শান্তি লাভে ধর্ম পালনের গুরুত্ব
ড. সাইফুল ইসলাম
এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে সৃষ্টিকর্তার যত সৃষ্টি আছে, প্রতিটি সৃষ্টিই নির্দিষ্ট নিয়মের মধ্যে পরিচালিত হয়। যে যেই নিয়মে পরিচালিত হচ্ছে সেটাই তার ধর্ম। ধর্ম শব্দটি বিশ্লেষণ করলে দাঁড়ায় ধৃ+মন=ধর্ম, ধৃ মূল শব্দ, মন হলো প্রত্যয়। ধৃ শব্দের অর্থ ধারণ করা। যে যা ধারণ করে তা-ই ধর্ম। জগতে যত মহামানবের আগমন ঘটেছে প্রত্যেক মহামানবই ঐশ্বরিক বাণী প্রচার করেছেন। যিনি যে মহামানবের ঐশ্বরিক বাণী ধারণ করেছেন, তিনি সেই ধর্মের অনুসারী। ইসলাম ধর্মে শান্তিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এটি ইসলাম ধর্মের অন্যতম মূলনীতি। আল্লাহর রাসুল (সা.) তাঁর প্রচারিত ইসলাম ধর্মে আল্লাহ্র নির্দেশে মানবজাতিকে এ শান্তির বার্তাই দিয়েছেন। ইসলাম শব্দটি ‘সালাম’ ও ‘সিলম’ শব্দ থেকে এসেছে; যেগুলোর অর্থ যথাক্রমে ‘শান্তি’ এবং ‘আত্মসমর্পণ’। ‘ইসলাম’ শব্দটির মূলেই রয়েছে শান্তি। পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি করা কখনোই ইসলাম সমর্থিত নয়।
মহান আল্লাহ্ পবিত্র কুরআনে সূরা বাকারার ২০৫নং আয়াতে বলেন, “যখন সে প্রস্থান করে, তখন সে পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি করে এবং শস্যক্ষেত্র ও জীবজন্তু নিপাতের চেষ্টা করে। আর আল্লাহ্ অশান্তি পছন্দ করেন না।” অন্য এক জায়গায় মহান আল্লাহ্ আরও বলেন, “দুনিয়ায় শান্তি স্থাপনের পর তোমরা তাতে বিপর্যয় ঘটিয়ো না। তাঁকে ভয় ও আশার সহিত ডাকবে। নিশ্চয়ই আল্লাহর অনুগ্রহ সৎকর্মপরায়ণদের নিকটবর্তী।” (সূরা আ‘রাফ ৭: আয়াত ৫৬) সূরা বাকারার ১১নং আয়াতে শান্তির পক্ষে আল্লাহ্ বলেন, “তোমরা পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি করো না।”
উল্লিখিত আয়াতসমূহ থেকে শান্তির পথে জীবন পরিচালনায় মহান আল্লাহর নির্দেশনা স্পষ্টভাবে প্রকাশ পেয়েছে। শান্তি লাভ করা আমাদের মুখ্য উদ্দেশ্য হলেও স্রষ্টা থেকে বিমুখ হওয়ার কারণে আমরা সেই কাঙ্খিত শান্তি লাভে ব্যর্থ হচ্ছি। আত্মিক শান্তি লাভে ধর্মীয় গুরুত্ব সম্পর্কিত আলোচনা করা হলো-
আল্লাহর প্রতি পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণ
হৃদয়ে শান্তি লাভের প্রধান শর্তই হচ্ছে আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আত্মসমর্পণ। এ আত্মসমর্পণের গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে মহান আল্লাহ্ বলেন, “হে রাসুল (সা.)