বীর মুক্তিযোদ্ধা সূফী সম্রাট হযরত দেওয়ানবাগী (রহ.)
ড. জাহাঙ্গীর আলম
অলী আরবি শব্দ, যার অর্থ বন্ধু। অলীর বহুবচন হলো আউলিয়া তথা আল্লাহর বন্ধুগণ। অলী-আল্লাহর সাথে আল্লাহর সম্পর্ক বা যোগাযোগ থাকার কারণে তাঁদেরকে বলা হয় অলী-আল্লাহ্। তাইতো বলা হয়েছে অলী-আল্লাহ্ কখনো আল্লাহ্ নয়, কিন্তু আল্লাহ্ থেকে পৃথকও নয়।
রাহ্মাতুল্লিল আলামিন হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর মাধ্যমে নবুয়তের যুগের পরিসমাপ্তি হয়। বর্তমান যুগ বেলায়েতের যুগ বা বন্ধুত্বের যুগ। এই যুগের মুক্তির কাণ্ডারী ও আলোর দিশারি হলেন অলী-আল্লাহ্গণ। এই প্রসঙ্গে হযরত রাসুল (সা.) বলেন, “আমার উম্মতের মধ্যে যারা আলেম তথা আল্লাহ্র পরিচয় লাভকারী অলী-আল্লাহ্, তাঁরা বনি ইসরাইলের নবিগণের মতো। (তাফসীরে রুহুল বয়ান ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৪৮)
সৃষ্টির আদি থেকে অদ্যাবধি আল্লাহ্কে পাওয়ার জন্য যাবতীয় পাপাচার, কামাচার, ব্যভিচার, জুলুম, অত্যাচার থেকে বিরত থেকে উত্তম চরিত্র গঠনের জন্য মানুষকে নবুয়তের যুগে নবি-রাসুল এবং বেলায়েতের যুগে অলী-আল্লাহ্গণের সান্নিধ্যে গমন করতে হয়। অলী-আল্লাহগণ জগতের মাঝে রহমতস্বরূপ আগমন করেন।
জগতে অসংখ্য অলী-আল্লাহর আগমন ঘটেছে- তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য গাউসে পাক হযরত মহিউদ্দিন আব্দুল কাদের জিলানি (রহ.), গরিবে নেওয়াজ হযরত খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি (রহ.), মাহবুবে সোবহানি হযরত মোজাদ্দেদ আলফেসানি (রহ.), সুলতানুল আরেফিন হযরত বাহাউদ্দিন নকশবন্দ (রহ.), ইমাম সৈয়দ আবুল ফজল সুলতান আহমদ (রহ.)। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৪৯ সালের ১৪ই ডিসেম্বর, ১৩৫৬ বঙ্গাব্দের ২৭শে অগ্রহায়ণ বুধবার সকাল ১০ ঘটিকায় এই ধূলির ধরায় আগমন করেন, আল্লাহর প্রিয় বন্ধু, শান্তির দূত, মানবজাতির মুক্তির কাণ্ডারী সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহ্বুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (রহ.) হুজুর কেব্লাজান। তিনি একজন শ্রেষ্ঠ সংস্কারক ছিলেন। যাঁর বহু সংস্কার আন্তর্জাতিকভাবে সমাদৃত এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে গৃহীত হয়েছে। তিনি ছিলেন জাতির সূর্য সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধা রণাঙ্গনের বীর সেনানী। তিনি ১৯৭১ সালের ১১ই এপ্রিল মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেন। জীবন বাজি রেখে তিনি দেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন কোনো এক আক্রমণে তাঁর সহযোদ্ধারা ধরে নিয়েছে তিনি মারা গেছেন। কিন্তু না, তিনি দেশকে পরশক্তির আক্রমণ থেকে রক্ষা করে, জন্মভূমিকে স্বাধীন করে তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।
