হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর শুভ জন্ম ও ওফাতের সঠিক তারিখ
ড. জাহাঙ্গীর আলম
সর্বকালের সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হযরত মোহাম্মদ (সা.)। যাঁকে মহান রাব্বুল আলামিন, প্রেরিত নবি-রাসুলদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ সম্মান ও মযার্দার আসনে অধিষ্ঠিত করেছেন। এই প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ্ এরশাদ করেন- “[হে রাসুল (সা.)!] আমি আপনার আলোচনাকে (জ্বিকির) উচ্চ মযার্দা দিয়েছি।” (সূরা আল ইনশিরাহ ৯৪: আয়াত ৪) রাহ্মাতুল্লিল আলামিন হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর কারণে সৃষ্টিজগৎ সৃজিত হয়েছে। এই প্রসঙ্গে মহান রাব্বুল আলামিন হাদিসে কুদসিতে বলেন- “লাও লাকা লামা খালাকতুল আফলাক।” অথার্ৎ- হে রাসুল (সা.)! যদি আমি আপনাকে সৃষ্টি না করতাম তবে সৃষ্টিকুলের কোনো কিছুই সৃজন করতাম না।” (তাফসীরে মাজহারী ১০ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৮০) যে মহামানবের কারণে এই জগৎ সংসার সৃষ্টি, সেই মহামানবকে জগতের বুকে পাওয়ার জন্য সমগ্র মাখলুকাত লক্ষ লক্ষ বছর ধরে তাঁর উপর দরূদ ও সালাম পাঠ করে। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেছে, যার আগমনের উপযুক্ত ক্ষেত্র প্রস্তুতের জন্য মহান প্রভু হযরত আদম (আ.) থেকে শুরু করে হযরত ঈসা (আ.) পর্যন্ত অসংখ্য নবি ও রাসুল জগতের বুকে প্রেরণ করেছেন। আল্লাহ্র সেই প্রিয়বন্ধুর শুভাগমনের দিন জগদ্বাসীর জন্য সবচেয়ে বেশি আনন্দের, খুশির ও সুখের দিন। পক্ষান্তরে হযরত মোহাম্মদ (সা.) ৬৩ বছর হায়াতে জিন্দেগি শেষে যেদিন এই ধুলির ধরা হতে পর্দা করলেন সেই দিনটি ছিল সারাবিশ্বের জন্যে অত্যন্ত দুঃখের, শোকের ও বেদনার।
মহান রাব্বুল আলামিন মহাপরাক্রমশালী। তাঁর ইচ্ছায় সবকিছু নিয়ন্ত্রিত হয়। মহান রাব্বুল আলামিনের সবচেয়ে প্রিয় ও সর্বশ্রেষ্ঠ বন্ধু দোজাহানের বাদশাহ হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর আগমনের দিন এবং জগৎ হতে প্রস্থানের দিন কি একই মাসের একই তারিখে? নাকি ভিন্ন কোনো তারিখে? তবে আমাদের সমাজে বহুল প্রচলিত হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর শুভ জন্ম ও ওফাৎ একই তারিখে, অর্থাৎ ১২ই রবিউল আউয়াল।
হযরত মোহাম্মদ (সা.) যে জগতের জন্য রহমতস্বরূপ এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে- “[হে রাসুল (সা.)!] আমি তো আপনাকে জগতসমূহের জন্য রহমত করে প্রেরণ করেছি।” (সূরা আল আম্বিয়া ২১: আয়াত ১০৭) এই মহামানবের উপর দরূদ না পড়লে কারো প্রার্থনা মহান আল্লাহ্র দরবারে কবুল হয় না। তাঁর সাফায়াত ছাড়া কারো মুক্তি হবে না। সেই মহামানবের জন্ম ও ওফাতের সঠিক তারিখ জানা আমাদের সকলের ইমানি দায়িত্ব। হযরত রাসুল (সা.)-এর শুভ জন্ম ও ওফাতের তারিখ একই দিন নয়। পবিত্র কুরআন ও হাদিসের আলোকে আমরা জানার চেষ্টা করবো হযরত রাসুল (সা.)-এর ওফাতের সঠিক তারিখ। বিশ্বনবি হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর ওফাতের সঠিক তারিখ ১লা রবিউল আউয়াল, একাদশ হিজরি, রোজ সোমবার সূর্যাস্তের পূর্বে।
