Cancel Preloader

মোরাকাবার গুরুত্ব ও ফজিলত – আশেকা রাসুল কামরুন নাহার নূর

মোরাকাবা আরবি শব্দ। বাংলায় মোরাকাবা শব্দের অর্থ হচ্ছে নজরে রাখা, পর্যবেক্ষণ করা, ধ্যান করা ইত্যাদি। আরবি মোরাকাবা শব্দের প্রতিশব্দ হচ্ছে তাফাক্কুর। আরবি তাফাক্কুর শব্দের অর্থ গভীরভাবে চিন্তা করা। আর ইংরেজিতে মোরাকাবাকে মেডিটেশন (গবফরঃধঃরড়হ) বলা হয়। সাধারণ অর্থে জাহেরি দুই চোখ বন্ধ করে হৃদয় মাঝে ডুব দেওয়াকে ধ্যান বলে। ইসলামে সুফিবাদ তথা তাসাউফের ভাষায়, যে ধ্যান বা চিন্তাধারার মাধ্যমে স্বয়ং রাব্বুল আলামিন ও রাহমাতুল্লিল আলামিনের পরিচয় জানা যায় এবং তাঁদের নির্দেশমতো চলা যায় এবং সমগ্র সৃষ্টিজগত সম্পর্কে অবগত হওয়া যায়, প্রকৃতঅর্থে তাকেই মোরাকাবা বলে।
একজন সাধকের জীবনে মোরাকাবার গুরুত্ব অপরসীম। মোরাকাবা হচ্ছে নফল ইবাদত। নফল ইবাদত হচ্ছে আল্লাহ্র নৈকট্য লাভের উত্তম পন্থা। তাই পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে- “(তারাই তত্ত¡জ্ঞানী) যারা দাঁড়িয়ে, বসে ও শায়িত অবস্থায় আল্লাহ্র জিকির করে এবং আসমান, জমিন সৃষ্টির বিষয়ে গভীরভাবে চিন্তা করে (মোরাকাবা করে)।” (সূরা আলে ইমরান ৩: আয়াত ১৯১)
মোরাকাবা সম্পর্কে হযরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন, আল্লাহ্র রাসুল (সা.) এরশাদ করেন- “এক ঘণ্টা মোরাকাবা করা ষাট বছরের ইবাদতের চেয়েও উত্তম।” (তাফসীরে দুররে মানছুর, ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪১০)

মোরাকাবা সম্পর্কে সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহবুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (রহ.) হুজুর কেব্লাজান বলেন, “আল্লাহ্র নৈকট্য লাভের জন্য মোরাকাবা হলো সহজ ও সর্বোত্তম পদ্ধতি। গভীর সাধনা ও মোরাকাবা করে যিনি নিজের ভিতরে আল্লাহ্কে খুঁজে পেয়েছেন, তিনিই প্রকৃত মু’মিন। সেজন্য নিয়মিত মোরাকাবা করতে হবে এবং মোরাকাবার মাধ্যমে নিজের মাঝে আল্লাহ্ ও রাসুল (সা.)-কে খুঁজে পেতে হবে। ইবাদতের মধ্যে মোরাকাবা হলো উত্তম ইবাদত। মোরাকাবার মাধ্যমে রিপু দমন করা যায়। আত্মার উন্নতির জন্য অধিক মোরাকাবা করতে হয়। ধ্যান বা মোরাকাবা দ্বারা ষড়রিপু দমন করা সম্ভব। মোরাকাবার মাধ্যমে মহান আল্লাহ্র নৈকট্য লাভ করা যায়। হযরত মোহাম্মদ (সা.) জাবালে নুরের হেরা গুহায় সুদীর্ঘ ১৫ বছর মোরাকাবার মাধ্যমে মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিনের সাথে যোগাযোগ করেন। তাই আমাদেরকেও অধিক মোরাকাবা করতে হবে।”
মোরাকাবার দ্বারা ক্বালবের মাঝে প্রেম জাগ্রত হয়। এই প্রসঙ্গে ইমাম প্রফেসর ড. কুদরত এ খোদা (মা. আ.) হুজুর বলেন, “মোরাকাবার মাধ্যমে বান্দার অন্তরে তাকওয়া বা খোদাভীতি তৈরি হয়। ফলে বান্দা মুত্তাকি হওয়ার পাশাপাশি ক্বালবে জ্বিকির জারির মাধ্যমে আল্লাহ্র প্রেমিক হতে পারে।”


