প্রকৃত মুসলমানের পরিচয় – হযরত এম. আমিরুল ইসলাম
ইসলাম অর্থ শান্তি। আর মুসলমান শব্দের অর্থ শান্তিতে বসবাসকারী। মুসলমান প্রসঙ্গে মহান সংস্কারক সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহ্বুবু-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (রহ.) হুজুর কেব্লাজান বলেন, “ইসলাম শব্দ থেকে মুসলিম শব্দের উৎপত্তি। উভয় শব্দেরই মাদ্দাহ তথা শব্দমুল ‘সিলমুল’, যার অর্থ শান্তি। ইসলাম শব্দের অর্থ আত্মসমর্পণ করা, বশ্যতা স্বীকার করা, নিজেকে সমর্পণ করে দেওয়া। অন্যদিকে মুসলমান শব্দের অর্থ আত্মসমর্পণকারী, বশ্যতা স্বীকারকারী, শান্তিতে বসবাসকারী।” (মুক্তি কোন পথে? পৃষ্ঠা ১)
মহান আল্লাহ্ হযরত ইব্রাহিম (আ.)-কে শান্তি ও মুক্তির পথনির্দেশনা দেওয়ার জন্য ইসলাম ধর্মের আদর্শ শিক্ষা দিতে গিয়ে নির্দেশ করেন ‘আসলিম’ অর্থাৎ ‘আত্মসমর্পণ করুন’। জবাবে হযরত ইব্রাহিম (আ.) পূর্ণ আত্মসমর্পণ করে বলেন- “আসলামতু লিরাব্বিল আলামীন।” অর্থাৎ- “আমি জগৎসমূহের প্রতিপালকের নিকট আত্মসমর্পণ করলাম।” (সূরা আল বাকারাহ ২: আয়াত ১৩১)
প্রকৃত মুসলমানের পরিচয় প্রসঙ্গে সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহ্বুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (রহ.) হুজুর কেব্লাজান বলেন, “প্রকৃতপক্ষে যে জীবন ব্যবস্থায় মানুষ স্রষ্টার উপর পূর্ণ আত্মসমর্পণ করে এবং তাঁর নির্দেশে পরিচালিত হয়ে সৃষ্টিকে পূর্ণ শান্তিতে বসবাসের সুযোগ করে দেয়, এটিই ইসলাম। আর যে ব্যক্তি ইসলামকে নিজের জীবনে বাস্তবায়িত করে পূর্ণ শান্তির অধিকারী হয়েছেন এবং অন্যের জন্যও শান্তির কারণ হয়েছেন, তিনিই প্রকৃত মুসলমান।” যে ব্যক্তি ইসলামকে নিজের জীবনে বাস্তবায়িত করে পূর্ণ শান্তির অধিকারী হয়েছেন এবং অন্যান্য মানুষের শান্তির কারণ হয়েছেন, তিনিই প্রকৃত মুসলমান। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ্ বলেন, “মান আসলাম ওয়াজহাহু লিল্লাহি ওয়া হুওয়া মুহসিনুন ফালাহু আজরুহূ ইনদা রাব্বিহী।” অর্থাৎ- “যে নিজেকে আল্লাহ্র উদ্দেশ্যে সম্পূর্ণরূপে আত্মসমর্পণ করে এবং সে সৎকর্ম পরায়ণ ও তার জন্য রয়েছে তার প্রতিপালকের কাজে পুরস্কার।” (সূরা আল বাকারাহ ২: আয়াত ১১২)
আল্লাহ্র রাসুল (সা.)-কে প্রশ্ন করা হলো মুসলিম কে? তিনি বলেন, “আলমুসলিমু মান সালিমান মুসলিমুনা মিল লিসানিহী ওয়া ইয়াদিহী।” অর্থাৎ- “মুসলমান সেই ব্যক্তি, যার জবান ও হাত থেকে অপর মুসলমান (তথা অন্য মানুষেরা) নিরাপদ থাকে।” (মেশকাত শরীফ, পৃষ্ঠা ১২) আমরা মুসলমান দাবী করি, কিন্তু কাজে কর্মে তার প্রমাণ পাওয়া যায় না। আমাদের ধারণা মুসলমান পিতামাতার ঘরে জন্মগ্রহণ করেছি বলে অবশ্যই আমরা মুসলমান। আসলে এটি ভুল ধারণা। কেননা ইসলাম একটি আদর্শের নাম এবং মুসলমান ঐ আদর্শ নিজ চরিত্রে বাস্তবায়নকারীর নাম। ইসলামের আদর্শ সাধনার মাধ্যমে নিজ চরিত্রে বাস্তবায়ন করতে হয়, এটি উত্তরাধিকারী সূত্রে অর্জন করা যায় না। যেমন- ডাক্তারের ছেলে ডাক্তারি বিদ্যা শিক্ষা না করে জন্মসূত্রে ডাক্তার হতে পারে না।