আমাদের সমাজে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে আখেরি চাহার সোম্বা পালন করা হয়। এই দিনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য হলো হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর ওফাতের পূর্বে কিছুদিন তিনি অসুস্থ ছিলেন, তবে ওফাতের পাঁচ দিন পূর্বে বুধবার তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠেন। এতে সাহাবিরা আনন্দে আত্মহারা হয়েছিলেন। ঐদিনটি সফর মাসের শেষ বুধবার ছিল বলে ঐদিনকে ‘আখেরি চাহার সোম্বা’ বলা হয়। হযরত রাসুল (সা.)-এর জীবদ্দশায় আরেকটি বুধবার তিনি পাননি। এই হিসাব মোতাবেক একাদশ হিজরির ২৫শে সফর ছিল বুধবার। সফর মাস ২৯ দিনে, এই দিন ও তারিখ অনুযায়ী গণনা করলে একাদশ হিজরির ১লা রবিউল আউয়াল তারিখ রোজ সোমবার হযরত মোহাম্মদ (সা.) ওফাত লাভ করেন। কিন্তু ১২ই রবিউল আউয়াল কিছুতেই হয় না।
পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে -“আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের ধর্মকে পূণার্ঙ্গ করে দিলাম, তোমাদের প্রতি আমার নেয়ামত পূর্ণ করে দিলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্য দ্বিন হিসেবে পছন্দ করলাম। (সূরা মায়েদা ৫: আয়াত ৩) পবিত্র কুরআনের এই আয়াত দশম হিজরির ৯ই জিলহজ তারিখে আরাফার ময়দানে অবতীর্ণ হয়। এই আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার স্থান, দিন ও তারিখ নির্দিষ্ট হওয়ায় হযরত রাসুল (সা.)-এর ওফাতের তারিখ নির্ণয়ের জন্য এই আয়াতটি নির্ভরযোগ্য ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করা হয়। হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর বিদায় হজের ভাষণদানকালে উক্ত আয়াতটি অবতীর্ণ হয়। এই আয়াতটি অবতীর্ণ হওয়ার পর মাত্র ৮১ দিন হযরত রাসুল (সা.) জীবিত ছিলেন। বিদায় হজ অনুষ্ঠিত হয় ১০ম হিজরির ৯ই জিলহজ, শুক্রবার। এই হজকে আকবরি হজ বলা হয়। এই তারিখ হিসাব করে আমরা হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর সঠিক ওফাতের তারিখ খুব সহজে জানতে পারি। চান্দ্রপঞ্জিকা মোতাবেক আরবি মাস হয় ২৯ দিনে এবং পরবর্তী মাস হয় ৩০ দিনে। জিলহজ মাস ২৯ দিনে, মহররম মাস ৩০ দিনে এবং সফর মাস ২৯ দিনে ছিল। জিলহজ মাসের ২১ দিন, মহররম মাসের ৩০ দিন এবং সফর মাসের ২৯ দিন (২১+৩০+২৯)=৮০ দিন। ১লা রবিউল আউয়াল মাসের ১ দিন। সুতরাং সর্বমোট ৮০+১= ৮১তম দিবস ১লা রবিউল আউয়াল হযরত মোহাম্মদ (সা.) ওফাত লাভ করেন।
