Cancel Preloader

সম্পাদকীয়

আরবি ‘হাজ্জুন’ শব্দ থেকে হজ শব্দটির উৎপত্তি। হজের আভিধানিক অর্থ হলো সংকল্প করা, ইচ্ছা করা। ইসলামের পরিভাষায়- মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে জিলহজ মাসের নির্ধারিত দিনসমূহে নির্ধারিত পদ্ধতিতে বায়তুল্লাহ (আল্লাহর ঘর) ও সংশ্লিষ্ট স্থানসমূহ জিয়ারত করাকে হজ বলে। হজের পারিভাষিক সংজ্ঞা প্রসঙ্গে সংক্ষিপ্ত ইসলামী বিশ্বকোষে বলা হয়েছে- “শরিয়তের পরিভাষায় নির্দিষ্ট মাসের নির্দিষ্ট তারিখে মক্কার কাবাঘর প্রদক্ষিণ, আরাফাত ময়দানে অবস্থান, সাফা-মারওয়া পাহাড়ের মধ্যবর্তী স্থানে গমনাগমন, মিনায় অবস্থান, প্রভৃতি কতিপয় কার্য যেভাবে হযরত মোহাম্মদ (সা.) নির্ধারণ করে দিয়েছেন, সেভাবে সম্পাদন করার নাম হজ। এটি ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের পঞ্চম।” (ই.ফা.বা কর্তৃক প্রকাশিত সংক্ষিপ্ত ইসলামী বিশ্বকোষ, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৫২৩) হজ ওই সকল মুসলমানদের উপর ফরজ, যাদের হজের কাজ সম্পাদন করার মতো আর্থিক, মানসিক ও দৈহিক সামর্থ্য রয়েছে। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ্ বলেন, “মানুষের মধ্যে তার উপর আল্লাহর জন্য এই ঘরের হজ করা ফরজ, যার সেখানে যাওয়ার সামর্থ্য আছে।”(সূরা আলে ইমরান ৩: আয়াত ৯৭)

মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইব্রাহিম খলিলুল্লাহ (আ.) সাড়ে চার হাজার বছর পূর্বে মহান আল্লাহর নির্দেশে সর্বপ্রথম হজের প্রবর্তন করেন। হজ প্রবর্তনের পূর্বে তিনি আল্লাহ্ তায়ালার নির্দেশে স্বীয় পুত্র হযরত ইসমাইল জাবিহুল্লাহ (আ.)-কে সাথে নিয়ে কাবাঘর নির্মাণ করেন। উল্লেখ্য যে, কালের বিবর্তনে মানবজাতির আদি পিতা হযরত আদম (আ.) কর্তৃক নির্মিত কাবাঘরটি বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। পরবর্তীতে কাবাঘর নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হলে মহান আল্লাহ্ তাঁর বন্ধু হযরত ইব্রাহিম (আ.)-কে হজ পালনের নির্দেশ প্রদান করেন। এই প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ্ বলেন “যখন আমি ইব্রাহিমকে কাবাগৃহের স্থান নির্ধারণ করে বলেছিলাম যে, আমার সাথে কোনো কিছু শরিক করো না এবং আমার গৃহকে পবিত্র রেখো তাওয়াফকারীদের জন্য, নামাজে দণ্ডায়মান লোকদের জন্য, রুকুকারী ও সিজদাকারীদের জন্য এবং মানুষের মধ্যে হজের ঘোষণা করে দাও।” (সূরা আল হাজ্জ ২২: আয়াত ২৬ ও ২৭) মহান আল্লাহর নির্দেশে হযরত ইব্রাহিম (আ.) হজের ঘোষণা করেন, তিনি এভাবে মানুষকে আহ্বাবান করেছিলেন- “হে লোক সকল! আল্লাহর নির্দেশে তার গৃহ নির্মিত হয়েছে এবং তিনি তোমাদের উপর এই গৃহে হজ ফরজ করেছেন, তোমরা আল্লাহর আদেশ পালন করো।” এভাবে পবিত্র মক্কা নগরীতে হজ পালনের নিয়ম চালু হয়।

