Cancel Preloader

পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের বিধান ও ফজিলত

মহান সংস্কারক, মোহাম্মদী ইসলামের পুনর্জীবনদানকারী, সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহবুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (রহ.) হুজুর কেবলাজান
[সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান রচিত ‘তাফসীরে সূফী সম্রাট দেওয়ানবাগী’ নামক তাফসীর কিতাব থেকে প্রবন্ধটি সংকলন করা হয়েছে।-সম্পাদক]

(শেষ পর্ব)

প্রিয় পাঠক! এ পর্যায়ে আমরা দেখব, মহান আল্লাহ্ তাঁর রাসুল (সা.)-এর উম্মতে মোহাম্মদীকে যে পাঁচ ওয়াক্ত ফরজ নামাজ উপহার দিয়েছেন, এ নামাজের ফজিলত সম্পর্কে হাদিস শরীফে কী বাণী মোবারক উপস্থাপিত হয়েছে, সাথে সাথে এ বিষয়টিও পরিষ্কার করব যে, মহান আল্লাহ্ কোন নামাজে কী পুরস্কার দেন। অতঃপর নামাজ কীভাবে মানুষকে যাবতীয় পাপের কাজ থেকে বিরত রেখে আদর্শ চরিত্রবান ও মু’মিনরূপে গড়ে তোলে।


ফজরের নামাজের ফজিলত
১। হযরত সালমান (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেন- “যে ব্যক্তি ভোর বেলায় সালাত তথা ফজরের নামাজ আদায় করেছে, সেই ইমানের পতাকা উত্তোলন করেছে। (সুনানে ইবনে মাজাহ’র সূত্রে মেশকাত শরীফ, পৃষ্ঠা ৬৩)
২। হযরত উমারা ইবনে রুয়াইবাহ (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেন- “যে ব্যক্তি সূর্যোদয়ের পূর্বে এবং সূর্যাস্তের পূর্বে সালাত আদায় করেছে, সে কখনো জাহান্নামে যাবে না। অর্থাৎ- ফজর ও আসরের নামাজ।” (মুসলিম শরীফের সূত্রে মেশকাত শরীফ, পৃষ্ঠা ৬২)
৩। হযরত জুনদুব আল কাসরী (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেন- “যে ব্যক্তি ফজরের নামাজ আদায় করেছে, সে আল্লাহর হেফাজতে রয়েছে।” (মুসলিম শরীফের সূত্রে মেশকাত শরীফ, পৃষ্ঠা ৬২)
হাদিস শরীফের এ বাণী মোবারকসমূহে ফজরের নামাজের গুরুত্ব, প্রয়োজনীয়তা ও ফজিলত উপস্থাপিত হয়েছে। আসলে এ বাণী মোবারকসমূহের যথার্থতা ও বাস্তবতা এ দুনিয়াতেই নামাজ আদায়ের মাধ্যমে অর্জন করে নিতে হয়। অর্থাৎ ফজরের নামাজ আদায়কারী নামাজের সালাম ফেরানোর সাথে সাথেই এ ফজিলত লাভ করতে পারে, যদি সে খুশু-খুযুর সাথে হুজুরি দিলে অর্থাৎ একাগ্রতার সাথে নামাজ আদায়ে সক্ষম হয়। তবে এ লক্ষ্যে একা একা সাধনা করে মঞ্জিলে মাকসুদে পৌঁছানো যায় না। নামাজের এ পুরস্কার লাভ করতে হলে আল্লাহ্ ও তাঁর রাসুলের মনোনীত প্রতিনিধি তথা মোর্শেদের সুমহান শিক্ষা অনুযায়ী হুজুরি দিলে ফজরের নামাজ আদায় করতে হয়। ফজরের এ ওয়াক্তে অশেষ দয়াময় আল্লাহ্ কুয়্যাতে এলাহিয়ার ফায়েজ নাজিল করেন। কুয়্যাতে এলাহি-এর অর্থ আল্লাহর মহান শক্তি। এ ফায়েজ ওয়ারিদ হয় রহমতের সময়ের পর হতে অর্থাৎ- সুবহে সাদেকের ফজরের সময় থেকে জোহর ওয়াক্তের পূর্ব পর্যন্ত। যদিও এ ফায়েজ দিবা-রাত্রি চব্বিশ ঘন্টাই ওয়ারিদ হয়, উল্লিখিত সময়ে এ ফায়েজের শক্তি বেশি