তাফসীরে দুররে মানসুরের ৬ষ্ঠ খণ্ডের ২০ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করা হয়েছে- ইবনে জারীর কর্তৃক ইবনে জুরাইজ হতে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন এই আয়াতটি অবতীর্ণ হওয়ার পর হযরত রাসুল (সা.) ৮১ রাত দুনিয়াতে অবস্থান করেন। তাফসীরে তাবারীর ৬ষ্ঠ খণ্ডের ৮০ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করা হয়েছে- হাজ্জাজ কর্তৃক ইবনে জুরাইজ হতে বর্ণিত হয়েছে তিনি বলেন- এ আয়াতটি অবতীর্ণ হওয়ার পর ৮১ রাত হযরত রাসুল (সা) জীবিত ছিলেন। হযরত মোহাম্মদ (সা.) ১লা রবিউল আওয়াল ওফাত লাভ করেছে- এটাই সঠিক ও নির্ভুল তথ্য। তাহলে আমাদের সমাজে জন্ম ও ওফাতের তারিখ ১২ই রবিউল আওয়াল হলো কীভাবে? হযরত মোহাম্মদ (সা.) ১লা রবিউল আউয়াল সূর্যাস্তের কয়েক মিনিট পূর্বে ওফাত লাভ করেন। তখন বিশ্বে তথ্যপ্রযুক্তির কোনো ব্যবহার ছিল না। একজনের কাছ থেকে অপরজনের কাছে সংবাদ ছড়াতে সন্ধ্যা পার হয়ে রাত হয়ে যায়।
আরবি দিন শুরু হয় সূর্যাস্তের পর হতে। সূর্যাস্তের পর যে সকল সাহাবি এবং মুসলিম জনতা জানতে পারল তাদের নিকট তারিখটি ছিল ২রা রবিউল আউয়াল। আরবের ইতিহাসবিদগণ হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর ওফাতের তারিখ লিখেছেন ১/২ রবিউল আউয়াল। উমাইয়া শাসনামলে তারা চক্রান্ত করে যাতে হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর শুভ জন্ম দিন সঠিক তারিখে পালন করে আনন্দ প্রকাশ করতে না পারে, সেজন্য সুকৌশলে ১/২ এর মাঝে অবলিক (/) চিহ্নটি উঠিয়ে দিয়েছে। ফলে তারিখটি হয়ে গেছে ১২ই রবিউল আউয়াল। এটি একটি সম্পূর্ণ মিথ্যা বানোয়াট ও ভুল তথ্য। তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে আমরা যদি একাদশ হিজরির ১২ই রবিউল আউয়াল গুগলে সার্চ করি দেখতে পাবো একাদশ হিজরির ১২ই রবিউল আউয়াল ছিল শুক্রবার। দিনটি কিছুতেই সোমবার হয় না। মহান রাব্বুল আলামিন যতটুকু রাজত্বের জন্য রব, হযরত মোহাম্মদ (সা.) ততটুকু রাজত্বের জন্য রহমত। যিনি জগতের জন্য রহমত ও বরকতের, যাঁর কারণে বিশ্বজাহান সৃষ্টি সেই মহামানবের শুভাগমনের দিন হলো ১২ই রবিউল আউয়াল। এই দিনটি যদি যথাযথ মর্যাদার সাথে আমরা সারা বিশ্বের মানুষ পালন করি তাহলে আমরা ইহলৌকিক ও পারলৌকিক সুখ শান্তি অর্জন করতে পারব।
খ্রিষ্টান ধর্মের প্রবর্তক হযরত ঈসা (আ.)-এর শুভ জন্মদিন ২৫শে ডিসেম্বর তাঁর অনুসারীরা পালন করে। দিনটি সারা বিশ্বে ছুটি থাকে। হিন্দু ধর্মের প্রবর্তক শ্রীকৃষ্ণের জন্মদিন, সারাবিশ্বে একই দিন মহাধুমধামে পালন করা হয়। বৌদ্ধধর্মের প্রবর্তক গৌতম বুদ্ধের শুভ জন্মদিন বৌদ্ধধর্মের সকল মানুষ অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে পালন করেন, অথচ রাহ্মাতুল্লিল আলামিন হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর অসিলায় ঈসা (আ.), মুসা (আ.), শ্রীকৃষ্ণ, গৌতমবুদ্ধসহ বিশ্বের সকল সৃষ্টির আবিভার্ব, সেই মহামানবের শুভজন্ম বিশ্বময় উদ্যাপন করা অত্যাবশ্যক। যে সকল মুসলমান হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর শুভ জন্মদিন ১২ই রবিউল আউয়াল তথা ঈদে মিলাদুন্নবি (সা.) পালন করেন, তারা বিভিন্ন প্রকার ফতুয়াসহ নানা প্রতিকূল সমস্যার সম্মুখীন হন। মহান সংস্কারক মোহাম্মদী ইসলামের পুনজীর্বনদানকারী সূফী সম্রাট হযরত দেওয়ানবাগী (রহ.)