Cancel Preloader

হজ পালনের উদ্দেশ্য

মহান সংস্কারক, মোহাম্মদী ইসলামের পুনর্জীবনদানকারী, সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহ্বুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (রহ.) হুজুর কেব্লাজান


[সূফী সম্রাট হুজুর কেব্লাজান রচিত ‘শান্তি কোন পথে?’ কিতাব থেকে লেখাটি সংকলন করা হয়েছে।-সম্পাদক]
হজ শব্দটির আভিধানিক অর্থ সংকল্প করা, ইচ্ছা করা। শরিয়তের পরিভাষায় জিলহজ মাসের ৯ তারিখে কতগুলো নির্দিষ্ট কাজ সম্পাদনের উদ্দেশ্যে ইহরামের সাথে বাইতুল্লাহ অর্থাৎ পবিত্র কাবা শরীফ জিয়ারতের সংকল্প করার নামই হজ। এটি কেবলমাত্র ধনীদের উপর ফরজ করা হয়েছে।

হজের পারিভাষিক সংজ্ঞা প্রসঙ্গে সংক্ষিপ্ত ইসলামী বিশ্বকোষে বলা হয়েছে- “শরিয়তের পরিভাষায় নির্দিষ্ট মাসের নির্দিষ্ট তারিখে মক্কার কাবাঘর প্রদক্ষিণ, আরাফাত ময়দানে অবস্থান, সাফা-মারওয়া পাহাড়ের মধ্যবর্তী স্থানে গমনাগমন, মীনায় অবস্থান, প্রভৃতি কতিপয় কার্য যেভাবে হযরত মোহাম্মদ (সা.) নির্ধারণ করে দিয়েছেন, সেভাবে সম্পাদন করার নাম হজ। এটি ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের পঞ্চম।” (ই.ফা.বা. কর্তৃক প্রকাশিত সংক্ষিপ্ত ইসলামী বিশ্বকোষ ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৫২৩)

বিষয়টি মহান আল্লাহ্ ওহির বাণী আল কুরআনে সুস্পষ্ট করেছেন, এরশাদ হচ্ছে- “ইন্না আওয়্যালা বাইতিও উদ্বি‘আ লিন্নাসি লাল্লাযী বিবাক্কাতা মুবারাকাও ওয়া হুদাল লিল‘আলামীনা, ফীহি আইয়াতুম বাইয়্যিনাতুম মাক্বামু ইবরাহীমা, ওয়া মান দাখালাহূ কানা আমিনান, ওয়া লিল্লাহি ‘আলাল নাসি হিজ্জুল বাইতি মানিস তাত্বা‘আ ইলাইহি সাবীলা।” অর্থাৎ- “নিশ্চয় সর্বপ্রথম যে ঘর মানুষের (ইবাদতের) জন্য স্থাপিত হয়েছিল, তা তো সেই ঘর, যা মক্কায় অবস্থিত, যা বরকতময় এবং বিশ্ববাসীর জন্য হিদায়েত। এতে রয়েছে অনেক প্রকাশ্য নিদর্শন, মাকামে ইব্রাহীম তার অন্যতম। যে কেউ এ ঘরে প্রবেশ করে, সে নিরাপদ হয়ে যায়। মানুষের মধ্যে তার উপর আল্লাহর জন্য এ ঘরের হজ করা ফরজ, যার সেখানে যাওয়ার সামর্থ্য আছে।” (সূরা আলে ইমরান ৩: আয়াত ৯৬ ও ৯৭)
ধনীরা সাধারণত পার্থিব বিষয়ে অধিক নিমগ্ন থাকে। ফলে ধর্ম পালনের ব্যাপারে তারা কিছুটা উদাসীন থাকে। হজ পালনের মাধ্যমে দৈহিক, আর্থিক ও মানসিক বিভিন্ন অনুশীলন তাদের মনকে ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট করে থাকে। যেমন ইহরাম বাঁধার সময় সেলাই বিহীন সাদা কাপড় পরিধানের মাধ্যমে হাজিদের হৃদয়ে মৃত্যু চিন্তা আসে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেন- “মূতূ ক্বাবলা আন তামূতূ।” অর্থাৎ- “মৃত্যু আসার পূর্বে তোমরা মরার বিদ্যা শিখে নাও।” (সূফী দর্শন, পৃষ্ঠা ৩৯ ও ১৫৭)