থাকে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ফায়েজ হলো আল্লাহ্ তায়ালা থেকে উৎসারিত প্রেমের প্রবাহ। এ ফায়েজই ধর্মের মূল চালিকাশক্তি। এ ফায়েজ দ্বারাই মানুষ আত্মশুদ্ধি অর্জন করে আশরাফিয়াতের গুণ অর্জন করে আল্লাহর সাথে যোগাযোগ করতে পারে। এজন্যই মহান আল্লাহ্ উম্মতে মোহাম্মদীকে দিনে রাতে পাঁচ ওয়াক্ত ফরজ নামাজের বিধান দিয়েছেন। অতঃপর এ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজে তিনি স্বীয় বান্দাকে পাঁচ প্রকারের ফায়েজ পুরস্কারস্বরূপ দান করেন। যথা-ফজর ওয়াক্তে কুয়্যাতে এলাহিয়ার ফায়েজ, জোহর ওয়াক্তে হযরত রাসুল (সা.)-এর মহব্বতের ফায়েজ, আসর ওয়াক্তে তওবার ফায়েজ, মাগরিবের ওয়াক্তে তওবা কবুলিয়াতের ফায়েজ এবং এশার ওয়াক্তে গাইরিয়াতের ফায়েজ মহান আল্লাহ্ পুরস্কার হিসেবে দিয়ে থাকেন।
এরই ধারাবাহিকতায় মহান আল্লাহ্ ফজর ওয়াক্তে কুয়্যাতে এলাহিয়ার ফায়েজ নাজিল করেন। মোর্শেদের শিক্ষা অনুযায়ী কোনো মুসলমান ব্যক্তি যখন খেয়াল ক্বালবে, ক্বালব আল্লাহর দিকে আল্লাহকে হাজির, নাজির ও ওয়াহিদ জেনে সিজদা করে, তখন আল্লাহর কুয়্যাতের এ ফায়েজ সূক্ষাতিসূক্ষ্মভাবে নামাজি ব্যক্তির ক্বালবে ওয়ারিদ হতে থাকে। এ ফায়েজ নফ্সকে ইসলাহ তথা পবিত্র-পরিশুদ্ধ করতে অত্যন্ত কার্যকরী। ফজরের নামাজ আদায়কারী ব্যক্তি নামাজের মাঝেই যেমন এ ফায়েজ স্বীয় ক্বালবে লাভ করে, একইসাথে নামাজ শেষে মোর্শেদের দেওয়া ওয়াজিফার নিয়ম অনুযায়ী মোরাকাবা করে আরো ভালোভাবে এ ফায়েজ হাসিল করে নিতে হয়। আর কুয়্যাতে এলাহিয়ার এ ফায়েজ ভালোভাবে লাভ করতে পারলে নামাজি ব্যক্তির ক্বালব বা দিল পরিষ্কার হয়। এর ফলে দিলের জাহের-বাতেন ছুফিদায়ে ক্বালবের ৭০ হাজার পর্দার ভেতর যত প্রকার গুনাহর পাহাড়, গুনাহর জুলমত, গুনাহর বাসনা আছে সব দূর হয়ে যায়। নফ্সের কুচরিত্র, কুখায়েশ, আল্লাহ্ ভুলানোর দুশমন, মানুষ শয়তান, জিন শয়তান, নফ্স শয়তানের ওয়াসওয়াসা, বান, টোনা, জাদু, কুজ্ঞান, কুমন্ত্রণা, নফসের সর্ব প্রকার খারাবি, সমস্ত বিপদ-আপদ, মাথার তালু হতে পায়ের তলা পর্যন্ত সর্ব প্রকার ব্যাধি ও বালা-মুসিবতের উপর আল্লাহর কুয়্যাত পড়ে সলব হয়ে সিজ্জিন জাহান্নামে দফা হয় এবং দিল সাফ হয়। ফজরের নামাজ আদায় করে এ ফায়েজ হাসিল করতে পারলে, এ ফায়েজ দ্বারাই তকদিরের খারাবি, হায়াতের কমজোরী, সর্বপ্রকার বিপদ-আপদ ও রোগশোক থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। উপরন্তু কুয়্যাতে এলাহীয়ার এ ফায়েজ দ্বারা কিল্লা অর্থাৎ দুর্গ তৈরি করা যায়। এ কিল্লা করে নিয়ে কিল্লার হেফাজতে থাকতে পারলে জাদু-টোনা, বান ও যাবতীয় বালা-মুছিবত থেকে সারাদিন আল্লাহর হেফাজতে থাকা যায়। প্রকৃতপক্ষে কুয়্যাতে এলাহিয়ার এ ফায়েজ দ্বারাই আত্মশুদ্ধি অর্জিত হয়। এজন্যই ইতঃপূর্বে উল্লিখিত হাদিসে যে ব্যক্তি ফজরের নামাজ আদায় করেছে, সে ইমানের পতাকা উত্তোলন করেছে- মর্মে আল্লাহর রাসুল (সা.) ঘোষণা করেছেন। অর্থাৎ যে ব্যক্তি ফজরের নামাজ আদায় করে আপন দিলে কুয়্যাতে এলাহিয়ার ফায়েজ লাভ করেছে, সে মূলত স্বীয় অন্তরে ইমানের পতাকা উত্তোলন করে সারা দিনের কর্ম শুরু করল। এরূপ ব্যক্তি মহান আল্লাহর হেফাজতের বেষ্টনীতে থাকার কারণে তার জন্য জাহান্নাম হারাম হয়ে যায়। এটিই ফজরের নামাজ ফরজ হওয়ার রহস্য ও ফজিলত।

