মানুষ আল্লাহর প্রতিনিধি
মহান সংস্কারক, মোহাম্মদী ইসলামের পুনর্জীবনদানকারী, সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহবুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (রহ.) হুজুর কেবলাজান
[সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান রচিত ‘শান্তি কোন পথে?’ এবং ‘মুক্তি কোন পথে?’ কিতাব থেকে প্রবন্ধটি সংকলন করা হয়েছে।-সম্পাদক]
মানুষ আল্লাহর খলিফা বা প্রতিনিধি। এই প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে পরম করুণাময় আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিন বলেন, “ওয়া ইয ক্বালা রাব্বুকা লিলমালাইকাতি ইন্নী জা‘ইলুন ফিল আরদ্বি খালীফাহ।” অর্থাৎ- স্মরণ করো, যখন তোমার প্রতিপালক ফেরেশতাদের বললেন- আমি পৃথিবীতে আমার প্রতিনিধি সৃষ্টি করব। (সূরা আল বাকারাহ ২: আয়াত ৩০)
মানুষ আল্লাহর সৃষ্টিসমূহের মধ্যে সর্বোত্তম সৃষ্টি। প্রতিটি মানুষের মধ্যে আল্লাহর এক টুকরো নুর সুপ্ত অবস্থায় বিদ্যমান রয়েছে। যে ব্যক্তি সাধনার মাধ্যমে এই নুরকে প্রজ্বলিত করে আল্লাহর পরিচয় লাভ করে, নিজেকে উত্তম চরিত্রে চরিত্রবান করতে সক্ষম হয়েছেন, তিনিই প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর খলিফা। প্রতিটি মানুষের মাঝে আল্লাহর খলিফা বা প্রতিনিধি হওয়ার যোগ্যতা সুপ্ত অবস্থায় বিদ্যমান থাকলেও, কেবল নবি, রাসুল ও আওলিয়ায়ে কেরামের মাঝে মহান আল্লাহর নুর প্রজ্বলিত প্রদীপরূপে বিদ্যমান থাকে। (এই প্রজ্বলিত প্রদীপ সিরাজুম মুনির সম্পর্কে) মহান আল্লাহ্ বলেন- “ইয়া আইয়্যুহান নাবিইয়্যু ইন্না আরসালনাকা শাহিদাও ওয়া মুবাশশিরাও ওয়া নাযীরাও, ওয়াদা‘ইইয়ান ইলাল্লাহি বিইযনিহী ওয়া সিরাজাম মুনীরা।” অর্থাৎ- হে নবি (সা.)! নিশ্চয় আমি তো আপনাকে পাঠিয়েছি সাক্ষীরূপে, সুসংবাদদাতারূপে ও সতর্ককারীরূপে। আল্লাহর অনুমতিক্রমে তাঁর দিকে আহ্বানকারীরূপে এবং প্রজ্বলিত প্রদীপরূপে। (সূরা আল আহযাব ৩৩: আয়াত ৪৫ ও ৪৬)
আসলে প্রতিটি মানুষের মাঝে দুটি আত্মা বিরাজমান। আত্মা বলতে সত্তাকে বুঝায়। মানুষের মূল চালিকা শক্তিই হলো আত্মা। আত্মা প্রধানত দুভাগে বিভক্ত। যথা-
১। নফ্স তথা জীবাত্মা, এবং ২। রুহ তথা পরমাত্মা।
জীবাত্মা তিন ভাগে বিভক্ত। যথা-
১। পশুর আত্মা, ২। হিংস্র জন্তুর আত্মা ও ৩। শয়তানের আত্মা।
রুহ বা পরমাত্মা দুই ভাগে বিভক্ত। যথা-
১। মানবাত্মা ও ২। ফেরেশতার আত্মা।
হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে শাকীক (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে, আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেন- “প্রত্যেক মানুষের ক্বালবে দুটি করে কক্ষ রয়েছে, এর একটিতে ফেরেশতার অবস্থান, অন্যটিকে শয়তানের। ক্বালব আল্লাহর জিকিরে নিমগ্ন থাকলে, শয়তান তার থেকে দূরে সরে যায়। আর সে যখন আল্লাহর জিকির থেকে বিরত হয়, তখন শয়তান তার ক্বালবের ভিতরে কুমন্ত্রণা দিতে থাকে।” (তাফসীরে মাজহারী ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৬৮)
মানুষের জন্ম প্রক্রিয়ায় পিতার শুক্রকীট থেকে যে সত্তার জন্ম হয় এবং যা দেহের ষড়রিপুতে পরিণত হয়, এটিই জীবাত্মা। আর মায়ের উদরে সন্তান মানবাকৃতি লাভ করার পর আল্লাহর যে সত্তা রুহ হিসেবে মানবের ভেতরে ফুঁকে দেওয়া হয়, এটিই পরমাত্মা। জীবের জন্ম প্রক্রিয়ার বিচারে মানুষ এবং অন্যান্য জীবের মধ্যে মৌলিক কোনো পার্থক্য নেই। (মুক্তি কোন পথে? পৃষ্ঠা ১৭৩ ও ১৭৪)
পশুর মধ্যে কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসর্য- এই ষড়রিপু বিদ্যমান; যেগুলো মানুষের মধ্যেও রয়েছে। কিন্তু মানুষের মধ্যে রুহ বা পরমাত্মা বিদ্যমান থাকার কারণে, তারা সৃষ্টির সেরা জাতি বলে গণ্য হয়ে থাকে। বিষয়টি মহান আল্লাহ্ তাঁর পাক জবানেই বলে দিয়েছেন। এরশাদ হচ্ছে- “আল্লাহ্ অতি সুন্দররূপে তাঁর প্রত্যেকটি সৃষ্টিকে সৃজন করেছেন এবং মানব সৃষ্টির সূচনা করেছেন কাদামাটি দিয়ে। তারপর তার বংশধরকে সৃষ্টি করেন দুর্বল পানির নির্যাস থেকে। অতঃপর তিনি তাকে সুঠাম করেন এবং তাতে নিজের তরফ থেকে রুহ ফুঁকে দেন। আর তোমাদের দান করেন কর্ণ, চক্ষু ও অন্তঃকরণ। কিন্তু তোমরা খুব কমই শোকর করো।” (সূরা আস সাজদাহ ৩২: আয়াত ৭ থেকে ৯) অনুরূপভাবে মহান আল্লাহ্ অন্য আয়াতে এরশাদ করেন- “ফাইযা সাওয়্যাইতুহূ ওয়া নাফাখতু ফীহি মির রূহী ফাক্বা‘উ লাহূ সাজিদীন।” অর্থাৎ- যখন আমি তাকে [আদম (আ.)-কে] সুঠাম করব এবং তার মধ্যে আমার রুহ থেকে রুহ ফুঁকে দেবো, তখন তোমরা (ফেরেশতারা) তাকে সিজদা করবে। (সূরা আল হিজর ১৫: আয়াত ২৯) মূলত এ রুহই হলো পরমাত্মা, আল্লাহর সত্তা বিশেষ। একমাত্র মানুষ ব্যতীত অন্য কোনো প্রাণীর মধ্যে এই রুহ বা পরমাত্মা নেই। (মুক্তি কোন পথে? পৃষ্ঠা ১৭৪ ও ১৭৫)
আগুন, পানি, মাটি ও বায়ুর সংমিশ্রণে সৃষ্ট নফ্স বা জীবাত্মা সর্বদা মানুষকে খারাপ পথে পারিচালিত হওয়ার ইন্ধন জোগায়। পক্ষান্তরে রুহ বা পরমাত্মা প্রতিনিয়ত তাকে খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকতে সতর্ক করে এবং আল্লাহর পথে ধাবিত হওয়ার জন্য তাকে আহ্বান জানায়। (শান্তি কোন পথে? পৃষ্ঠা ২২) এই প্রসঙ্গে হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে- তিনি বলেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেন- “নিশ্চয় আদম