প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ্ প্রেরিত মহামানবগণের অনুসরণ করার শিক্ষা নিজ হৃদয়ে ধারণের জন্য হজ পালন করতে হয়। ১০ই জিলহজ কাবা শরীফ তাওয়াফ করার সময় মন আল্লাহর প্রতি আকৃষ্ট হয়। আরাফাতের ময়দানে গিয়ে আদি পিতার মাফের ঘটনা স্মরণ করে নিজের জীবনের কৃত গুনাহর জন্য মনে অনুশোচনা সৃষ্টি হয় এবং মহান আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করা হয়। মদীনায় গিয়ে হযরত রাসুল (সা.)-এর রওজা শরীফ জিয়ারতের মাধ্যমে অন্তরে দয়াল রাসুল (সা.)-এর প্রেম জাগ্রত হয়। এ প্রসঙ্গে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেন- “আমার ওফাতের পর যে ব্যক্তি হজ সম্পাদন করে আমার রওজা জিয়ারত করবে, সে যেন আমার জীবদ্দশায় আমার সাথে সাক্ষাৎ করল।” (ইমাম বায়হাকীর সুনানে কুবরা ৫ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪০৩) হযরত উমর (রা.) বলেন, “আমি আল্লাহর রাসুলকে বলতে শুনেছি তিনি বলেন- “যে ব্যক্তি আমার রওজা জিয়ারত করবে, অথবা তিনি বলেছেন- যে ব্যক্তি আমার রওজায় এসে আমার সাথে সাক্ষাৎ করবে, আমি তার জন্য শাফায়াতকারী হবো, অথবা আমি তার জন্য সাক্ষ্যদাতা হবো।” (ইমাম বায়হাকীর সুনানে কুবরা ৫ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪০৩) এছাড়া হজের মাধ্যমে হযরত ইব্রাহিম (আ.) ও তাঁর সম্মানিত সাহেবজাদা হযরত ইসমাইল (আ.) এবং হযরত বিবি হাজেরা (আ.)-সহ পূর্ববর্তী মহামানবগণের স্মৃতির কথা স্মরণ হয়ে থাকে। মূলত ধনীদের উপর হজ পালনের বিধান রাখার উদ্দেশ্য হলো যেন তারা ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ধর্মের বিধিবিধান পালন ও আমলের গুরুত্ব উপলদ্ধি করতে পারে। সূফী সম্রাট হযরত দেওয়ানবাগী (রহ.) বলেন, “হজ পালন করে আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য আমাদের অবশ্যই মহামানবদের সাহচর্যে গিয়ে এলমে তাসাউফের শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। কারণ তাসাউফ সাধনার মাধ্যমে অন্তরের পবিত্রতা আনয়ন করতে সফল হলেই হাকিকতে হজ পালন করা সম্ভব।”


এবার আসা যাক কোরবানি প্রসঙ্গে। কোরবানি অর্থ নিকটবর্তী হওয়া, নৈকট্য লাভ করা, উৎসর্গ করা। যেহেতু মুসলমান ব্যক্তি তার প্রিয় বস্তু আল্লাহর নামে উৎসর্গ করে প্রমাণ করে সে সবকিছুর ঊর্ধ্বে আল্লাহ্কে বেশি ভালোবাসেন এবং এর মাধ্যমে সে আল্লাহর নিকটবর্তী হন। এজন্য এই ইবাদতকে কোরবানি বলে। একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি ও তাঁর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট দিনের নির্দিষ্ট সময় নির্দিষ্ট পশুকে আল্লাহর নামে জবেহ করাকে কোরবানি বলে। আমাদের দেশে নিজের নামে, পিতার নামে, এমনিভাবে সাত নামে কোরবানি দেওয়ার প্রচলন ছিল। সূফী সম্রাট হযরত দেওয়ানবাগী (রহ.) পবিত্র কুরআনের আলোকে বলেন, “কোরবানি বান্দার নামে নয়, বরং বান্দার পক্ষ থেকে আল্লাহর নামে দিতে হয়।” তাঁর এই সংস্কারের ফলে মানুষের ভুল সংশোধন হয়। হাদিস শরীফে বর্ণিত হয়েছে, হযরত রাসুল (সা.) কোরবানি দেওয়ার সময় এভাবে নিয়ত বলতেন, “হে আল্লাহ্! আপনি আমার পক্ষ থেকে, আমার পরিবার পরিজনের পক্ষ থেকে এবং আমার উম্মতের পক্ষ থেকে কোরবানি কবুল করুন।” (মেশকাত শরীফ, পৃষ্ঠা ১২৭)

পরিশেষে মহান আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা- তিনি আমাদের সকলকে তাঁর মহান বন্ধু সূফী সম্রাট হুজুর কেব্লাজানের শিক্ষা মোতাবেক হাকিকতে হজ পালন ও কোরবানি করার তৌফিক দান করুন। আমিন।

সম্পর্কিত পোস্ট