মোরাকাবার গুরুত্ব ও ফজিলত
মহান আল্লাহ্র দর্শন একমাত্র মোরাকাবা তথা ধ্যানের মাধ্যমেই সম্ভব। হযরত আদম (আ.) থেকে শুরু করে রাহমাতুল্লিল আলামিন হযরত রাসুল (সা.) পর্যন্ত সকল নবি-রাসুল, অলী-আল্লাহ, গাউস-কুতুব মোরাকাবার মাধ্যমে মহান আল্লাহ্র সাথে যোগাযোগ করেছেন। নবুয়ত পরবর্তী বেলায়েতের যুগে অলী-আল্লাহ্গণ একই পদ্ধতিতে আল্লাহ্র সাথে যোগাযোগ করেন। মানুষের হৃদয়ে তথা ক্বালবের ৭ম স্তর নাফসির মোকামে আল্লাহ্র অবস্থান। যুগপরিক্রমায় যত মহামানব আল্লাহ্কে পেয়েছেন তাঁদের সকলেই হৃদয় মাঝে অনুসন্ধান করেই মহান আল্লাহ্র পরিচয় লাভ করেছেন। মোরাকাবার মাধ্যমে সাধক জীবাত্মাকে বেষ্টনকারী ষড়রিপু, যথা- কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, ও মাৎসর্যকে দমন করে হৃদয়ের পরিশুদ্ধতা অর্জনের মাধ্যমে আধ্যাত্মিক উন্নতি সাধন করতে পারেন। সেজন্য সাধককে গভীর মোরাকাবার মাধ্যমে অন্তরচক্ষু জাগ্রত করতে হয়। দীর্ঘ ১৫ বছর ধ্যান-সাধনা করে সর্বকালের, সর্বযুগের, সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব রাহমাতুল্লিল আলামিন হযরত রাসুল (সা.) আল্লাহ্ তা’য়ালার পরিচয় লাভ করে মানবমুক্তির বিধান মহাগ্রন্থ আল কুরআন লাভ করেন। ইমাম সৈয়দ আবুল ফজল সুলতান আহমদ (রহ.) তাঁর পবিত্র জবানে বলেছেন: “আমিত্ব ভুলে আল্লাহ্র নৈকট্য লাভের সহজ উপায় হলো মোরাকাবা।”


আমাদের মহান মোর্শেদ মোহাম্মদী ইসলামের পুনর্জীবনদানকারী সূফী সম্রাট হযরত দেওয়ানবাগী (রহ.) বলেন-“মোরাকাবার মাধ্যমে রিপুগুলোকে দমন করতে হয়৷ আপনি যদি মোরাকাবার দ্বারা, সাধনার দ্বারা স্বীয় রিপুকে বশে আনতে পারেন, এই রিপু আপনাকে সাধনার পথে সাহায্য করবে। যেমন, অসংযমি কামরিপু খুব খারাপ। আপনি যদি এই কাম রিপুকে মোরাকাবার মাধ্যমে বশে আনতে পারেন, তখন আপনার মাঝে আল্লাহ্র গভীর প্রেম সৃষ্টি হবে।”


ঠিক একই পরিক্রমায় দয়াল মোর্শেদের মনোনীত ইমাম, সিরাজুম মুনিরার ধারক ও বাহক, প্রফেসর ড. কুদরত এ খোদা (মা. আ.) হুজুর আমাদের সেই শিক্ষাই দিচ্ছেন। একজন সাধক কীভাবে মনজিলে মকসুদে পৌঁছানোর জন্য নিয়মিত মোরাকাবা করবে, কীভাবে আল্লাহ্ ও রাসুলের দর্শন লাভ করবে সেই শিক্ষা প্রতিনিয়ত আশেকে রাসুলদেরকে দিচ্ছেন। তিনি আমাদেরকে প্রতিদিন ৬ বার মোরাকাবা করার নির্দেশ দিয়েছেন। অতএব একজন সাধকের জন্য মোরাকাবা সত্যিকার অর্থে খুবই ফজিলতপূর্ণ।
“মোরাকাবা মারেফাতের সাধকদের জন্য অত্যন্ত উপকারী। কেননা এই পদ্ধতিতে ধ্যান করলে কুরিপুসমূহ সহজে দমন হয়ে মানব অন্তরের অন্ধকার দূর হয়। ফলে মানুষের পক্ষে আল্লাহ্র রূপ দর্শন সম্ভব হয়। অলীয়ে কামেল আল্লাহ্র গুণে গুণান্বিত থাকেন। তাঁর অন্তর আল্লাহ্র নুরে জ্বালানো বাতির মতো। এ কারণে যখন কোনো লোক কামেল অলীর সামনে যায় এবং তাঁর পবিত্র চেহারা দর্শন করে, তখন তার অন্তরে কুরিপুর প্রভাব কেটে গিয়ে আল্লাহ্র কথা স্মরণ হয়। যতক্ষণ সে কামেল অলীর সামনে অবস্থান করে, ততক্ষণ তার দিলে অলীর ফায়েজ বর্ষিত হতে থাকে। অলীর সঙ্গ ত্যাগ করার পর পুনরায় তার কুরিপুসমূহ সক্রিয় হয়ে উঠে। এ অবস্থায় যদি সে কামেল অলীর চেহারা মোবারক স্মরণ করে, তখন কুরিপু পুনরায় নিস্তেজ হয়ে যায়। অর্থাৎ- অলীর সামনে অবস্থান করার সময় যেমন তার দিলে ফায়েজ বর্ষিত হয়, তাঁর পবিত্র চেহারা স্মরণ করলেও দিলে অনুরূপ ফায়েজ বর্ষিত হতে থাকে। আল্লাহ্র রাসুল (সা.) এরশাদ করেন- ‘মহান আল্লাহ্ বলেছেন- নিশ্চয় আমার বান্দাদের মধ্যে অলী-আল্লাহ্ হলেন তাঁরা, আমাকে স্মরণ করলে যাঁদের কথা স্মরণ হয়। তেমনি যাঁদেরকে স্মরণ করলে আমার কথা স্মরণ হয়।’ (তাফসীরে মাজহারী ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩৪৮)”


