঞান সাধনায়, পরের ৩০ বছর পর্যটনে এবং ৩০ বছর সাধু দরবেশদের সাহচর্যে ও কঠোর তপস্যায় কাটিয়েছেন। জীবনের শেষ ৩০ বছর তিনি খাইবার গিরিপথে বিদেশি দুস্থ, বিপদগ্রস্ত পথিকদের সেবায় অতিবাহিত করেন। তাঁর জ্ঞান পিপাসা ছিল অদম্য, তেমনি স্বাস্থ্যও ছিল অটুট। তাই বৃদ্ধ বয়সেও তিনি ছিলেন যুবকের মতো কর্মঠ এবং কষ্ট সহিষ্ণু।
শিক্ষা জীবন সমাপ্ত করে শেখ সাদি (রহ.) দেশ ভ্রমণের বাসনায় বেরিয়ে পড়েন। তিনি ১২২২ থেকে ১২২৩ সালে বাগদাদ ত্যাগ করেন এবং সিরিয়া, দামেস্ক, হিজাজ, লেবানন, রোম, মক্কা, মদীনা ও দক্ষিণ আফ্রিকা প্রভৃতি দেশের শহরসমূহ পরিভ্রমণ করে বিচিত্র অভিজ্ঞতা লাভ করেন। এরপর তিনি কাশগর, নাজাফ, কারবালা, হিন্দুস্তান এবং তুর্কিস্তানও ভ্রমণ করেন। দীর্ঘকাল ভ্রমণের পর শেখ সাদি (রহ.) ১২৫৭ সালে নিজ জন্মভূমি সিরাজ নগরীতে ফিরে আসেন এবং তথায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। সেখানে তিনি সর্বদা কাশিদা, গজল এবং ওয়াজ নসিহতে নিজেকে নিয়োজিত রাখেন। শেষ জীবনে তিনি স্বীয় খানকায় অবস্থান করতেন এবং সেখানেই তিনি ১২৯১ মতান্তরে ১২৯২ সালে ওফাত লাভ করেন।
বাংলাদেশে শেখ সাদির কাব্যচর্চা
ত্রয়োদেশ শতাব্দীর সূচনা লগ্নে বীর ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মাদ বিন বখতিয়ার খিলজি বাংলা বিজয় করেন। তাঁর এ বিজয়ের মধ্য দিয়ে বালখ ও মাওয়াবা-উল-নাহার (ঞৎধহংড়ীধহরধ-উজবেকিস্তানের পুরাতন নাম) এলাকার মুসলিম বণিক, সুফি-সাধক ও আওলিয়ায়ে কেরাম ভারতীয় উপমহাদেশে আগমন করেন এবং বাংলার আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়েন। তাঁদের অধিকাংশের মাতৃভাষা ছিল ফারসি। তারা ছিলেন ফারসি ভাষা ও সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। যার ফলে ফারসি ভাষা এ উপমহাদেশের মানুষের প্রাণের ভাষায় রূপান্তরিত হয়। প্রায় সাড়ে ছয়শত বছর এ ভাষা রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদা লাভ করে। এতে মানুষ ফারসি ভাষা-ভাষী কবি-সাহিত্যিক এবং তাদের সাহিত্যকর্মের সাথে খুব সহজেই পরিচিত হয়ে উঠে। বিশেষত তারা ফেরদৌসির শাহনামা, ওমর খৈয়ামের রূবাইয়াত, হাফিজের দীওয়ান, আত্তারের পান্দনামা, মাওলানা জালাল উদ্দীন রুমীর মসনবি শরীফ এবং নীতিশাস্ত্রীয় কবি শেখ সাদি (রহ.)-এর গুলিস্তান ও বুস্তান গ্রন্থের সাথে সর্বাধিক পরিচিতি লাভ করে।
১৮৩৭ সালে তৎকালীন শাসকগোষ্ঠী রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ফারসিকে বাতিল করলেও অদ্যাবধি বাংলাদেশে ফারসি সাহিত্যের চর্চ্যা অব্যাহত রয়েছে। ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তথা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সাদি (রহ.)-এর গ্রন্থাবলি পাঠ্যতালিকার অন্তর্ভুক্ত হয়ে আসছে। কবি-সাহিত্যিকসহ দেশের শিক্ষিত সমাজ শেখ সাদি (রহ.)