-এর অন্যতম সংস্কার হলো ১২ই রবিউল আউয়াল পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবি (সা.), আল্লাহ্র এই মহান বন্ধুর বলিষ্ঠ ভূমিকায় আজ বাংলার বুকে ঈদে মিলাদুন্নবি (সা.)-এর জোয়ার এসেছে। তিনি ঈদে মিলাদুন্নবির গুরুত্ব, তাৎপর্য ও প্রয়োজনীয়তা রাষ্ট্রপক্ষকে বুঝিয়ে দিনটিকে রাষ্ট্রীয়ভাবে পালনের অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন। সরকার রাষ্ট্রীয়ভাবে ঈদে মিলাদুন্নবি (সা.) পালন করে এবং এই দিন সরকারি ছুটি ঘোষণা করে। সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান ১২ই রবিউল আউয়াল ‘সৃষ্টিকুলের শ্রেষ্ঠ ঈদ, দয়াল রাসুলের জন্মঈদ’ হিসেবে ঘোষণা দেন।
উমাইয়ারা হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর জন্ম ও ওফাত ১২ই রবিউল আউয়াল প্রচার করে মুসলিম জাতিকে হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর শুভ জন্মের ঈদের মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রহমত ও বরকতপূর্ণ অনুষ্ঠান থেকে বিরত রেখেছে। অথচ মহান রাব্বুল আলামিন হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর শুভ জন্মদিন পৃথিবীর সকল কিছুর থেকে শ্রেষ্ঠ ঘোষণা করেছেন। এরশাদ হচ্ছে- “[হে রাসুল (সা.)] আপনি বলুন এটি আল্লাহ্র অনুগ্রহে ও তাঁর দয়ায়। সুতরাং এতে [মোহাম্মদ (সা.)-এর আগমনে] তারা আনন্দিত হউক। তারা যা পুঞ্জীভূত করে তা অপেক্ষায় তিনি [হযরত মোহাম্মদ (সা.)] অনেক উত্তম।” (সূরা ইউনুস ১০: আয়াত ৫৮)
হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর শুভ জন্মদিন জগদ্বাসীর জন্য রহমত ও বরকতের, আর এটি এজন্য যে হযরত মোহাম্মদ (সা.) হলেন হায়াতুন্নবি। তিনি সৃষ্টির আদিতে ছিলেন তেমনি সৃষ্টির অন্তেও থাকবেন। আসুন আমরা সবাই মোহাম্মদী ইসলামের নেতৃত্বপ্রদানকারী মহামানব ইমাম প্রফেসর ড. কুদরত এ খোদা (মা. আ.) হুজুরের সঠিক দিক নির্দেশনায় পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবি (সা.) অনুষ্ঠান মহাধুমধামের সাথে ঘরে ঘরে পালন করি এবং যার যার সামর্থ্য অনুযায়ী ঈদের আনন্দ করি এবং হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর সাফায়াত লাভ করি। ইমাম প্রফেসর ড. কুদরত এ খোদা (মা. আ.) হুজুরের বরকতে, আমাদেরকে আগামী দিনের মোহাম্মদী ইসলামের সৈনিক হওয়ার তৌফিক দান করুন, মহান রাব্বুল আলামিনের নিকট এই ফরিয়াদ। আমিন।
[লেখক: ইসলামি গবেষক]