মূলত মোর্শেদের চেহারা মোবারক স্মরণ করে মোরাকাবা করলে মৃত অন্তর সজীব হয় এবং অস্থির হৃদয়ে প্রশান্তি আনে। মোর্শেদের রূপের ধ্যান মুরিদকে তাঁর সাহচর্যের মাধ্যমে হৃদয়কে প্রজ্বলিত করতে পারে। মোর্শেদের ধ্যানের মাধ্যমে শত সহস্র সংকেত ও গোপন রহস্য সম্পর্কে আলোকজ্ঞান লাভ হয়। তাছাড়া ধ্যানের মাধ্যমে মোর্শেদের চেহারা মোবারক অবলোকন করে মুরিদের ভিতর বিশ্বাস, প্রেম এবং ধ্যান শক্তি বৃদ্ধি পায়। ধ্যানের দ্বারা হৃদয় মাঝে প্রেমাগুণ প্রজ্বলিত হয়। যে ধ্যান করে না সে অধ্যাত্ম প্রেম থেকে বঞ্চিত হয়।


মোরাকাবা করার পদ্ধতি
জাহেরি দুই চোখ বন্ধ করে দুনিয়াবি চিন্তা মুক্ত হয়ে নিজের দিলের মাঝে ডুব দিতে হয়। যেমন একজন ডুবুরী গভীর সমুদ্রে ডুব দিয়ে মণিমুক্তা তুলে আনেন, তেমনি একজন সাধককে তার দিলের মাঝে ডুব দিয়ে আপন মোর্শেদের নুরানিময় চেহারা মোবারক খেয়াল করতে হবে। তাঁর পবিত্র কদম মোবারক জড়িয়ে ধরে নিজের গুনাহর কথা স্মরণ করে দুই চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে কাকুতি মিনতি করে তাঁর এশক ও মহব্বত ভিক্ষা চাইতে হবে। অতঃপর আপন মোর্শেদের পবিত্র দিল মোবারকের সাথে সাধক তার নাপাক দিল মিশিয়ে দিলকে পবিত্র করতে হবে এবং মোর্শেদের কাছ থেকে ফায়েজ হাসিল করতে হবে। এই ফায়েজ দ্বারা একজন সাধকের কালবের ভিতরে পাপ কালিমা দূরীভূত হবে এবং সাফ দিলে আল্লাহ্ আল্লাহ্ জিকির হবে। এছাড়া নফসের যাবতীয় খারাবি ধ্বংস হয়ে সাধকের দিলকে পরিশুদ্ধ করবে।


পরিশেষে আমরা যেন মহান ইমাম প্রফেসর ড. কুদরত এ খোদা (মা. আ.) হুজুুরের শিক্ষানুযায়ী আমল করে নফসকে দমন করে নিজের ভিতরে পরমাত্মার রাজত্ব কায়েম করতে পারি। মহান আল্লাহ্ আমাদের সেই তৌফিক দান করুন। আমিন।
তথ্যসূত্র:
১। মুক্তি কোন পথে? সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহ্বুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (রহ.) হুজুর কেব্লাজান, পৃষ্ঠা ১২৭-১২৮
২। মোহাম্মদী ইসলামের তালিম, ইমাম প্রফেসর ড. আরসাম কুদরত এ খোদা (মা. আ.)
৩। মোর্শেদের দরবারে মুরীদের করণীয়, ইমাম প্রফেসর ড. আরসাম কুদরত এ খোদা (মা. আ.)
[লেখিকা: বিএসএস ডিগ্রি ১ম বর্ষ]

সম্পর্কিত পোস্ট