জোহরের নামাজের ফজিলত
হযরত জায়েদ ইবনে সাবেত (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন- “আল্লাহর রাসুল (সা.) জোহরের নামাজ আদায় করতেন দ্বিপ্রহরে। আর জোহরের নামাজ ব্যতীত অন্য কোনো নামাজ রাসুল (সা.)-এর সাহাবিদের নিকট অধিক কষ্টসাধ্য ছিল না।” (মেশকাত শরীফ, পৃষ্ঠা ৬৩)
হযরত উম্মে হাবিবা (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেন- “যে ব্যক্তি জুমার দিনে (ফরজ নামাজের) পূর্বের চার রাকাত ও পরের চার রাকাত নামাজ নিয়মিত আদায় করবে, মহান আল্লাহ্ তার উপর জাহান্নামের আগুন হারাম করে দেবেন।” (আবু দাউদ ও তিরমিযী শরীফের সূত্রে রিয়াদুস সালেহীন পৃষ্ঠা ৪৯১, হাদিস নং ১১১৭)
হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে সায়েব (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, জোহরের নামাজ আদায়ের ক্ষেত্রে আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর পদ্ধতি ছিল এরূপ- “তিনি সূর্য পশ্চিম দিকে ঢলে পড়ার পর জোহরের (ফরজ নামাজের) পূর্বে চার রাকাত নামাজ আদায় করতেন এবং বলতেন- এটি এমন এক সময় যখন ঊর্ধ্বলোকে রহমতের দরজা খোলা হয়। অতএব আমি পছন্দনীয় মনে করি যে, এ সময় আমি সৎকর্ম করি, আর তা ঊর্ধ্বে গমন করুক।” (তিরমিযী শরীফের সূত্রে রিয়াদুস সালেহীন, পৃষ্ঠা ৪৯১, হাদিস নং ১১১৮)
রাহমাতুল্লিল আলামিন হযরত রাসুল (সা.)-এর বাণী মোবারকে জোহরের নামাজের সময়, গুরুত্ব ও ফজিলত উপস্থাপিত হয়েছে। এ জোহরের নামাজের সময়ই মহান আল্লাহ্ হযরত রাসুল (সা.)-এর মহব্বতের ফায়েজ নাজিল করেন। এ ফায়েজ ওয়ারিদ হয় জোহরের নামাজের পূর্ব থেকে আসরের নামাজের পূর্ব সময় পর্যন্ত। এ ফায়েজ ছাড়া হযরত রাসুল (সা.)-এর মহব্বত লাভ করা যায় না। সুতরাং এ সময়ই হযরত রাসুল (সা.)-এর মহব্বত হাসিলের উপযুক্ত সময়। আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেন- “তোমাদের মধ্যে কেউ ততক্ষণ মু’মিন হতে পারবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত সে আমাকে তার পিতামাতা, সন্তানসন্ততি ও সকল মানুষ অপেক্ষা অধিক ভালো না বাসবে।” (বোখারী শরীফ ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৭ ও মুসলিম শরীফ ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪৯)