! আপনি বলে দিন আমি তো আত্মসমর্পণ করেছি আল্লাহর কাছে এবং আমাকে যারা অনুসরণ করে, তারাও। আর যাদের কিতাব দেওয়া হয়েছে, তাদের এবং নিরক্ষরদের বলুন-তোমরাও কি আত্মসমর্পণ করেছ? যদি তারা আত্মসমর্পণ করে, তবে অবশ্যই তারাও সরল সঠিক পথ পাবে। কিন্তু যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে আপনার দায়িত্ব কেবল তা শুধু পৌঁছে দেওয়া। আর আল্লাহ্ তার বান্দাদের সম্যক দ্রষ্টা।” (সূরা আলে ইমরান ৩: আয়াত ২০) বর্তমান সময়ের মানুষ ষড়রিপুর তাড়নায় আল্লাহর উপর আত্মসমর্পণের পরিবর্তে আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে। তারা আল্লাহর নির্দেশিত পথকে উপেক্ষা করে, নিজেদের মনগড়া অসংখ্য মতবাদের সৃষ্টি করে, সমাজে শান্তিপ্রতিষ্ঠা করার প্রত্যাশা করছে। কিন্তু মানুষের এ প্রচেষ্টায় সমাজে শান্তিপ্রতিষ্ঠিত না হয়ে কলহ-বিবাদে লিপ্ত হয়ে, সংঘাত ও পারস্পরিক হানাহানির সৃষ্টি হচ্ছে। আল্লাহ্ বলেন, “তবে কি তারা আল্লাহর দ্বিনের পরিবর্তে অন্য দ্বিন অন্বেষণ করে? অথচ আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করেছে আসমান ও জমিনে যা কিছু আছে, স্বেচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায় এবং তাঁরই দিকে তারা প্রত্যাবর্তিত হবে।” (সূরা আলে ইমরান ৩: আয়াত ৮৩) প্রকৃতপক্ষে, মানুষ নিজেদের ভ্রান্ত মতবাদ পরিত্যাগ করে আল্লাহর মনোনীত মহামানব তথা নবি-রাসুল ও পরবর্তীতে আওলিয়ায়ে কেরামের দেখানো পথে চলে আল্লাহর কাছে সম্পূর্ণরূপে আত্মসমর্পণ করে যখন আল্লাহর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টির গুণাবলি অর্জন করতে সক্ষম হয়, তখনই ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়।
ক্ষমা
শান্তি লাভের আরেকটি উপায় হলো ‘ক্ষমা’। ক্ষোভ ধরে রাখা সহজ, কিন্তু যারা আমাদের আঘাত করেছে তাদের ক্ষমা করার মহৎ গুণটি নিজের মধ্যে থাকা অত সহজ নয়। আপনি যদি মনের শান্তি চান, তবে যাদের প্রতি আপনার তিক্ততা যা আছে, তা সরিয়ে ফেলতে হবে। আপনি না চাইলে সেসব লোকদের সাথে পুনর্মিলনের দরকার নেই, তবে তিক্ততা ভুলে যাওয়াটা প্রয়োজন। ক্ষমা হচ্ছে মানুষের মহৎ গুণ। আপনি যখন ক্ষমা করেন, তখন আপনি নিজেকে নিরাময়ের রাস্তা তৈরি করছেন। কারণ, আপনি আপনার অভিযোগ এবং নেতিবাচক রায় গুলিকে ছেড়ে দিচ্ছেন। ক্ষোভ ধরে রাখার অভ্যাস থাকলে জীবনের প্রতিটি নতুন পরিস্থিতিতে রাগ এবং তিক্ততা এনে আপনাকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করতে পারে। বর্তমানকে উপভোগ করতে না পারার মতো ঘটনা ঘটতে পারে। অন্যদের সাথে যোগাযোগ হারাতে পারেন। কখনও কখনও জীবনকে অর্থহীন মনে হয়ে হতাশাগ্রস্ত ও উদ্বিগ্ন হতে পারেন। তাই ক্ষমা করার চর্চা থাকতে হবে। ক্ষমার গুরুত্ব নিয়ে মহাগ্রন্থ আল কুরআনে অনেক আয়াত নাজিল হয়েছে। মহান আল্লাহর গুণাবলির মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ‘আল্লাহ্ ক্ষমাশীল’। সূরা নিসার ১৪৯নং আয়াতে আল্লাহ্ বলেন, “তোমরা যদি কল্যাণ করো প্রকাশ্যে কিংবা গোপনে অথবা যদি তোমরা অপরাধ ক্ষমা করে দাও, তবে জেনে রেখো অবশ্যই আল্লাহ্ নিজেও ক্ষমাকারী, মহাশক্তিমান।” সূরা শূরা’র ৪০নং আয়াতে আল্লাহ্ বলেন, “আর মন্দের প্রতিফল মন্দ। অতঃপর যে ক্ষমা করে দেয় এবং আপস নিষ্পত্তি করে, তার পুরস্কার আল্লাহর কাছে রয়েছে। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ জালিমদের পছন্দ করেন না।” অতএব, যে গুণের দিকে আল্লাহ্ এবং রাসুল (সা.) ইঙ্গিত দিয়েছেন, সে গুণ নিজের মধ্যে ধারণ করলে আত্মিক শান্তি আসবে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