সন্তানের মনে শয়তানের যেমন এক প্রকার প্রভাব রয়েছে, তেমনি ফেরেশতারও একটি প্রভাব রয়েছে। আর শয়তানের প্রভাব হলো- সে মিথ্যার প্রতিশ্রুতি দেয় এবং সত্যকে অস্বীকার করে। আর ফেরেশতার প্রভাব হলো- সে ভালো ও কল্যাণের প্রতিশ্রুতি দেয় এবং সত্যকে সত্য বলে জেনে নেয়। সুতরাং যে ব্যক্তি আপন হৃদয়ে এটি অনুভব করবে, সে যেন এটি যে আল্লাহর পক্ষ থেকে হয়েছে, তা বিশ্বাস করে এবং আল্লাহর প্রশংসা করে। আর যে অপরটি, অর্থাৎ শয়তানের প্ররোচনা উপলব্ধি করবে, তার কর্তব্য হবে শয়তান হতে আল্লাহর নিকট আশ্রয় চাওয়া।” (তিরমিযী শরীফের সূত্রে তাফসীরে মাজহারী ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৮৫)
অনুরূপভাবে আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, হাদিসে কুদসিতে মহিমান্বিত আল্লাহ্ ফরমান- “আমার বান্দা নফল ইবাদত দ্বারা আমার এত নিকটবর্তী হয়ে যায়, আমি তাকে ভালোবাসতে বাসতে তার কর্ণ হয়ে যাই, যে কর্ণ দ্বারা সে শুনে; চক্ষু হয়ে যাই, যে চক্ষু দ্বারা সে দেখে; হাত হয়ে যাই, যে হাত দ্বারা সে ধরে এবং পা হয়ে যাই, যে পা দ্বারা সে হাঁটে। এমন বান্দা কোনো বিষয়ে প্রার্থনা করা মাত্র আমি তা দান করে থাকি এবং কোনো বিষয়ে আমার কাছে আশ্রয় চাওয়া মাত্র তাঁকে আশ্রয় দিয়ে থাকি।” (বোখারী শরীফ ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৯৬৩; তাফসীরে মাজহারী ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৫৮; বোখারী শরীফের সূত্রে মেশকাত শরীফ, পৃষ্ঠা ১৯৭)
প্রকৃতপক্ষে যখন কোনো ব্যক্তি চেষ্টা বা সাধনার মাধ্যমে আপন জীবাত্মাকে দমন করে পরমাত্মাকে শক্তিশালী করেন এবং খারাপ কাজ হতে বিরত থেকে আল্লাহর পরিচয় লাভে সক্ষম হন, অতঃপর আল্লাহর নির্দেশে পরিচালিত হয়ে থাকেন, তখন তিনি আল্লাহর খলিফা বা প্রতিনিধি হিসেবে মর্যাদার অধিকারী হন। (শান্তি কোন পথে? পৃষ্ঠা ২৪)
মানুষ কীভাবে নিকৃষ্ট হতে পারে?
মহান আল্লাহ্ বলেন- “ওয়ালাক্বাদ কাররামনা বানী আদামা ওয়া হামালনাহুম ফিল বাররি ওয়াল বাহরি ওয়া রাঝাক্বনাহুম মিনাত্ব ত্বাইয়্যিবাতি ওয়া ফাদ্বদ্বালনাহুম ‘আলা কাছীরিম মিম্মান খালাক্বনা তাফদ্বীলা।” অর্থাৎ- নিশ্চয় আমি বনি আদমকে মর্যাদা দান করেছি এবং আমি তাদেরকে স্থলভাগে ও জলভাগে চলাচলের বাহন দান করেছি। আর আমি তাদেরকে দিয়েছি নানাবিধ উত্তম জীবনোপকরণ এবং আমি তাদেরকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি আমার অনেক সৃষ্টি অপেক্ষা। (সূরা বনী ইসরাঈল ১৭: আয়াত ৭০) প্রকৃতপক্ষে মানুষ সৃষ্টির সেরা। মহান আল্লাহ্ তাকে প্রতিনিধির যোগ্যতা ও দায়িত্ব দিয়ে জগতে প্রেরণ করেছেন। যিনি একনিষ্ঠ চেষ্টার মাধ্যমে নিজের মাঝে আল্লাহর পরিচয় লাভ করে, নিজেকে উত্তম চরিত্রে চরিত্রবান করতে সক্ষম হয়েছেন, তিনিই উৎকৃষ্ট মানুষ। (শান্তি কোন পথে? পৃষ্ঠা ২৫)