সুতরাং মু’মিন হওয়ার জন্য হযরত রাসুল (সা.)-এর মহব্বত অন্তরে ধারণ করা আবশ্যক। প্রতিদিন জোহরের নামাজের ওয়াক্তে মহান আল্লাহ্ হযরত রাসুল (সা.)-এর মহব্বতের ফায়েজ নাজিল করে মানুষকে আশেকে রাসুল হওয়ার সুযোগ করে দিয়ে থাকেন। এ জন্য জোহরের নামাজে যেমন এ ফায়েজ হাসিল করা যায়, তেমনি নামাজ আদায় শেষ করে মোরাকাবায় বসে খেয়াল ক্বালবে ডুবিয়ে নিয়ম অনুযায়ী আল্লাহর হুজুরে হাজির হয়ে, এ ফায়েজ অর্জন করে নিতে হয়। সাহাবায়ে কেরাম জোহরের নামাজে হযরত রাসুল (সা.)-এর মহব্বতের এ ফায়েজ হাসিল করার কারণেই তারা নবি প্রেমে উজ্জীবিত ছিলেন এবং নবির জন্য অকাতরে জীবন উৎসর্গ করেছেন। আর জোহরের প্রচণ্ড তাপদাহে মহান আল্লাহ্ তাঁর হাবিবের মহব্বতের ফায়েজের এ রহমতি দরজা খুলে দেওয়ার কারণে, যারা নামাজ ও নামাজ পরবর্তীতে মোরাকাবা করে ফায়েজ লাভ করতে পারে, তাদের হৃদয় পরম প্রশান্তিতে ভরে ওঠে। ফলে জোহরের সময় জাহান্নামের অংশ যে প্রচণ্ড তাপদাহ, এ কঠিন সময় তাদের জন্য কোনই কষ্টের কারণ হয় না, বরং হযরত রাসুল (সা.)-এর মহব্বতের ফায়েজ মু’মিন ব্যক্তির দেহমন প্রশান্ত করে দেয়। এজন্যই ইতঃপূর্বে উল্লিখিত হাদিস থেকে দেখা যায়, জোহরের নামাজ আদায়কারীর জন্য জাহান্নাম হারামের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। আসলে হযরত রাসুল (সা.)-কে ভালোবেসে তাঁর প্রেমে ডুবে সুন্নত নামাজ আদায় করলে রাসুল (সা.)-এর মহব্বতের ফায়েজ অর্জিত হয়। এর ফলে জাহান্নামের তাপদাহ মু’মিন ব্যক্তিকে স্পর্শ করতে পারে না। এ সময় মহান আল্লাহ্ তাঁর শ্রেষ্ঠ হাবিব হযরত রাসুল (সা.)-এর মহব্বতের ফায়েজের দ্বার উন্মুক্ত করেন, যে কারণে হাদিস শরীফে তুফতাহু ফীহা আবওয়াবুস সামাই’ অর্থাৎ ‘এতে ঊর্ধ্বলোকের রহমতের দরজা খোলা হয়’ মর্মে সুসংবাদ দেওয়া হয়েছে। আর এটিই জোহরের নামাজ ফরজ হওয়ার রহস্য ও ফজিলত।


আসরের নামাজের ফজিলত
হযরত জাবীর ইবনে আবদুল্লাহ্ (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন, একদা আমরা আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর সহবতে উপস্থিত ছিলাম। অতঃপর- “আল্লাহর রাসুল (সা.) রাতে চাঁদের দিকে লক্ষ্য করলেন এবং বললেন- অচিরেই তোমরা অবশ্যই তোমাদের প্রতিপালককে দেখতে পাবে, যেমনিভাবে এ চাঁদকে দেখছ। আর এটি দেখতে তোমাদের কোনো অসুবিধা হবে না। সুতরাং যদি তোমরা সূর্যোদয়ের পূর্বে এবং সূর্যাস্তের পূর্বে সালাত আদায় করতে সক্ষম হও, তবে তা আদায় করে নাও। অতঃপর তিনি কুরআনের এ আয়াত পাঠ করেন। আল্লাহ্ বলেন- ‘হে রাসুল (সা.)! আপনি আপনার প্রতিপালকের স্বপ্রশংস তাসবিহ পাঠ করুন, সূর্যোদয়ের পূর্বে (ফজর) এবং সূর্যাস্তের পূর্বে (আসর)।’ ইমাম ইসমাঈল আল-বোখারী (রহ.) বলেন- হে মুসলমানগণ এ কাজটি তোমরা করো, যেন কোনোভাবেই তা বাদ না পড়ে।” (বোখারী শরীফ, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৭৮ ও ৭৯ এবং ই.ফা.বা. কর্তৃক অনুদিত বোখারী শরীফ ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-১৭, হাদিস নং ৫২৭; মুসলিম শরীফ ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২২৮ ও ই.ফা.