কৃতজ্ঞতা ও সন্তুষ্টি
আপনার জীবনে যা আছে তার জন্য কৃতজ্ঞ হওয়া মানসিক শান্তি বিকাশের দুর্দান্ত একটি উপায়। কৃতজ্ঞতা মানসিক চাপ হ্রাস করে এবং আশাবাদ ও সন্তুষ্টির মতো অনুভূতিগুলোকে বৃদ্ধি করে। কৃতজ্ঞ হওয়ার জন্য অনেক কিছু থাকার দরকার নেই, সবসময়ই এমন কিছু আছে যার জন্য আপনি কৃতজ্ঞ হতে পারেন। মূলত সন্তুষ্টির ফলই কৃতজ্ঞতা। এটাই ইমানের আসল রূপ। যে ব্যক্তি আল্লাহ্র করুণা, শাসন, বিধান, তাঁর দান ও তাঁর ছিনিয়ে নেওয়ার প্রতি সন্তুষ্ট নয়, সে তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ নয়। কৃতজ্ঞ লোকেরাই সর্বাপেক্ষা ধন্য ও সমৃদ্ধ লোক। আল্লাহ্ তায়ালা বান্দাকে যখন যে অবস্থায় রাখেন তাতেই তার সন্তুষ্ট থাকা উচিত। আল্লাহ্ আমাদের যে সুস্থতা, সামর্থ্য ও বিবেক-বুদ্ধি দান করেছেন, তার উপর কৃতজ্ঞতা আদায় করা উচিত। হযরত রাসুল (সা.) প্রচারিত ইসলামে কৃতজ্ঞতা ও সন্তুষ্টির প্রতি অত্যাধিক গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। প্রকৃত মু’মিনের সকাল-সন্ধ্যার পুরোসময়টাই কৃতজ্ঞতার ছাঁচে বাঁধা। মু’মিন ব্যক্তি যে কোনো জিনিস অর্জন করে সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহর প্রশংসা করে। সুখ কিংবা দুঃখ সর্বাবস্থায়ই আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ থাকে। সূরা ইব্রাহীমের ৭নং আয়াতে মহান আল্লাহ্ বলেন, “যদি তোমরা কৃতজ্ঞতা আদায় করো, তবে আমি অবশ্যই নিয়ামত বাড়িয়ে দেবো। আর যদি তোমরা অকৃতজ্ঞ হও, নিশ্চয়ই আমার শাস্তি অত্যন্ত ভয়াবহ।” আল্লাহ্ আরো এরশাদ করেন, “আল্লাহ্র অনুমতি ছাড়া কেউ মরতে পারে না, এজন্য নির্দিষ্ট সময় লিখিত আছে। যে কেউ পার্থিব পুরস্কার চায় আমি তাকে তা দুনিয়াতেই দেই; আর যে পারলৌকিক পুরস্কার চায় আমি তাকে তা সেখানে দেবো। অতি সত্বর আমি কৃতজ্ঞদের পুরস্কার দেবো।” (সূরা আলে ইমরান ৩: আয়াত ১৪৫) হযরত রাসুল (সা.) রাতে উঠে নামাজ আদায় করতেন। এ প্রসঙ্গে হযরত মুগীরা (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে- তিনি বলেন, “নবি (সা.) রাত্রি জাগরণ করতেন অথবা সালাত আদায় করতেন, এমনকি তাঁর পদযুগল অথবা তাঁর দুপায়ের গোছা ফুলে যেত। যখন এ ব্যাপারে তাঁকে বলা হলো, ইয়া রাসুলাল্লাহ্! এত কষ্ট কেন করছেন? অতঃপর তিনি বলতেন আমি কি (আল্লাহর নিকট) একজন শুকর গুজার বান্দা হবো না?” (বোখারী শরীফ ২য় খণ্ড, ই.ফা.বা. কর্তৃক অনূদিত পৃষ্ঠা ৩০২) কৃতজ্ঞতাবোধ আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভে আমাদের সাহায্য করে, যা রাসুল (সা.)-এর শিক্ষা। মানুষ যখন যে অবস্থায়ই থাকে, সেই অবস্থায় আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট এবং কৃতজ্ঞতাবোধ মানুষের আত্মার শান্তির জোগান দেয়।