এজন্য মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইব্রাহিম (আ.) এবং হযরত ইয়াকুব (আ.) তাঁদের পুত্রদেরকে সাধনার মাধ্যমে প্রকৃত মুসলমান হওয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন, তেমনি আল্লাহ্তে পূর্ণ আত্মসমর্পণকারী না হয়ে মৃত্যুবরণ করতে নিষেধ করেছেন। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ্ বলেন, “আর এরই অছিয়ত করেছেন ইব্রাহিম (আ.) তাঁর সন্তানদের এবং ইয়াকুব (আ.)- ওহে পুত্রগণ! নিশ্চয় আল্লাহ্ তোমাদের জন্য এ দ্বিনকে মনোনীত করেছেন। সুতরাং তোমরা মুসলমান না হয়ে মৃত্যুবরণ করো না।” (সূরা আল বাকারাহ ২: আয়াত ১৩২) মহান আল্লাহ্র বাণী ও হযরত রাসুল (সা.)-এর বাণী থেকে বুঝা যায়। আমাদেরকে মুসলমান হতে হবে। আল্লাহ্ অন্যত্র বলেন- “হে মু’মিনগণ! তোমরা আল্লাহ্কে যথার্থরূপে ভয় করো এবং তোমরা আত্মসমর্পণকারী না হয়ে কোনো অবস্থাতেই মৃত্যুবরণ করো না।” (সূরা আলে ইমরান ৩: আয়াত ১০২)
তাহলে আমরা কীভাবে মুসলমান হবো? মানুষেরা মাঝে দুটি সত্তা বিরাজমান। (১) রুহ বা পরমাত্মা (২) নফস বা জীবাত্মা। পরমাত্মা বা রুহ আল্লাহ্র পক্ষ থেকে আসে। তাই রুহ আল্লাহ্র ইচ্ছাতে পরিচালিত হয়। আর নফস তৈরি হয় চারটি উপাদান থেকে। যেমন- আগুন, পানি, মাটি ও বায়ু থেকে। তাই এই চারটি উপাদানের কারণে ছয়টি রিপুর সৃষ্টি হয়েছে। যথা- কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসর্য। মানুষের মাঝে যতক্ষণ পর্যন্ত এই ষড়রিপু বিদ্যমান থাকবে, সে ব্যক্তি কখনই পরিপূর্ণভাবে আত্মসমর্পণকারী মুসলমান হতে পারবে না। কারণ কাম রিপুর কারনে ব্যভিচার করে, ক্রোধের কারণে মারামারি, ঝগড়া বিবাদ করে, লোভ রিপুর কারণে ধন সম্পদ আত্মসাৎ করে, মদ রিপুর কারণে আমোদ-প্রমোদ, গান বাজনায় ব্যস্ত থাকে, মোহ রিপুর কারণে দুনিয়ায় প্রভাব প্রতিপত্তি বিস্তার করে এবং মাৎসর্য রিপুর কারণে পরশ্রীকাতরতায় ভুগে। প্রত্যেকটা রিপুই পশুর চরিত্র বিরাজমান। যতক্ষণ পর্যন্ত একজন মানুষের ষড়রিপুর বেড়াজাল থেকে মুক্ত হতে না পারবে ততক্ষণ পর্যন্ত সে হাকিকতে মুসলমান হতে পারবে না।
হযরত রাসুল (সা.)-এর জামানায় একজন মানুষ কাফিরের ঘরে জন্ম নিয়েও হযরত রাসুল (সা.)-এর শিক্ষা নিয়ে, ষড়রিপু পরিশুদ্ধ করে হাকিকতে মুসলমান হয়ে আলোকিত সাহাবি হয়েছে। অনুরূপভাবে মুসলমান পিতামাতার ঘরে জন্ম নিয়েও হযরত রাসুল (সা.)