বা. কর্তৃক অনূদিত মুসলিম শরীফ ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ১১৬, হাদিস নং ১৩০৯; তিরমিযী শরীফ ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৮২ ও ই.ফা.বা. কর্তৃক অনূদিত তিরমিযী শরীফ-৫ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪০, হাদিস নং ২৫৫৩ এবং সুনানে আবু দাউদ শরীফ ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৬৫০, ও ই.ফা.বা. কর্তৃক অনূদিত আবু দাউদ শরীফ ৫ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪৩৬, হাদিস নং ৪৬৫৪)
হযরত আবু বকর ইবনে উমারা ইবনে রুবাইয়া (রা.) তার পিতার সূত্রে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ্ (সা.)-কে বলতে শুনেছি, আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেন- “যে ব্যক্তি সূর্যোদয়ের পূর্বে এবং সূর্যাস্তের পূর্বে সালাত আদায় করবে অর্থাৎ ফজর ও আসরের সালাত আদায় করবে, সে কখনো জাহান্নামে প্রবেশ করবে না।” (মুসলিম শরীফ, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২২৮ ও ই.ফা.বা. কর্তৃক অনূদিত মুসলিম শরীফ ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ১১৬ ও ১১৭, হাদিস নং ১৩১১; আবু দাউদ শরীফ ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৬১ ও ৬২ এবং ই.ফা.বা. কর্তৃক অনূদিত আবু দাউদ শরীফ ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৩৮ এবং মেশকাত শরীফ, পৃষ্ঠা ৬২)
এভাবেই হাদিস শরীফে আসরের নামাজের গুরুত্ব, প্রয়োজনীয়তা ও ফজিলত উপস্থাপিত হয়েছে। এ নামাজের মাধ্যমেই বান্দা নিজেকে আল্লাহর দিদার লাভের যোগ্য করে গড়ে তুলতে পারে।
উল্লিখিত হাদিসসমূহে পূর্ণিমার চাঁদের ন্যায় স্পষ্টভাবে মহান আল্লাহর চেহারা মোবারকের দিদার লাভ করে ধন্য হলে ফজরের নামাজের গুরুত্বের ন্যায় আসরের নামাজও গুরুত্বের সাথে আদায়ের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
আর এ কারণে, আসরের নামাজে পরম করুণাময় আল্লাহ্ নামাজ আদায়কারীর অন্তরে তওবার ফায়েজ নাজিল করেন। আর তওবার ফায়েজ ওয়ারিদ হয় আসরের সময় থেকে মাগরিবের নামাজের শেষ সময় পর্যন্ত। এজন্য আসরের নামাজ আদায়কারীকে মহান আল্লাহ্ তওবার ফায়েজ পুরস্কার হিসেবে দান করেন। এ ফায়েজ দ্বারা মানুষের আত্মার গুনাহর ময়লা, গুনাহর পাহাড়, গুনাহর জুলমত (পাপ কালিমা) অর্থাৎ সর্ব প্রকার গুনাহ্ মাফ হয়। এ ফায়েজ দ্বারাই বান্দা আল্লাহর নৈকট্য লাভ করে। অর্থাৎ অসহায় সন্তান যখন কৃত অপরাধ স্বীকার করে, পিতামাতার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে এবং সান্নিধ্য লাভের জন্য ব্যাকুল-বেকারার হয়ে ওঠে, তখন পিতামাতা তাদের দয়ার কারণে আর দূরে থাকতে পারে না, বরং সন্তানের সামনে হাজির হয়ে তার তাপিত হৃদয়ের কষ্ট মুছে দিয়ে পুনরায় কাছে টেনে নেয়। তদ্রুপ আসর ওয়াক্তে তওবার ফায়েজ নাজিল হওয়ায় আসরের নামাজ আদায়কারী ব্যক্তি আপন হৃদয়ে এ ফায়েজ লাভ করে। আর তওবার ফায়েজ দ্বারা মহান আল্লাহ্ বান্দার গুনাহ-খাতা সাফ করে তাদেরকে যেমন পবিত্র করেন, তেমনি তাদেরকে নিজের দিদার দানের জন্য মনোনীত করেন। আর এরূপ লোকেরাই শীঘ্রই আল্লাহকে পূর্ণিমার চাঁদের ন্যায় দেখবে বলে হযরত রাসুল (সা.) ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন। সুতরাং এটিই আসরের নামাজ ফরজ হওয়ার রহস্য ও ফজিলত।