-এর নৈতিক গ্রন্থাবলির দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। অনেক কবি-সাহিত্যিক তাঁর গ্রন্থাবলিকে পদ্যরীতিতে আবার অনেকে গদ্যরীতিতে অনুবাদ করেছেন। যা বাংলা সাহিত্য ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধি দান করেছে। এছাড়া এ দেশের আলেম সমাজ ওয়াজ ও মিলাদ মাহ্ফিল এবং পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবি (সা.) ও পবিত্র আশুরা উপলক্ষ্যে বিভিন্ন মিলাদ মাহ্ফিলে শেখ সাদি (রহ.)-এর গ্রন্থ ‘গুলিস্তান’ ও ‘বুস্তান’ হতে উদ্ধৃতি প্রদান করেন এবং এর বহু পংক্তি বিভিন্ন সভা-সমিতিতে নিজেদের বক্তব্যকে শানিত করার লক্ষ্যে তুলে ধরেন। বিশেষ করে তাঁর গুলিস্তান গ্রন্থের নিম্নোক্ত অমর পংক্তি দুটি ছাড়া আজও যেন আমাদের ওয়াজ ও মিলাদ মাহ্ফিল সম্পন্ন হয় না। এই মহান কবির রচিত চারটি চরণ উচ্চারিত হচ্ছে উপমহাদেশের মুসলমান জনগণের ঘরে ঘরে।
“বালাগাল উলা বিকামালিহি
কাসাফাদদুজা বিজামালিহি
হাসানাত জামিউ খিসালিহি
সাল্লু আলাইহি ওয়া আলিহি”
অনুবাদ: মানবতার শীর্ষে তুমি হলে উপনীত,
রূপের ছটায় দূর করিলে আঁধার ছিল যত।
সকল গুণের সমাবেশে চরিত্র মহান,
তুমি ও তোমার বংশ পরে হাজারো সালাম।
রাহমাতুল্লিল আলামিন হযরত রাসুল (সা.)-এর জিয়ারতে যাওয়ার জন্য কবি শেখ সাদি (রহ.) উল্লিখিত নাতটির তিনটি চরণ রাসুলের শানে লিখেছিলেন। পরবর্তীতে জগদ্ বিখ্যাত আধ্যাত্মিক সাধক কবি শেখ সাদি (রহ.) যখন হযরত রাসুল (সা.)-এর রওজা জিয়ারতের নিয়ত করেন। তিনি মনে মনে চিন্তা করেন যে, হযরত রাসুল (সা.)-এর প্রশংসা ব্যক্ত করে সুন্দর ছন্দময় পংক্তি রচনা করে তিনি রওজা মোবারকে গিয়ে নবিজিকে তা নজরানা দেবেন। এ চিন্তায় নিমগ্ন থেকে তিনি মদীনার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করলেন। পথ চলতে চলতে তিনি রচনা করলেন, “বালাগাল উলা বিকামালিহি, কাসাফাদদুজা বিজামালিহি, হাসানাত জামিউ খিসালিহি” এ পর্যন্ত রচনা করে তিনি নবিজির প্রেমে বিভোর হয়ে আনন্দিত ও রোমাঞ্চিত হতে লাগলেন। কিন্তু স্তবক পূর্ণকারী ৪র্থ পংক্তিটি কিছুতেই তিনি রচনা করতে পারলেন না। অনেক চেষ্টা করেও বিফল হয়ে নিজের অক্ষমতার গভীর মনোবেদনায় ক্রন্দনরত অবস্থায় তিনি নবিজির রওজা শরীফে গিয়ে হাজির হয়ে পূর্বে রচিত ৩টি পংক্তি নবিজির উদ্দেশ্যে নিবেদন করলেন। তখন নবিজি (সা.) তাঁর কবিতার স্তবকের ৪র্থ পংক্তিটি পূর্ণ করে দিয়ে বললেন, “সাল্লু আলাইহি ওয়া আলিহি”।
শেখ সাদি (রহ.) এই নাতে যেমন রাসুলে খোদার (সা.) ওপর দরূদ ও সালাম পৌঁছে দিয়েছেন, তেমনি তাঁর নিজের ওপরও প্রতিটি মুসলমানের কাছ থেকে প্রতিনিয়ত সালাম বর্ষিত হচ্ছে এবং হতে থাকবে হয়তো অনন্তকাল।
হযরত রাসুল (সা.)-এর চরিত্র-বৈশিষ্ট্য, শান সম্পর্কে শেখ সাদি (রহ.) আরো বলেন :
‘মহান স্বভাব চরিত্র মধুর
উম্মতের কান্ডারী নবি বিভুর,
রাসুলগণের নেতা, পথের দিশারি
খোদার বিশ্বস্ত জিবরাইলের মনজিল।