-এর উত্তরসূরি মহামানব তথা যুগের ইমাম, মোজাদ্দেদ ও আওলিয়ায়ে কেরামের শিক্ষা অনুসরণ করে নিজেকে প্রকৃত মুসলমানে পরিণত করতে হবে। আমাদের মহান মোর্শেদ সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহ্বুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (রহ.) হুজুর কেব্লাজান মানুষকে চারটি শিক্ষা দিতেন। যথা- আত্মশুদ্ধি, দিলজিন্দা, নামাজে হুজুরি ও আশেকে রাসুল হওয়া। আত্মশুদ্ধি হলেই মানুষের মধ্যে ষড়রিপু পরিশুদ্ধ হয়ে যায়। তখন এই ষড়রিপুই মানুষকে আল্লাহ্কে পেতে সাহায্য করে। মহান মোর্শেদ সূফী সম্রাট হযরত শাহ্ দেওয়ানবাগী (রহ.) বলেন, “আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে ব্যক্তি শুদ্ধ হয়, আর ব্যক্তি শুদ্ধির মাধ্যমে সমাজ শুদ্ধ হয়।” মোর্শেদের দ্বিতীয় শিক্ষা নিয়ে যখন একজন মানুষ ক্বালবে আল্লাহ্র জ্বিকির জারি করে, তখন সে দয়াময় আল্লাহ্র পক্ষ থেকে পরম শান্তি অনুভব করতে থাকেন। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ্ বলেন, “আল্লাযীনা আমানূ ওয়া তাত্বমাইন্নু ক্বুলূবুহুম বিযিকরিল্লাহি আলা বিযিকরিল্লাহি তাত্বমাইন্নুল ক্বুলূব।” অর্থাৎ- “যারা ইমান আনে এবং আল্লাহ্র জিকিরে যাদের ক্বালব প্রশান্ত হয়; জেনো রেখো আল্লাহ্র জিকিরেই কেবল ক্বালব প্রশান্তি লাভ করে।” (সূরা আর রা‘দ ১৩: আয়াত ২৮) আর তখন ষড়রিপু তার নিয়ন্ত্রণে থাকে।
মোর্শেদের তৃতীয় শিক্ষা নামাজে হুজুরি। যখন ক্বালবে জিকিরের মাধ্যমে হৃদয়ে পরম শান্তি আসে, তখনি হুজুরি দিলে নামাজ আদায় করা সম্ভব হয়। সূফী সম্রাট হুজুর কেব্লাজানের চতুর্থ শিক্ষা আশেকে রাসুল হওয়া। আত্মশুদ্ধি, দিল জিন্দা, নামাজে হুজুরি হলেই একজন মানুষ পরিপূর্ণ আশেকে রাসুল হতে পারে। অর্থাৎ তার মাঝে প্রকৃত মুসলমানের গুণ প্রকাশ পায়। মুসলমান তথা আত্মসমর্পণকারী হিসেবে তিনটি বিষয় অর্জন হয়ে থাকে। তা হলো- ১। আল্লাহ্র কাছে আত্মসমর্পণ করে, ২। নিজের ভিতরে আল্লাহ্র পরিচয় লাভ করে ও ৩। আল্লাহ্র নির্দেশে নিজেকে পরিচালিত করে। আমাদের মহান মোর্শেদ সূফী সম্রাট হুজুর কেব্লাজানের শিক্ষায় প্রকৃত মুসলমান হওয়ার গুণ অর্জন করা সম্ভব।
বর্তমানে সূফী সম্রাট হুজুর কেব্লাজানের সুমহান শিক্ষা বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধয়ার জন্য মোহাম্মদী ইাসলামের নেতৃত্ব প্রদানকারী মহামানব ইমাম প্রফেসর ড. কুদরত এ খোদা (মা. আ.) হুজুরের আহ্বানে আগামী ২৩শে ফেব্রুয়ারি শুক্রবার ময়মনসিংহের বাবে বরকত দেওয়ানবাগ শরীফে মহান মোর্শেদ সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহ্বুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (রহ.) হুজুর কেব্লাজানের ৭৪তম শুভ বার্ষিকী স্মরণে অনুষ্ঠিত হবে বিশ্ব আশেকে রাসুল (সা.) সম্মেলন। উক্ত সম্মেলনে আমাদেরকে অংশগ্রহণ করে প্রকৃত মুসলমান তথা আত্মসমর্পণকারীর মর্যাদা লাভ করার তৌফিক দান করুন। আমিন।
[লেখক: সদস্য, আল কুরআন গবেষণা কেন্দ্র, পেশ ইমাম, বাবে রহমত দেওয়ানবাগ শরীফ।]