মাগরিবের নামাজের ফজিলত
হযরত আবু আইউব (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেন- “আমার উম্মত ততদিন কল্যাণজনক অবস্থায় থাকবে, যতদিন তারা মাগরিবের নামাজ বিলম্ব করে আদায় না করে সময় মতো আদায় করবে।” (আবু দাউদ শরীফ ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৬০ এবং ই.ফা.বা. কর্তৃক অনূদিত, আবু দাউদ শরীফ ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৩২ ও ২৩৩, হাদিস নং ৪১৮১)
হাদিস শরীফের এ বাণী মোবারকে মাগরিবের নামাজ যথাসময়ে আদায়কারীর জন্য সুসংবাদ দেওয়া হয়েছে যে, সে সকল সময়ে কল্যাণ লাভ করবে অর্থাৎ সত্য ধর্মের উপর সে প্রতিষ্ঠিত থাকবে। আর এ সুসংবাদ দেওয়া হয়েছে, যেহেতু মহান আল্লাহ্ মাগরিবের সময় তওবা কবুলিয়াতের ফায়েজ নাজিল করেন।
সুফিদের বর্ণনা হতে জানা যায়, হযরত আদম (আ.)-কে যেদিন মহান আল্লাহ্ ক্ষমা করেছিলেন, সেদিন তিনি আসরের সময় হযরত রাসুল (সা.)-এর অসিলা ধরে আল্লাহর কাছে তওবা করেছিলেন, অতঃপর মহান আল্লাহ্ মাগরিবের সময় তাকে তওবা কবুলের সুসংবাদ দেন। আর এ সময় তিনি আপন ক্বালবে তওবা কবুলিয়াতের ফায়েজে সিক্ত হয়ে পরম প্রশান্তি লাভ করেন। আর এজন্যই মহান আল্লাহ্ আদম সন্তান তথা মানুষের জন্য আসরের নামাজের সময় থেকে মাগরিবের নামাজের সময় শেষ হওয়া পর্যন্ত তওবার ফায়েজ এবং তওবা কবুলিয়াতের ফায়েজ নাজিল করেন। এজন্য মোর্শেদের শিক্ষা অনুযায়ী হুজুরি দিলে মাগরিবের নামাজ আদায় করতে পারলে, মুরিদ নামাজে তওবা কবুলিয়াতের ফায়েজ স্বীয় ক্বালবে লাভ করে, পাশাপাশি নামাজ শেষ করে মোর্শেদের দেওয়া ওয়াজিফা অনুযায়ী মোরাকাবা করেও তওবা কবুলিয়াতের ফায়েজ অর্জন করে নিতে হয়। এ ফায়েজ ক্বালবে ওয়ারিদ হলে দিলের জাহের বাতেন সত্তর হাজার পর্দার ভেতরে যত প্রকার গুনাহর ময়লা, গুনাহর জুলমত, গুনাহর পাহাড় অর্থাৎ সকল প্রকার গুনাহ মাফ করে দিল সাফ হয়ে যায়। এজন্যই হাদিস শরীফে মাগরিবের নামাজ আদায়কারী উম্মতে মোহাম্মদী সর্বদা কল্যাণের মধ্যে থাকবে, মর্মে সুসংবাদ দেওয়া হয়েছে। একইভাবে মাগরিবের নামাজ আদায়কারী সর্বদা সত্য ধর্মের উপর সুপ্রতিষ্ঠিত থাকবে বলে আল্লাহর রাসুল (সা.) জানিয়ে দিয়েছেন। তওবা কবুলিয়াতের ফায়েজের মাধ্যমে এ সুসংবাদ লাভ করা যায়। কেননা বান্দা যখন অনুতপ্ত হয়ে তওবা করে, অতঃপর মহান আল্লাহ্ বান্দাকে ক্ষমা করেন, তখন আল্লাহ্ ও বান্দার মাঝে আর কোনো দূরত্ব থাকে না।