সত্যবাদী থাকা
দুনিয়ার সব কাজ, বিচার ফয়সালা সত্য কথা বা সত্যবাদিতার উপর নির্ভরশীল। সততায় অন্তরের প্রশান্তি। নাজাত লাভ, খোদার সন্তুষ্টি এবং ধনসম্পদে ও বরকতের মাধ্যম হলো নিজের সত্যকে উদ্ভাসিত করে আদর্শ চরিত্র ধারণ করা। সততা মানবচরিত্রের শ্রেষ্ঠ গুণ। মানবজীবনে এর প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। মানব সমাজের নিরাপত্তা, প্রশান্তি, সুখ-শান্তি, বিনির্মাণ, উন্নতির ভিত্তি হলো সততা। এ কারণে সততাকে আপন করে নিতে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে মোহাম্মদী ইসলামে। পবিত্র কুরআন ও হাদিসে এর ফজিলত ও প্রয়োজনীয়তা দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট। কুরআন ও হাদিস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, সততা বিষয়টি অনেক ব্যাপক। সততা কেবলমাত্র সত্য কথা বলার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। বরং সত্য কথা বলার সাথে কাজ-কর্ম, আকিদা সবগুলোতে সততা অন্তর্ভুক্ত। মহান আল্লাহ্ পবিত্র কুরআনে সূরা নিসার ৬৯নং আয়াতে বলেন, “আর কেউ আল্লাহ্ এবং রাসুলের আনুগত্য করলে, সে নবি, সত্যনিষ্ঠ, শহিদ ও সৎকর্মপরায়ণ- যাদের প্রতি আল্লাহ্ অনুগ্রহ করেছেন- তাঁদের সঙ্গী হবে এবং তারা কত উত্তম সঙ্গী!” তাইতো বিখ্যাত এক সুফিসাধকের কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছে-
শান্তি লাভে ছুটে চলেছো হে মন!
পেয়েছো কি তুমি প্রভুর মিত্রের দর্শন?
সত্যবাদীদের সঙ্গের গুরুত্ব প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে সূরা তাওবার ১১৯নং আয়াতে আল্লাহ্ বলেন, “হে ইমানদারগণ! আল্লাহ্কে ভয় করো এবং সত্যবাদীদের সাথি হও।” হযরত আবু মোহাম্মদ হাসান ইবনে আলী ইবনে আবু তালিব (রা.) বর্ণনা করেছেন, আমি রাসুল (সা.) থেকে এই শব্দগুলো স্মরণ রেখেছি যে, “তুমি ঐ জিনিস পরিত্যাগ করো, যে জিনিস তোমাকে সন্দেহে ফেলে এবং তা গ্রহণ করো যাতে তোমার সন্দেহ নেই, কেননা, সত্য প্রশান্তির কারণ এবং মিথ্যা সন্দেহের কারণ।” (তিরমিজি, নাসাঈ, মুসনাদে আহমাদ, দারেমি) মু’মিন স্বচ্ছ আর মুনাফিক হচ্ছে অস্বচ্ছ। তাই মু’মিন সত্যবাদী। প্রকৃত শান্তি লাভে মু’মিনের গুণাবলি অর্জন অন্যতম পূর্বশর্ত। আমরা নফসের বেড়াজালে জড়িয়ে প্রভুর প্রতিনিধিত্বের গুণ হারিয়ে ষড়রিপুর তাড়নায় জীবাত্মাকে পরমাত্মার তুলনায় অধিকতর শক্তিশালী করে আত্মিক শান্তি বিনষ্ট করে ফেলেছি। আল্লাহ্র নির্দেশিত এবং রাসুলের প্রদর্শিত পথে জীবনযাপনই মানব জীবনে বয়ে আনতে পারে অবিরাম শান্তি। তাই পরমাত্মাকে সঠিক দিশায় পৌঁছে দেওয়ার মধ্য দিয়ে আত্মিক শান্তি অর্জনের লক্ষ্যে আল্লাহ্ ও রাসুল (সা.)-এর নির্দেশিত পথের দায়িত্বপ্রাপ্ত পথপ্রদর্শকের শরণাপন্ন হওয়া অত্যাবশ্যক।
[লেখক: ইসলামি গবেষক]