এমনিভাবে কাবা শরীফ তাওয়াফ করার সময়, মন আল্লাহর প্রতি আকৃষ্ট হয়; আরাফাতের ময়দানে গিয়ে আদি পিতার মাফের ঘটনা স্মরণ করে, নিজের জীবনের কৃত গুনাহের জন্য মনে অনুশোচনা সৃষ্টি হয় এবং আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করা হয়। এ প্রসঙ্গে হযরত জাবের (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, আরাফাত দিবসে মহান আল্লাহ্ ফেরেশতাদের বলেন- “উনজুরূ ইলা ‘ইবাদী আতাওনী শা‘ইছান গুবরান দ্বাজ্জীনা মিন কুল্লি ফাজ্জিন ‘আমীক্বিন উশহিদুকুম আন্নী গাফারতু লাহুম ফাইয়াক্বুলুল মালাইকাতু ইয়া রাব্বি ফুলানুন কানা ইউরাহহাক্বু ওয়া ফুলানুন ওয়া ফুলানাতুন ক্বালা ইয়াক্বুলুল্লাহু ‘আঝঝা ওয়া জাল্লা ক্বাদ গাফারতু লাহুম ক্বালা রাসুলুল্লাহি (সা.) ফামা মিন ইয়াওমিন আকছারু ‘আতীক্বাম মিনান নারি মিই ইয়াওমি ‘আরাফাহ।” অর্থাৎ- “তোমরা আমার বান্দাদের দিকে দেখো, তারা আমার নিকট আসছে এলোমেলো কেশ, ধুলোবালি গায়ে, ফরিয়াদ করতে করতে বহু দূর-দূরান্ত থেকে। হে ফেরেশতাগণ! আমি তোমাদেরকে সাক্ষী রেখে বলছি- আমি তাদেরকে মাফ করে দিলাম। তখন ফেরেশতাগণ বলেন- হে আমার প্রতিপালক! অমুককে তো বড়ো গুনাহগার বলা হয়। আর অমুক পুরুষ ও অমুক স্ত্রীকেও গুনাহগার বলা হয়। হযরত রাসুল (সা.) বলেন, তখন আল্লাহ্ তায়ালা বলেন- আমি তাদেরকেও মাফ করে দিলাম। অতঃপর আল্লাহর রাসুল (রা.) এরশাদ করেন- আরাফাতের দিবসে এতবেশি সংখ্যক লোককে আল্লাহ্ দোযখ থেকে মুক্তি দেন, যা আর কোনো দিন দেন না।” (শরহে সুন্নাহ কিতাবের সূত্রে মেশকাত শরীফ, পৃষ্ঠা ২২৯)

মদীনায় গিয়ে হযরত রাসুল (সা.)-এর রওজা জিয়ারতের মাধ্যমে অন্তরে হযরত রাসুল (সা.)-এর প্রেম জাগ্রত হয়। এ প্রসঙ্গে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেন- “মান হাজ্জা ফাঝারা ক্বাবরী বা‘দা মাওতী কানা কামান ঝারানী ফী হাইয়াতী।” অর্থাৎ- “আমার ওফাতের পর যে ব্যক্তি হজ সম্পাদন করে আমার রওজা জিয়ারত করবে, সে যেন আমার জীবদ্দশায় আমার সাথে সাক্ষাৎ করল।” (বায়হাকী শরীফ ৫ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪০৩)

হযরত উমর (রা.) বলেন, আমি আল্লাহর রাসুল (সা.)-কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেন- “মান ঝারা ক্বাবরী আও ক্বালা মান ঝারানী কুনতু লাহু শাফী‘আন আও শাহীদা।” অর্থাৎ- “যে ব্যক্তি আমার রওজা জিয়ারত করবে, অথবা তিনি বলেছেন- যে ব্যক্তি আমার রওজায় এসে আমার সাথে সাক্ষাৎ করবে, আমি তার জন্য শাফায়াতকারী হবো, অথবা আমি তার জন্য সাক্ষ্যদাতা হবো।” (বায়হাকী শরীফ ৫ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪০৩)

এছাড়া হজের মাধ্যমে মুসলিম জাতির আদি পিতা হযরত ইব্রাহিম খলিলুল্লাহ (আ.), তাঁর সম্মানিত সাহেবজাদা হযরত ইসমাঈল যবিহুল্লাহ (আ.) এবং হযরত বিবি হাজেরা (আ.)-সহ পূর্ববর্তী মহামানবগণের স্মৃতির কথা স্মরণ হয়ে থাকে।

মূলত ধনীদের উপর হজ পালনের বিধান রাখার উদ্দেশ্য হলো, তাদেরকে ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার অনুশীলন করার একটি ব্যবস্থা তৈরি করা। এমনিভাবে হজের যেমন জাহের তথা বাহ্যিক বাস্তবতা ও তাৎপর্য রয়েছে, তেমনি হজের বাতেন তথা আত্মিক বাস্তবতা ও তাৎপর্যও রয়েছে। মারেফাতের দৃষ্টিকোণ থেকে আপন ক্বালবে আল্লাহর দিদার লাভ করা এবং তাঁর আনুগত্য স্বীকার করার মাধ্যমে হাকিকতে হজ পালন হয়ে থাকে। মহান আল্লাহ্ এরশাদ করেন- “কুল ইন্না সালাতী ওয়া নুসুকী ওয়া মাহইয়াইয়া ওয়া মামাতী লিল্লাহি রাব্বিল ‘আলামীন।” অর্থাৎ-“হে রাসুল (সা.)! আপনি বলুন- নিশ্চয় আমার নামাজ, আমার যাবতীয় ইবাদত (হজ ও কোরবানি), আমার জীবন ও আমার মরণ জগতসমূহের প্রতিপালক আল্লাহরই উদ্দেশ্যে।” (সূরা আল আন‘আম ৬: আয়াত ১৬২)
সুতরাং হাকিকতে হজসহ ইবাদতের মূল উদ্দেশ্যে পৌঁছার বিধান প্রত্যেকটি মানুষের জন্য অবশ্য পালনীয়।
[লেখক: প্রতিষ্ঠাতা, দেওয়ানবাগ শরীফ]

সম্পর্কিত পোস্ট