যেমন- খোলা আকাশের নিচে অবস্থানকারী কোনো ব্যক্তির সূর্যের তাপ বা আলো পেতে কোনো বাধা থাকে না, একইভাবে তওবার মাধ্যমে বান্দা যখন পাপের দেওয়াল চূর্ণ করে ফেলে, তখন সরাসরি আল্লাহর আলো ক্বালবের মাঝে এসে পতিত হয়। এ কাজ নিয়মিত করতে পারলে বান্দা সর্বদাই আল্লাহর নুর দ্বারা নিজেকে আলোকিত করে, সত্য ধর্মের উপর সুপ্রতিষ্ঠিত রাখতে পারে। আর এটিই মাগরিবের নামাজ ফরজ হওয়ার রহস্য ও ফজিলত।


এশার নামাজের ফজিলত
হযরত আবু হুরায়রাহ (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেন- “মুনাফিকদের নিকট ফজর ও এশার নামাজ অত্যন্ত ভারী বা কঠিন মনে হয়ে থাকে। যদি তারা জানতো যে এ দু’ নামাজে কী ফজিলত রয়েছে, তবে তারা হামাগুড়ি দিয়ে হলেও এ দুই নামাজে উপস্থিত হতো।” (বোখারী ও মুসলিমের সূত্রে মেশকাত শরীফ, পৃষ্ঠা ৬২)
হযরত উসমান (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন- আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেন- “যে ব্যক্তি এশার নামাজ জামাতের সাথে আদায় করেছে, সে যেন অর্ধরাত পর্যন্ত ইবাদতে দণ্ডায়মান রয়েছে।” (মুসলিমের সূত্রে মেশকাত শরীফ, পৃষ্ঠা ৬২)
হাদিস শরীফের এ বাণী মোবারকসমূহে এশার নামাজের গুরুত্ব, সময় ও ফজিলত উপস্থাপিত হয়েছে। এশার নামাজই মু’মিন ব্যক্তিকে কুফরির চেয়েও ধ্বংসাত্মক যে মুনাফিক চরিত্র সে নিফাকের পাপ থেকে মুক্ত করে এবং নির্ভেজাল খাঁটি মু’মিনরূপে গড়ে তোলে। আর এর কারণ, এশার নামাজে মহান আল্লাহ্ তাঁর বান্দাদেরকে একটি বিশেষ পুরস্কার দিয়ে থাকেন, সেটি হলো গাইরিয়াতের ফায়েজ। এ ফায়েজ সদাসর্বদা ওয়ারিদ হলেও এশার নামাজের পূর্ব থেকে রহমতের সময়ের পূর্ব পর্যন্ত এ ফায়েজের শক্তি বেশি থাকে।
গাইরিয়াতের আভিধানিক অর্থ শরম বা লজ্জা। এটি একটি সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম শক্তি বিশেষ। এ শক্তি পূর্ণরূপে হাসিল করতে পারলে, মানুষ আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কারো নিকট কোন কিছুর আশা বা আকাঙ্ক্ষা করতে লজ্জা অনুভব করে। মোর্শেদের শিক্ষা অনুযায়ী হুজুরি দিলে এশার নামাজ আদায় করতে পারলে, নামাজের ভেতরেই নিজ নিজ ক্বালবে এ ফায়েজ উপলব্ধি করা যায়। অতঃপর নামাজ শেষে মোর্শেদের দেওয়া ওয়াজিফা অনুযায়ী মোরাকাবা করে, এ ফায়েজ ভালোভাবে হাসিল করে নিতে হয়। এ ফায়েজ নামাজ বা মোরাকাবার মাধ্যমে অর্জন করে নিতে পারলে নফ্সের কুখায়েশ, কুধ্যান, জাদু, টোনা, জিন-ভূতের আছর, তকদিরের দুরবস্থা, হায়াতের ফাঁড়া, বুদ্ধির স্বল্পতা, প্রভৃতি খারাবি ধ্বংস হয়ে সিজ্জিন জাহান্নামে দফা হয় এবং ক্বালব বা দিল সাফ হয়। এমননিভাবে এ ফায়েজ দ্বারা রোগশোক ও বালা-মুসিবত দূর হয়। এ ফায়েজ অর্জিত হলে অন্তরের কুফরি ধ্যানধারণা, মুনাফিকি চিন্তাচেতনা, আল্লাহ্ ও রাসুল বিরোধী সকল কুবাসনা দিল থেকে বিলুপ্ত হয়ে যায়। আর এজন্যই এ নামাজ মুনাফিকদের জন্য আদায় করা অত্যন্ত কঠিন বলে হাদিসে উল্লেখ করা হয়েছে।