সৃষ্টলোকের সুপারিশকারী, পুনরুত্থান দিবসের সরদার
হেদায়াতের ইমাম, বিচার দিনের নেতা।
নভোমণ্ডল যার তুর পাহাড় আল্লাহর সাথে করতে আলাপ,
সকল আলো তারই নুরের বিকিরিত আলোর ছটা।’
আল্লাহর নবির অস্তিত্ব সম্পর্কে শেখ সাদি (রহ.) বলেন :
‘আপনি সৃষ্টির মূল উৎস। অন্যসব সৃষ্টি আপনার শাখা প্রশাখা।’
তাঁর জন্ম প্রসঙ্গে বলেন :
‘আগমন পরে যে কণ্ঠ ধ্বনিত হলো এ ধরায়
তাতেই কম্পিত কিসরার সিংহাসন।’
শেখ সাদি (রহ.)-এর সমকালিন সময়ে তাঁর মতো জ্ঞানী ব্যক্তি মুসলিম বিশ্বে দ্বিতীয় কেউ ছিল না। অনেক ইংরেজ লেখক পণ্ডিত তাঁকে প্রাচ্যের শেক্সপিয়র বলে আখ্যা দেন। শেখ সাদির ২২টির মতো গ্রন্থের নাম জানা যায়। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো গুলিস্তান, বূস্তান, করিমা, সাহাবিয়া, কাসায়েদে ফারসি, কাসায়েদে আরাবিয়া, গজলিয়াত, কুল্লিয়াত ইত্যাদি।
শেখ সাদি (রহ.)-এর কবিতা মানুষের মননকে পরিশীলিত ও নৈতিক মূল্যবোধে উদ্বুদ্ধ করে। ভৌগোলিক সীমাপরিসীমা পেরিয়ে জীবনকে সভ্য, সমৃদ্ধ ও উন্নত করে তোলে। জীবনবোধ, দর্শন, মূল্যবোধ, নান্দনিকতার অপূর্ব সম্মিলনে তাঁর কবিতা জীবনকে সত্য ও নান্দনিকতায় পূর্ণ করে দেয়। মানবজীবনে তাঁর কবিতার বাহ্যিক ও অন্তর্লোকের প্রেরণা সুদূরপ্রসারী। তাই যুগ যুগ শেখ সাদি (রহ.) তাঁর স্বীয় শিল্প কর্মের মধ্যদিয়ে স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে থাকবেন মহাকলের ঘূর্ণিপাকে।
(চলবে)
সহায়ক গ্রন্থ:
১। সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহ্বুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (রহ.), সূফী সম্রাটের যুগান্তকারী ধর্মীয় সংস্কার ২য় খণ্ড, সূফী ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, দেওয়ানবাগ শরীফ, ঢাকা, পৃষ্ঠা ১৩১
২। মুজতাহিদ ফারুকী, স্মরণে মহান কবি শেষ সাদী, নিউজ লেটার, ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দূতাবাস, ঢাকা থেকে প্রকাশিত, ২০ এপ্রিল ২০২০
৩। ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী, মানবতার কবি শেখ সাদি, নিউজ লেটার, ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দূতাবাস, ঢাকা থেকে প্রকাশিত, ৩৯তম বর্ষ: ২য় সংখ্যা, মার্চ-এপ্রিল ২০১৭, পৃষ্ঠা ৩৭
৪। ড. মাওলানা এ. কে. এম. মাহবুবুর রহমান, ফারসি কাব্যসাহিত্যে মহানবি (সা.), সাপ্তাহিক দেওয়ানবাগ, ঢাকা থেকে অনলাইনে প্রকাশিত, ফেব্রæয়ারি ১২, ২০২১
৫। গুলিস্তানে সাদী, শেখ সাদী
৬। ড. মোঃ ওসমান গনী, বাংলাদেশে শেখ সাদীর কাব্যচর্চা: একটি পর্যালোচনা, আইবিএস জার্নাল, অষ্টাদশ সংখ্যা ১৪১৭ এবং সাপ্তাহিক দেওয়ানবাগ, ঢাকা থেকে অনলাইনে প্রকাশিত, জানুয়ারি ২২, ২০২১
৭। মহামানবদের জীবনে যা ঘটেছে- শেখ সাদী (রহ.), সাপ্তাহিক দেওয়ানবাগ, ৩১ বর্ষ, ৪৫ সংখ্যা, ২৩ জানুয়ারি, ২০১৫, ঢাকা, পৃষ্ঠা ৭
[লেখক: প্রাবন্ধিক ও গবেষক]