মুক্তিযুদ্ধের হাজারো স্মৃতির সাথে একদিনের একটি ঘটনার বর্ণনা দিয়ে সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান এক সাপ্তাহিক আশেকে রাসুল (সা.) মাহ্ফিলে বলেন, “দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সূফী সম্রাট হুজুর কেবলা ৩নং সেক্টর হেডকোয়ার্টার যান। ৩নং সেক্টরের হেড কোয়ার্টার ছিল পিলখানায়। কিছুদিন পর সেক্টর হেডকোয়ার্টার পিলখানা হতে কচুক্ষেতে স্থানান্তর করা হয়। সূফী সম্রাট হুজুর কেব্লা কোয়ার্টার মাস্টার হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন। কচুক্ষেতে আর্মি কোয়ার্টারে থাকাকালীন ৩নং সেক্টর ও ১১নং সেক্টরের সমন্বয়ে ১৬নং বেঙ্গল রেজিমেন্ট গঠিত হয়। মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনকে তিনটি বিগ্রেড ফোর্সে বিভক্ত করা হয়। ফোর্সের নামকরণ করা হয় ব্রিগেডগুলোর অধিনায়কদের নামের প্রথম অক্ষর দিয়ে। যথা: মেজর খালেদ মোশারফ ‘কে’ ফোর্সের অধিনায়ক, মেজর কে এম শফিউল্লাহ ‘এস’ ফোর্স এর অধিনায়ক এবং মেজর জিয়াউর রহমান ‘জেড’ ফোর্সের অধিনায়ক। (অক্ষরের ক্রমানুসারে ফোর্সের নাম লেখা হয়েছে)
কচুক্ষেত ক্যান্টনমেন্টে থাকাকালীন স্বাধীন বাংলার মুক্ত বাতাসে একদিন ফজরের নামাজের পর সূফী সম্রাট হুজুর কেবলা প্রাতর্ভ্রমণে বের হলেন। এমন সময় এস ফোর্সের ও ৩নং সেক্টরের প্রাক্তন অধিনায়ক বাংলাদেশের নতুন সেনাপ্রধান জেনারেল শফিউল্লাহ গাড়ি নিয়ে সৈনিকদের খোঁজ খবর নিতে বের হলেন। পথিমধ্যে তিনি সূফী সম্রাট হুজুর কেব্লাকে দেখে গাড়ি থামিয়ে, গাড়ি থেকে নেমে সূফী সম্রাটের সাথে কুশল বিনিময় করলেন। সূফী সম্রাট হুজুর কেবলা তাঁর অধীনে মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন। ৩নং সেক্টর হেডকোয়ার্টারে থাকাকালীন মেজর শফিউল্লাহ সাহেবের সাথে সূফী সম্রাট হুজুর কেবলার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। সূফী সম্রাট হুজুর কেবলা কথা প্রসঙ্গে জেনারেল শফিউল্লাহ সাহেবকে বললেন, এতদিন দেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছি, দেশ এখন স্বাধীন, মুক্ত। আমাকে ছেড়ে দিন। আমি আমার পূর্বের জায়গায় ফিরে যাই। আমি তো একজন আলেম মানুষ। ধর্মচর্চা ও শিক্ষা দেওয়া আমার কাজ। একথা শুনে মেজর শফিউল্লাহ সাহেব বললেন-হুজুর! মুক্তিযুদ্ধে আপনার অনেক অবদান রয়েছে। আমরা আপনাকে ছাড়বো না। আপনি আমাদের সাথে থাকবেন। আমি এখনই ১৬ বেঙ্গল রেজিমেন্টের সিও মেজর হাসমতকে বলে দিচ্ছি- আজই যেন আপনাকে ‘রিলিজিয়াস টিচার’ হিসেবে নিয়োগ দিয়ে দেয়।
এই বলে জেনারেল সফিউল্লাহ চলে গেলেন। ওই দিন বেলা ১২টায় মেজর হাসমত সাহেব সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাকে তার অফিসে ডেকে এনে ১৬ বেঙ্গলের রিলিজিয়াস টিচার হিসেবে নিয়োগ দেন।