এত সকল আত্মিক রোগের প্রতিষেধক এ গাইরিয়াতের ফায়েজে নিহিত থাকার কারণেই আল্লাহর রাসুল (সা.) হামাগুড়ি দিয়ে হলেও এশার নামাজে হাজির হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। অর্থাৎ কোনো ক্রমেই যেন এ নামাজ বাদ না পড়ে।
এমনিভাবে গাইরিয়াতের এ ফায়েজ দ্বারা কিল্লাও করা যায়। মোর্শেদের শিক্ষা অনুযায়ী ফায়েজের কিল্লা করে নিতে পারলে সারা রাত আল্লাহর হেফাজতে থাকা যায়, যেমনিভাবে কুয়্যাতে এলাহিয়ার ফায়েজ দ্বারা কিল্লা করে নিতে পারলে, সারা দিন আল্লাহর হেফাজতে থাকা যায়। আর গাইরিয়াতের ফায়েজের কিল্লার ফলে বান, জাদুটোনা, জিন-ভূতের তাছির ও যাবতীয় বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। আসলে এটিই এশার নামাজ ফরজ হওয়ার রহস্য ও ফজিলত।
আপনারা একে একে পাঁচ ওয়াক্ত ফরজ নামাজের বিধান, একইভাবে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ হওয়ার ঘটনা এবং পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের অবারিত ও অফুরন্ত ফজিলত অবগত হলেন। মহান আল্লাহ্ ও তাঁর রাসুল (সা.)-এর বাণী মোবারক এবং আমার সাধনালব্ধ এলমে মারেফতের নিগূঢ় রহস্যে বিষয়টি সুস্পষ্ট হয়েছে যে, নামাজ মানুষকে সকল প্রকার পাপ থেকে রক্ষা করে কীভাবে আদর্শ চরিত্রবান মু’মিনরূপে গড়ে তোলে। আর পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের মাধ্যমেই আল্লাহর কাছ থেকে পাঁচটি ফায়েজ পুরস্কারস্বরূপ কীভাবে লাভ করা যায়, অতঃপর নামাজেই মু’মিন ব্যক্তি কীভাবে আল্লাহর সাথে মি’রাজ লাভ করে এবং কীভাবে আল্লাহর সাথে বান্দার যোগাযোগ স্থাপিত হয়। আর এজন্যই আল্লাহর রাসুল (সা.) পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ সম্পর্কে এরশাদ করেন- “আচ্ছা তোমাদের কারো বাড়ির সামনে যদি একটি গভীর প্রবাহমান নদী থাকে, আর সে প্রতিদিন পাঁচ বার তাতে গোসল করে, তবে কি তার শরীরে কোনোরূপ ময়লা থাকতে পারে? উপস্থিত সাহাবায়ে কেরাম জবাব দিলেন- ইয়া রাসুলাল্লাহ (সা.)! না, এতে কোনই ময়লা থাকবে না। অতঃপর হযরত রাসুল (সা.) এরশাদ করেন- পাঁচ ওয়াক্ত নামাজও এরূপই, মহান আল্লাহ্ নামাজ (কবুলিয়াতের ফায়েজ) দ্বারা বান্দার সকল পাপ ও ভুল-ত্রুটি ধুয়েমুছে পরিস্কার করে দেন। (মুসলিম শরীফের সূত্রে তাফসীরে ইবনে কাছীর ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৬৬৭)
তাহলে আসুন, রাহমাতুল্লিল আলামিন হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর রেখে যাওয়া শান্তি ও মুক্তির ধর্ম মোহাম্মদী ইসলামের সুমহান শিক্ষা অনুযায়ী আমরা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ কায়েম করি। অতঃপর নিজেদেরকে আদর্শ মু’মিনরূপে গড়ে তুলি। আর মু’মিনের অভিভাবক মহান আল্লাহ্ নিজেই। আল্লাহ্ যার অভিভাবক হয়ে যান, ইহকাল ও পরকালে তার কোনো ইচ্ছাই অপূর্ণ থাকে না। হে আল্লাহ্! আপনি আমাদের জন্য আপনার রহমতের দ্বার খুলে দিন।
[লেখক: দেওয়ানবাগ শরীফের প্রতিষ্ঠাতা]

সম্পর্কিত পোস্ট