হযরত আবু হুরায়রাহ (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে, আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেন- “আলমু’মিনু আকরামু ‘আলাল্লাহি মিম বা‘দ্বি মালাইকাতিহী।” অর্থাৎ-মু’মিন মহান আল্লাহর নিকট কিছুসংখ্যক ফেরেশতার চেয়েও অধিক মর্যাদাবান । (ইবনে মাজাহ শরীফ, পৃষ্ঠা ২৮৩) অন্যদিকে যে ব্যক্তি ষড়রিপুর বেড়াজালে আবদ্ধ থেকে আল্লাহর পরিচয় লাভে ব্যর্থ, সে নিকৃষ্ট প্রাণীতুল্য। মহিমান্বিত আল্লাহ্ বলেন- “ওয়ালাক্বাদ যারা’না লিজাহান্নামা কাছীরাম মিনাল জিন্নি ওয়াল ইনসি, লাহুম কুলূবুল লা ইয়াফকাহূনা বিহা, ওয়ালহুম আ‘ইউনুল লা ইউবসিরূনা বিহা, ওয়ালাহুম আযানুল লা ইয়াসমা‘উনা বিহা, উলাইকা কালআন’আম বালহুম আদ্বাল্লু, উলাইকা হুমুল গাফিলূন।” অর্থাৎ-আর আমি সৃষ্টি করেছি জাহান্নামের জন্য এমন অনেক জিন ও মানুষ, যাদের ক্বালব বা অন্তর আছে বটে, কিন্তু তা দিয়ে তারা বুঝে না, তাদের (অন্তরে) চোখ আাছে বটে, কিন্তু তা দিয়ে তারা দেখে না এবং তাদের (অন্তরে) কান আছে বটে, কিন্তু তা দিয়ে তারা (সত্যবাণী) শুনে না। তারা চতুষ্পদ জন্তুর ন্যায়, বরং তারা সেগুলোর চেয়েও নিকৃষ্টতর। তারাই গাফেল বা উদাসীন।” (সূরা আল আ‘রাফ ৭: আয়াত ১৭৯)
অন্যত্র মহান আল্লাহ্ এরশাদ করেন- “লাক্বাদ খালাক্বনাল ইনসানা ফী আহসানি তাক্ববীমিন, ছুম্মা রাদাদনাহু আফসালা সাফিলীন।” অর্থাৎ- আমি তো মানুষেকে সৃষ্টি করেছি অতিশয় সুন্দর গঠনে, অতঃপর আমি তাকে (পাপ কর্মের কারণে) ফিরিয়ে দেই হীন থেকে হীনতম অবস্থায়। (সূরা আত তীন ৯৫: আয়াত ৪ ও ৫) এজন্য আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেন- “ইন্না মিন খিইয়ারিকুম আহসানুহুম আখলাক্বা।” অর্থাৎ- তোমাদের মধ্যে উত্তম ঐ ব্যক্তি, যার চরিত্র সবচেয়ে উত্তম। (বোখারী ও মুসলিমের সূত্রে মেশকাত শরীফ, পৃষ্ঠা ৪৩১)
সুতরাং মহান আল্লাহ্ ও তাঁর রাসুল (সা.)-এর বাণী মোবারকে বিষয়টি সুস্পষ্ট যে, উত্তম চরিত্রগুণে আল্লাহর প্রতিনিধিত্বকারী মানুষ ফেরেশতার চেয়েও বেশি মর্যাদাশীল, আবার অসচ্চরিত্রের দ্বারা সেই মানুষই পশুর চেয়ে নিকৃষ্ট হয়ে থাকে। উপমাস্বরূপ বলা যায়- দুধ, পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ একটি উৎকৃষ্ট খাদ্য। অথচ এ দুধের মাঝে যখন এক ফোঁটা চোনা (গরুর প্রসাব) পড়ে, তখন এ দুধ আহারের অযোগ্য হয়ে যায়। সুতরাং চরিত্রই ধর্মের মূল। যার চরিত্র নেই, তার ধর্মও নেই।
[লেখক: দেওয়ানবাগ শরীফের প্রতিষ্ঠাতা]