মহান আল্লাহর প্রিয় হাবিব হযরত মোহাম্মদ (সা.) বলেন- “আনা বুইস্তু মুআল্লিমান।” অর্থাৎ- আমি জগতে শিক্ষকরূপে প্রেরিত হয়েছি। হযরত মোহাম্মদ (সা.) একজন শিক্ষকরূপে জগতে আগমন করেছিলেন। তিনি মানুষ, সমাজ ও জাতিকে শিক্ষা দিয়েছিলেন, যে শিক্ষা গ্রহণ করে বর্বর আরবজাতি নানাপ্রকার পাপ, পঙ্কিলতা, মানুষ হত্যা, অত্যাচার, জুলুম, নির্যাতনের পথ ছেড়ে দিয়ে শান্তির পথে আসে। তাঁর সংস্পর্শে এসে শিক্ষা গ্রহণ করে বর্বর আরবজাতি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাতিতে পরিণত হয়েছিলেন। ঠিক তেমনি হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর সুযোগ্য উত্তরসূরি সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজানও একজন শিক্ষক হিসেবে জগতে সুপরিচিত ছিলেন। সূফী সম্রাট হুজুর কেবলার সুযোগ্য উত্তরসূরি, সিরাজাম মুনিরার ধারক ও বাহক ইমাম প্রফেসর ড. কুদরত এ খোদা (মা. আ.) হুজুর একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বনামধন্য শিক্ষক হিসেবে আমাদের মাঝে সুপরিচিত।
সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান একজন জাগতিক ও আধ্যাত্মিক শিক্ষক ছিলেন। ছাত্রজীবনেও তাঁর বীরত্ব ও সুদৃঢ় নেতৃত্বের পরিচয় পাওয়া যায়। মুক্তিযুদ্ধের সময় সৈনিকদের তিনি শপথ বাক্য পাঠ করাতেন। যুদ্ধ পরবর্তীতে সেনাবাহিনীর রিলিজিয়াস টিচার হিসেবে যোগদান করেন। আমাদের সমাজে রিলিজিয়াস টিচার হওয়ার যোগ্যতা সকল আলেমদের হয় না। অপরদিকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস হতে আমরা জানতে পেরেছি যে, বাংলার আলেম সমাজের বেশিরভাগই মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে ছিলেন। একজন আলেম হিসেবে সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজানই একজন ব্যতিক্রমধর্মী মহামানব ছিলেন। যিনি অস্ত্র হাতে নিজের জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করে বাংলার বিজয় ছিনিয়ে এনেছেন। তিনি ছিলেন দেশের স্বাধীনতার বিজয়ের ভবিষ্যদ্বাণী প্রদানকারী মহামানব।
রিলিজিয়াস টিচার হওয়ার পর তিনি সার্বক্ষণিক চিন্তা করতেন দেশ শত্রুমুক্ত করে স্বাধীন করলাম, এখন একজন মানুষকে কীভাবে অন্যায় অত্যাচার ও অবিচার থেকে মুক্ত করে আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা যায়, কীভাবে সৎ চরিত্রের অধিকারী করে আলোকিত মানুষে রূপান্তরিত করা যায়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৪ সালের ২রা ফেব্রুয়ারি চন্দ্রপাড়া দরবার শরীফে ইমাম সৈয়দ আবুল ফজল সুলতান আহমেদ (রহ.)-এর সান্নিধ্য লাভ করেন। শুরু করেন মানব মুক্তির কাজ এবং মোহাম্মদী ইসলামের পুনর্জাগরণ। তিনি সমাজের অসংখ্য অসংগতি শুধু দূরই করেননি, পাশাপাশি শতাধিক ধর্মীয় সংস্কারও করেন। নামাজ, রোজা ও হজের মতো গুরুত্বপূর্ণ ফরজ ইবাদতের হাকিকত উদ্ভাবন করেছেন। লক্ষ লক্ষ মুসলমান তাঁর শিক্ষা পদ্ধতিতে ইবাদত বন্দেগি করে যাবতীয় পাপ ও অন্যায়-অপরাধ হতে দূরে সরে উত্তম চরিত্র গঠন করতে সক্ষম হয়েছে।
সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজানের শিক্ষা লাভ করে লক্ষ লক্ষ মানুষ হযরত রাসুল (সা.)-এর দিদার ও মহান প্রভুর দর্শন লাভ করেছে। তিনি ইসলামের মূল শিক্ষা এলমে তাসাউফ পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করেন। শিরক মুক্তভাবে কীভাবে কোরবানি করা যায় এবং জমির দলিল লিখা যায়, তা সংস্কার করেছেন। রবিবারের পরিবর্তে শুক্রবারে সাপ্তাহিক ছুটি, পবিত্র আশুরা ও ঈদে মিলাদুন্নবি (সা.)-এর মতো গুরুত্বপূর্ণ ও মর্যাদাবান অনুষ্ঠান রাষ্ট্রীয়ভাবে পালনের ব্যবস্থা করেছেন সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান। এই মহামানবের সত্য ও সুমহান শিক্ষা পদ্ধতি অনুসরণ করে লক্ষ লক্ষ মানুষ ব্যক্তিজীবন, সামাজিক ও পারিবারিক জীবনে সুখ শান্তি ও কল্যাণ লাভ করেছে।
সূফী সম্রাট হুজুর কেব্লাজান ৭১ বছর হায়াতে জিন্দেগিতে ৩ কোটি আশেক, জাকের, ভক্ত ও মুরিদ সন্তান সৃষ্টি করে ২০২০ সালের ২৮শে ডিসেম্বর দারুল বাকায় তাশরিফ নেন। ডিসেম্বর মাস সূফী সম্রাট হুজুর কেবলার আশেকদের নিকট যেমনি আনন্দের তেমনি দুঃখের ও শোকের মাস। ১৪ই ডিসেম্বর হুজুর কেবলার শুভ জন্মদিন, ১৬ই ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবস ও মোজাদ্দেদিয়াত লাভের দিবস এবং ২৮শে ডিসেম্বর হুজুর কেব্লার ওফাত দিবস। মহান বিজয়ের এই মাসে জাতির বীর মুক্তিযোদ্ধা সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহ্বুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (রহ.)-এর প্রতি রইল বিনম্র শ্রদ্ধা ও গভীর ভালোবাসা।
ডিসেম্বর মাসের গুরুত্ব ও তাৎপর্য উপলব্ধি করে সূফী সম্রাট হুজুর কেবলার সুযোগ্য উত্তরসূরি, সিরাজুম মুনিরার ধারক ও বাহক মোহাম্মদী ইসলামের নেতৃত্ব প্রদানকারী মহামানব, ইমাম প্রফেসর ড. কুদরত এ খোদা (মা. আ.) হুজুর তাঁর মোর্শেদের শুভ জন্মদিনকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে দেওয়ানবাগ শরীফের সর্ববৃহৎ অনুষ্ঠান বিশ্ব আশেকে রাসুল (সা.) সম্মেলনের আহ্বান করেন। এই মহামানবের আহবানে সাড়া দিয়ে গোটা বিশ্বের আশেকে রাসুলগণ এই মহামিলন মেলায় ছুটে আসার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছেন। মহান রাব্বুল আলামিনের নিকট ফরিয়াদ, আমরা যেন দেওয়ানবাগ শরীফের শ্রেষ্ঠ আয়োজন ২৩শে ডিসেম্বর তারিখের বিশ্ব আশেকে রাসুল (সা.) সম্মেলনে গোলামি করে অশেষ ফায়েজ, বরকত ও রহমত লাভ করতে পারি।
[লেখক: ইসলামি গবেষক]